এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  বিবিধ

  • ক্যাফে বিষয়ক

    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়
    আলোচনা | বিবিধ | ১০ আগস্ট ২০০৮ | ৯২১ বার পঠিত
  • সমস্যাটা আসলে ঠিক কোথায় বোঝা যাচ্ছেনা। বেঙ্গালুরু এবং আমেদাবাদে সারি দিয়ে বোমা বিস্ফোরণ হল। অনেক মানুষ প্রাণ হারালেন। সুরাটে খুঁজে পাওয়া গেল না ফাটা বোমা। প্রবল পুলিশী তদন্ত এবং কয়েকটি জঙ্গী সংগঠনের স্বীকারোক্তি সত্ত্বেও কারা বোমা ফাটালো জানা গেলনা। আমেদাবাদে বোমা ফাটার পাঁচ মিনিট আগেই নাকি দস্যু মোহন স্টাইলে আগাম খবর দেওয়া ইমেল আসে সংবাদ সংস্থার দপ্তরে। তা সত্ত্বেও বোমা বিস্ফোরণ আটকানো যায়নি। একজন জঙ্গীও ধরা পড়েনি। দিন কয়েকের মধ্যেই কলকাতার এক সংবাদসংস্থার দপ্তরে এল একই রকম ইমেল। ইমেলে নাকি লেখা ছিল, কলকাতার বিভিন্ন জায়গায় অবিলম্বে বোমা বিস্ফোরণ হবে। পরিস্থিতির গুরুত্ব বিচার করে সংবাদসংস্থাটি অবিলম্বে পুলিশকে ফরোয়ার্ড করল ইমেলটি। কলকাতা জুড়ে পুলিশ জোর তদন্ত চালাল। কোনো বোমা মিললনা। বিস্ফোরণও হলনা। বোঝা গেল ইমেলটি ভুয়ো ছিল। ওদিকে এই ভুয়ো ইমেলের সূত্র ধরে পুলিশ পৌঁছে গেল সল্টলেকের এক সাইবার ক্যাফেতে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হল সাইবার ক্যাফের মালিক এবং এক মহিলা ম্যানেজারকে।

    ঘটনা এতেই শেষ হলে, জাল মেল পাঠানোর জন্য ব্যক্তিবিশেষকে দোষারোপ করা যেত। এই ধরণের ভুয়ো খবর দিয়ে যারা আনন্দ পায়, তাদের গ্রেপ্তারের দাবী করা যেত। কিন্তু ঘটনা গড়াল অন্যদিকে। ভুয়ো ইমেল পাঠানো নয়, ক্যাফে-মালিককে গ্রেপ্তার করা হল ভয়ঙ্কর সব অভিযোগে। যেমন, রাষ্টের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। রাষ্টের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার হুমকি। এবং সরকারি সম্পত্তি ধ্বংসের অভিযোগ। সাধারণবুদ্ধি একটু প্রয়োগ করলেই বোঝা যায়, যে, ভুয়ো ইমেল পাঠানোর সঙ্গে এই সব অভিযোগের কোনো সম্পর্কই নেই। কোনো প্রমাণ নেই, তবুও যদি ধরেই নেওয়া হয়, যে, ভদ্রলোক ভুয়ো মেল পাঠানোর সঙ্গে সরাসরি যুক্ত, তাহলেও অভিযোগগুলি অবাস্তব। অযৌক্তিক। ভুয়ো মেল পাঠানো অপরাধ, নি:সন্দেহে। কিন্তু সেটা কোনোমতেই রাষ্ট্রদ্রোহিতা নয়। তার কাছাকাছিও কিছু নয়। একজন ব্যক্তি ইন্টারনেটকে ব্যবহার করে একটি ভুয়ো মেল করেছিলেন। ধরা পড়লে যা শাস্তি প্রাপ্য তা তাঁর হবে। এই পর্যন্ত। সহজ কান্ডজ্ঞান থেকেই এটুকু বোঝা যায়।

