হিন্দি সিনেমার গান শুনে বাঙালি কেন উলুতপুলুত হয়, আপাতদৃষ্টিতে বোঝা মুশকিল। যে ঘরানার গানের শ্রেষ্ঠ লিরিক নাকি 'মেরা কুছ সামান তুমহারে পাস পড়া হ্যায়', অর্থাৎ কিনা 'আমার কিছু মালপত্তর তোমার কাছে পড়ে আছে' আর দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ লিরিক তর্কযোগ্যভাবে 'বিড়ি জ্বালাইলে', অর্থাৎ কিনা 'সিঁড়ির নিচে বিড়ির দোকান', সে গান শুনলে এমনিই ভদ্রজনের মাথা হেঁট হয়ে যাবার কথা। হিন্দি বলয়ের কথা আলাদা, ওদের এরকমই কপাল। ইউপি-বিহারে আধুনিক কালে কোনো জীবনানন্দ জন্মাননি। আর অতীতের গৌরব যা ছিল, সেসব স্টিমরোলার চালিয়ে কবেই ফ্ল্যাট করে দেওয়া হয়েছে। ব্রজবুলি বা মৈথিলির যে মাধুর্য তাকে র্যাঁদা মেরে বাতিল করেই আধুনিক হিন্দুস্তানির বাড়বাড়ন্ত। আর লক্ষ্ণৌ এর যে ডায়লেক্ট গায়ে -কাঁটা দেওয়া ঠুংরি গজল উৎপাদন করেছে একটানা, বাহাদুর শার সঙ্গে তাকে প্রাথমিকভাবে বার্মায় নির্বাসন দেওয়া হয়েছিল। দূরদর্শনের রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম এসে তৎসম হিন্দুস্তানি দিয়ে কফিনে শেষ পেরেকটা পুঁতে দিয়েছে। অভাগা হিন্দিবলয়ের অধিবাসীদের দুর্ভাগ্যে তাই খোঁটা দিয়ে লাভ নেই। সবই কপাল। কিন্তু বাঙালিরা কেন "আমার কিছু মালপত্তর (ওহো আহা), তোমার কাছে পড়ে আছে (ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ)" বলে আহা উহু করে বোঝা মুশকিল।
এই পর্যন্ত পড়েই, যেকোনো বোদ্ধা, ক্যাঁক করে ধরে যেটা বলবেন, সেটা আগে থেকেই আন্দাজ করা যায়। "কাব্যমাধুর্য কি আর ওরকম সরল অনুবাদে বোঝা যায় হে? এখানে 'সামান' হল মেটাফর। ওর মানে মালপত্তর নয়, ওর অর্থ হল হৃদয়, জীবনের টুকরো" ইত্যাদি প্রভৃতি। সেসবই খুব খাঁটি কথা। কিন্তু তাতেও লিরিকের কোনো উন্নতি হয় বলে মনে হয়না। কিন্তু বোদ্ধারা যেহেতু সিধে কথায় বশ হবেননা, তাই তাঁদের মাথায় বিষয়টা গজাল মেরে ঢোকানো দরকার। আসুন, হাতে যখন সময় আছে, গানখানার একটা জটিল অনুবাদই করা যাকঃ
আমার লাগেজ রাখা তোমার ওই ক্লোকরুমে
কখনও সময় পেলে ছুঁয়ে দিও শীতঘুমে
পড়ে কেমন লাগছে? ফ্যাচফেচিয়ে হাসি আসছেনা? আসারই কথা। তাও তো আপনার কপাল ভালো, ওখানে 'লাগেজ' লিখেছি। 'হৃদয়' লিখলে আন্তারা একেবারে ফাঁচকলিয়ে যেত। তা, সে নিহাৎই আমার হৃদয়ে মায়াদয়া আছে বলে। তা, সে আমার মায়া থাকুক ইউপিতে, মমতা পশ্চিমবঙ্গে, এর পরে আপনার একটা হোমটাস্ক আছে। আপনার বাড়ির কাজ হল, এইবার লিরিকখানা যথাযথ সুরে গুনগুনিয়ে গেয়ে ফেলুন। মানে, ওই "মেরা কুছ সামান" এর সুরে। "আমাআআর লাগেএএজ রাখা। তোমাআআর ওই ক্লোওওকরুমে"। পুরোটা যদি গম্ভীর গলায় গাইতে পারেন, আপনার মন্ত্রী সান্ত্রী হবার যোগ্যতা আছে। মাক্কালী। এবং মা শেতলার দিব্যি, এই হল ওই সুবিখ্যাত গানের লিরিকের দৌড়। যার স্বাদ আপনি এখনই পেলেন। বিশ্বাস করুন, হৃদয়কে 'সামান' বলা এক অতি অখাদ্য মেটাফর। জীবনকে মরুভূমি হয়ে গেল বলার মতই।
