আজ সকালেও নানা সমস্যা নিয়ে মাথা ঘামিয়েছি। মাথা ফাটাফাটি করেছি ব্যক্তিগত সমস্যায়। হাহা করে হেসেছি। রেগেছি। ব্যক্তিগত অ্যাজেন্ডায় উথালপাথাল হয়েছি। ভারতীয় সময় ছটায় ফোন এলো, সে মারা গেছে। যাকে আমি চিনিনা। নাম জানিনা। মানে সংবাদমাধ্যম জানায়নি। ভালই করেছে। ধর্ষণ মানে তো শুধু একটি যোনিতে জোর করে একটি পুরুষাঙ্গ ঢুকিয়ে দেওয়া নয়। ধর্ষণ মানে এক জলছাপ। সেই ফরাসী দেশে দাগী আসামীদের যেমন করা হত। গায়ে গেঁথে দেওয়া হত এক বিশেষ নক্সার উল্কি। সে অনেক কাল আগের কথা। আমি প্রত্যক্ষজ্ঞানে জানিওনা। "থ্রি মাসকেটিয়ার্স"এ পড়েছি। সেখানেও এক মহিলা ছিলেন, মিলেডি। সুন্দরী ও ছলনাময়ী, ক্লাইম্যাক্সের আগে, মনে আছে, যার শরীরে পাওয়া গেল সেই দাগ। যা মোছা যায়না। দুমা কতদিন মারা গেছেন, প্রায় দেড়শো বছর তো হবেই। কিন্তু এই পোড়া তৃতীয় বিশ্বে আজও ধর্ষিতা মাত্রেই সেই দাগের অধিকারিণী। ও জিনিস মোছার নয়। কাঠগড়ায় উকিল জানতে চাইবে, ঠিক কী কী করেছিল বলুন তো? আচ্ছা গায়ে যখন প্রথম হাত দিল তখনই চেঁচাননি কেন, ভালো লাগছিল না? গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসেছিলেন কেন বউন তো? ছেলেছোকরারা আলগোছে বলবে উফ এনজয় তো করে নিয়েছে। মাসীমারা বলবেন, ওর সঙ্গেই হল কেন, আমাদের বাড়ির মেয়ের তো হয়না।
ছিনতাইবাজ হার ছিনতাই করে নেয়। ডাকাতরা মানুষকে কুপিয়ে দিয়ে চলে যায়। তার পরেও মানুষ লাজলজ্জাহীনভাবে বেঁচে থাকে। যুদ্ধে হাত-পা কাটা যাবার পরেও বেঁচে থাকলে বীরের সম্মান পায় সৈনিক। কিন্তু এ তো শুধু শারীরিক হিংসা নয়। ভিক্টিমই এখানে অপরাধী। লোকলজ্জার ভয়ে তাই তার নাম চেপে রাখতে হবে। প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে, তুমি যা হারিয়েছ, তা শরীর নয়। অঙ্গহানির চেয়েও মারাত্মক, মানসিক আঘাতের চেয়ে সুদূরপ্রসারী। যোনিতে আঘাতে দাগ মুছে যাবে, ক্ষত শুকিয়ে আসবে, কিন্তু ফিরে আসবেনা মহার্ঘ সেই জিনিস, যার নাম ইজ্জত। নারীর সম্মান, যা প্রাণের চেয়েও দামী। তোমার সম্মান বাঁচানোর জন্য প্রতিশোধস্পৃহায় ক্ষিপ্ত হবে প্রিয়জনেরা। যত ক্ষোভ, যত হাহাকার, ততই তীব্র হবে দাগ। যা হারিয়েছ তা আর ফিরে আসবেনা। এর পরে প্রাণ নিয়ে বেঁচে থাকলেও সে তো শুধু শরীরের বেঁচে থাকা। যতদিন বাঁচবে ততদিন স্মরণ করিয়ে দেওয়া হবে, শরীর নয়, আঘাত নয়, তুমি হারিয়েছ তোমার সম্মান, যার পরে বেঁচে থাকা অর্থহীন।
এর চেয়ে কি মরে যাওয়া ভালো? জানিনা। এই নিরাপত্তাহীনতা, সম্মান হারানোর ভয় তো শুধু বাইরে নয়, নারীর গভীরে ঢুকে থাকে নিশ্চয়ই। আন্দাজ করা যায়, কিন্তু পুরুষ হিসেবে এই অভিঘাত বোঝা অসম্ভব। আজকের কাগজেই দেখলাম জনৈকা রাজনীতিকের সদর্প উক্তি। প্রায় ভুলে যাওয়া সেই পার্ক স্ট্রিট কান্ডের ধর্ষণ নাকি ধর্ষণ নয়, জনৈক যৌনকর্মী আর তাঁর খদ্দেরদের মধ্যে গোলমাল। যৌনকর্মী হলে কী ধর্ষিতা হবার অধিকারও চলে যায়? যায় না সে তো আমরা কবে কবে থেকেই জানি। বাকতাল্লা দিই। তাতে কি আর এসব বলা আটকায়? আটকায়না। হাই প্রোফাইল হলে তো আরও বিপদ। ধর্ষণ হয়ে উঠবে রাজনৈতিক দড়ি টানাটানির খেলা। আমাদের ধর্ষণ বনাম ওদের ধর্ষণ। ওদেরট ধর্ষণ আমাদের টা চক্রান্ত। এইসব।