    এই সহজ কান্ডজ্ঞানটি পুলিশ ও মিডিয়ার আচরণে লক্ষ্য করা যাচ্ছেনা। এমন একটা ভাব দেখানো হচ্ছে, যেন, ভুয়ো মেলটি কে করল, তাইই আসলে মূল রহস্য। সুরাটে, ব্যাঙ্গালোরে বোমা কারা ফাটাল, কে বানাল সেই বোমা, সেই রহস্য উদ্ধারে কি কি করা হচ্ছে, জানা যাচ্ছেনা। এখন পুলিশের মূল সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ভুয়ো ইমেল দমন করা। তাতেই সব সমস্যার চাবিকাঠি। এমন একটা হাওয়া তোলা হচ্ছে, যেন বোমা বানানো, বোমা ফাটানো আর ভুয়ো ইমেল করা একই গোত্রের অপরাধ। বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে জড়িয়ে ফেলা হচ্ছে ভুয়ো ইমেলকে। এবং ইমেলের সঙ্গে জড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সাইবার জগৎকে। এমন একটা ভঙ্গীতে পুরো জিনিসটা প্রোজেক্ট করা হচ্ছে, যেন, বোমা বিস্ফোরণের মূল কারণ হল সাইবার ক্যাফে। ইন্টারনেটের অপার স্বাধীনতাই আসলে মূল কালপ্রিট। হাস্যকর সন্দেহ নেই। যেন ইন্টারনেটে বসে বোমা বানানো হয়, আর সাইবার ক্যাফে দিয়ে তৈরি হয় ষড়যন্ত্রের জাল। বা বোমার অবৈধ আউটলেট হল সাইবার ক্যাফে। যেকোনো বুদ্ধিমান লোকই বুঝবেন, যে, সাইবার ক্যাফের সঙ্গে সুরাটের বোমা বিস্ফোরণের কোনো সম্পর্ক নেই। সাইবার ক্যাফেতে প্রবল নজরদারি চালু হলে, বড়জোর যেটা হতে পারে, যে, বোমাবাজরা ইমেল করে হুমকি দেওয়া থেকে বিরত থাকবে। সম্ভবত: ফোনে হুমকি দেবে। বা চিঠি দিয়ে যাবে। এই পর্যন্ত। কিন্তু বোমা বানানো বা ফাটানোর সমস্যা বাড়বেওনা, কমবেওনা। দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিস। চেরাপুঞ্জিতে বৃষ্টি কম হলে মিসিসিপির জল কমে যায়না। বা কচিবাচ্চা জন্মদিনের কেকে ফু দিলে তার সঙ্গে সাইক্লোনের কোনো সম্পর্ক নেই।

    পুলিশ ও প্রশাসনের বড়োকর্তারা আসলে সত্যিই এতটা বোকা নন, যে, এই সহজ কথাটা তাঁরা বুঝবেন না। সেই কারণেই সন্দেহ হয়, যে, আসলে, অন্য কিছু নয়, এই সব সুনির্দিষ্ট অভিযোগ এনে মিডিয়ায় যে হৈচৈ ফেলে দেওয়া হচ্ছে, তার পিছনে গভীরতর কোনো উদ্দেশ্য আছে। এবং উদ্দেশ্যটি সত্যি সত্যিই বিপজ্জনক। হুজুগই জনমত তৈরির সর্বোৎকৃষ্ট পন্থা। মিডিয়া আর পুলিশ মিলে তৈরি করা হচ্ছে হুজুগ। কৌশলে তৈরি করা হচ্ছে জনমত। আমেদাবাদ, সুরাটের বোমা আর কলকাতার সাইবার ক্যাফে, এই দুটো সম্পূর্ণ আলাদা জিনিসকে অত্যন্ত কেয়ারফুলি একসঙ্গে জোড়া হচ্ছে। সাইবারক্যাফে গুলিকে বেঁধে ফেলা হচ্ছে বিধিনিষেধের আওতায়। কি কি বিধিনিষেধ? একটু লিস্ট করা যাক:

    ক। প্রতিটি সাইবার ক্যাফেতে একটি রেজিস্টার রাখতে হবে। ব্যবহারকারীদের নিজের হাতে নাম-ধাম লিখতে হবে।
    খ। প্রতিটি ব্যবহারকারীকে একটি সচিত্র পরিচয়পত্র দেখাতে হবে।
    গ। প্রতিটি কম্পিউটারে কি করা হল, তার রেকর্ড ছ মাস রাখতে হবে।
    ঘ। সন্দেহজনক কাজকর্ম দেখলেই পুলিশকে জানাতে হবে।

    এছাড়াও পুলিশ/প্রশাসনের মাথায় আরও যে কটি পরিকল্পনা আছে, তার মধ্যে অন্যতম হল, ক্যাফেতে কম্পিউটার ব্যবহারকারীর মুখের ছবি আর হাতের ছাপ ধরে রাখা হবে।

