দু-ভাবে ভাবা যেতে পারত। লেখাটা শুরু করা যেত, ১৯৬৯এ জাপানের চিবায় ফিফার কোচেদের ট্রেনিং কোর্স দিয়ে যেখানে চুনী বা পিকে উভয়েই ফার্স্টক্লাসে পাস করেছিলেন। অথবা শুরু করা যেতে পারত ১৯৬২র এশিয়ান গেমসে যাবার আগের এক সন্ধ্যার কথা বলে। যখন ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে পিকে আর চুনী ঘন্টাখানেক হাঁটতে হাঁটতে আড্ডা মেরে এলেন।
কিন্তু ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বলছে, না। এই লেখাটা শুরু করতে গেলে আমাদের ফিরে যেতে হবে ১৯৫৩র সেই দিনটায়। রাঁচির গভর্ণর্স কাপ খেলতে গেছে বেহালার রামকৃষ্ণ স্পোর্টিং। জামশেদপুর থেকেও একটা টিম এসেছে। রামকৃষ্ণ স্পোর্টিং-এর হয়ে খেলতে গেছেন চুনী ওরফে সুবিমল গোস্বামী আর জামশেদপুরের দলটায় রয়েছেন প্রদীপ কুমার ব্যানার্জী ওরফে পি কে। খেলার শেষে সবাই মুরি যাচ্ছেন বাসে করে। মুরি থেকে ট্রেন। দু ঘন্টার জার্নি। পিকে চুনী একই বাসে। সময় কম, বাস চলছে জোরে, ট্রেন ধরতে হবে তো। হঠাৎ চোখ ধাঁধিয়ে গেল ড্রাইভারের, উল্টোদিকে বোধহয় একটা বাস বা লরি কিছু ছিল, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদের দিকে ছুটছে বাস। বাসে রয়েছেন বসে আগামী দিনের দুই সুপারস্টার, প্রদীপ আর সুবিমল। পিকে আর চুনী। আঠারো মাসের ছোটো বড়। মোটামুটি নাম হয়ে গেছে দুজনেরই। সবাই ধরে নিয়েছে এরা কলকাতা মাঠ কাঁপাবে আর কিছুদিন পরেই। বাস ছুটতে ছুটতে ধাক্কা খেল বড় পাথরে। কাত হয়ে সামলে গেল। ভাগ্যিস গেল। না হলে?
এই গল্পটা থেকে শুরু করলে কী হল? আসলে কলকাতা মাঠে যখন পিকে আর চুনী দুজনেই এলেন তখন থেকেই বোধ হয় এঁরা পরবর্তীকালে একসঙ্গে দেশের হয়ে কিছু একটা করার ভবিতব্য নিয়েই এসেছিলেন। ১৯৫৪, জামশেদপুর থেকে প্রদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়কে বড় ক্লাবে খেলার আশা দিয়ে নিয়ে আসে একটি ক্লাব কিন্তু কথা রাখেনি। ফলত এরিয়ান ক্লাবে প্রথম বছর খেলা শুরু করেন তিনি।
চুনী গোস্বামীর ক্ষেত্রে শুরু থেকেই সবাই জানতেন যে মোহনবাগানে খেলবেন তিনি। তদানীন্তন মোহনবাগান কোচ বলাই দাস চ্যাটার্জী হাতে গড়া চুনি গোস্বামী সিনিয়র টিমে খেলার আগে মোহনবাগান জুনিয়র দলে খেলেছেন। কিন্তু মোহনবাগানের হয়ে প্রথম ম্যাচ খেলাটা নাটকীয়ভাবে হয়।
