ধন্যবাদ আপনাদের সবাইকে। পুলিশের হাতে লাঠিটা তো প্রতীকি! সুদীপ্তকে সফলভাবে হত্যা এবং জোশেফ হুসেনকে প্রায় আধমরা (এই লেখা তৈরী করার সময় পর্যন্ত বেঁচে ওঠার সম্ভাবনা খুব-ই কম) করে দেবার জন্যে আপনাদের সকলের সম্মিলিত যুক্তি, আবেগ এবং পরিশ্রমের যে মূল্য, তা কখনো বৃথা যেতে পারে না। আপনারা সফলভাবে একটি রাজনৈতিক হত্যাকান্ডকে নিপুণ তুলির টানে পারফেকশনের শেষ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন। ধন্যবাদ এই কারণে যে আপনাদের এই সকলের সম্মিলিত প্রয়াস না থাকলে আমরা আম-আদমী বুঝতেই পারতাম না এই সোনার গণতন্ত্রে ঠিক কত ধানে কত চাল হয়। তবু এত কিছুর পরেও বিশেষভাবে কয়েকজনকে ধন্যবাদ না জানালে অস্বীকৃতির অভিযোগ উঠতে বাধ্য।
প্রথমেই ধন্যবাদ, পুলিশমন্ত্রী, আপনাকে। শুনেছিলাম লাতিন আমেরিকায় এক একনায়ক নাকি বলতেন শাসকের মেরুদণ্ড তৈরী করার মূল উপাদান হল খুন উপভোগ করা। আপনি হাতে কলমে দেখিয়ে দিলেন যে আপনি, এবং আপনিই, শাসক হবার যোগ্যতম ব্যক্তি। আমরা যারা লজ্জায় কাঁদব ভাবছিলাম, যদি লজ্জা জিনিসটা এখনো থেকে থাকে, মেরুদণ্ডের কথা না হয় বাদই দিলাম, তাদের এই শোকের মুহূর্তে বরাভয় দেবার জন্যে আর কে থাকতে পারে, আপনি ছাড়া? যখন সুদীপ্ত এস এস কে এম-এ মরে যাচ্ছে, আপনি তখন আই পি এল-এ শাহরুখ খানের সংগে উদবোধনী অনুষ্ঠানে ব্যস্ত। বেসরকারি চ্যানেলের কল্যাণে আপনার হাসিমুখ ছড়িয়ে গেছে আসমুদ্র হিমাচল। প্রসন্ন ভংগীতে আপনি তাকিয়ে আছেন সামনের জমকালো স্টেজের দিকে। হয়ত তখন আপনার কানে এসেছে আপনারই পুলিশের লাঠির বাড়ি খেয়ে একটি ছেলের মৃত্যুর খবর। কিন্তু শাসকের অবিচলিত প্রত্যয়ে মুখের একটা মাংসপেশীও কাঁপাননি আপনি। স্বাভাবিক। আপনাকে রাজ্য চালাতে হয়। আর তার জন্যে দরকার ভোট। যখন নন্দীগ্রামে বামফ্রন্টের পুলিশ অমানবিক গুলি চালিয়ে ১৪ জনকে মেরে ফেলেছিল, আপনি ছুটে গিয়েছিলেন, কারণ ওই মৃতদেহগুলো আপনাকে ভোট এনে দেবে। আজ সেই লাশের পাহাড় ডিংগিয়ে বিপুল জনাদেশ পেয়ে আপনি ক্ষমতায় এবং সুদীপ্ত গুপ্ত আপনাকে কোনো বাড়তি ভোট এনে দেবে না। তাই শাসকোচিত ঔদ্ধত্য আপনাকেই সাজে। আমাদের জন্য শাসক হিসেবে আপনি এক্কেবারে আদর্শ। আজ প্রমাণ করে দিলেন। আপনি আজ একদম গন্ডী কেটে দেখিয়ে দিলেন যে এইটুকুই আমাদের নাগরিক অধিকারের সীমানা। এর বাইরেটা জলপুলিশের অধীন। আমরা আন্তরিক আশা রাখি যে এইটুকু সীমানার মধ্যেই আমরা নাগরিক স্বাধীনতা হারানো উদবাস্তুদের দল, নিয়ম মাফিক কুমীরডাংগা খেলে যাব।