জানি, 'বিশ্বাস করুন' বললেই আপনার বিশ্বাস হবেনা। আঁতেল মাত্রেই নাস্তিক, তাদের বিশ্বাসে কিছু মিলায়না। তাঁরা এই পর্যন্ত পড়েই, "যত্ত সব ভাট" বলে কেটে গেছেন। কিংবা "জীবনকে মরুভূমি বলা কী এমন খারাপ?" বলে মাসল ফুলিয়ে রবিঠাকুরের 'যে নদী মরুপথে হারাল ধারা' আওড়াচ্ছেন। তা, ওতে জীবনকে ঠিক মরুভূমি বলা হয়নি, একথা বললে তাঁরা মুখের কথায় বিশ্বাস করবেন কেন? তাই প্রত্যক্ষ প্রমাণ দেওয়া যাক। গুরুদক্ষিণা দেখেছেন? নিশ্চয়ই দেখেননি। নামও শোনেনই বোধহয়। তাই অবিলম্বে ইউটিউব খুলে দেখে নিন বাংলাই আশির দশকের সুপারহিট ছবি গুরুদক্ষিণার সুপারহিট গান, 'পৃথিবী হারিয়ে গেছে মরু সাহারায়'। তরুণ বয়সের এক মানবশিশু, দেখুন নেচে নেচে উচ্চারণ করছেন, মানে ঠোঁট মেলাচ্ছেন আর কী, এই অব্যর্থ পংক্তিগুলিঃ
পৃথিবী হারিয়ে গেল মরু সাহারায়
মিশরের নীলনদ আকাশে মিলায়
খুশির প্রাসাদ গড়ি মাঝ দরিয়ায়
আকাশ রাঙাতে চায় প্রদীপ শিখায়
শুনে হাসি পাচ্ছে? পাক। হাসি থামান। গম্ভীর হোন। তারপর বুকে পাথর চাপা দিয়ে নির্মোহভাবে দেখুন, কী অব্যর্থ এই মেটাফরগুলি। পৃথিবী হারিয়ে গেছে মরু সাহারায়। মিশরের নীলনদ মিলিয়েছে আকাশের নীলে। ইত্যাদি। খারাপ কি কিছু আছে?
বস্তুত কেউ যদি ভাবেন, আমি "খারাপ কিছু আছে" দেখাতে চাইছি, তাঁরা ভুল ভাবছেন। আমার অ্যাজেন্ডা হল, মেনলি ব্রাহ্মণের উপর আরোপিত গৌরব হরণ, আর ব্রাত্যজনকে তার কিছু ভাগ দেওয়া। এই জন্য আপনারা আমাকে রবিনহুড আখ্যা দিতে পারেন, আমি কিছু মনে করবনা। কিন্তু মোদ্দা কথাটা হল, সামান থেকে সাহারা সব গোড়েগোব্দা মালের কেউই অধিক খারাপ কিছু না। তা, অধিক খারাপ যে কিছু নয় ব্যাপারটা, সে বিষয়ে আমার প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা আছে। সে গল্পটাই এখানে বলে নেওয়া যাক। আমার কলেজ লাইফের এক গোমড়া বন্ধুকে গিটার বাজিয়ে গম্ভীর মুখে আমি এই গানটি শুনিয়েছিলাম, সে বহুকাল আগে। সে ছেলেটি বিস্তর ডিলান-বিটলস মুখস্থ করলেও, কস্মিনকলে গুরুদক্ষিণা দেখেনি। নামও শুনেছিল কিনা সন্দেহ। শহুরে বস্তু হলে যা হয়। তা, গানটা শুনে সে মুগ্ধ হয়ে যায়। এই সাররিয়েল লিরিক? বাংলা ভাষায়? এইসব বলে। আমার প্ররোচনায় তারপর ভিডিও ক্যাসেট ভাড়া করে বাড়িতে সে সিনেমাটি দেখে (বললে বিশ্বাস হবেনা তখনও ইউটিউব এমনকি ডিভিডিরও চল ছিলনা)। আমি খুবই বদ ছিলাম, খানিকটা স্যাডিস্ট টাইপের, বিনা কারণে লোককে অত্যাচার করে আনন্দ পেয়েছি, এ কথা স্বীকার করতে আমার আর কোনো দ্বিধা নেই। ফলে সে সিনেমাটি দেখে, এবং যা হবার তাইই হয়। আমাদের বাক্যালাপ বন্ধ হয়। এখানেই গপ্পোটা শেষ না অবশ্য। সেই সেই হ্যাপি বা আনহ্যাপি এন্ডিং এর গপ্পো পরে বলা যাবে, এখানে মোদ্দা কথা হল, সিনেমা বাদ দিয়ে দেখলে, এ গান এমন কিছু খারাপ নয়। লিরিকের প্রশ্নে। ওই 'মেরা কুছ' টাইপেরই। সেইটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতেই ছোকরা গিয়েছিল রেগে।