    তো, এর মধ্যে বিপদটা কোথায়? রেজিস্টার রাখা, বা, সচিত্র পরিচয়পত্র দেখানো নিয়ে কোনো গোলযোগ নেই। আপাতত:। কিন্তু আসল বিপদ হল, প্রতিটি কম্পিউটারের তথ্য ছমাস ধরে রাখা নিয়ে। এর অর্থ হল, আপনি আজ সাইবার ক্যাফেতে বসে যদি বান্ধবীর সঙ্গে রসালাপ করেন, তার প্রতিটি অক্ষর, প্রতিটি শব্দ, ক্যাফের মালিকের কাছে রাখা থাকবে। যদি মেল পড়েন, মেল করেন, আপনার প্রতিটি অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড রেকর্ড থাকবে ক্যাফেতে। থাকবে মেলের প্রতিটি শব্দ। যদি ক্রেডিট কার্ড ব্যবহার করে কিছু কেনেন, তবে থাকবে ক্রেডিট কার্ডের প্রতিটি নম্বর। আরও ব্যক্তিগত এবং সেন্সিটিভ যা যা মনে করতে পারছেন, আপনার সেইসব গোপনতম তথ্যগুলি আপনাকে বিনা বাধায় তুলে দিতে হবে একজন ক্যাফে মালিকের হাতে। আইন ক্যাফে মালিককে বাধ্য করবে তথ্যগুলিকে জমা রাখতে। নইলে অপরাধ হবে। জেল খাটতে হতে পারে।

    এর সঙ্গে এটাও মনে রাখতে হবে, ভারতবর্ষে প্রাইভেসি সংক্রান্ত অধিকারগুলি সেভাবে স্বীকৃতই নয়। ফলে ঐ ব্যক্তিগত তথ্য নিয়ে ঠিক কি কি করা যেতে পারে, আর কি করা যাবেনা, তার কোনো গাইডলাইন নেই। ফলে যা-যা হতে পারে,

    এক। আপনার মেল আইডি হ্যাকড হতে পারে সহজেই, কিচ্ছু করার নেই। আপনার ব্যক্তিগত সমস্ত মেল চালাচালির ইতিহাস অন্য লোকে দেখতে পারে। আপনার ব্যক্তিগত আলাপচারিতায় স্বচ্ছন্দে উঁকি মারতে পারে অন্যের নাক। আপনার অর্থনৈতিক তথ্য, ক্রেডিট কার্ডের নম্বর, গোপন থাকবে কি থাকবেনা, তাও নির্ভর করছে অন্যের দয়ার উপর।

    দুই। পুলিশ। তারা যে কি কি করতে পারে, তার তো লেখাজোখা নেই। রাজনৈতিক বিরোধীদের উপর নজর রাখতে পারে সরকার পক্ষের হয়ে। স্রেফ ফাঁসানোর জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এই তথ্যসমূহ।

    তিন। মিডিয়া। এই প্রতিযোগিতামূলক অনুসন্ধানী সাংবাদিকতার যুগে কোমরে গোপন ক্যামেরা গোঁজা হাইটেক সাংবাদিককূল যা খুশি করতে পারেন। কোনো গাইডলাইন নেই।

