“শুনেছি নাকি চাঁদের বুড়ির পোস্টটা নাকি খালি হয়েছে। তুমি চরকা কাটতে জানো ?”
আপাতভাবে অলীক এই সংলাপগুলি ১৯৮৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি ‘ওম দর ব দর’-এর অন্তর্ভুক্ত। এই চলচ্চিত্রটিকে ভারতের ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’ (Avante - Garde) সিনেমার একটি পথপ্রদর্শক হিসেবে গণ্য করা হয়। ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’ শব্দটি চলচ্চিত্র জগতে বিভিন্ন রকমের পরীক্ষামূলক গোত্রের সিনেমার পরিচায়ক । মূল আলোচনায় ঢোকার আগে ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’ সিনেমা সম্বন্ধে দু’চার কথা বলা দরকার।
১৯২০ খ্রিস্টাব্দে ইউরোপে ম্যান রে (Man Ray), দুচ্যাম্প (Duchamp), রেনে ক্ল্যার (Rene Clair) প্রভৃতি পরিচালকদের হাত ধরে ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’-এর সূচনা। এরপর ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে প্রতিভাধর পরিচালক লুই বুনুয়েল (Lui Bunuel) এবং চিত্রশিল্পী সাল্ভাদর দালি (Salvador Dali) মিলে সৃষ্টি করলেন ‘অ্যাঁ শিয়েঁ অ্যাঁদালু’(Un Chien Andalou) নামে এক আশ্চর্য ছবি, যা ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’-এর ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। এই পরীক্ষা- নিরীক্ষার আঁচ বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়ল। নানান দেশের পরিচালকেরা নিজগুণে ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’-কে আরও সমৃদ্ধ করে তুললেন। ভারতবর্ষেও এর প্রভাব অনুভূত হতে লাগলো ১৯৬০-এর দশকের গোড়া থেকেই। এই প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল যে, ১৯৪৮ সালে উদয়শঙ্করের ‘কল্পনা’ ছবিটিতে প্রচুর পরীক্ষামূলক প্রয়োগ রয়েছে, তবে এটিকে ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’ এর শ্রেণিভুক্ত করা যায় কিনা, সেই নিয়ে বির্তক আছে। সাধারণভাবে ভারতের প্রথম দৃষ্টান্তমূলক ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’ সিনেমা বলতে ‘ওম দর ব দর’-এর কথাই মাথায় আসে। বস্তুত,এটিই ভারতবর্ষের প্রথম ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’ ফিল্ম, যেটি দেশে ও বিদেশে সমানভাবে বন্দিত হয়েছে। ১৯৮৯ সালে কমল স্বরুপ এই ফিল্ম-এর জন্য ফিল্মফেয়ার-এ জু্রিস চয়েস পুরস্কার পান। আজ, এই সিনেমা মুক্তি পাবার প্রায় ২৫ বছর পরেও, সিনেমাপ্রেমী মানুষদের মধ্যে এটি নিয়ে সমান উদ্যমে আলোচনা হয়।
