তিনটি গ্রীক নাটকের বাংলা করেছিলেন শিশিরকুমার দাশ। প্রথমে এউরিপিদেসের ‘ত্রোইআদেস’ (ট্রয়ের নারী), নাম দেন ‘বন্দিনী’। তারপর সোফোক্লেসের ‘আন্তিগোনে’। সবশেষে সোফোক্লেসেরই ‘রাজা ওইদিপৌস’। তিনটিই প্রথম প্রকাশ করেন প্রমা-র সুরজিৎ ঘোষ, যথাক্রমে ১৯৮৩, ৮৪ ও ৮৮-তে । ২০১২-য় তাদের ‘গ্রীক নাটক সংগ্রহ’ নামে একত্র করে দে’জ পাবলিশিং। প্রকাশকের নিবেদনে সুধাংশুশেখর দে বলেন, আরো অনুবাদের ইচ্ছে তাঁর ছিল। ‘কলোনাসে ওইদিপৌস’ তিনি করতে যাচ্ছিলেন কিনা জানি না, তবে জানি যে থীবীয় পুরাণে ‘ওইদিপৌস’ ও ‘আন্তিগোনে’-র অন্তর্বর্তী এই নাটক তাঁর খুব প্রিয় ছিল। তার এক বিখ্যাত কোরাস—‘বিদেশী পথিক তুমি এলে আজ সুন্দরতম দেশে / দ্রুত তুরঙ্গ-খ্যাত কলোনাসে, ...’—তাঁর গ্রীক গীতিকবিতার অনুবাদগ্রন্থ ‘বহু যুগের ওপার হতে’-য় (প্রকাশ ১৯৮৯) আছে । যদিও তাঁর নাট্যানুবাদের সঙ্গে আরিস্টটলের কোনো প্রত্যক্ষ যোগ ছিল না, তবু মনে রাখা ভালো যে তিনি ‘কাব্যতত্ত্ব’ও অনুবাদ করেছিলেন। নাটক তিনটির ভাষান্তরের সঙ্গে ভাষ্যও আছে। প্রয়োজনে মুখবন্ধ বা পূর্বকথা এবং টীকাও।
মৃত পলিনাইসিস-এর সামনে আন্তিগোনে। শিল্পী নিকিফোরোস লাইত্রাস। সৌজন্য ন্যাশনাল গ্যালারি অফ এথেন্স।
অনুবাদ পড়বে সে-ই যে মূল জানে না। তবে তার ভাষার সে রসগ্রাহী। অতএব তাকে তার ভাষায় রসের জোগান দিতে হবে। তার মানে, অনুবাদের মুহূর্তে অনুবাদককে হতে হবে রসস্রষ্টা লেখক। আর যদি তিনি স্বধর্মানু্যায়ীই লেখক হয়ে থাকেন তাহলে তো সোনায় সোহাগা। কিন্তু তাঁর স্বেচ্ছাচারী হলে চলবে না। যদিও অনুবাদপাঠক জানবে না তিনি কী করছেন না করছেন, তবু তার উপর সে নির্ভর করবে। অর্থাৎ, এই নির্ভরতার দায় নিতে হবে অনুবাদককে। এই মর্মে এক সন্দর্ভ লিখেছিলেন শিশিরকুমার দাশ কয়েক দশক আগে। এবং এই দায়িত্ব কীভাবে পালন করবেন অনুবাদক, তা তিনি এক দুই তিন করে সাজিয়েও দিয়েছিলেন। সেই ক্রমান্বিত কর্তব্যকে আজ অনুবাদক-কুলের এক প্রস্তাবিত বৈয়াকরণিকতা বললে বোধহয় খুব ভুল হবে না।
অনুবাদ নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। মূল আর গন্তব্যের বা ঘর আর বাহিরের যে-ভারসাম্য অনুবাদে কাম্য তা মাঝে মাঝেই ব্যাহত হয়। মূলাভিমানে অনুবাদের ভাষা স্বাচ্ছন্দ্য হারায়; নয়তো মূলকে ভেঙেচুরে স্বাধীন রচনা হয়ে উঠতে চায় অনুবাদ। আদর্শত, অনুবাদ বুঝি-বা মূল লেখকেরই অনুবাদের ভাষায় লিখতে চাওয়া। সোফোক্লেস বা এউরিপিদেস বাংলায় লিখলে যা