‘রামচরিত্র মানস-সরোবরের মত বিশাল। এর মধ্যে রামকথারূপ হাঁস ঘুরে বেড়ায়’। -সতীনাথ ভাদুড়ি
গল্পটা অনেকের-ই জানা নেই। বিশেষ করে শেষটায় কি ঘটেছিল। লঙ্কায় শ্রীরামচন্দ্রের জয় ছিল নিশ্চিত। একে হনুমান জাতির পপুলার সাপোর্ট তাঁর দিকে, তার ওপর আর্য সাম্রাজ্যে রাক্ষসদের দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মতন অস্তিত্ব-ও গলার কাঁটা হয়ে উঠেছিল দিনকে দিন। শেষকালটায় আর্য সমাজের প্রধান পুরুষদের অনুরোধে রামচন্দ্রকেই প্রতিনিধিত্বের কঠিন দায়িত্বটা নিতে হয়েছিল। সাম্রাজ্যরক্ষার নিয়ম মেনেই, মূল লক্ষ্যটা ছিল রাক্ষসদের একটু সবক শেখানো, যাতে তারা বোঝে যে এই সাম্রাজ্যে থাকতে গেলে রাবণের প্রতি সমস্ত আনুগত্য বিসর্জন দিয়ে আর্যদের পায়ের তলায় থাকাটাই নিয়তি। অন্তত এমনটাই ভেবেছিলেন ঋষি বিশ্বামিত্র বা শতানন্দের মতন আর্যনেতারা। কিন্তু রামচন্দ্রের ভাবনাটা ছিল একটু অন্যরকম।
রামচন্দ্র জানতেন, এবং বুঝতেন, জম্বুদ্বীপে পাকাপাকি সাম্রাজ্য বিস্তার করতে গেলে, পপুলার সাপোর্ট তাঁর দরকার। শুধুমাত্র গায়ের জোরে এই আসমুদ্র-হিমাচল দাবিয়ে রাখা বেশিদিন সম্ভব নয়। আজ লঙ্কা জয়ের দরকার হয়ে পড়েছে কারণ এই অযোধ্যাই হবে তাঁদের আর্য-সাম্রাজ্যের পরীক্ষাগার। কিন্তু দশরথ বা গৌতম মুনির মতন ওটাকেই মূল লক্ষ্য বলে রামচন্দ্র ধরে নেননি। কারণ কেউ জানুক বা না জানুক, এটা ঘটনা যে আর্যত্ব দিয়ে রামচন্দ্রের কিছু এসে যায় না। ওটা ততদিন-ই দরকার, যতদিন ক্ষমতার পক্ষে কাজ করবে। রামচন্দ্র বোঝেন ব্যবসা। ক্ষমতার ব্যবসা। যে বা যা তাঁকে ক্ষমতা এনে দেবে, তিনি তাকেই ব্যবহার করবেন। যেমন, এই মুহূর্তে, অযোধ্যার ক্ষমতায় নিজের গদি সুনিশ্চিত করতে হলে, লঙ্কা অভিযান দরকারি, আর তাই ব্যবহার্য।
তা যুদ্ধটা হয়েছিল সাঙ্ঘাতিক। যুদ্ধ না বলে গণহত্যা বলাই ভাল। সীতাহরণের ধুয়ো তুলে দেওয়ার পরিকল্পনাটা অবশ্য জাম্বুবানের। কারণ মানুষকে এই ধারণাটা দিতে হবে যে যুদ্ধটা শুরু করেছে রাক্ষসেরাই। আর কে না জানে, প্রতিটি ক্রিয়ার-ই সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া থাকে! তার জন্য রামভক্ত জটায়ুকে মরতেই হত। নাহলে কার মৃতদেহ দেখিয়ে যুদ্ধটা শুরু হবে? বাঁদর বাহিনীকে অবশ্য শেষের দিকে সামলাতে ভালই বেগ পেতে হয়েছিল। বস্তি মহল্লা পাড়া জ্বালিয়ে পুড়িয়ে রাক্ষস মেয়েদের ধরে ধরে ধর্ষণ করে তাদের পেট চিরে বাচ্চা বার করে ত্রিশূলের ডগায় ঘোরানোর দৃশ্য দেখে শিউরে উঠেছিল গোটা সিন্ধু অববাহিকা। আর্য-কুলপতিরা চেয়েছিলেন বাঁদরসেনারা যা খুশি করুক, কিন্তু বাইরে যেন প্রচার না হয় বেশি। কিন্তু বাস্তবে তাঁদের কথা শোনা হয়নি। এক বাঁদর নেতা উতসাহের আতিশয্যে প্রকাশ্যে বর্ননা দিয়ে বসলেন কেমনভাবে নিপুণ ত্রিশূলের চাড়ে পেটের নাড়িভুঁড়ি ভ্রূণ বেরিয়ে আসত রাক্ষস মেয়েদের। ওদিকে মহল্লা ঘিরে ধরে পাঁউরুটি সেঁকার মতন করে রাক্ষসদের উনুনে সেদ্ধ করার গল্প-ও ফাঁস হয়ে গেল। দেশজোড়া সমালোচনার ঝড়ে বাধ্য হয়েই বিকাশপুরুষ দশরথকে মিনমিনে গলায় বলতে হল, রামচন্দ্রের উচিত রাজধর্ম পালন করা। রামচন্দ্র সে কথায় তোয়াক্কা করলেন না।