স্বাভাবিক ভাবেই পাঠকদের মনে প্রশ্ন উঠতে পারে, এমন কী আছে এই ফিল্মে, যার জন্য এই গুরুত্ব ? এককথায় বলতে গেলে, কল্পবাস্তব(Surrealism)-নির্ভর এই সিনেমা ভারতীয় জীবনদর্শনের এক বিদ্রূপাত্মক প্রতিচ্ছবি, যাকে ইংরেজিতে স্যাটায়ার বলা হয়। যাঁরা এই ফিল্মে নিটোল কাহিনি খুঁজতে যাবেন, তাঁরা হতাশই হবেন। ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’-এর প্রথা অনুসারেই এই সিনেমাটি স্পষ্ট ন্যারেটিভ-এর গন্ডিতে আবদ্ধ নয়, সর্বতোভাবে এর মধ্যে কোনও বক্তব্য খুঁজে বের করার প্রচেষ্টাও বৃথা। তবে এর মধ্যে যে বিভিন্ন ধারার সংমিশ্রণ ঘটেছে, সেগুলিকে আলাদা করে দেখলে অনেকগুলি অন্তর্নিহিত অর্থ উপলব্ধি করা যায়।
তথাকথিত কাহিনি না থাকলেও, পাঠকদের স্বার্থে এই সিনেমার সারাংশ লেখার চেষ্টা করছি।
ঘটনার শুরু রাজাস্থানের আজ্মেরে। বীর শঙ্কর (লক্ষ্মীনারায়ণ শাস্ত্রী) নামের এক সরকারি কর্মচারীর ঘরে একটি ছেলে জন্মায়। এই বীর শঙ্করকে গোটা ছবিতে বাবুজি নামেই সম্বোধন করা হয়েছে। বীর শঙ্কর সরকারি চাকরির পাশাপাশি ফলিত জ্যোতিষ নিয়েও চর্চা করেন। সিনেমার ঘটনাবলির শুরুতে আমরা দেখতে পাই যে, উনি চাকরি ছেড়ে পাকাপাকি ভাবে জ্যোতিষশাস্ত্রে মনোনিবেশ করেছেন। সন্তানের জন্মের পর তার কুষ্ঠী করার সময়, বীর দেখতে পেয়েছিলেন যে, তার ছেলের আয়ু মাত্র আঠারো বছর। তিনি ছেলের নাম রেখেছিলেন ওম্, কারণ তাঁর ধারণা ছিল যে ওম্কার ধ্বনি কোনোদিন যমালয়ে শোনা যায়নি। তার বিশ্বাস, এই নামকরণের জন্যে যমদুতেরা তার ছেলের ধারেকাছে ঘেঁষবে না। ওম (মনীশ গুপ্ত/আদিত্য লাখিয়া) ছাড়াও বীর শঙ্করের একটি মেয়ে আছে, যার নাম গায়ত্রী। গায়ত্রী (গোপী দেশাই) বয়সে যুবতী, এবং নারীস্বাধীনতায় বিশ্বাসী। সে সিনেমা হলে নির্দ্বিধায় পুরুষদের সেকশনে বসে সিনেমা দেখে। জগদীশ (ললিত তিওয়ারি) নামের এক যুবক সবে ঝুমরিতলইয়া থেকে আজমেরে এসে বসবাস শুরু করেছে। একদিন সিনেমাহলে স্বাধীনচেতা গায়ত্রীকে দেখে সে তার প্রেমে পড়ে যায়। পরে জগদীশ আবিষ্কার করে, সে এবং গায়ত্রী বহুদিন ধরে রেডিওতে একই গানের জন্য অনুরোধ করে আসছে। ইতিমধ্যে ওম তার এক বিশেষ ক্ষমতা আবিষ্কার করেছে। সে বহুক্ষণ জলের নীচে নিঃশ্বাস ধরে রাখতে পারে। বীর তার মেয়েকে একটি সাইকেল কিনে দেন। জগদীশ তাকে সাইকেল শেখানোর দায়িত্ব নেয়। এইভাবেই তারা কাছে আসতে শুরু করে। ওম এক বন্ধুর বাড়ির ছাদে তার জন্মদিনের অনুষ্ঠানে যোগ দেয়। ঘটনাচক্রে সেই রাতেই নিল আর্মস্ট্রং চাঁদের মাটিতে পা রাখেন।