৫৪ মোহনবাগানে রাইট আর লেফট ইনে খেলার জন্য রয়েছেন চারজন, সাত্তার, রুণু গুহঠাকুরতা, সমর (বদ্রু) ব্যানার্জী আর রবীন পাত্র। এদের মধ্যে প্রথম তিনজন ভারতীয় দলের খেলোয়াড়। ৫৪র মে মাসের শেষ শনিবার। তখন আবার পরিবর্ত খেলোয়াড়ের নিয়ম ছিল না। ফুটবল মাঠে পরিবর্ত খেলোয়াড়ের নিয়ম চালুই হয় ১৯৬৯তে স্প্যানিশ লা লিগা থেকে। যাই হোক, প্রথম চার ম্যাচে সুযোগ হয়নি চুনীর, পঞ্চম ম্যাচেও হবে না ধরেই নিয়েছেন। হঠাৎ, দুপুরে দেখেন বাড়িতে তাঁর গাড়ি নিয়ে পৌঁছে গেছেন মোহনবাগান কিংবদন্তী উমাপতি কুমার। উনি তখন ফুটবল দল দেখাশোনা করছেন। কোচ সেই বলাইদাস চ্যাটার্জী। যাই হোক উমাপতি কুমার তো চুনীকে নিয়ে মাঠে এলেন। আর বলাইবাবু চুনীকে ইশারায় বললেন জার্সি পরে রাখতে। তখন অবশ্য ট্র্যাডিশন ছিল যে আগে মোজা বুট পরে তারপর জার্সি পরত ফুটবলাররা। কিন্তু চুনী জার্সি পরে বসে রইলেন। আর হঠাৎ দেখলেন বদ্রু ব্যানার্জী এসে গেছেন। চুনী তখন রাইট ইনের খেলোয়াড়। বদ্রুও তাই। কিন্তু সমস্যা হল উমাপতি কুমারের একটি সংস্কারবশত মোহনবাগানের জার্সি কেউ গায়ে চড়ালে আর খোলাতেন না। চুনী খেললেন আর গোলও করলেন। ময়দান জয়ের সেই শুরু।
কিন্তু পিকে কি ছেড়ে দেবার বান্দা? অনেক কষ্ট করে ফুটবলটা খেলছেন তিনি। পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে বড় এবং বাবার অবর্তমানে পরিবারের দায়িত্ব তাঁর উপর। এই অবস্থায় ৫৬য় ইস্টার্ন রেলের ১৭০ টাকা মাইনের চাকুরীর অফার ছাড়েন কী করে! তারপরে অবশ্য লোণে মোহনবাগান দলের সঙ্গে দূরপ্রাচ্য সফরও করে চলে এসেছেন তিনি। তবুও সরকারীভাবে বড় কোনও টিমেই খেলা হল না তাঁর। তাতে কী! ১৯৫৬র চতুর্থ স্থানাধিকারী অলিম্পিক দলে স্থান হল। ১৯৫৮য় তিন বড়দলকে হারিয়ে ইস্টার্ন রেলকে কলকাতা লীগ দেওয়া হল। আর সে বছরই স্থাপিত হল ভারতীয় ফুটবলের সেরা ত্রিভূজ, চুনী-পিকে-বলরাম।
তুলসীদাস বলরাম এলেন সেকেন্দ্রাবাদ থেকে ইস্টবেঙ্গলের হয়ে খেলতে। চুনী গোস্বামী টানা ১৪ বছর মোহনবাগানে খেলে ক্ষান্ত দিলেন। পিকেও ফুটবল ছাড়েন ১৯৬২তে। বলরামের খেলা অবশ্য আগেই থেমে গেছে ১৯৬৪তে ফুসফুসের সংক্রমণের কারণে। সে অন্য কথা।
কেমন খেলতেন এই ত্রিভূজ? ইউরোপীয় ফুটবলের নিরিখে যদি দেখি তাহলে কাছাকাছি দেখতে পাচ্ছি প্যারিস সাঁ জাঁর ত্রিভুজকে। চুনী যেন নেইমার জুনিয়র। চূড়ান্ত স্কিল, তীক্ষ্ণ বুদ্ধি এবং মাঠের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার কাচের মতো ধারণা, অপর দিকে পিকে ব্যানার্জী যেন কিলিয়ান এমবাপে, ডান প্রান্ত ধরে ভয়ঙ্কর গতি, ডান আর বাঁ পায়ে গোলার মতো শট, জাল কাঁপাতে সময় লাগে না। দেশের হয়ে ৬৬ গোল করার রেকর্ড এই কদিন আগে ভাঙলেন মাত্র সুনীল ছেত্রী। আর তুলসীদাস বলরাম যেন এডিনসন কাভানি। নিচে নেমে ডিফেন্সা সহায়তা করে বল ধরে উইঙে বাড়িয়ে বক্সের মধ্যে বল পায়ে পেলেই গোল।