করলেন না, কারণ তিনি জানেন তাঁর অপ্রতিহত উত্থানের এই শুরু। ওসব দশরথ ফশরথকে দুদিনে হাওয়া করে দেবেন তিনি। আর হল-ও তাই। লঙ্কার সাফল্যে দুদিন বাদেই সব ভুলে গিয়ে রামের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করতে শুরু করলেন দশরথ। করলেন, কারণ তিনিও জানতেন, রামকে ছাড়া তাঁর এখন আর চলবে না। কিন্তু দশরথ, এবং অন্যান্যরা ভেবেছিলেন, আর্যত্বের পরীক্ষা যেহেতু সফল, তাই এইবার তাঁদের সবার আত্মসন্তুষ্টির সময় এসেছে। একমাত্র এভাবে ভাবলেন না রামচন্দ্র। কারণ দশরথদের ভাবনার সীমাবদ্ধতাটা তিনি বুঝতেন।
দশরথেরা ভেবেছিলেন, আর্যত্ব প্রতিষ্ঠায় রামকে তাঁরা ব্যবহার করবেন। হল ঠিক তার উল্টোটা। লঙ্কাকে ব্যবহার করে আর্য সমাজের অধীশ্বর হিসেবে উঠে এলেন রাম। কারণ তিনি বোঝেন, মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল। দু’ দশ বছরেই মানুষ সব ভুলে যায়। দশরথেরা ভাবলেন, আর্যত্ব চিরস্থায়ী হবে। রামচন্দ্র জানতেন, ব্যবসা বাদে আর কিচ্ছু চিরস্থায়ী হয়না। তাই এবার, যখন নিজেকে তিনি আর্য-হৃদয়সম্রাট হিসেবে প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন, তাঁর দরকার সারা সিন্ধু অববাহিকার হৃদয়সম্রাট হবার। আর তার জন্যে, তাঁকে সুশাসন দিতে হবে। যখন দরকার ছিল, রাক্ষসদের মেরেছেন। এখন দরকার ফুরিয়েছে, একটা রাক্ষসের গায়েও হাত পড়বে না আর।
উন্নয়নের বন্যা বয়ে গেল অযোধ্যা দিয়ে। নতুন শিল্প, ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, আকাশচুম্বী অট্টালিকায় সোনার শহর হয়ে উঠল অযোধ্যা। রাম জানতেন, সারা দেশের নেতা হবার জন্যে সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন তাঁর দরকার। উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্তদের তিনি খুশি রাখলেন কর্মসংস্থান, শিল্প আর শাইনিং অযোধ্যার স্বপ্নে। কারণ এরা অকারণে আর্যত্ব নিয়ে মাথা ঘামাতে চায় না যদি না সেটা ব্যবসার পক্ষে সহায়ক হয়। রাম তাঁদের সামনে নিজেকে খাড়া করলেন এক সৎ, সফল প্রশাসক হিসেবে, যিনি উন্নয়ন আর সুশাসনের খাতিরে নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত ত্যাগ করে ব্রহ্মচারীর জীবন কাটাতে পিছপা হন না। আর দিন আনা দিন খাওয়া গরীব মানুষ, যাদের আধখাওয়া পেট দিনের শেষে আরেকটু বেশি বেশি করে খালি হয়ে যাচ্ছিল, সেই মানুষদের রামচন্দ্র বুঁদ করে রাখলেন আর্যসাম্রাজ্যের স্বপ্নে। তাদের সামনে শত্রু হিসেবে রাক্ষসদের খাড়া করে দিলেন, আর বললেন সমস্ত কর্মসংস্থান কেড়ে নিচ্ছে ওরাই। সেই বিদেশি হানাদারদের বিরুদ্ধে ন্যায্য লড়াইয়ের অধীরথ হিসেবে গরীব মানুষ তাঁকে সমর্থনের জোয়ারে ভাসিয়ে দিল।