এ অবশ্য ঠিক প্রত্যক্ষ প্রমাণ হলনা। সেই তুরুপের টেক্কার জন্য জন্য আপনাকে আরেকটা হোমটাস্ক করতে হবে। অনেকেরই মনে আছে, নব্বইয়ের দশকে বাংলা কাঁপিয়ে প্রকাশিত হয়েছিল বাংলা গানের অ্যালবাম, "আবার বছর কুড়ি পরে"। মহীনের ঘোড়াগুলি সম্পাদিত বাংলা গান। বইমেলায় তাই নিয়ে তুমুল আলোড়ন, এ মুখার্জির সামনে ভিড়, খোকা পরমব্রত (ভাবা যায়, সে এখন বাংলা সিনেমার হিরো?), ছোট্টো গাবু আর তার টি-শার্ট পরা বাবাকে অনেকেরই মনে আছে। তা, সেই অ্যালবামের একটি গান ইউটিউব থেকে ঝপ করে দেখে ফেলুন। "আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি"। আমি খুব হাবিজাবি একটা লেখা লিখছি বলে, গানটাকে হতশ্রদ্ধা করবেন না যেন। খুব অস্বাভাবিক হলেও সত্য, যে, এই গানের লিরিকের মান নিয়ে বঙ্গীয় আঁতেলকূলে কোনো মতপার্থক্যই নেই, সবাই একবাক্য মানেন লিরিকটি অতি চমৎকারা। অতঃপর মন দিয়ে গানটা শুনুন। পুরোনো লিরিক আর সুর একটু ঝালিয়ে নিনঃ
আকাশে ছড়ানো মেঘের কাছাকাছি
দেখা যায় তোমাদের বাড়ি
না, এখানেই কম্মো খতম নয়। আরেকটা ছোট্টো কাজ আছে। সুরটা ভালো করে ভেঁজে নিয়ে, তারপর তার উপর বসিয়ে দিন আমাদের পুরোনো গুরুদক্ষিণার গানটি। লিরিকটা সামান্য বদলাতে হবে। কী গাইতে হবে সেটা নিচে দিয়ে দেওয়া হাঃ
পৃথিবী হারিয়ে গেল সাহারায়
মিশরের নীলনদ মিলায়
প্রথমে একটু অসুবিধে হবে, তারপর একটু চোখ টোখ বুজে অভ্যাস করে দেখুন। করতে থাকুন করতে থাকুন। একেই সাধনা বলে। পুরোটা একবার জায়গায় বসিয়ে ফেলার পর দেখুন, আর তেমন খারাপ কিছু লাগছেনা। এরপর বাকিটাও নিজে নিজে বসিয়ে গেয়ে ফেলুন। মেঘের জায়গায় সাহারা, বাড়ির জায়গায় নীলনদ, এইসব আর কি। আমার কলেজের যে বন্ধুর কথা বলছিলাম, সে এই ভাবে পুরো গানটা গেয়ে শোনানোর পর, তবে আমাকে শাপমুক্ত করে। এখনও আমাদের বন্ধুত্ব অটুট। ফলে যাঁরা দুশ্চিন্তা করছিলেন, তাঁরা নিশ্চিন্ত থাকুন, আমাদের গপ্পোটা হ্যাপি এন্ডিং এর। বাংলা সিনেমার গান আজ পর্যন্ত কোনো বিচ্ছেদ ডেকে আনেনি।
তো, সে খুব আনন্দের কথা, আপনাদের ভালো-মন্দ যদি ঘেঁটে দিয়ে থাকতে পারি, তাতেও আনন্দের পরিসীমা থাকবেনা, কিন্তু আপনাদের পেটে যে প্রশ্নটা গজগজ করছে, তার উত্তর না দিয়ে লেখা শেষ করা যাবেনা। প্রশ্নটা হল, তাহলে কিছু গানের লিরিক ভালো, কিছু গানের লিরিক খারাপ, এসব কোনো ব্যাপারই না? সবই পারিপার্শ্বিকতা? উত্তরটা জটিল। খুব গোদা ভাষায় বললে, ভালো-খারাপ এই প্রক্রিয়াটাতো এমনিই সামাজিক। ছোটো থেকে শেখানো হয়। কিন্তু আমরা এখানে সেটা নিয়ে কথা বলছিনা। এই জটিল ব্যাপারে ঢুকলে আশু প্রশ্নটার কোনো সমাধন হবেনা। তাই আসুন, ধরে নিই, ছোটো থেকে লোকে যা 'ভালো' বলে শেখে সেটাই 'আসল ভালো'। অর্থাৎ, 'আসল ভালো' বলে কিছু হয়। ব্যাপারটা খানিক টটোলজিকাল হল বটে, কিন্তু এটুকু ধরে না নিলে পরের ধাপে আর যাওয়াই যাবেনা। কাজেই 'ধরিয়া লইলাম'এর মতো 'আসল ভালো'টুকু থাক।