এই তিনজন আর গোলে পিটার থঙ্গরাজ, প্রদ্যোৎ বর্মন, ডিফেন্সে অরুণ ঘোষ, প্রশান্ত সিংহ, জার্নেল সিং, চন্দ্রশেখর, ত্রিলোক সিং মাঝমাঠে ফ্র্যাঙ্কো, পি সিং রাম বাহাদুর আর ৩-২-৫ ছকের ফরোয়ার্ড হিসাবে অরুময় নৈগম, আফজল খাঁ, ইউসুফ খাঁ। সঙ্গে কোচ সর্বজনশ্রদ্ধেয় রহিম সাহেব। এই নিয়েই ১৯৬২র জাকার্তা গেমস। ভারতের সর্বকালের সেরা টিম। ভারতের সর্বকালের সেরা কোচ।
বল চুনীর পায়ে পড়লেই পিকে বুঝে যেতেন কোথায় আসতে পারে, ডান প্রান্ত ধরে ছুট। চুনী তখন ল্যাজে খেলাচ্ছেন ডিফেন্ডারদের। বলরাম চুনীর সঙ্গে ওয়াল খেলার জন্য রেডি। ওয়ান-টু-ওয়ান ওয়াল খেলে বল গেল ডান দিকের টাচ লাইন বরাবর। চুনি বাঁ দিকে বলরাম মাঝ বরাবর ছুটলেন। পিকে দুর্নিবার গতিতে ডানদিক দিকে ইনসাইড কাট করে ঢুকে পড়েছেন। বলরাম বক্সের কোণায়। চুনি বক্সের বাঁ দিকে পিকে মাঝখানে। পাঠক বলুন, তিন ডিফেন্ডার কার দিকে নজর রাখবে? নাকি পিকের আগুনের গোলার সামনে শরীর পেতে দেবে। চামড়ার বল, পায়ের সপাট স্পর্শে গতি পেয়ে তখন অপ্রতিরোধ্য। আর চুনীর কাছে বল পৌঁছলে? টুথপিক দিয়ে ফুটবল খেলতেন, অগুনতি শরীরের মধ্যে দিয়েও খুঁজে নিতেন গোলের কোণ। ৬২ এশিয়াড প্রথম ম্যাচ হেরেও সেই দক্ষিণ কোরিয়াকেই ফাইনালে পর্যদুস্ত করে যখন জিতলেন তাঁরা, চুনী তখন জাতীয় নায়ক। টটেনহ্যাম হটস্পার তখন ব্রিটিশ লীগ এবং এফএ কাপ দ্বিমুকুট জিতেছে। যোগাযোগ করল তারা চুনীকে ট্রায়ালে ডাকা হল। এশিয়ার সেরা ফুটবলারকে তারা চায় ইংল্যন্ডের মাঠে। চুনী যাননি, ঠিক যেভাবে মধ্যপ্রাচ্যের অফার বহু পরে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন, চুনীর মতো স্টাইলে খেলা আই এম বিজয়ন। আসলে কলকাতা মাঠের আদর ভালবাসা, জল কাদা আর ঘাসের স্পর্শ ছেড়ে কেই বা যেতে চায়! তখন তো টিভি ছিল না, ইংল্যন্ডে গিয়ে খেললে কি আর চুনী গোস্বামীর আপামর মোহনবাগানীর বুকের পাঁজর হওয়া সম্ভব হত?
অথচ রেকর্ডের খাতায় বারবার প্রদীপ ব্যানার্জী হারিয়ে গেছেন চুনীকে। আঠারো মাসের পার্থক্যের ভরপুর ফায়দা, আগে ভারতের হয়ে খেলা, প্রথম অর্জুন, দ্বিগুণের বেশি গোল। আসলে চুনীর জায়গায় খেলার লোক শুরুতে অনেকে ছিলেন। চুনীর প্রথম অধিনায়কই ১৯৫৬র সেই অলিম্পিক গেমসে অধিনায়কত্ব করেছেন। ১৯৬০এর রোম অলিম্পিকে যেমন করলেন পিকে। তাহএল ১৯৬২তে চুনী কেন অধিনায়ক হলেন?