সময় এগোতে থাকে। আমরা দেখি যে, বীর শঙ্কর তাঁর বাড়িতে একটি সফল জ্যোতিষকেন্দ্র খুলে বসেছেন। জগদীশ তাঁর টাইপিস্ট হিসেবে নিযুক্ত হয়েছে। গায়ত্রীও তার বাবাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করে। ওম এখন বয়ঃসন্ধির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। তার বিজ্ঞানে যত আগ্রহ, ঠিক ততটাই অলৌকিক এবং তন্ত্রমন্ত্রে। ব্যাঙের প্রতি তার প্রবল আকর্ষণ। এইরকম সময়ে ফুলকুমারী (অনিতা কান্ওয়ার) নামে এক তরুণী বীরের কাছে ভাগ্যবিচার করাতে আসে। সে পারিশ্রমিক দিতে অক্ষম, তাই বীর এবং গায়ত্রী মিলে ঠিক করে যে, ফুলকুমারীকেই টাইপিস্ট হিসেবে নিয়োগ করা হবে। জগদীশ প্রচুর বানান ভুল করে, তাই তার বদলে ফুলকুমারীকেই রাখা যথাযথ, এই যুক্তি শুনে জগদীশ ক্ষুণ্ণ হয়। রাগের মাথায় সে গায়ত্রীদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ফুলকুমারী ওমদের বাড়িতেই থাকতে শুরু করে। ওম তার প্রতি আকৃষ্ট হয়।
ইতিমধ্যে জগদীশ একদিন গায়ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসে। বাড়ি ফাঁকা পেয়ে এবং গায়ত্রীর পীড়াপীড়িতে, জগদীশ তার সঙ্গে শারীরিক ভাবে মিলিত হয়।
এদিকে, লালা লোটামল (ডক্টর চন্দ্র) নামের এক স্থানীয় ব্যবসায়ী কোনও এক আসন্ন যুদ্ধের আঁচ পেয়ে, তার বহুমূল্য হিরেগুলির সুরক্ষার বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি একজোড়া জুতোর সোলে হিরেগুলি লুকিয়ে বীর শঙ্করের কাছে গচ্ছিত রাখেন। ওম না জেনে, এই জুতো পরেই বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। লোটামলের জমিতেই তার জুতো থেকে হিরে পড়ে যায়। সেখানকার ব্যাঙেরা এই হিরে গিলে ফেলে। বীর হিরে না পেয়ে ফুলকুমারীকে সন্দেহ করেন। ফুলকুমারী রেগে দিয়ে তাঁকে এমন শাপ দেয়, যাতে ঘর থেকে বেরলেই তাঁর মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী। তারপর ফুলকুমারীও বাড়ি ছেড়ে চলে যায়।
কিছুদিন পর যখন লোটামল তার হিরে ফেরত নিতে আসেন, তখন বীর শঙ্কর বাধ্য হয়ে তাঁকে বলেন যে, হিরেগুলোকে চূর্ণ করে তিনি লোটামলের খাবারে মিশিয়ে দিয়েছেন। শঙ্কর তাঁকে এও বোঝান যে, ১৫ দিন পর্যন্ত অপেক্ষা করে পূর্ণিমার রাত্রে নিজের জমিতে গিয়ে মলত্যাগ করলে সেখানে অফুরান হিরে ফলবে। লালাকে এই বলে সাবধানও করেন, ওই সময় যদি কেউ তাকে দেখে ফেলে তা হলে সে যেন সকাল পর্যন্ত আর কাউকে না-দেখে। লালা লোটামল এই নির্দেশমতো পূর্ণিমার রাত্রে তার জমিতে যান। ওম সেইখানে তাকে দেখে ফেলে, তাই