জনসমর্থন দৃঢ় করবার লক্ষ্যে এবার গোটা দেশ জুড়ে প্রচারে বেরিয়ে পড়লেন রামচন্দ্র। কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, তাঁর উন্নয়নের বাণীতে, ঝকঝকে শিল্প প্রাসাদ রাজপথ কর্মসংস্থান শোভিত নগরায়নের স্বপ্নে ভেসে গেল গোটা দেশ। উন্মাদের মতন জনসমর্থন আছড়ে পড়ল তাঁর পায়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের যুবসমাজ তাঁকে ঘিরে স্বপ্ন দেখতে শুরু করল। আলোকপ্রাপ্ত নাগরিক সমাজ তাঁকে আখ্যায়িত করল আলোর পথযাত্রী হিসেবে। কেউ কেউ অবশ্য মিনমিন করে বলার চেষ্টা করেছিল ‘কী একটা যেন ঘটেছিল না? সেই যে, লঙ্কায়?’ কিন্তু দেখা গেল, সে সব নিয়ে ভাবতে কেউ-ই আর উৎসাহী নয়। অনেকেই ভুলে গেছে। তার ওপর এই ধারণাটা তো ছিল-ই যে রাক্ষসেরাও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। অপরাধী থেকে সন্ত্রাসবাদী, এদের সিংহভাগ-ই আসে রাক্ষসদের মধ্যে থেকে। সবথেকে বড় কথা, গত কয়েক বছরে রামচন্দ্রের অনুচরদের অক্লান্ত প্রচারটাও কাজ করেছিল, যে, নিরপেক্ষ প্রশাসক হিসেবে সেই যুদ্ধে রামচন্দ্র যেটুকু করার করেছেন। এমনকি সেই যুদ্ধে অনেক বাঁদর সেনাও মরেছে তাঁর সৈন্যদের হাতে। প্রশ্নকর্তাদের এসব তথ্য দিয়ে দাবড়ে চুপ করিয়ে দেওয়া হল।
বিরোধিতা আসেনি তা নয়। বশিষ্ঠ বিশ্বামিত্ররা দেরিতে হলেও বুঝতে পেরেছিলেন তাঁদের আর্যসাম্রাজ্যের লক্ষ্যের থেকে অনেক বড়, অনেক বিপজ্জনক লক্ষ্য রামচন্দ্রের, যা একদিন তাঁদের গিলে খাবে। তাঁরা রাশ ধরার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে রাম তাঁদের নাগালের বাইরে বেরিয়ে গেছেন। বরং রাম এবার অস্ত্র ঘুরিয়ে ধরলেন তাঁদের দিকেই। মুখ বন্ধ করে, বহিষ্কার করে, প্রয়োজনে গুমখুন করেও, আর্য-কুলপতিদের গলা চেপে ধরলেন তিনি। আর আর্যপুরুষরাও বুঝেছিলেন, আর্যত্ব মানে গোটা দেশ এখন রামকেই বোঝে। কেউ রাক্ষস দমনের সফল সেনাপতি হিসেবে তাঁকে পুজো করে, আর কেউ উন্নয়নের কান্ডারী হিসেবে তাঁর গুণমুগ্ধ। বশিষ্ঠরা আশায় আশায় বসে থাকলেন, রামের কাঁধে ভর করে সারা দেশে সাম্রাজ্য বিস্তার হবার পর, প্রয়োজনে রামকে ছেঁটে ফেলা যাবে।
রামচন্দ্র এই ভাবনায় বাধা দিলেন না। শুধু মনে মনে মুচকি হাসলেন। কেউ জানে না, শুধু তিনি জানেন, যে, কোনো তত্ব দিয়েই তাঁর কিছু এসে যায় না। আদর্শ দিয়েও না। অযোধ্যায় রাজপথ বাড়ানোর অজুহাতে রাক্ষসদের উপাসনাগৃহগুলো ভেংগে ফেলার পাশাপাশি আর্যদের মন্দিরগুলোকেও ভেংগে ফেলতে পারতেন না তাহলে। তিনি জানেন, আদর্শ বা টাকাপয়সার ব্যবসা দুদিন থাকে, তারপর মিলিয়ে যায়। কিন্তু ক্ষমতার ব্যবসা, একবার সফলভাবে করতে পারলে, তিনি অমর হয়ে থাকবেন। আর এই সব, এই উন্নয়ন, এই আর্যত্ব, এই শাইনিং অযোধ্যা, এ সব-ই তাঁর সেই তৃতীয় রাইখে চড়ার সিঁড়ি, আর কিছুই নয়। প্রয়োজন ফুরোলে এগুলোকে নির্মমভাবে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হাত কাঁপবেনা তাঁর। যেমন ছুঁড়ে ফেলেছেন বৃদ্ধ অসুস্থ দশরথকে।
সারা ভারতবর্ষ বুটপরা শ্রীরামচন্দ্রের পদধ্বনিতে কেঁপে কেঁপে উঠল।
(লেখাটির সংক্ষিপ্ত রূপ এই সময়ে গুরুচণ্ডা৯ র পাতা ‘প্যাঁচা৯’ তে প্রকাশিত হয়েছিল।)