কী অসহ্য লাগে আজকাল সন্দীপনের লেখা । অথচ আগে আগে কী সমৃদ্ধ-ই না মনে হত! আসলে, মনে হয়, প্রতিদিনের বিরিয়ানীও তার জয়িত্রীর গন্ধে বমি আনে। যে লোকটা একখানা 'মীরাবাঈ' বা একখানা কুকুর সম্বন্ধে দুটো একটা কথা' লিখেই পা দুলিয়ে দুলিয়ে হাসতে পারত অমরত্বের ল্যা ল্যা লেজ নাড়ানো দেখে তার পায়ের কাছে, সময় আধুনিকতা সচেতনতা স্মার্টনেস এসব ফালতু ক্লিশের চাপে তাকে হয়ে যেতে হল রিপিটেটিভ । ক্রমাগত, ক্লান্তিহীন এক-ই কথা ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলতে থাকল, প্রথম চমকের ঘোর কাটিয়ে চল্লিশ বছরের ব্যবহারে ব্যবহারে যা তদ্দিনে বিরক্তিকর ।
বলা যেতেই পারে, সন্দীপন সবসময়েই কী লিখছেন তার থেকে কেমনভাবে লিখছেন সেটা বেশি ইম্পর্টান্ট । তাহলে এক-ই রকমভাবে, এক-ই প্রেক্ষিতে, এক-ই স্টাইলের পুনরাবৃত্তি কেন বাবা? এটা তারাই করে যার কিছু বলার নেই । উদাহরণ চাই? এক সাঁওতাল আদিবাসী, যে কুয়ো খোঁড়ার জন্য রাত্রিদিন পরিশ্রমের পর শাবলের ঠং শব্দে আবিষ্কার করে আসলে এতদিন নিরবচ্ছিন্ন ঘাম ঝরিয়ে সে পৌঁছেছে এক অনুর্বর পাহাড় চুড়ায়, আর তারপর নিজের গরু অরে গেলে তাকে সেই গর্তে ফেলে দেয়, এমন উল্টো সিসিফাস কাহিনি সন্দীপনের তিনখানা উপন্যাসে এসেছে । এক-ই রকমভাবে । 'কোলাজ' আর 'এখন জীবন অনেক বেশী সতেজ স্বাস্থ্যে ভরা'-তে তো মনে হয় কপি পেস্ট হয়েছে এই গল্প, শুধু নাম পালটে । অন্যরকমভাবে বলা? বারবার এক-ই আখ্যানের বিভিন্ন দিক থেকে আলো ফেলে অভূত্পূর্ব ঝলক আবিষ্কার? হাঃ, সেসব পুরনো সন্দীপনের ক্রীতদাস ক্রীতদাসী, যখন বোন আত্মহত্যা করার পর তার ফাঁকা ঘরে প্রেমিকার সাথে সময় কাটানোর সুযোগের কথায় ধাঁ হয়ে যেতে হয় । কী লেখা রে ভাই! কাঁউ কাঁউ বিলাপ নেই, প্রেম নেই, এমনকি আখ্যান-ও নেই, আছে শুধু ঝকমকে রাজপুত্রের তরবারী, দ্বিধাহীন, নিষ্কলঙ্ক। সন্দীপন আমাদের কাটে, সেই ভাষা প্রথম মাস্টারবেশনের মতই অসহ্য নিষ্পাপ, তপতপে খাপখোলা। আর সেই লেখক, শুধু সময়, আধুনিকতা এসব মধ্যবিত্ত কেরানীর চাপে পড়ে রিপিটেটিভ হয়ে গেল? এ কি বাজারের সাথে গা না ভাসানোর উল্টো চাপ? মধ্যবিত্ত পুরুষের সাথে প্রায় অচেনা একটি মেয়ের অসমবয়েসী শারিরীক সম্পর্ক সন্দীপনের কতগুলো উপন্যাসে এসেছে? আমার ধারণায় প্রায় ৮০% । 