আসলে এখানে বড় দলের ইগো আর সমর্থকদের সেন্টিমেন্ট কাজ করেছিল। চুনী তখন সন্তোষ ট্রফিতে বাংলার এবং মোহনবাগানেরও অধিনায়ক। এক উত্তাল জনসমর্থনের চূড়ায় বসায় এক অনন্য ফুটবলার। সেখানে প্রদীপ ব্যানার্জী খেলেন মাত্র ইস্টার্ণ রেলে, অফিস ক্লাব। উপরের কলকাঠি নাড়ে, এক বন্ধুর হাত থেকে অধিনায়কত্বের ব্যান্ড চলে যায় অপর বন্ধুর হাতে। তা বলে কি বন্ধুত্বে আঁচ লাগে? ক্যাম্পের শেষ দিন দুজনে মিলে বেরোন হেঁটে আসতে। হাঁটতে হাঁটতেই চুনীর হাত ধরে পিকে বলেন, ‘তুই অধিনায়ক হয়েছিস আমি খুব খুশী হয়েছি’। জড়িয়ে ধরেন একে অপরকে, গল্প শেষ।
তারপর? তারপর ১৯৬৩য় রহিম সাহেব মারা গেলেন ক্যান্সারে। ব্রিটিশ হ্যারি রাইট কোচ হলেন, বলরাম টিমের বাইরে গেলেন তবু ইন্দর সিং, সুকুমার সমাজপতিদের নিয়ে এশিয়া কাপ ফুটবলে ইজরায়েলের কাছে হেরে রানার্স হলেন চুনী পিকেরা। চুনী, পিকে তখনও মাঠ কাঁপাচ্ছেন। চুনি পরপর তিনবার ডুরান্ড জিতলেন মোহনবাগানের হয়ে। তখন ফাইনালের হাফটাইমে রাষ্ট্রপতি দুই দলের অধিনায়কের সঙ্গে চা খেতেন। রাধাকৃষ্ণণ ১৯৬৫তে তৃতীয়বারের জন্য চা খেতে এসে চুনীকে বললেন, ‘আর কী কথা বলব তোমার সঙ্গে? সবই তো জেনে গিয়েছি তোমার সম্পর্কে!’ ১৯৬৩তে অর্জুনও পেয়ে গেলেন চুনী। ১৯৬২তে এশিয়ান অলস্টার দলে সুযোগ এবং এশিয়ার সেরা ফরোয়ার্ড শিরোপা।
তারপর ১৯৬৮ আসতে আসতে উভয়ই খেলা ছাড়লেন। খেলা কিন্তু ছাড়ল না চুনী আর পিকেকে। ফিফার কোচিং কোর্সে উভয়ই জাপান থেকে ডিস্টিংশন নিয়ে পাস করলেন। সময়টা ১৯৬৯। তারপর? দুই বন্ধু দুই পথে!
চুনী তখন বাংলার হয়ে খেলে চলেছেন রঞ্জি ট্রফি। এরই মধ্যে খেলা হয়ে গেছে পূর্বাঞ্চলের হয়ে। পূর্বাঞ্চল এবং মধ্যাঞ্চলের মিলিত একাদশের হয়ে ১৯৬৬তে বিশ্বের এক নম্বর দল ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে নিয়েছেন পাঁচ উইকেট এবং লোয়ার মিডল অর্ডারে গুরুত্বপূর্ণ যোগদান দিয়েছেন, ওয়েস্ট ইন্ডিজ ইনিংসে হারে সেই ম্যাচ। চুনী গোস্বামী ম্যাচে পান আট উইকেট। ফুটবলার হিসাবে তাঁর ফিটনেস ছিল অনবদ্য। মিডিয়াম পেসে ইনস্যুইং বোলিং-এর সঙ্গে লোয়ার মিডল অর্ডারে ব্যাটও করতেন। ১৯৬৮-৬৯এর ফাইনালে বাংলার হয়ে বোম্বের বিরুদ্ধে ৯৬ ও ৮৪ রানও করেন। ফাইনাল যদিও বাংলা হেরে যায়। তারপর ১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ তিনি বাংলার অধিনায়কত্বও করেছেন। শেষ বারে আবার ফাইনালে হারেন তাঁর অধিনায়কত্বেই।