কিন্তু আরেকটা কারণেও আপনার ধন্যবাদ প্রাপ্য। হাজারটা মার্ডার যা করতে পারেনি, এমনকি হয়ত নন্দীগ্রাম-ও নয় (যদিও ধারে এবং ভারে তার বীভৎসতা অকল্পনীয়), আপনি আজ একটা মার্ডার করেই তা দেখিয়ে দিলেন। সুদীপ্ত-র মার্ডার তো আসলে সুদীপ্তকে খুন করা নয়। গণতন্ত্রকে খুন করা। সাধারণ আইন অমান্য আন্দোলনেই যদি পুলিশ এরকমভাবে পিটিয়ে মেরে ফেলতে পারে, তাহলে কতখানি বজ্রমুষ্টি হতে পারে আপনার হাত এবং কতটা ব্যাপ্ত হতে পারে আপনার পুলিশ স্টেটের মানসপ্রতিমা, সেটা ভেবেই জাস্ট রোমাঞ্চ হচ্ছে। এমনিতেই গণতন্ত্র জিনিসটা শাসকের পক্ষে যথেষ্ট অস্বস্তিকর। ও জিনিস নেহাত ভারতের মতন দেশে চক্ষুলজ্জার কারণে পাকাপাকি বিসর্জন দেওা যায় না তাই রাখা। কিন্তু তার মধ্যেই আপনি গণতন্ত্রের সীমাটাকে কমাতে কমাতে একেবারে ঘরের চৌকাঠে নিয়ে এসেছেন প্রায়। এরপর হয়ত ঘরের বাইরে পা বাড়ালেই সেটা আইন অমান্য বলে সাব্যস্ত হতে পারে। আবার সেই আপনি-ই আমাদের আই পি এল দেখাচ্ছেন, কলকাতাকে লন্ডন বানাচ্ছেন, দশ লাখ চাকরীর প্রতিশ্রুতি পুরণ করছেন। শাসন করা তার-ই সাজে, সোহাগ করে যে। আবারো বলি, এরকম বেনেভোলেন্ট ডিক্টেটরের ছত্রছায়ায় আমরা অনেক নিরাপদে থাকি। আমাদের নাগরিক অধিকার নিয়ে আপনি মাথা ঘামান, তাতে আমাদের-ই কাঁধ থেকে একটা বাড়তি চিন্তার বোঝা নেমে যায়। আমরা বরং বিশ্বাস রাখি শাইনিং কলকাতায়, বিশ্বাস করি যে শাসকের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ। আর আপনার হাতে রক্তের দাগ? আপনি তো আর লেডি ম্যাকবেথের মতন বোকা নন! বিপুল জনসমর্থনের সাবান কি ওটুকু দাগ মোছার জন্য যথেষ্ট নয়, যেমন হয়েছে মোদীর বেলায়?
ধন্যবাদ পুলিশকে। অহিংস আইন অমান্যকারীদের বাসে তুলে পেটানোর কায়দাটা বেশ অভিনব। কিন্তু শুধু সেটুকুতে থেমে গেলে আমরা পাত্তাও দিতাম না। যেভাবে নিপুণ রুলের বাড়িতে সুদীপ্তর বাঁ-চোখ খুলে উপড়ে দিলেন, বা জোশেফের হাতের শিরা ছিঁড়ে-খুঁড়ে দিলেন, তাতে আপনারাই যে দেবী-রুণুর যোগ্য উত্তরসুরী, সেটা মেনে নিতে আর কোনো দ্বিধা থাকার কথা নয়। এত দেখে শুনে প্রায় শিল্পীর সংযমে লাঠি গুলি চালালেন সমাজকে অবাঞ্ছিত হঠকারিতা থেকে রক্ষা করার জন্যে, আপনাদের যদি সমাজবন্ধু না বলি, তো বলব কাকে? আপনারা প্রমাণ করে দিলেন, আইন অমান্য করার ফলশ্রুতি ঠিক কতখানি হতে পারে। বিশ্বাস করুন, আমরা অনেক নিরাপদ বোধ করছি আপনাদের হাতে জান-মালের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে।