তিনি ওমকে তাঁর জমির ঠিকাদার হিসেবে নিয়োগ করেন। এর মাঝে ওম বাড়িতে এলে বীর তাকে ধরতে গিয়ে উত্তেজিত অবস্থায় উঠোনে বেরিয়ে আসেন। ফুলকুমারীর শাপে তাঁর মৃত্যু হয়। ওম স্থানীয় মেয়েদের স্কুলে জীববিজ্ঞান ক্লাসের জন্য এই জমি থেকে ব্যাঙ সরবরাহ করতে শুরু করে। প্র্যাক্টিকাল ক্লাসে কিছু ব্যাঙ কাটতেই তাদের পেট থেকে হিরে বের হয়। খবরটা ছড়াতে বেশিক্ষণ লাগে না। হিরের আশায় একদল লোক লালার জমিতে ব্যাঙ শিকারে নামে। লোটামলের ধারণা অনুযায়ী হিরেগুলো তার মল থেকে উৎপন্ন হয়েছে, যদিও তা আসলে ওমের জুতো থেকেই ওখানে এসেছে। যাই হোক, এই ব্যাঙ শিকারে বাধা দিতে গিয়ে গুলিতে প্রাণ হারান লোটামল।
এর পর ওম পুষ্করে এসে উপস্থিত হয়। এক স্থানীয় ব্রাহ্মণ তার দম ধরে রাখার ক্ষমতা জানতে পারে। সামনেই পুষ্কর উৎসব, তাই এই সময়ে ওমের এই ব্যতিক্রমী ক্ষমতা প্রদর্শন করে দু’চার পয়সা কামাবার ফন্দি করে সে। পরিকল্পনামতো উৎসবের সময় প্রতিদিন রাত ১২টায় ওম জল থেকে উঠে দর্শন দেয়। তাকে দেখতে পূর্ণাথীদের ভিড় বাড়তেই থাকে। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও টিভি চ্যানেল এই আশ্চর্য ঘটনাকে কভার করে। বিভিন্ন ব্র্যান্ড তাদের প্রচারের জন্য ওমকে ব্যবহার করে। ওমের জনপ্রিয়তার কারণে সাধারণ মানুষ এক মিনিটের জন্য নিঃশ্বাস বন্ধ রাখার এক অভূতপুর্ব আন্দোলনের ডাক দেয়। এই সময় ওম ও তার বন্ধুর কথোপকথনে আমরা জানতে পারি যে, সবাই যখন নিঃশ্বাস বন্ধ রাখবে, তখন জলের নীচে ওম নিঃশ্বাস নিলেই এই আন্দোলনে তার যোগদান সার্থক হবে। নির্দিষ্ট সময়ে এটা করতে গিয়ে ওমের মৃত্যু হয়। তার মৃতদেহ পুষ্করের জলে ভেসে ওঠে।
এর অনেক দিন পর, দেশবিদেশ ঘুরে জগদীশ গায়ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে আসে। এসে দেখে, গায়ত্রী এক ছেলের জন্ম দিয়েছে। এই সন্তান যে তারই, জগদীশের এটা বুঝতে বাকি থাকে না। গায়ত্রী প্রথমে রাগ করলেও, পরে তাকে ক্ষমা করে। এর পর একদিন জগদীশ ও গায়ত্রী পটাশিয়াম সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। উদ্দেশ্য, দুনিয়াকে পটাশিয়াম সায়ানাইডের স্বাদ কেমন, সেটা জানিয়ে যাওয়া। যেহেতু জগদীশ বানানে কাঁচা, তাই সে আগে বিষ খেয়ে গায়ত্রীকে লেখার ভার দেয়। মরার আগে সে “গোবর” শব্দটি উচ্চারণ করে। এর থেকে ধারণা হয় যে, পটাশিয়াম সায়ানাইড-এর টেস্ট গোবরের মতো। গায়ত্রী শেষ মুহূর্তে মত পরিবর্তন করে। আত্মহত্যা না করে, সে স্কুটারে চেপে বাড়ি ফিরে যায়।