তবু একটা গল্প বলতেই হয় ক্রিকেটের। সুভাষ গুপ্তে, ভারতের সর্বকালের অন্যতম সেরা লেগস্পিনার তখন খেলেন কালীঘাট ক্লাবের হয়ে। চুনী মিলন সমিতির হয়ে। সুভাষ গুপ্তে ফুলহাতা শার্ট পরে বল করতেন, ফলে গুগলির হাত উল্টোলে বোঝা যেত না। বন্ধু শঙ্কর ব্যানার্জী পরামর্শ দেন, ‘গুপ্তেকে বুঝতে যাবি না। উইকেট গার্ড করে বলের লাইনে পা নিয়ে গিয়ে চালিয়ে দিবি ব্যাট। ব্যাটে বলে হলে আর কে দেখে!’ চুনী নামলেন, আর অক্ষরে অক্ষরে মেনে খেলতে শুরু করলেন, বল একটু ফ্লাইটেড হলে ব্যাট চালিয়ে দিচ্ছেন আর অফ স্টাম্পের বাইরে পা নিয়ে বল সামলে যাচ্ছেন, তখন চুনী কলেজ পড়েন, বাচ্চা ছেলে। একটা বাচ্চা ছেলেকে আউট না করতে পেরে গুপ্তে নাকি ভয়ানক রেগেই যান। তারপর বেশ কিছুবছর কথা বলেননি। পরে ১৯৬০এর রোম অলিম্পিক থেকে ফিরলে, সুভাষ গুপ্তে বোম্বেতে নিজে এসে দেখা করেন চুনী গোস্বামীর সঙ্গে এবং লাঞ্চে নিয়ে যান।
এবারে আসি পিকের কথায়। পিকে ফুটবল অন্তপ্রাণ। ১৯৬৯তে কোচিং করার পর ডাক পেলেন এশিয়ান গেমসের ম্যানেজার হিসাবে। কোচ তখন বাসা। কিন্তু বকলমে কোচিং করছেন পিকেই। টিমে তখন নইমুদ্দিন, সুধীর কর্মকার, সুভাষ ভৌমিক, সুরজিত সেনগুপ্ত, শ্যাম থাপা, আব্দুল লতিফ, চন্দ্রেশ্বর প্রসাদ, মহম্মদ হাবিব। কোয়ার্টার ফাইনাল গ্রুপে জাপানের কাছে হেরেও সেমি ফাইনালে বার্মার মুখোমুখি নইমরা। প্রথম একাদশের সুভাষ ভৌমিক সুরজিত এবং শ্যাম তখন সদ্য সদ্য কলকাতা লিগ খেলে এসেছেন, ক্লান্ত। সেমি ফাইনালে বিশ্রাম চাইলেন, পিকের সঙ্গে কথা না বলে বাসা দিয়েও দিলেন। বার্মার বিরুদ্ধে দু গোলে হেরে সোনার পদক হারাল ভারত, আর তারপর তেড়েফুঁড়ে খেলে অমর বাহাদুরের গোলে জাপানকে হারিয়ে ব্রোঞ্জ, ভারতের শেষ এশিয়ান গেমস ফুটবলে মেডেল।
তারপর? তারপর একটা সুযোগ এসেছিল, ১৯৮২তে। গোলে ভাস্কর গাঙ্গুলী, ব্রহ্মানন্দ, ডিফেন্সে কম্পটন দত্ত, মনোরঞ্জন ভট্টাচার্য, সুদীপ চ্যাটার্জী, অলোক মুখার্জী, পারমার, মাঝমাঠে ভাই প্রসূন ব্যানার্জী, প্রশান্ত ব্যানার্জী, পারমিন্দার সিং, সামনে বিদেশ বসু, সাবির আলি, কার্তিক শেঠ, সি বি থাপা, বিশ্বজিত ভট্টাচার্য। কিন্তু গেমস শুরুর আগেই কলকাতার বড় দোলেগুলির সঙ্গে সমস্যা তৈরি হল। তারা ক্যাম্পের জন্য প্লেয়ার ছাড়ল না। শেষে যখন এল তখন তারাও ক্লান্ত। ক্লাব বনাম দেশের লড়াইয়ে এশিয়ান গেমসের স্বপ্ন বলিপ্রদত্ত হল। কোয়ার্টার ফাইনাল সৌদি আরবের বিরুদ্ধে, সুদীপ আর কম্পটন পারছেন না। তাঁদের তুলে নেওয়া হল পিকের সঙ্গে আলোচনা না করেই। টেকনিকাল ডিরেক্টর ডেটমার ফিফার এবং কোচিং স্টাফে নামকরা অরুণ ঘোষ, বাসা, হাকিম, আব্দুল লতিফ। শেষ মূহুর্তের গোলে স্বপ্ন ভঙ্গ হল।