ধন্যবাদ সেই নাগরিকদের, সুদীপ্তর মৃত্যুতে টসকানো পাত্তাটুকুও না দিয়ে যাঁরা আইপিএল দেখলেন আজ সারা সন্ধ্যে। যে আইন ভেংগেছে, প্রাপ্য সাজা সেই পাবে। তার দায়ভার আপনাদের ঘাড়ে এসে বর্তায় না। আর গণতান্ত্রিক অধিকার? সেটা তো পুলিশ এবং সরকার দেখছেই। শপিং মল পার্কিং প্লাজা ফ্লাইওভার আইটি হাব সমৃদ্ধ ভারতবর্ষে যে আলাদা করে আর কোনো নাগরিক অধিকারের দরকার নেই, বাদবাকিটুকু হত্যাযোগ্য অপরাধ, সেটা আমাদের চোখে আংগুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন আপনারা। অবধারিতভাবে আপনাদের-ই কেউ কেউ কাল অশ্রুপাত করবেন এই বলে যে সর্বনাশা ছাত্র রাজনীতি এরকম কত কত প্রাণ অকালে কেড়ে নিচ্ছে! যুক্তি এবং নৈতিকতার দিক থেকে আপনাদের অবস্থান এত-ই স্বচ্ছ, যে চিনে নিতে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয় না।
আর সবশেষে ধন্যবাদ বিরোধী দলকে, যাদের অপদার্থতার কারণে, হঠকারিতা, অন্যায় আর অবিমৃষ্যকারিতার কারণে আমরা এমন যোগ্য শাসক এবং আলোকপ্রাপ্ত পরিবর্তনের রাস্তায় হাঁটছি।দীর্ঘ চৌঁত্রিশ বছরের বিরোধিতাহীন এক অধ্যায় আপনাদের রূপান্তরিত করেছিল নন্দীগ্রামের শাসকে। আজ তার বিপরীতে, তুমুল জনাদেশ পেয়ে আসা শাসক দলের সেই একই বিরোধীতাহীন অধ্যায় চলেছে। কিন্তু বিশ্বাস করুন, আপনাদের থেকে এরা আরো অনেক বেশি ভণ্ডামিহীন। একটা বাইশ বছরের ছেলেকে মেরে ফেলার সময়ে আই পি এল অনুষ্ঠান করতে এদের হাত কাঁপে না। এরা জানে, মানুষের স্মৃতি খুব দুর্বল। কাল যদি নাইট রাইডার্স চ্যাম্পিয়ন হয়, সুদীপ্ত গুপ্ত নামটা ইতিহাসের পাতার একটা ফুটনোটেও জায়গা পাবে না। ঠিক এই শাসকই তো আমরা চেয়েছিলাম, কারণ এদের আমরাই ডিজার্ভ করি। এরা আন্দোলন করতে দেবে না। কিন্তু আন্দোলন ধুয়ে তো আর জল খাওয়া চলে না! এরা যা দিতে পারে, যা আপনারা শেষের দিকটায় দেবার স্বপ্নে বুঁদ হয়ে থেকেছেন কিন্তু পারেননি, তা হল এক অবিমিশ্র নিখাদ অরাজনৈতিক উন্নয়ন। যেখানে কোনো আন্দোলন থাকবে না, পঞ্চায়েত ভোট থাকবে না, ধর্মঘট থাকবে না, ট্রেড ইউনিয়ন থাকবে না। আপনাদের ধন্যবাদ যে এমন এক শাসককে আপনারাই হাতে করে রাইটার্সে বসিয়ে দিয়ে গেছেন।
সবশেষে আশা করি কাল কলকাতায় কোনো প্রতিবাদ হবে না। প্রতিবাদ হলে কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব, প্রতিবাদকারীদের ধরে চোখ উপড়ে হাঁটু ভেংগে পেটের নাড়িভুঁড়ি বার করে দিতে হবে! সবথেকে ভাল হয় লাশগুলো রাস্তার ওপর সাজিয়ে রাখলে, বা ত্রিফলা ল্যাম্পপোস্টে ঝুলিয়ে দিলে। যাতে প্রতিবাদের প্রতিবাদ করার আগে মানুষের গায়ের রক্ত একবার হিম হয়ে যায়। আশা রাখি, বিপুল জনাদেশে জিতে আসা মুখ্যমন্ত্রী আমাদের এই গণতান্ত্রিক দাবিটুকু পূরণ করবেন। অবশ্য এই দাবিটুকু করতে গিয়েও ‘কুমীর তোর জলকে নেমেছি’ বলে ফেললাম কি না, এখনই ঠিক বুঝতে পারছি না।