    এই বিশেষ ঘটনাটিই দেখুন। সল্টলেকের ঐ ক্যাফের মহিলা ম্যানেজারের "মহিলা' পরিচয়টি গৌণ হবারই কথা ছিল। কিন্তু এই বাজারে এমন কেচ্ছার সুযোগ ছাড়া যায়? অতএব সংবাদপত্রের কল্যাণে আমরা জেনে ফেললাম, যে, মহিলা এইট পাশ হলে কি হবে, ফরফরিয়ে ইংরিজি টাইপ করতে পারেন। তাঁর ওর্কুট প্রোফাইলের নাম "রানী লাভ'। সেখানে তাঁর শ দুই বন্ধুর মধ্যে দুজন মাত্র মহিলা (ইশ ছি ছি)। শুধু তাইই নয়, মহিলার নাকি এমবিএ থেকে বিএমডাব্লু পর্যন্ত বিচিত্র সব বিষয়ে আগ্রহ। একে তো বিবাহবিচ্ছিন্না, তারসঙ্গে প্রোফাইলে নামের সঙ্গে "লাভ', চারিদিকে পুরুষবন্ধু, এবং বিএমডাব্লু চড়ার শখ, এর পরেও কি মহিলা যে কি চিজ তা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকতে পারে কি? ফলে বাইচান্স আপনাকে যদি পাবলিকের চোখে ভিলেন বানাতে হয়, তাহলে মিডিয়া কি কি করতে পারে, সেটা এই বিশেষ ঘটনাটিতে দেখাই যাচ্ছে। একজন বিবাহবিচ্ছিন্না আশ্রিতা মহিলা, তিনি কোনো অপরাধ করেছেন কিনা জানা নেই, তাঁর ব্যক্তিগত মেলের লেখালিখি, বন্ধুদের পাঠানো চিঠিপত্র সবই পুলিশের হাত ঘুরে বেরিয়ে যাচ্ছে মিডিয়ায়। ওর্কুট প্রোফাইলে কটি বন্ধু তা নিয়ে রসালো আলোচনা করছেন ইন্টারনেট বিশারদ সাংবাদিক। এর পরে আর পুলিশ-টুলিশও লাগবেনা, অদূর ভবিষ্যতে ক্যাফে মালিককে দু-দশ (বা দু-দশ হাজার) টাকা দিলেই হাতে চলে আসবে রত্নগুহার গুপ্তধন। কাকে কাকে মেল করেছেন, কি কি লিখেছেন, কার সঙ্গে প্রেম ছিল আপনার, কিভাবে ভাঙল সবই উঠে আসতে পারে খবরের কাগজের পাতায়। এবং এই জঙ্গলের রাজত্বে কোথাও কোনো রক্ষাকবচ নেই। কোনো এথিক্স নেই। প্রাইভেসি লঙ্ঘনের লক্ষণরেখা নেই।

    এবং এটা কোনো বিচ্ছিন্ন বা আকাশ থেকে পড়া ঘটনা নয়। ভারতীয় সমাজে, বা রাষ্ট্রে, প্রাইভেসি বা ব্যক্তির অধিকার, এগুলি চিরকালই প্রান্তিক বর্গ। শাসনতান্ত্রিকতার মূল স্রোতে এরা অপাংক্তেয়। "সমাজ' পাশের বাড়ির মেয়ের পোশাকের উপর নিয়ন্ত্রণ বিস্তার করতে চায়। কলোনি আমলে যে আইনগুলির জন্ম হয়েছিল, এবং আজও যারা রাষ্ট্রের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তারা "ব্যক্তির অধিকার' নামক বিষয়টিকে কখনও স্বীকার করেনি, যে কারণে "প্রাইভেসি' নামক বর্গটির দেশের আইনব্যবস্থায় কোনো অস্তিত্ব নেই। গোপনীয়তা নয়, আমাদের রাষ্ট্র কলোনি আমলের ট্র্যাডিশন বজায় রেখে সকলকে আলোর মধ্যে রাখতে চায়, যাতে প্রয়োজনমতো "বিপজ্জনক' লোকটিকে চিহ্নিত করা যায়। এবং কলোনি আমলের ট্র্যাডিশন মেনে, যাহাই আলোকের নিচে নেই, তাহাই বিপজ্জনক। গোপনীয়তা মানেই তা রাষ্ট্রের পক্ষে বিপজ্জনক। আবার আমাদের আদি ও পুরাতন "সমাজ'ও গোপনীয়তাকে বরদাস্ত করেনা। শোবার ঘরে নজরদারি তার প্রাগাধুনিক বৈশিষ্ট্যগুলির অন্যতম। প্রাগাধুনিক সমাজের অবশেষ আর কলোনি-উত্তর রাষ্ট্রের এই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন নিয়ে অন্যত্র বিশদে আলোচনা করা যেতে পারে। এখানে শুধু এইটুকুই বলা যাক, যে, ইন্টারনেটের অপার স্বাধীনতা এই সাংস্কৃতিক মেলবন্ধনকে অস্বীকার করে। আক্রমণ করে। খানিকটা আন্তর্জাতিক চরিত্রের জন্য, খানিকটা প্রযুক্তিগত কারণে, অ্যাননিমিটি, গোপনীয়তা, প্রাইভেসি পলিসি, এসব ইন্টারনেটের অবিচ্ছেদ্য অংশ। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীরা সবাই এগুলির সঙ্গে পরিচিত। এই রক্ষাকবচে অভ্যস্ত। এই গোপনীয়তা, এই বিশেষ মাধ্যমটির জন্য প্রয়োজনীয়ও বটে। একজন মানুষের মুখচ্ছবি নয়, পরিচিতি যেখানে কিছু অক্ষরসমূহের বিন্যাস দিয়ে, যাকে সোজা বাংলায় আইডি বলে, তখন সেই আইডির রক্ষাকবচ পাসওয়ার্ডকে গোপন না রাখতে পারলে, পরিচিতিটাই বিপন্ন হয়ে পড়ে। কারেন্সি নয়, বিনিময়ের মাধ্যম যেখানে একটি কার্ডের কিছু নম্বর, সেখানে, নম্বর গুলি গোপন না রাখতে পারলে ব্যক্তিগত কেনাবেচার পদ্ধতিটাই তুলে দিতে হবে। ফলে গোপনীয়তা এবং গোপনীয়তার অধিকার ইন্টারনেটের সঙ্গে এক ও অবিচ্ছেদ্য।