কিন্তু কোচ পিকে ব্যানার্জীর তো শুধুমাত্র দেশের হয়ে কোচিং-এ নামডাক নয়! ইস্টবেঙ্গলের স্বর্ণযুগ ১৯৭১-১৯৭৫এ কোচ তিনিই, আবার মোহন বাগানের ৭৬-৭৮ তিনবছরের সোনার সময়েও তিনি কোচ। নামডাক অবশ্যই ম্যানম্যানেজমেন্টের জন্য। কিন্তু গেম রিডিং ও ট্যাক্টিক্সের কথা ভাবলে হয়তো পিকের মতো আর একজনও ছিলেন কি না সন্দেহ। কার থেকে কীভাবে সেরাটা বার করতে হবে সেটা জানতেন। ৭২এ যখন সুভাষ ভৌমিক মোহন বাগান ছেড়ে ইস্টবেঙ্গলে, তখন অতিরিক্ত মদ্যপানের জন্য ওজন বেড়েছে। নিজের বাড়িতে নিয়ে এসে নিয়মিত শরীর চর্চা করিয়ে করিয়ে ক্ষুরধার ফরোয়ার্ড লাইনের জন্ম দিলেন, সুরজিত শ্যাম থাপা আর সুভাষ ভৌমিক। দুর্জনেরা বলেন যে পিকে নাকি রেফারি ম্যানেজ করতেন অথবা খেলোয়াড়দের ডোপ করাতেন। বয়োজ্যেষ্ঠ হলেও অমল দত্তের সঙ্গে রেষারেষি চরমে উঠেছিল। অভিযোগগুলি অমল দত্তই করেছেন। লিমকার সঙ্গে অ্যাসপিরিন মিশিয়ে ডোপিং করানো বা অন্য কিছু।
৭৬এ আকবর যে সতেরো সেকেন্ডের গোলে প্রায় পাঁচ বছর পরে কলকাতা ময়দানে ইস্টবেঙ্গলকে হারালো মোহনবাগান, সেটাও তো একপ্রকার সেটপিসই। হাবিব থ্রু বাড়ালেন বাঁ দিকে উলগানাথনকে সেন্টার থেকেই। সুধীর কর্মকার ধরে নিয়েছিলেন যে বল বেরিয়ে যাবে, কিন্তু কাদা মাঠে বল আটকে গেল, আকবর একেবারে ফাঁকায় অপেক্ষায় ছিলেন, ভাস্করকে হারাতে সময় লাগেনি। কিন্তু তারপর সারা ম্যাচ ছিঁড়ে খেল ইস্টবেঙ্গল। প্রদীপ চৌধুরী তো প্রায় ফেলেই দিয়েছিলেন শ্যাম থাপাকে পেনাল্টি বক্সে, রেফারি পেনাল্টি দিলেন না। ম্যাচ জিতল মোহনবাগান। এই প্রদীপ চৌধুরীকে জামশেদপুর টাটা দল থেকে এনেছিলেন মোহনবাগানে প্রদীপ ব্যানার্জীই। পরিষ্কার ফুটবল খেলতেন, পরিষ্কার ট্যাকল আর সব থেকে বড় কথা। গত পাঁচ বছর ধরে বারবার হারার ব্যাগেজ ছিল না তাঁর।
এই প্রদীপ চৌধুরীই একটা গল্প বলেন। প্র্যাকটিসে একবার পিকে বারে বল মেরে প্রদীপ চৌধুরীকে বলেন, ‘দেখলি?’ প্রদীপ চৌধুরী বললেন, ‘ফ্লুক’। পিকে আবার বারে মারলেন, আবার বললেন প্রদীপ চৌধুরী, ‘ফ্লুক’। তকন বলে বলে বাঁ পায়ে শট মেরে বারে মেরে প্রদীপ চৌধুরীকে বললেন প্রদীপ ব্যানার্জী, ‘বাবাকে জিজ্ঞাসা করিস ব্যাটা, প্রদীপ ব্যানার্জী কী জিনিস!’