এবার, আসল প্রশ্ন। 'আসল ভালো' কি একটা ধ্রুবসত্য? একেবারেই না। যদিও, ধরে নেওয়া অনুযায়ী আমরা একটা 'আসল ভালো' ই শিখি, কিন্তু নানা পারিপার্শ্বিকতার ঠেলায় নানা জিনিসের ভালোত্ব বা খারাপত্ব ক্রমশই পিছলে যেতে থাকে। পুরোনো গান 'খারাপ' বা 'অচল' হতে থাকে, নতুন গান হিট অর্থাৎ 'ভালো' হয়ে ওঠে। আবার ঠিক এর উল্টোদিকে নস্টালজিয়ার চাপ কিছু জিনিসকে 'ভালো' বানায়। অর্থাৎ মাল একই থাকে, কিন্তু তার ভালোত্ব বা খারাপত্ব বদলাতে থাকে। ট্রেন্ড যা চাইছে, তাকে 'ভালো' হয়ে উঠতে হয়। যেমন হিন্দি আইটেম গান 'ভালো' (মানে হাস্যোদ্রেককারী নয়), কিন্তু বাংলা আইটেম গান 'খারাপ' (মানে হাস্যকর), এটা ট্রেন্ডের জন্য। নইলে 'বিড়ি জ্বালাইলে' বা 'মাই নেম ইজ শীলা'র চেয়ে 'ধুকুপুকু বুক কাঁপে শুধু যে রাতে' ঢের ভালো লিরিক। বিশেষ করে 'আমায় চটকেছে চিলেকোঠাতে' লাইনটাতো বৈপ্লবিক। একই ভাবে বাংলা গানের চেয়ে হিন্দি গান ভালো, কারণ সর্বভারতীয় চাপ। আবার বলিউডের চেয়ে হলিউড ভালো, কারণ আন্তর্জাতিক চাপ। এর সঙ্গে 'আসল ভালো'র সরাসরি সম্পর্ক খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
তা, খুঁজলে এরকম গাদা-গাদা প্রক্রিয়া পাওয়া যাবে। সেসবের লিস্টি বানানো এই লেখার উদ্দেশ্য নয়। এখানে আপনাকে কেবল মূল সূত্রটি ধরিয়ে দেওয়া হল। এর পরে 'ভালো' বা 'খারাপ' সিদ্ধান্ত নেবার আগে একটা 'ভালো' গানের সুরে 'খারাপ' গানের লিরিক বসিয়ে বসিয়ে নিজেরাই দেখতে পারবেন, এবং নানা অজানা সূত্র সূত্র আবিষ্কার করতে পারবেন। প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়, তিনটি সূত্র আবিষ্কার করে, বলা যায়না আপনিই হয়ে উঠলেন গানের জগতের নিউটন। নিউটন আপনাকে বানিয়ে দেওয়া যাবেনা অবশ্য, জাস্ট হয়ে ওঠার কায়দাটা এখানে বাতলানো হল। ফরাসী দেশ হলে এই নিয়ে দিগ্বিদিকে হইচই পড়ে যেত। লিরিকের 'ভালোত্ব' পিছলে যাওয়ার প্রক্রিয়াকে দিফাঁরস এবং একটা গানের ঘাড়ে আরেকটাকে চাপিয়ে এই পিছলে যাওয়াকে পুনরাবিষ্কার করার পদ্ধতিকে রিকনস্ট্রাকশন বলা হত। আঞ্চলিক ভাষায় লেখায় সেসবের চান্স নেই। তবু, লেখকের যেহেতু আপন-পর বোধ নেই, তাই মানবজাতির কল্যাণে এই লেখা গোবিন্দায় নমঃ বলে উৎসর্গীকৃত হল। পরম মঙ্গলময় আপনাদের মঙ্গল করুন।
সংশ্লিষ্ট গানগুলি, জনগণের স্বার্থে এইখানে দিয়ে দেওয়া হল। মানবসেবায় এতটাই যখন করলাম, তখন এটাই বা বাদ থাকে কেন।
ধুকুপুকু বুক কাঁপে শুধু যে রাতেঃ