উপরোক্ত সারাংশে কিছুটা কাহিনির আভাস পাওয়া গেলেও, মূল চলচ্চিত্রে তা বোঝার কোনও অবকাশ নেই। এর কারণ ছবিটিতে ‘নন্লিনিয়ার ন্যারেটিভ্’ -এর প্রয়োগ এবং ইচ্ছাকৃত খাপছাড়া সংলাপ এবং দৃশ্যায়ন। একটা ছোট উদাহরণ দেওয়া যাক। ওমের পুষ্করে আসার ব্যাপারটা লোটামলের জমিতে ঘটে যাওয়া ঘটনার আগেই দেখানো হয়েছে, যদিও সেটা পরেই ঘটে। আবার লালা গুলিবিদ্ধ হবার পরে তাকে বীর শঙ্করের বাড়ি গিয়ে তার জন্য শোকপ্রকাশ করতে দেখা যায়। বোঝাই যাচ্ছে, এই ঘটনাগুলি সময়ের নিরিখে বিপরীতক্রমে দেখানো হয়েছে।
এবার এই ছবির কয়েকটি মূল বৈশিষ্টের দিকে নজর দেওয়া যাক:
• যুক্তিবিদ্যায় ‘নন্ সেক্যুইটার্’ বলে একধরনের লজিকের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই লজিক আসলে অবাস্তব যুক্তিকে বোঝাতেই ব্যবহৃত হয়, যেমন ১=২, অথবা এই বাক্যটি: ‘সব ফলই আসলে সব্জি’। এ ছবিতে এই লজিক-এর প্রচুর প্রয়োগ রয়েছে। শুরুর দিকে গায়ত্রী ওমকে জিজ্ঞেস করে, “তুই কী করে জানলি যে এখন বৃষ্টি হতে চলেছে?” উত্তরে ওম বলে, “তুই চুল আঁচড়াচ্ছিস, তাই।” এই ধরনের অলীক সংলাপ ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’-এর বৈশিষ্ট। এর মানে খুঁজতে যাওয়া নিরর্থক।
• তবে সব অলীক সংলাপই যে অর্থহীন, এমন ভাবার কোনও কারণ নেই। প্রবন্ধের শুরুতে দেওয়া সংলাপ জগদীশ ও গায়ত্রীর কথোপকথনের অংশ। যেখানে গায়ত্রী জিজ্ঞেস করে, “কোনও নারী কি পুরুষের সাহায্য ছাড়া এভারেস্টে উঠতে পারে ?” জগদীশ বলে, “কেন, দেবী পার্বতী তো উঠেছিলেন”। চাঁদের বুড়ি সংক্রান্ত সংলাপ প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখিত। এই চাঁদের বুড়ির প্রসঙ্গ আরেক জায়গাতেও আসে। ওম যেদিন বন্ধুর জন্মদিন পালন করতে বন্ধুর বাড়ির ছাদে যায়, সেদিনের উৎসব যেন মানুষের চাঁদে অবতরণেরই উপলক্ষে। ঠিক যখন নিল আর্মস্ট্রং তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে চাঁদের মাটিতে পা রাখবেন, তখনই ছাদের উপর এক সাদা চুলের বৃদ্ধার হাসিমুখ আমাদের নজরে পড়ে। ছোটবেলায় শোনা চাঁদের বুড়ির বর্ণনার সঙ্গে এই চরিত্রের অদ্ভুত মিল খুঁজে পাওয়া যায়। এই ধরনের সংলাপ এবং দৃশ্যায়ন প্রথমে অর্থহীন জগাখিচুড়ি মনে হতে পারে। কিন্তু ভারতীয় জীবনদর্শনের কথা ভাবলে, দেখা যাবে যে, আমাদের জীবনে বিজ্ঞান, ধর্ম, আচারবিচার, কুসংস্কার অবিচ্ছেদ্য ভাবে জড়িয়ে আছে। যেখানে সঙ্গতির অভাব পদে পদেই। এর পরিপ্রেক্ষিতে, এই ট্রিট্মেন্ট্ ছবিটিকে অন্য এক মাত্রায় উপস্থিত করে। এই অনন্য উপায়ে ভারতীয় জীবনদর্শনকে তুলে ধরার জন্য পরিচালককে সাধুবাদ জানাতেই হয়।