৭৭এর কসমস যখন এলো, তখন পেলে আটকাবার রাস্তা বার করলেন পিকেই। গৌতম সরকারকে পুলিশ ম্যান লাগিয়ে দিলেন, বল ধরলে ফার্স্ট ট্যাকলে যেতে বললেন। শিবাজীকে পেলের ফ্রিকিক বাঁচাবার রাস্তাও শেখালেন।
এসব অনেক অনেক অনেক গল্প কথা রয়ে গেছে পিকের সম্পর্কে। সাঙ্ঘাতিক মিশুকে লোক ছিলেন। মারদেকায় পাকিস্তানি খেলোয়াড়রা নৈশভোজে গজল গেয়ে কামাল করে দিলেন, তো পিকেও কম যাবার পাত্র নন, ‘সব ফুটবলারদের নিয়ে ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ গেয়ে মাত করে দিলেন।
পিকে ব্যানার্জী ভারতের সর্বকালের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং সর্বাধিক সফল ক্লাব কোচ। তাঁর সাফল্যের একটা গল্প দিয়ে শেষ করি।
মোহনবাগানে সেবার দুর্দান্ত টিম, গোলে হেমন্ত ডোরা, ডিফেন্সে অলোক দাস, রঞ্জন দে, দেবজিত ঘোষ, মাঝমাঠে সত্যজিৎ চ্যাটার্জী, বাসুদেব মণ্ডল, অমিত দাস, লোলেন্দ্র সিং আর সামনে চিমা ওকোরি, আব্দুল খালেক। তার উপর কোচ অমল দত্ত ডায়মন্ড সিস্টেমের ফুল ফোটাচ্ছেন। সেই ডায়মন্ড সিস্টেম যা আশির শেষের দিকে বার্সিলোনায় আমদানি করেন যোহান ক্রুয়েফ। উৎসাহে টগবগ করছে জনতা। মাঠ ভর্তি লোক হচ্ছে। ইস্টবেঙ্গলের কোচ পিকে। হাতে কেবল বাইচুং ভুটিয়ার মতো স্ট্রাইকার আর স্যামি ওমেলোর মতো ডিফেন্ডার। অমল দত্ত আবার ফুটছেন, সেমি ফাইনালের আগে সংবাদ সম্মেলনে বলে বসলেন বাইচুংকে ‘চুংচুং’, ‘ওমলেট’ ওমেলোকে। পিকে কিছু বললেন না। শুধু একটু ধীরগতির দুই সাইড ব্যাক ফাল্গুনী দত্ত ও ইলিয়াস পাশার জায়গায় খেলালেন দ্রুত গতির দুলাল বিশ্বাস এবং অমিতাভ চন্দকে। বাসুদেব, সত্যজিতের উইং দিয়ে দৌড় বন্ধ করলেন। বাইচুংকে বক্স স্ট্রাইকার হিসাবে না খেলিয়ে ডানদিকে সরিয়ে রাখলেন। আর বক্সে ডিফেন্ডারদের বিরক্ত করার জন্য রাখলেন, নাজিমুল হকের মতো অখ্যাতকে। খেলা শুরুর পরেপরেই ধরতে পারলেন না ছকভাঙার বিরোধী অমল দত্ত। খেলা ধরে নিল ইস্টবেঙ্গল ২৫ মিনিটে নাজিমুলের গোলে। দ্বিতীয়ার্ধের খেলা শুরু হতে না হতেই ২-০, বাইচুং। মোহনবাগান এবার চেপে ধরে ৬৬ মিনিটে চিমার গোলে ২-১ করলেও প্রতিআক্রমণে ছিঁড়ে ফেললেন পিকে। বাইচুং হ্যাট্রিক, ইস্টবেঙ্গল ৪-১। না শিল্ডটা পাওয়া হয়নি ইস্টবেঙ্গলের। ব্রুণো কুটিনহোর সালগাঁওকর নিয়ে যায় ট্রফি। কিন্তু ডায়মন্ড সিস্টেমকে হারানোর জন্য পিকেকে ভারতীয় ফুটবলের ইতিহাস মনে রেখে দেবে ডায়মন্ড কাটার হিসাবে।
পিকে ব্যানার্জীর সঙ্গে একবারই মুলাকাত হয়েছিল। ১৯৯৪ একটা অনুর্ধ ১৬ টুর্ণামেন্ট করছিল ইস্ট ক্যালকাটা ডিসট্রিক্ট স্পোর্টস কাউন্সিল। আমাদের ক্লাব, আমরা ভলান্টিয়ার। খেলা হচ্ছিল সল্টলেক স্টেডিয়ামে। বাইরে থেকে দল এসেছিল রমাকান্ত আচরেকরের কোচিং সেন্টার, মাদ্রাজের একটা কোচিং সেন্টার। তা সেই উপলক্ষেয় ফাইনালের আগে একটা নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন তদানীন্তন ক্রীড়ামন্ত্রী সুভাষ চক্রবর্তী। সেই নৈশভোজ মাতিয়ে দিয়েছিলেন পিকে, ক্রিকেটের লোক না হয়েও।