ওই মহ্লার বক্তব্য নিয়ে ছিছিক্কার করবেন অনেকেই। উচিতও। কিন্তু সেসব নয়, এই লিখতে লিখতে আমার মনে পড়ছে পার্ক স্ট্রিট কান্ডের সেই মহিলার কথা। তাঁর নামও আমি জানিনা। হয়তো মুখ লুকিয়ে কোনোমতে টিকে ছিলেন তিনি। এই দিল্লী এপিসোডের পর আবার ভেবে উঠল সব কিছু। ভুলে যাওয়া প্রতিটি এপিসোড পাবলিকের দরবারে দশ হাজার কিলোওয়াটের আলোর নিচে জ্বলজ্বল করে উঠল আবার। সমস্ত ক্ষত ও বেদনা সহ। কেমন আছেন তিনি? কেমন করে থাকবেন, পৌনঃপনিক এই লাঞ্ছনার পরে?
এইসব খুব জটিল কথা। আসলে তেমন কিছু ভেবে লিখছিনা। অস্থির লাগছে। এই সোফার নিশ্চিন্ত আরামে বসে অস্থিরতা তাড়ানোর জন্য কি বোর্ডে যা আসছে টাইপ করে যাচ্ছি। তার বেশি কিছু নয়। লেখা, লেখা, লেখা। এসব লিখে কি হবে কে জানে। দিল্লীর প্রতিবাদী মহিলাদের উপর পুলিশী লাঠিচার্জের নৃশংসতার কথা মনে পড়ছে। গতকালই পাঞ্জাবের গণধর্ষিতা যে মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে, তার কথা মনে পড়ছে। সে তো চুপচাপ মরে গেল। চুপিচুপি একা একা। তার জন্য তো এই শহীদের মর্যাদা নেই। আমি তার জন্য তো এতটা উদ্বেল হচ্ছিনা। এই আবেগ-ক্ষরণ, এই খারাপ লাগা, এই অস্থিরতা কি শুধুই প্রচারের দৌলতে? ক্রিকেটীয় উন্মাদনা যেভাবে তৈরি হয়? মানবিকতা কি শুধু কথার কথা? নাকি আসলে আমাকে হন্ট করছে নৃশংসতা? যেভাবে ধর্ষণ করার পর যৌনাঙ্গ দিয়ে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে রড। পেঁচিয়ে উপড়ে আনা হয়েছে অঙ্গপ্রত্যঙ্গ। খবরের কাগজে এত স্পষ্ট করে তো লেখেনি। কিন্তু ভাবতে গা টা শিরশির করে ওঠে। সে জন্যই হবে। নইলে সত্যিই তো এত নৃশংসতার মধ্যে এখন বসবাস এই মিডিয়ালোকিত কালে, হিংসা তো গা সওয়াই হয়ে গেছে। যাবার কথা। তবু কিছু কিছু জিনিস এই মোটা চামড়া ভেদ করে কোথাও একটা গিয়ে লাগে। কেন কে জানে।
অবশ্য আরও একটা কারণও থাকতে পারে। এত অস্থির হবার। আসলে সব ছাপিয়ে আরও একটা কথা মনে পড়ছে। মেয়েটা সেই রাতে সিনেমা দেখে ফিরছিল। লাইফ অফ পাই। সে তো আমিও এই সেদিন দেখে এলাম। বৌ-বাচ্চা নিয়ে। পপকর্ন খেলাম। আমার পরিচিত মেয়েটি, মেয়েরা, অনেকেই তো দেখেছে, যারা দেখেনি দেখবে সিনেমাটা। কে জানে কোনদিন তাদের কেউ খবরের কাগজে "ধর্ষিতা" হয়ে যাবে কিনা। নাম অবশ্য জানা যাবেনা এই বাঁচোয়া, কারণ, আব্রু রক্ষার্থে সেসব আমরা চেপে রাখতে জানি। আমরা ভদ্র ও সভ্য হয়েছি। লোকলজ্জা থেকে বাঁচানোর জন্য আমরা ভিক্টিমের নাম মিডিয়ায় উচ্চারণ করিনা। আমাদের ধর্ষিতাদের কোনো নাম হয়না।