শঙ্খ ঘোষ (৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৩২ – ২১ এপ্রিল, ২০২১)
এমন কে আছে বলো এ পাথুরে পথে যাবে কিন্তু কোনো নিন্দা পোহাবে না!
সব আশা ছেড়ে দিয়ে প্রবেশো এ দ্বারে
সব দেশ সব কাল তোমাকে দেখাবে অভিসারে
এ-রকমই পুঁজরক্তবমি। এবং দেখাবে কত মানুষ সুখাদ্য ভেবে তাকে
আহ্লাদে গোঙায়!
তুমি কি বাতুল এত? তুমি কি এমনই অসহায়
ওরই কাছে রেখে যাবে দেনা?
এমন কে আছে বলো শব্দের ঈশ্বরে যাবে জীবনে সর্বস্ব খোয়াবে না!
১৯৬৫-তে, দান্তের সপ্তম জন্মশতবার্ষিকী মাথায় করে, একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন শঙ্খ ঘোষ, ‘চণ্ডীদাস বা দান্তে’—তাঁর ‘ঐতিহ্যের বিস্তার’ গ্রন্থে তা আছে। নামটা নেওয়া বিষ্ণু দে-র একটা কবিতা থেকে (‘চিরঅস্থির উদাত্ত এক শান্তি/ যেমন জেনেছে চণ্ডীদাস বা দান্তে’), যদিও এক পাদটীকায় রবীন্দ্রনাথেও যে এই ‘সমীকরণ’-এর আভাস ছিল তা জানিয়ে দিয়েছেন লেখক। এই প্রবন্ধ নিয়ে ১৯৯৪-র ‘অনুষ্টুপ’ শঙ্খ ঘোষ বিশেষ সংখ্যায় যা একটু বলেছিলাম তার পুনরুক্তি না করে শঙ্খ ঘোষেরই উপসংহার উদ্ধৃত করছি:
ভরাট শব্দে কথা বলবার অভ্যাস আবার কবে হবে কে জানে, কিন্তু সে-রকম শব্দের পিছনে এখন আমরা অনেক অতিক্রম চাই, প্রজ্ঞাপ্রেমের মিলন চাই, কোনো সহজ সমাধানে উত্তীর্ণ হবার স্বপ্ন আর চাই না এখন। তাই এখন মানবধর্মানুভূতির একটা বিশ্বব্যাপক অভিজ্ঞতা অর্জনের নূতন সময়ে দান্তে হ্য়তো আমাদের কাছে অন্যভাবে আসবেন, এইরকম আশা হতে থাকে।
উপরের কবিতাটির নাম ‘সর্বস্ব’, আছে তাঁর ২০০৪-এর জন্মদিনে প্রকাশিত ‘জলই পাষাণ হয়ে আছে’ বইতে। এই কবিতাতে কি তিনি দান্তের দিকে হাঁটছেন? শুধু যে ‘ইনফেরনো’ ৩-এর সদাস্মরণীয় ‘লাশ্শিয়াতে অন্নে স্পেরাঞ্জা, ভই কিন্ত্রাতে’-এর অনুবাদ, ‘সব আশা ছেড়ে দিয়ে প্রবেশো এ দ্বারে’ পাচ্ছি, তা-ই নয়, পাচ্ছি ‘ইনফেরনো’-র সারাৎসারও। আর অবশেষে, ‘পারাদিসো’-র অন্তিম জ্যোতি। কিন্তু শঙ্খ ঘোষ লিখছেন তাঁর ‘দিভিনা কম্মেদিয়া’, দান্তের কাব্য এক পরম উৎপ্রেক্ষা তাঁর কাছে। কবি কে তারই এক আত্মিক সংজ্ঞা তিনি দিচ্ছেন। কঠিন এই পথ। ভ্রূকুটিকুটিল। তা না মানতে পারলে এ-পথে এগোনো যায় না। আর না এগিয়েই বা কী উপায়— এ-ই তো ভবিতব্য। চাইলেই কি ছেড়ে দেওয়া যায়! টমাস মান্-এর টোনিও ক্র্যগার হয়তো একটু তীব্রভাবেই বলেছিল, লেখা অভিসম্পাত, না লিখে থাকতে পারার মতো সুখ আর নেই। তবে তা বোধ করি শেষপর্যন্ত ঠিকই। এই ‘দ্বার’ দিয়ে যে ঢুকবে, তাকে ‘সব আশা ছেড়ে দিয়ে’ই ঢুকতে হবে।
প্রথম লাইনের ‘নিন্দা’-তে কি দান্তের সেই তিন ক্রমান্বিত শ্বাপদের সূক্ষ্ম ইঙ্গিত আছে—সেই চিতাবাঘ, সিংহ ও নেকড়েনি— সেই ত্রিবিধ পাপের রূপক— যারা আলোকোজ্জ্বল পাহাড়চুড়োয় সোজা উঠে যেতে দেবে না, পথ আটকে থাকবে, আর যার ফলে ঘুরপথ নিতেই হবে, সেই প্রেতলোকের পথ যেখানে আছে এক মস্ত প্রবেশদ্বার? কবিতা সব বলে না, আড়ে জানায়। এই প্রবেশদ্বারে শুধু ‘লাশ্শিয়াতে অন্নে স্পেরাঞ্জা, ভই কিন্ত্রাতে’-ই উৎকীর্ণ নয়, আরও ৩+৩+২ লাইন আছে তার আগে— এটা তৃতীয় তেপাটির শেষ লাইন। এক শোকাচ্ছন্ন নগরে পৌঁছে দেয় এই দ্বার, এক অন্তহীন দুঃখে, সমুদয় পতিত মনুষ্যকুলে; ঐশ ন্যায়ে এর সৃষ্টি, মহান প্রজ্ঞায় ও আদিপ্রেমে; এর আগে নেই কোনো অচির, আর এও চিরন্তন। যে-নামেই ডাকি না কেন এই দ্বারাভ্যন্তরীণ পুরীকে, কবির অভিজ্ঞতার আধার হবার এর বাধা কীসের? কী দেখেন কবি? দেশ-কাল। কী লেখেন কবি? শব্দ। কী থাকে সেই শব্দে? বোধ। আর বোধ জুড়ে জুড়ে যা হয় তা-ই সত্য। আর তার জন্য তাঁকে জীবন বাঁধা রাখতে হয়। তাঁর একমাত্র দেনা সত্যের কাছে।