দাঁড়াত, তারই কি এক নিদর্শন দিচ্ছেন শিশিরকুমার দাশ? আবার, অনুবাদ বুঝি-বা মুলের এক পাঠও। অনুবাদক যেন আমাদের সঙ্গে বসে তা পড়ছেন। শিশিরকুমার দাশের ক্ষেত্রে এই কথাটা বোধহয় বিশেষভাবে প্রয়োজ্য। তাঁর ভাষ্য তথা ‘উত্তরলেখ’গুলি এই সাক্ষ্য দেবে। তারা তাঁর আপন পাঠের অভিজ্ঞতা। নিতান্তই অনুবাদকের কলকব্জা নয়। কলকব্জার জন্য হয়তো ‘টীকা’ বেশি কার্যকরী। ‘উত্তরলেখ’ মুখ্যত পাঠকালীন বা পাঠশেষের প্রতিক্রিয়া যা তিনি আমাদের গোচরীভূত করছেন। তাঁর অনুবাদে তা রসসিঞ্চন করছে।
‘আন্তিগোনে’-র বেলা যেমন। হেগেলের সেই ঐতিহাসিক পাঠ—‘আন্তিগোনে’ দুই সদর্থের দ্বন্দ্ব (ক্রেয়ন দেশের স্বার্থ দেখছেন, আন্তিগোনে পরিবারের)—নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন শিশিরকুমার দাশ। তিনি সোফোক্লেসে তার সমর্থন পাচ্ছেন না। ‘আন্তিগোনে’-র ক্রেয়ন ‘রাজা ওইদিপৌস’-এর পরিমিতি বোধসম্পন্ন ক্রেয়ন নন, তিনি অহংকারী, হুব্রিসে আক্রান্ত। রাষ্ট্রের নামে তিনি স্বৈর হয়ে উঠেছেন, কারো কথা শুনবেন না, এমনকী তাঁর শুভাকাঙ্ক্ষী পুত্রের কথাও না। অন্যদিকে, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে আন্তিগোনে শহিদ হচ্ছে, এই অভিমতেরও সমর্থন সোফোক্লেসে পান না শিশিরকুমার দাশ। নাটকটা আসলে ক্রেয়নের। তাঁর হুব্রিস তাঁকে যেখানে ঠেলে নিয়ে যায় সেখান থেকে ফেরা শক্ত। অপমানিত ও ক্রুদ্ধ তেইরিসিয়াসের ভবিষ্যদ্বাণী শুনে যখন তিনি প্রথম ধাক্কা খান ততক্ষণে দেরি হয়ে গেছে। তাঁর পুত্রের বাগদত্তা আন্তিগোনে তো গেছেই, ক্রেয়নের সামনেই তাঁর পুত্র হাইমোনও আত্মঘাতী হয়। এবং সেই খবর যখন তার মা তথা রানী এউরুদিকের কাছে পৌঁছয়, তখন তিনিও আত্মঘাতী হন। কী রইল ক্রেয়নের ? নাটকের শেষ কোরাসে আমরা শুনলাম, ‘দেবতার কঠিন শাসন / চূর্ণ করে সব দর্প / সব দর্প চায় ক্ষমাভিক্ষা।’
এউরিপিদেসের ‘ত্রোইআদেস’ তথা ‘বন্দিনী’ এক হাহাকারের নাটক। ট্রয় ধ্বস্ত, তার সব পুরুষ নিহত, বন্দি রাজপরিবারের রমণীদের ভাগ করে নেওয়া হচ্ছে গ্রীক সেনাপতিদের মধ্যে, অন্য নারীদের নিচ্ছে গ্রীক সৈন্যেরা, আর আগুন লাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ওই প্রাচীরবেষ্টিত নগরীতে। নাটক নারীদের। প্রবেশক বলানো হচ্ছে সমুদ্রদেবতা পসেইদোনকে দিয়ে (‘আমার নগর এই ট্রয়’), যাঁর সঙ্গে এসে যোগ দিয়ে তাঁর সাহায্য চাইছেন আথেনা, যিনি হেরার সঙ্গে ট্রয়ের পতন ঘটিয়েও এখন প্রত্যাবর্তনকামী গ্রীকদের তাঁর ট্রয়ের মন্দির অপবিত্রকরণের শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। দেবতাদের সঙ্গে অসম্পৃক্ত এক মানুষী প্রবেশক শুনি ট্রয়ের একদারাজ্ঞী হেকাবের মুখে :
আয়, স্বামীহীনা ট্রয়ের রমণী, আর্ত জননী, কুমারীরা আয়
ঘন ঘোর ধূমে ঢাকা আজ ট্রয়, এক সাথে কাঁদি, আর চেয়ে দেখি
ট্রয় জ্বলে দূরে, অগ্নিশিখায়।
প্রিয়াম-এর মৃত্যু। শিল্পী পিয়ের নারসিস গ্যের্যাঁ। সৌজন্য: ম্যুজে দে ব্যোজ-আর্ত, ফ্রান্স।
ভয়ার্ত ট্রয়-নারীদের কোরাস এসে ঢোকে, বেরোবে নাটকের শেষে। হেকাবেও আগাগোড়া নাটকে উপস্থিত, বুঝি-বা বন্দিনীপ্রধানা। আসে একে একে অন্য বন্দিনীরা। প্রথমে কন্যা কাসান্দ্রা, আপোলোর কুমারী বধূ, এক উন্মাদিনী ভাবীকথক, আগামেমনোন যাকে শয্যাসঙ্গিনী করতে নিয়ে যাবেন, যে গ্রীসে পৌঁছে তার আশু বিনাশের সঙ্গে সঙ্গে আর্গোসরাজের বিনাশও দেখতে পায় তার দিব্যদৃষ্টিতে। শুধু তাই নয়, তার ভাবীচোখে সে এও দেখে যে তার মা হেকাবেকে যাঁর নিয়ে যাবার কথা, সেই চতুরচূড়ামণি ইথাকাপতি অদুস্সেউস শুধু সমুদ্রে সমুদ্রে তাড়িত হয়ে ঘুরবেন দশবছর, বাড়ি যেতে পারবেন না, আর বাড়ি যখন পৌঁছবেন তখনও আশু নিস্তার পাবেন না। তারপর আসে বন্দিনী বধূ আন্দ্রোমাখে, বীর হেক্তোরের স্মৃতিকাতর, তাকে বেছে নিয়েছেন আখিল্লেসের পুত্র নেওপ্তালেমুস। তার কোলে হেক্তোরের শিশুপুত্র আস্তুআনাক্স্, আশা সে বড়ো হয়ে নতুন ট্রয় গড়বে। কিন্তু গ্রীকরা তা হতে দেবে না: পাছে সে বড়ো হয়ে প্রতিশোধ নেয়, তাই এখনই তাকে প্রাচীর থেকে ছুঁড়ে ফেলে হত্যার বিধান দিলেন অদুস্সেউস। বিলাপ ছাড়া আর কিছু নেই আন্দ্রোমাখের, নেই হেকাবের, ট্রয়ের নারীদের। এক ফাঁকে কোরাস গেয়ে নেয় সেই কাঠের ঘোড়ার গল্প, সেই উৎসবশেষে মৃত্যুরজনীর কথা। সবশেষে, স্পার্টারাজ মেনেলাঅসের আদেশে আসে বন্দি হেলেন, ট্রয়যুদ্ধের হেতু, সকলের চোখে এখন ঘৃণ্য, যদিও সে বলে সে নিরপরাধ কেননা সব ঘটিয়েছেন দেবী আফ্রোদিতে। তবে তার ভবিষ্যৎ নয় এই নাটকের ভাবনা—সে নয় আমাদের কোনো বিলপমান ‘বন্দিনী’।
এউরিপিদেসের ‘ত্রোইআদেস’, আমাদের মনে করিয়ে দেন শিশিরকুমার দাশ, প্রথম যুদ্ধবিরোধী নাটক। প্রত্যেক কুরুক্ষেত্রশেষেই তো এক ‘স্ত্রীপর্ব’ থাকবে। ‘বন্দিনী’ ট্রয়যুদ্ধের স্ত্রীপর্ব। এও আমাদের মনে করান শিশিরকুমার দাশ, যে এউরিপিদেস যখন এ-নাটকটা লেখেন তার কয়েক মাস আগেই আথেন্সের সৈন্যেরা মেলোস্ দ্বীপ দখল করে। তখন সেখানে তারা যা করে তা বর্বরতার চূড়ান্ত। সব যুবক ও বৃদ্ধকে হত্যা করে, নারীদের লুণ্ঠন ও ধর্ষণ করে—নারী ও শিশুরা পরে যুদ্ধপণ্য হিসেবে বিক্রি হয়। সেই ইতিহাস লিখে গেছেন থুকিদিদেস্।‘ত্রোইআদেস’ রচনার তা প্রাথমিক প্রেরণা। আরো একটা ঘটনা আমাদের মনে করিয়ে দেন শিশিরকুমার দাশ। প্রথম মহাযুদ্ধের মাঝামাঝি একবার এই নাটক লন্ডনে অভিনীত হয়—গিলবার্ট মারের অনুবাদে। তাতে দর্শকেরা এতই অভিভূত হন যে সমস্বরে নাট্যকারকে চোখে দেখবার দাবি করেন। তখন গিলবার্ট মারেকে মঞ্চে এসে বলতে হয়, এই নাট্যকার আড়াই হাজার বছর আগে মারা গেছেন।
রাজা ওইদিপৌস। শিল্পী বেনিনি গাগনেরো। সৌজন্য ন্যাশনাল মিউজিয়াম, স্টকহোম।
শম্ভু মিত্র-তৃপ্তি মিত্রের ওইদিপোউস-ইওকাস্তাকেও সাক্ষী রেখে বলছি, ‘রাজা ওইদিপৌস’ এক অতুলনীয় ট্র্যাজেডি। আর শিশিরকুমার দাশ তাঁর অনুবাদকলার তুঙ্গে এখানে। গ্রীকহীন পাঠককে তার রসের জোগান তো দিচ্ছেনই—তার ছিলা আগাগোড়া টানটান—সেইসঙ্গে সোফোক্লেসমুখীও করে তুলছেন তার মন। তাঁর ‘টীকা’ অধিকন্তু নয়, আর তাঁর ‘উত্তরলেখ’ সেই আয়না যাতে নাটকের মুখ উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। শেষ কোরাস যদি সোলোনের সংযোজন হয়ও বা, কী ক্ষতি ; এই প্রথাগত কথা তো আগেই একবার বলে নিয়েছে কোরাস :
হায়, হায়রে মানুষ, ক্ষণপ্রাণ
অর্থহীন, শূন্য তোর সমস্ত জীবন
সুখ তোর মুহূর্তের
ক্ষণিকের ছায়া।
ওইদিপৌস !
কী ভীষণ পতন তোমার।
এরপর ভাবি
এ জগতে
কেউ সুখী?
ভাল লাগল।
শিশিরকুমারকে নিয়ে খুব বেশি লেখা দেখি না। অবলুপ্ত চতুর্থ চরণের কথামুখ লিখেছিলেন সুধীর চক্রবর্তী মশায় - সেখানে শিশিরকুমারের গ্রিক ভাষা শেখা, অনুবাদের কথা প্রথম জানি।
সুধীর চক্রবর্তীর অন্য একটি লেখায় পড়েছিলাম শিশিরকুমারের 'অলীক সংলাপ' বইটির কথা- সে বইতেও শিশিরকুমারের গ্রিক সাহিত্যচর্চার প্রতিফলন। যেমন তিন অন্ধজনের সংলাপঃ ধ্রৃতরাষ্ট্র, অয়দিপাউস, তেইরোসিয়াস; বা দুই মাতৃঘাতী: পরশুরাম ও ওরেসতেস। আবার সাবিত্রী ও এউরুদিকে। ইন্দ্র ও প্যারিস। অভিমন্যু ও ইফিগেনেইয়া। আসতুয়ানাক্স ও ডাকঘরের অমল।সুধীরবাবু লিখেছিলেন, 'গ্রিক ও ভারতীয় কয়েকজন নিয়তিতাড়িত চরিত্র এসে দাঁড়াবে ন্যায়নীতি বিবেক ও জীবনের পরিণামের প্রশ্ন নিয়ে। পাঠকের পক্ষে পদে পদে জ্ঞানার্জনের সমান্তরালে প্রাপ্তি ঘটবে অনাস্বাদিত নিও ক্লাসিক রচনাশৈলীর রম্যতা...'
দুঃখিত। ভুল লিখেছি।
অলীক সংলাপ নয়। সে বই রবীন্দ্রকুমার দাশগুপ্তর। শিশিরকুমার দাশের বইটি 'অলৌকিক সংলাপ'।