আর চুনী, চুনী তো টেনিসও খেলেছেন, হকিতে বেটন কাপ। তাঁর সঙ্গে দেখা হয় দু’বার। দিল্লির বেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন আয়োজন করে একটি আলোচনা চক্রের, ‘বাঙালির কাল আজ ও কাল’। অনীতা অগ্নিহোত্রী, রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়, জহর সরকার প্রমুখের মধ্যে খেলা নিয়ে বলতে এসেছিলেন ভারতীয় ফুটবলের সর্বকের সেরা মেগাস্টার। সেবার খুব সুন্দর বলেন। আর তারপরের বছর ২০১৮ বিশ্বকাপ ফুটবল চলাকালীন সুব্রত ভট্টাচার্যের সঙ্গে এসেছিলেন দিল্লিতে কোনও সংবাদ চ্যানেলে। ফিরে যাবার সময় বিমানবন্দরে দেখা হয়। আগের বারের থেকে কেন জানি না খারাপ লাগছিল দেখতে, চোখ ঘোলাটে হয়েছে।
পিকে, চুনী উভয়েই আশি পেরিয়ে গিয়েছিলেন। কোনও একটা সময় তো থামতেই হয়। থেমেও গেলেন, দেড় বছরের বড় পিকে দেড় মাস আগে চলে গেলেন আর দেড় মাস পরে চুনীও। একা একা কি টাচলাইন বরাবর দৌড়নো যায়? পাস বাড়াবে কে? অমল দত্তও আগেই গেছেন। ভারতীয় ফুটবলের স্বর্ণযুগের প্রতিনিধিরা একে একে সন্ধ্যা প্রদীপ নিবিয়ে উত্তর আকাশে চলে যাচ্ছেন। এখন আর কেই বা রহিম সাহেবের গল্প বলবে আর কেই বা বলবেন, ‘চচ্চড়ির মশলা দিয়ে কি আর বিরিয়ানি রান্না করা যায়?’
পিকে আর চুনী ছিলেন এক অদ্ভুত তারা ভরা আকাশের সাক্ষী চলেও গেলেন তারা খসা সময়ে নিজের দাগ মুছে দিয়ে। স্বর্ণযুগের দুই সেরা ঘোড় সওয়ার যাদের কাঁধে চেপে ভারতীয় ফুটবল সোনার ঊষা দেখেছিল। গোধূলিতে মিশে গেলেন পিকে ব্যানার্জী এবং চুনী গোস্বামী। ভারত তথা বাংলার ফুটবলের কিংবদন্তী, উজ্জ্বল মিনারদ্বয়।
অসাধারণ লেখা। কত স্মৃতি। কত ভালোলাগা। মন ছুঁয়ে গেল। ফেসবুকে শেয়ার করলাম।
চমৎকার লেখা। বেশ লাগল। দেশপ্রিয় পার্কে চুনীকে আউট না করতে পেরে গুপ্তে নাকি রেগে গিয়ে দর্শকদের সঙ্গে ঝামেলা শুরু করেছিলেন।
পিকে আর চুনীর প্রসঙ্গে বার বার সেই সময়ের মধ্যবিত্ত যাপনের কথা মনে হয়। খুব যদি ভুল না করি, ব্যাঙ্ককে খেলতে গিয়ে ওঁদের ক্যাথে প্যাসিফিক হোটেলে রেখেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট। জবরদস্ত হোটেল, বিরাট ব্যাপার! পিকে আর চুনী এক ঘরেই ছিলেন। ঘরে ঢুকে অনেকক্ষণ সব আসবাবপত্র খুঁটিয়ে দেখেছিলেন ওঁরা, কোন সুইচ টিপলে কী হয়, কোনটা কেমন ভাবে ব্য বহার করতে হয়, বুঝতে সময় লেগেছিল অনেক।
অসাধারণ লেখা.. পুরোনো দিনের কত স্মৃতি.. ফুটবল ছাড়া বাঙালি ভাবা যায়? চ
পাগলা হয়েছে। আরও হোক।
খুব ভালো লাগল।
ভালো লেগেছে। তবে ১৭ সেকেন্ডের গোলের ঘটনাটায় কিছু তথ্যগত ভুল আছে সেটা ঠিক করে নেবেন।