    ইন্টারনেটের এই গোপনীয়তার ধারণা, এই আলোছায়ার আভাসই ভারতীয় প্রাগাধুনিক মূল্যবোধ আর কলোনি আমলের শাসক-সংস্কৃতিকে প্রতিনিয়ত আঘাত করছে। নাকের ডগা দিয়ে একটি যুবক বা যুবতী ইন্টারনেটে ঢুকে চুপচাপ ফুলে ছাপ দেবে, ফুর্তিফার্তা করবে, আর সনাতন সমাজ চুপচাপ বসে দেখবে মূল্যবোধের এই অবক্ষয়কে, কলোনির মরাল-পুলিশ অভব্যতার সাইবার ঝোপেঝাড়ে উঁকি মেরে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে পারবেনা, ভারতীয় কলোনি-উত্তর শাসনব্যবস্থার প্রতি এ এক চরম চ্যালেঞ্জ। ফলে রাষ্ট্র-সমাজ ইন্টারনেটে ভুত দেখছে। দেখেছে। আতঙ্ক এটাই, যে, এভাবে চলতে দিলে তো গোটা ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েবে একসময়। ব্যবস্থা ভেঙে পড়া অবশ্য এতো সোজা নয়, কিন্তু আতঙ্ক তো আতঙ্কই। তা কোনো যুক্তিবুদ্ধি মেনে চলেনা। ফলে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে এই আতঙ্কের বিভিন্নরকম প্রকাশ দেখেছি আমরা। ইন্টারনেটের ছুঁড়ে দেওয়া চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার বিভিন্নরকম পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছে। সাইবার-ক্যাফে গুলিতে হঠাৎ নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে বিভিন্ন অঞ্চলে। চুপি চুপি পর্নো সাইট দেখতে গেলে ধরপাকড় করা হয়েছে। কিন্তু এসব খুচরো ও বিচ্ছিন্ন পদ্ধতি। সুনির্দিষ্ট কোনো ব্যবস্থার মধ্যে দিয়ে একটা কড়া নজরদারির পদ্ধতি চালু করা যায়নি সেভাবে।

    এতদিন করা যায়নি। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাবলী, সন্ত্রাস, বোমা বিস্ফোরণ এবং ভুয়ো মেল, এই প্রগাঢ় এবং কড়া নজরদারিকে চাপিয়ে দেবার সেই সুযোগ এনে দিয়েছে রাষ্ট্র- সমাজের সামনে। ফলে, সন্ত্রাস-টন্ত্রাস না। সন্ত্রাসের সঙ্গে, বোমা বিস্ফোরণের সঙ্গে, সাইবার ক্যাফেকে গুলিয়ে দিয়ে, ব্যক্তির প্রাইভেসি হরণের একটা পদ্ধতি চালু হয়েছে। বোমাবিস্ফোরণের হুজুগ তুলে জনৈক ব্যক্তিবিশেষকে ভিলেন বানিয়ে একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে পুরোটাকেই র‌্যাশনালাইজ করার চেষ্টা হচ্ছে। কি হচ্ছে, কিভাবে হচ্ছে, পদ্ধতিটি ঠিক কি হবে, প্রশাসনের মাথায় ঠিক কি আছে, সেটা প্রশাসন বলতে পারবে, কিন্তু প্রক্রিয়াটি সনাতন সমাজ আর কলোনি-রাষ্ট্রের চিরপুরাতন প্রাইভেসি হরণের বৃহত্তর প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত। এর সঙ্গে বোমা বিস্ফোরণের কোনো সম্পর্ক নেই। সন্ত্রাসদমনেরও নয়।

    আগস্ট ১০, ২০০৮
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১০ আগস্ট ২০০৮ | ৯২১ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন