মানব আমার অনেক দিনের বন্ধু। আমরা একসঙ্গে প্রেসিডেন্সি কলেজে বি.এ. পড়েছি, যদিও মানব বাংলায়, আমি অঙ্কে। মানব তখনই লিখতে শুরু করেছে। আমি লিখতে চাইলেও পারতাম না। আমাদের এক বন্ধু ছিল, প্রদ্যুম্ন মিত্র, সেও লিখত। পড়ত ইংরেজি, কিন্তু কাঁটাছেঁড়া করত বাংলা কবিতার। অভ্যুদয়ের (?) অমিয় চক্রবর্তীর জন্য তো মানব নিজে অনুবাদ করছিলই, আমাকেও একবার জুড়ে দেবার চেষ্টা করেছিল। কাজ হয়নি। মানব যে করিমগঞ্জে ছিল তা, তার পুরোনো বন্ধু, আমার এক মামাতো ভাইয়ের কাছে শুনেছিলাম। আমিও সিলেটের ছেলে ছিলাম বলে কোনো বাড়তি হৃদ্যতার প্রশ্ন ওঠেনি আমাদের। কারণ আমরা তখন নতুন শেকড় গাড়ছি। তবে আমার ওই ভাইয়ের কাছেই শুনেছিলাম মানবের ডাকনাম টোগো, যদিও আমি কখনো তাকে সেই নামে ডাকিনি। আমরা যাদবপুরে এম.এ. পড়বার সময় আমাদের বন্ধু সহপাঠী প্রণবেন্দুর (দাশগুপ্ত) মুখে কখনোসখনো সে-নাম শোনা যেত। হয়তো উভয়েই যাদবপুর পাড়ার বাসিন্দা বলে। মানব প্রণবেন্দুকে আদৌ পুলক ডাকত কিনা মনে পড়ছে না। বোধহয় না। আমাদের তরুণ মাস্টারমশাই অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত ডাকতেন—তিনিও যাদবপুর পাড়ার।
কিন্তু আমার যাদবপুরে এম.এ. পড়তে আসাই হত না যদি না সেই গ্রীষ্মশেষের বিকেলে, কফিহাউসে গিয়ে টেবিল দখলের আগে, প্রেসিডেন্সির সিড়ির তলায় অপেক্ষারত প্রদ্যুম্ন ও আমার কাছে রীতিমত উদয় হয়ে, মানব বার্তা দিত, শহরে এক নতুন বিশ্ববিদ্যালয় বসেছে এবং তাতে তুলনামূলক সাহিত্য নামে এক নূতন বিদ্যা চালু হচ্ছে। আমাদের অনার্সের ফল বেরিয়ে গেছে, আমরা স্নাতকোত্তরের দরজায়। মানব জানাল, সে কলকাতায় বাংলা না পড়ে যাদবপুরে তুলনামূলক সাহিত্য পড়বে। সেই বিভাগের প্রধান, বুদ্ধদেব বসুকে সে চেনে; তিনি তাকে উৎসাহ দিয়েছেন। প্রদ্যুম্ন কলকাতাতেই ইংরেজি পড়বে। আমি কলকাতাতে পিওর ম্যাথেমেটিক্সে ঢুকতে পারতাম। কিন্তু তৎক্ষণাৎ ঠিক করলাম আমিও যাদবপুর যাব। এবং মানবের পরামর্শে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা করে আমার সাহিত্যপ্রীতি জ্ঞাপন করলাম। আমার জীবনটাই যে পাল্টে গেল, তার জন্য আমি প্রাথমিকভাবে মানবের কাছে ঋণী।
আমরা যে-কজন প্রথম তুলনামূলক সাহিত্যে এম.এ. পড়তে ঢুকি তার মধ্যে মানবই ছিল সবচেয়ে ছোটো, নবনীতার (তখন দেব) চাইতেও একটু ছোটো। সবচেয়ে বড়ো ছিল তরুণ (তরুণ মিত্র, গান্ধী বিচার পরিষদের সান্ধ্য গ্রন্থাগারিক), তার বিস্তর পড়াশুনো। কিন্তু সাহিত্য মানব তার চাইতে বেশি পড়েছে, বাংলাসাহিত্য তো বটেই বিদেশী সাহিত্যও। আমরা তখন পরস্পরকে আপনি বলতাম, খালি প্রেসিডেন্সির সূত্রে মানব-আমি তুমি (নবনীতাও কিছুদিন পরেই তুমি, মানব-প্রণবেন্দু-আমিও তার কাছে তাই)। আর শ্যামল (গঙ্গোপাধ্যায়) গোড়া থেকেই সকলের তুমি, কারণ সে আমাদের তুই বলত, শুধু তরুণ তরুণদা ও তুমি। মানবরা তখন যাদবপুরে ঠিক কোথায় থাকত মনে পড়ছে না, ৮বি-র পিছনের বাড়িতে বোধহয় নয়—ভিতরের দিকে এক অন্য বাড়ির ছবি চোখে আছে, একতলার ডানদিকের কোনো ঘরে বসে বুঝি সবুজ কালিতে খসখস করে লিখে যাচ্ছে। নানা রঙের কালির বিলাস কি তার তখন থেকেই? তবে লিখত বোধহয় দ্রুত, আমার মতো কাটাকুটি খেলত না। লিখতে লিখতে সিগারেটও খেত। বোধকরি চারমিনার।
তখন থেকেই মানবের গদ্যে কমার প্রাচুর্য। যাদবপুর আর্টস কলেজের পত্রিকা ‘অরণি’-র প্রথম সম্পাদক প্রণবেন্দু। তাতে মানব লিখল হান্স ক্রিশ্চিয়ান আন্ডারসেন-এর উপর প্রবন্ধ। তার প্রথম বাক্য বোধহয় ছিল: ‘এমনকি, আজ পর্যন্ত, দেনমার্ক যেন রূপকথার দেশ।’ এইরকম বাক্যে বাক্যে কমা। প্রণবেন্দু ‘অরণি’ ছাপতে দিয়েছিল তার এক বন্ধুর প্রেসে। সেটা লেটার প্রেসের যুগ। ‘মণি প্রেসে’ অত কমা নেই; বন্ধুটি প্রণবেন্দুকে বলল, এক পোয়া কমার অর্ডার দিতে হয়েছে। মানবের তখনকার গদ্যে কেউ কেউ বুদ্ধদেব বসুর ছাপ দেখতে পান। অসম্ভব নয়, কারণ মানবের মতো অত বুদ্ধদেব বসু তখন আর কে পড়েছে! (পরে আমার সাহিত্যসাধক চরিতমালার অন্তর্গত ‘বুদ্ধদেব বসু’ বইয়ের গ্রন্থপঞ্জিতে দুটি সংশোধন করে দিয়েছিল।) তাছাড়া তখন বুদ্ধদেব বসুর অত স্নেহভাজনই বা আর কে! বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে শিশুসাহিত্য নিয়ে গবেষণাও বোধহয় শুরু করেছিল। অন্তত ‘রবীন্দ্রনাথ: কথাসাহিত্যে’র অনুবর্তী বই ‘রবীন্দ্রনাথ: শিশুসাহিত্য’ লিখেছিল। তাছাড়া পাস্তেরনাকের ‘ডক্টর শিভাগো’১ যখন ইংরেজি অনুবাদে এদেশে এল, তখন বুদ্ধদেব বসুই মানব আর মীনাক্ষী দত্তকে দিয়ে তার বাংলা করালেন। আর মানব যে ব্রহ্মদেশের রেঙ্গুনে পড়াতে গেল সেও তো বুদ্ধদেব বসুরই ব্যবস্থাপনায়।
যতদূর মনে পড়ছে, মানব তখন পরত প্যান্ট ও বুশশার্ট, পায়ে চটি। শার্ট রঙিন। কবে যেন আমাকে কোনো ভিনদেশী বন্ধুর দেওয়া এক রংচঙে হাতকাটা ঝোলা জামা—যা পরে বেরোতে আমার লজ্জা করত—দেখতে পেয়ে দিব্যি তা পরে এক নেমন্তন্নে গিয়েছিল। তুলনায় আমি রক্ষণশীল। আচরণেও একবার তা হতে গিয়ে মানবের বকুনি খেয়েছিলাম । দেবীপদ ভট্টাচার্য প্রেসিডেন্সি কলেজে আমাদের বাংলা পড়াতেন। তিনি যখন যাদবপুর চলে এলেন, তখন তাঁর সঙ্গে প্রথম দেখা হতেই কেন জানি না হঠাৎ ঢিপ করে একটা প্রণাম করে বসলাম। মানব সঙ্গে ছিল। ফলে ওকেও তাই করতে হল। দেবীবাবু আড়াল হতেই মানবের তর্জন। স্বাভাবিক। কারণ প্রণাম ঠিক আমারও আসত না, মানবের তো না-ই। তবে চোখেমুখে দ্রোহ নিয়ে সে চলাফেরা করত না। কখনো কখনো বেশ লাজুকই লাগত তাকে। তবে আড্ডায় মুখচোরা আদৌ ছিল না। শ্লেষে সিদ্ধ। কোন বিখ্যাত ব্যক্তিকে সে পরে ঢ্যাঙা বলবে আর কাকে ক্ষিতীশ, তা বন্ধুরা জানেন।
রহস্যরোমাঞ্চ বা গোয়েন্দাগল্পে তার জ্ঞান আমার চাইতে অন্তত দশগুণ বেশি ছিল। তার লেখা একটা গোয়েন্দাগল্প মনে পড়ছে। নাম ‘যে-পুতুল পালিয়ে গেলো’। অকুস্থল শান্তিনিকেতন-সংলগ্ন। শুনেছি সেই সময়কার বিশ্বভারতীর কোনো কর্তাব্যক্তি নাকি বলেছিলেন, মানুষটা কি আমাদের নিয়ে ঠাট্টা করছে? খেলার রাজনীতি নিয়ে তার প্রগাঢ় ঔৎসুক্য অনেককেই মুগ্ধ করেছে। তবে তার একাধিক খণ্ড ‘ভারতীয় টেস্ট ক্রিকেটের ইতিহাস’ যে এক আকরগ্রন্থ তা কি সবাই মানব না? আর নাট্যজগতে তার উৎপল দত্ত-প্রীতি অন্তত আমাকে আনন্দ দিত। তার স্বভাবে বুঝি-বা এক প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতা ছিল, তার মতামত হয়তো সেই কারণেই কখনো কখনো আপেক্ষিক হয়ে উঠত। তোমার লজিক তোমার লজিক, আমার লজিক আমার লজিক—এটা মানবই বলতে পারত।
অথচ কী নরম মন ছিল মানবের তার এক প্রমাণ আমার আছে। আমার ঠিকানা তখন ৬৭ যতীন দাস রোড, কলকাতা ২৯। আমার সঙ্গে বাস করে মেয়ে মৌকে নিয়ে কণিকা ও ইন্দ্রজিৎ সরকার । মৌ তখন ছোটো। একদিন মানব এসেছে। মৌ আমার টেবিলের নীচে রান্নাবাড়ি খেলছিল। একটুখানি সত্যিকার আনাজ আছে তার হেঁসেলে। মানব একসময় নিচু হয়ে মৌয়ের পাশে বসে, খুব মনোযোগের সঙ্গে তার খেলনার বঁটিতে এক টুকরো আনাজ কুটতে লাগল। কে বলবে ইনিই বাংলায় মার্কেজ-খ্যাত ‘অনুবাদেন্দ্র মানবেন্দ্র’? আমি তাকে শুধুই মানব বলে এসেছি পুরোনো বন্ধুতাহেতু, যেমন সেও আমাকে শুধুই অমিয় বলত পুরোনো বন্ধুতাহেতু।
মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে চিনতে চাইলে এই লেখাটি সাহায্য করবে।বড় সুন্দর এ স্মৃতির ঝাঁপি।
দ্রুত শেষ হল,আরো হলে ভালো হত
হিরণ মিত্রর স্কেচ, যথারীতি অনবদ্য।
অমিয় দেব আন্তরিক।
আমার পরম সৌভাগ্য অমিয় দেব ও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই আমাদের মাস্টারমশাই ছিলেন যাদবপুরে । সেসময় তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ ছিল নক্ষত্রসমৃদ্ধ । ফাদার আঁতোয়ান, নরেশ গুহ, নবনীতা দেবসেন, প্ৰণবেন্দু দাশগুপ্ত, স্বপন মজুমদার ,সুবীর রায়চৌধুরী আর মানবেন্দ্র বাবু আর অমিয় দেব স্যার তো ছিলেনই । মানববাবুর কাছে একবার আমরা গিয়েছিলাম স্প্যানিশ কবিতা বেছে দেওযার অনুরোধ নিয়ে । আমরা অনুবাদ করব। উনি বললেন,স্প্যানিশ জানো ? আমরা ভেবেছিলাম ইংরিজি থেকে অনুুুবাদ করব । উনি বললেন , স্প্যানিশ শিখে এসো । আমাদের এত সময় ছিল না।স্প্যানিশ কবিতার তরজমা আর হল না।
আমার পরম সৌভাগ্য অমিয় দেব ও মানবেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় দুজনেই আমাদের মাস্টারমশাই ছিলেন যাদবপুরে । সেসময় তুলনামূলক সাহিত্য বিভাগ ছিল নক্ষত্রসমৃদ্ধ । ফাদার আঁতোয়ান, নরেশ গুহ, নবনীতা দেবসেন, প্ৰণবেন্দু দাশগুপ্ত, স্বপন মজুমদার ,সুবীর রায়চৌধুরী আর মানবেন্দ্র বাবু আর অমিয় দেব স্যার তো ছিলেনই । মানববাবুর কাছে একবার আমরা গিয়েছিলাম স্প্যানিশ কবিতা বেছে দেওযার অনুরোধ নিয়ে । আমরা অনুবাদ করব। উনি বললেন,স্প্যানিশ জানো ? আমরা ভেবেছিলাম ইংরিজি থেকে অনুুুবাদ করব । উনি বললেন , স্প্যানিশ শিখে এসো । আমাদের এত সময় ছিল না।স্প্যানিশ কবিতার তরজমা আর হল না।
ভালো লাগল