'রুবি কখন আসবে'-তে যা তুংগ স্মার্ট, 'কোলাজ'-এর মত লেখায় তা-ই হাস্যকর ভ্যাদভ্যাদে, যেখানে মেয়েটির মস্তান বয়ফ্রেন্ডের হুমকিতে লোকটি আত্মহত্যা করে । 'রিক্তের যাত্রায় জাগো' তুলনামূলকভাবে অনেক স্মার্ট। প্রেমিকার গর্ভজাত সন্তানকে দেখতে গিয়ে ট্রেনে বাঁ পা হারানোর বর্ণণা তো ঝলসানো। কিন্তু ওই পর্যন্ত-ই, বাকিটা ম্যাদামারা । তদ্দিনে সন্দীপন শুকিয়ে এসেছেন, মাঝে মাঝে বালির স্তুপ ফুঁড়ে অপাপবিদ্ধ জলধারা ভলকে উঠছে বটে, কিন্তু আসলে তা বালির মধ্যে টুকরো টাকরা জল, জলের মধ্যে টুকরো টাকরা বালি নয় ।
সেক্স নিয়ে লেখা? তিলোত্তমা সন্দীপনের থেকে বেশি সেক্স নিয়ে লিখেছে। তো? আর সবেতেই এক হাস্যকর রকমের অজুহাত রেখেছেন সন্দীপন, মানে সব গল্পেই । স্ত্রী বিয়ের আগে শর্ত দিয়েছিল আমরা দুজনে দুজনকে ভালবাসব না-যদিও অস্তিত্ব খুঁড়ে খুঁড়ে দেখানো, কেন এ শর্ত, প্রতিটা প্রশ্ন প্রতিটা উত্তর কাটাছেঁড়া করে দপদপে সার্চলাইটের নিচে মানুষ মানুষীকে উলঙ্গ করে দেওয়া, অসহ্য সে অ্যানালিটিকাল কলম সন্দীপনের নয়, যার তৈরী অজুহাত তো আছেই, যে বিশ্লেষনধর্মী লেখা নয়, সন্দীপন আসলে ফর্ম লেখেন। আর, 'স্বর্গের নির্জন উপকূলে ' টাইপ খাজা উপন্যাসে যদি প্রশ্ন করা হয় যে বাপু, এই ফর্ম সর্বস্বতা ভেংগে দিয়ে ও হেনরী উঁকি মারছে কেন, বা শরদিন্দুর 'রক্ত-সন্ধ্যা' কে পাশাপাশি রেখে এক উলট-পুরাণ নির্মানের প্রচেষ্টা কি আসলে এক পালটা আখ্যানের সম্ভাবনা এনে দেয়, তার উত্তরে হয়ত এই যুক্তি আসবে যে ফর্ম কনটেন্ট হয়ে যাচ্ছে এন্ড ভাইসি ভার্সা। মোদ্দা কথা, এই যুক্তি নতুন নয় এবং অতি-ব্যবহারে ক্লিশে । সুবিমল মিশ্র-ও এই জিনিস করতে গিয়ে ডুবেই জাচ্ছেন, ডুবেই-'কন্ঠ পালক ওড়া সবকিছুই বা'-র পর কতগুলো মনে রাখার মতন লেখা লিখেছেন সেটাও একটা প্রশ্ন বটে। সে যাক- তো, সেই অপ্রেমের ফাঁক দিয়ে ঢুকে আসছে অন্য নারী। যার সাথে তীব্র রিরংসাময় সম্পর্ক আবার ভেংগেও যাচ্ছে । এই জিনিস বারবার আমাদের ক্লান্ত করে, ক্লান্ত, ক্লান্ত করে । সেই মেয়েটি অবধারিতভাবেই সব উপন্যাসেই বলবে 'আমি তোমার ক্রীতদাসী, আমায় নিয়ে যা খুশী তাই করো' । অবধারিতভাবেই তার সাথে প্রেম করতে হবে কফিশপ, ফাঁকা রেস্টরা বা কবরখানায়। আর অনিবার্যভাবেই সবকিছু ছাপিয়ে উঁকি দেবে একটা ঘর পাওয়ার সমস্যা। এই মধ্যবিত্ত