‘সর্বস্ব’ কবিতার এক চাবি যেমন ‘নিন্দা পোহানো’, তেমনি অন্য চাবি ‘সর্বস্ব খোয়ানো’। এক চাবি ঘুরিয়ে দেশ-কালের দরজায় এসে দাঁড়াতে হয়; অন্য চাবি ঘুরিয়ে ‘শব্দের ঈশ্বরে’ পৌঁছোতে হয়। কবিমাত্রেরই গন্তব্য সেই ঈশ্বর। আবার যে-প্রেক্ষিতে এই কবিতা পড়তে নিয়েছি, তাতে তো ঐশ বিভাই দান্তের পথের শেষ। কিন্তু ওই শেষেরও আছে অনেক ধাপ, দশ দশটি ঊর্ধ্বারোহণ। দান্তের খ্রিস্টীয় ও মধ্যযুগীয় স্বর্গের কোনো প্রতিভাস আমরা, বলা বাহুল্য, এখানে খুঁজব না; শুধু জানব প্রেমই এখন পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এমনকি যে-প্রজ্ঞা এতক্ষণ পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছে তারও আদি প্রেরণা ছিল প্রেমে। আর ‘কম্মেদিয়া’ সমাপ্ত হচ্ছে এক দিব্য দর্শনে, যা প্রায় স্বপ্নের মতো গেঁথে যাচ্ছে দ্রষ্টার হৃদয়মনে। ভুলবার বোধহয় উপায় নেই যে এই কাব্যের ভেতরে বসে আছেন এক ‘শব্দের ঈশ্বর’লব্ধ কবি।
‘সর্বস্ব’ কবিতা কাকে শোনাচ্ছেন শঙ্খ ঘোষ? ‘এমন কে আছে বলো’-তে শুরু হচ্ছে; ‘এমন কে আছে বলো’-তে শেষ হচ্ছে। কাকে বলতে বলছেন? কোনো তরুণ কবিকে? মনে হয়, না। অতটা অভিভাবকত্ব কি তিনি চেয়ে নেবেন? তাহলে কি অনুকম্পায়ী কিন্তু অকবি কোনো পাঠককে বলতে বলছেন? খেলাচ্ছলে? অতটা খেলা কেন খেলবেন শঙ্খ ঘোষ যিনি এতদিন, এ ত দি ন, কবিতা লিখেছেন? আসলে বলতে বলছেন নিজেকেই। নিজের সঙ্গে এমন কথা কবিরা অনেকসময়ই বলেন। ম্যানিফেস্টো লেখেন। ফরাসি সিম্বলিস্ট কবি ভেরলেনের এক অনুরূপ কবিতার কথা আমাদের মনে পড়তে পারে যার শিরোনামই ছিল ‘কাব্যতত্ত্ব’। কবিরা যে ম্যানিফেস্টো লিখে নিয়ে তারপর কবিতা লিখতে বসেন তা আদৌ নয়, কবিতা লিখতে লিখতে হয়তো কোনো ম্যানিফেস্টোর প্রয়োজন বোধ করেন। হয়তো। হয়তো এমন কোনো মুহূর্ত আসে যখন নিজের সঙ্গে একটা কড়ার করে নিতে হয়। তার আগে পরে যা আছে তা যে সাধনধন নয়, তা নয়। তবু নিজের সঙ্গে নিজের সাধনা নিয়ে কথা বলতে হতে পারে। আপন মনে কথা, সত্তো ভোচে। পাঠক, তুমি কেবল সাক্ষী। শুনছ, আবার শুনছও না।
তোমায় শোনানোর জন্য তো কম কবিতা লেখেননি শঙ্খ ঘোষ! সারা লেখাজীবন ধরেই লিখেছেন! এই ‘জলই পাষাণ হয়ে আছে’ বইতেই তো আর সব কবিতা তোমার। ধরো ‘দায়’ নামের এই মৃদুস্বর কবিতা:
যতদূর দেখা যায় সারি সারি সেলাইকরা মানুষ
স্থির দাঁড়িয়ে আছে তার জন্য।
সে অবশ্য এখন একটু ব্যস্ত, তার অনেকরকম দায়।
পৃথিবীটা একটুখানি ঠিকঠাক করে দেবার দায়
তোমার বসতবাড়িতে ঘুঘু চরাবার দায়
তোমার সবটুকু নিশ্বাস শুষে নেবার দায়
তোমার মুখে রক্ত তুলে নিয়ে সে-রক্ত আবার মুছে নেবার দায়
আর, সত্যি বলতে কী,
তার নিজের গোর খুঁড়বারও দায়।
ক্রমমুক্তি? এভাবেই হবে।
সারি সারি সেলাইকরা মানুষ
প্রতীক্ষায় আছে ।
একুশে এপ্রিল ২০২১-এর কথা মাথায় রেখে আমার যে-কবিতা মনে পড়ল তা এই ‘সর্বস্ব’ই, যার শেষ লাইন, আরও একবার, ‘এমন কে আছে বলো শব্দের ঈশ্বরে যাবে জীবনে সর্বস্ব খোয়াবে না!’