আখ্যানের বাইরে সন্দীপন-ও বেরননি, কোনোদিন। বড়জোর কয়েকবার বেশ্যাপল্লী। কৃত্তিবাসী মধ্যবিত্ত চৈতন্য, যা বৌয়ের সিঁদুরে রক্ত প্রত্যক্ষ করে, সেই ষাট সত্তর পেরিয়ে আমরা এগিয়ে এসেছি অনেক, অনেক র্পথ। স্মার্ট লেখা? কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু তার মধ্যে সেক্সকে কাটাছেঁড়া করার সাহসের প্রসংগ না টানাই ভাল।
মধ্যবিত্তের যৌনতাও যদি ধরা যায়, তা নব্বই-য়ের লেখাগুলোতেও হয়ে গেছে সত্তরের মধ্যবিত্তের যৌনতা। ওই যে, পরকীয়ার নানা স্তর, নানা দিকের আলো, এসব না দেখে সন্দীপন শুধু আলো ফেলে গেছেন এক দিকেই, সারাজীবন, এক-ই রকমভাবে। এর সাথে সমরেশ বসু জাতীয় লেখকদের (শেষ জীবনের সমরেশের কথা বলছি আর কি) দুরত্ব খুব বেশি না। সমরেশের 'জন্মান্তরের জগত' পড়ে দেখুন। আনস্মার্ট ভিজে বেড়ালের মতন ভাষাকে রৌদ্রে শুকিয়ে টানটান করে নিলে সন্দীপন হয়ে যাবে। তফাতটা কথা বলার ধরণে। নতুন কোনো চেতনার দ্বীপ আবিষ্কারে নয়। মুশকিলটা হল, থীম যদি ফালতু হয়, শানিত ফর্ম তাকে বেশিদিন বাঁচাতে পারে না। 'রুবি কখন আসবে' বেরিয়ে গেছে চুড়ান্ত ঝটকালাগা থীম+ খাপখোলা ফর্ম। কলেরার দিনগুলিতে প্রেম'- শেষ চিঠিটা বাদ দিয়ে। আমার ধারণা ওটা সন্দীপন লেখেন নি। কোনো নারীবাদী মহিলাকে খুশি করার জন্য তাঁকে শেষ চিঠিটা লেখার অনুমতি দিয়েছিলেন, সন্দীপনের বকলমে-বা 'কুকুর সম্বন্ধে'-তেও তাই। 'রিক্তের যাত্রায় জাগো' ফর্ম-রিপিটেটিভ থীম। 'আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি' বা 'কোলাজ' ক্লান্তিকর, কারণ রিপিটেটিভ, ফর্ম- মাথামুন্ডুহীন কন্টেন্ট। 'আমি ও বনবিহারী' সম্বন্ধে যত কম বলা যায় তত-ই ভাল । একমাত্র সেক্সুয়াল অ্যাংগেল অন্যরকমভাবে এসেছিল কিছুটা 'জংগলের দিনরাত্রি'তে, যেখানে খাবার দেবার বিনিময়ে আদিবাসী রমণী খিদেয় মরতে বসা শহুরে পুরুষটির সংগে যৌনসম্পর্ক করে, আমাদের মধ্যবিত্ত জগতের অহরহ ঘটে চলা যৌন-এক্সপ্লয়টেশনের ছবিটা উল্টে দেন সন্দীপন, যদিও এই ধারণাও নতুন কিছু নয়। সুবিমল মিশ্র 'সত্য উৎপাদিত হয়'-তে এক-ই জিনিস দেখিয়েছেন, বা আরো আগের উদয়ন ঘোষ।
আসলে, নিজের জীবনের বাইরে একটা লাইন-ও না লেখার সমস্যা এটাই। এক সময়ে ক্লান্তিকর পুনরাবৃত্তির আবর্তে বাঁধা পড়তে হয়। সেটাকে তখন চালাতে হয় ফর্ম নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার নামে। নাহলে 'রুবি কখন আসবে' লেখার পরে 'এখন আমার কোনো অসুখ নেই' লেখার কোনো মানে হয়না। পাড়ার বেকার ছেলের সাথে কিশোরী কন্যার পালিয়ে যাবার কাহিনি 'কুকুর সম্বন্ধে'তে লিখে দেবার পর 'রিক্তের যাত্রায় জাগো'তে লেখার দরকার পড়ে না। তাও এক-ই রকম ভংগীতে। 'স্বর্গের নির্জন উপকুলে' উপন্যাসটাই অদরকারী হয়ে পড়ে। আবার 'কুকুর সম্বন্ধে' আর 'আমি আরব গেরিলাদের সমর্থন করি' লেখার পর 'ভারতবর্ষ' লেখার কোনো দরকার পড়ে না। যদিও বুট পরা শ্রীরামচন্দ্রের পদধ্বনি নিয়ে না লিখলে সমাজ সচেতন হওয়া যাবে না, বা ব্যর্থ বিপ্লব নিয়ে না লিখলে, এরকম ভাবনা অপরাহ্নের সন্দীপনকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছিল কিনা জানি না। 'হিরোশিমা মাই লাভ'কে অনেকে সন্দীপনের শ্রেষ্ঠ উপন্যাস বলে, কেন জানা নেই। সেটা কি এই কারণে যে একমাত্র এই উপন্যাসেই রাজকুমারের তরবারী নামিয়ে রেখে চলিত জং ধরা সাহিত্যভাষার অনেক কাছাকাছি এসেছিলেন, যাতে মানুষ আইডেন্টিফাই করতে পারে সহজে? আর, এই সম্ভাবনার কথা মাথায় আসলে সন্দীপন নিজেই হয়ত মাথায় কালির দোয়াত ঠুকে আত্মহত্যা করতেন।
আসলে কষ্ট হয়। খুব কষ্ট হয়। অপাপবিদ্ধ রাজপুত্রকে গোধুলির মলিন বেশ্যাপল্লিতে আবিষ্কারের কষ্ট। 'বিজনের রক্তমাংসের' লেখককে 'আমি ও বনবিহারী'তে দেখার কষ্ট। সন্দীপন-ও তাহলে ভয় পান! সারাজীবনে একটা বা দুখানা বই লিখে ইররিলেভান্ট হয়ে যাওয়ার ভয়! আপডেটেড না থাকার ভয়! সমসাময়িক না থাকার ভয়। ঠিকমত অপ্রাতিষ্ঠানিক না হতে পারার ভয়। অনন্য রায়ের পরিণতি যেহেতু নেই, তাই জল ঘুলিয়ে যেতেই হয়। যেতেই হয়। এত কিছুর পরেই বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ দশজন গদ্যলেখকের মধ্যে থেকে যাবেন সন্দীপন। কিন্তু তার জন্য প্রথম দশ বছর-ই যথেষ্ট ছিল। তা সত্বেও আমরা পড়ে যাব, 'ভারতবর্ষ' পড়ে আহ্লাদে গড়াগড়ি দেব। 'কলকাতা তুমি কার' পড়ে বলব উত্তর নব্বই এমন লেখা আর আসেনিকো! বিজনের রক্তমাংসের সুদে বেড়ে উঠবে তাঁর মিনিবুকের বহর। কন্টেন্ট যা-ই থাক, আমরা বলব, শুধু ফর্মের জোরে ঘাড় মুচড়ে সন্দীপন আখ্যানকে নতজানু করে দেন, বলব, উট শুকনো কুয়ো থেকেও জলপান করে। আর ভুলে যাব, উট সবসময় জলপান করতে বাধ্য নয়।