• গায়ত্রীর চরিত্রের মাধ্যমে নারীস্বাধীনতার বক্তব্য উঠে আসে। তার পুরুষদের জন্য নির্দিষ্ট আসনে বসে সিনেমা দেখা ইত্যাদি এই মনোভাবেরই পরিচায়ক। জগদীশকে সে-ই বাধ্য করে তার সঙ্গে শারীরিক সম্পর্কে লিপ্ত হতে। জগদীশ পাজামার দড়িতে গিঁট পাকিয়ে ফেললে, গায়ত্রী কাঁচি এনে সেটা কাটতে সাহায্য করে। তাদের মিলনের ঘটনাকে বোঝানোর জন্যে পরিচালক এক হাস্যরসাত্মক উপমা ব্যবহার করেছেন। ফিল্মে এই অংশে আমরা দেখি বীর শঙ্কর সাইকেলে চড়ে বাড়ির সামনে ঘুরপাক খাচ্ছেন আর গায়ত্রীর নাম ধরে ডাকছেন। এই দৃশ্যে বীর কিন্তু সশরীরে এসে উপস্থিত হননি। তিনি একটি মেটাফর্, বহু যুগের রক্ষণশীলতার প্রতীক, যা গায়ত্রীর অবচেতন মনে তাকে বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কে জড়াতে বাধা দেয়। অবশেষে বীর শঙ্করের সাইকেল থেকে পড়ে যাওয়ার অর্থ, গায়ত্রী এই বাধা উল্লঙ্ঘন করতে সক্ষম হয়েছে। সিনেমার শেষের দিকে, জগদীশ যখন গায়ত্রীকে নিয়ে সায়ানাইড খেয়ে আত্মহত্যা করতে যায়, তখন সে এই সংকল্প কে ‘ওড়া’র সঙ্গে তুলনা করে। সিনেমার পরিপ্রেক্ষিতে এই ‘ওড়া’ আসলে দ্ব্যর্থক। একদিকে সেটি যেমন মৃত্যুর উপমা, অন্যদিকে সেটি গায়ত্রীর মুক্তির ইঙ্গিত।
আজকের ভারতীয় ছবির পরিপ্রেক্ষিতে, এমন স্বাধীনচেতা নারীচরিত্র হয়তো নতুন কিছু নয়। কিন্তু এটা মনে রাখা দরকার যে, আশির দশকের বলিউডি সিনেমায় মেলোড্রামা এবং রক্ষণশীল ভাবাবেগের আধিক্য ছিল। সেই সময়ে দাঁড়িয়ে, এই রকম বলিষ্ঠ বক্তব্য ও প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গি দর্শকদের সামনে তুলে ধরার সাহস দেখিয়েছেন কমল। এই দিক দিয়েও তো ‘ওম দর ব দর’-কে পথপ্রদর্শক মনে করা যেতে পারে। লক্ষণীয় ব্যাপার এই যে, গায়ত্রীর উপর চিত্রায়িত দৃশ্যগুলির মধ্যে সুন্দর ধারাবাহিকতা আছে, যেটা অন্যান্য চরিত্রদের ক্ষেত্রে বিরল।
• এই ফিল্মে ওমের উপর চিত্রায়িত দৃশ্যাবলি সব চেয়ে বেশি বিমূর্ত বা অ্যাবস্ট্র্যাক্ট। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তার পরীক্ষাভীতি থেকে জন্মানো একটি স্বপ্নের দৃশ্য, ‘রানা টিগ্রিনা’(ব্যাঙ এর বৈজ্ঞানিক নাম) শীর্ষক গান ইত্যাদি। এই সব দৃশ্যে কল্পবাস্তবের উৎকৃষ্ট ও অভিনব নমুনা পাওয়া যায়। এক দৃশ্যে ওম বই পড়ার সময় বলে, “যখনই আমি পড়ার চেষ্টা করি, আমার নাকটা অক্ষরগুলোকে চোখের আড়াল করে দেয়”। এই অবাস্তব উক্তির মাধ্যমে পরিচালক বুদ্ধিদীপ্ত উপায়ে বুঝিয়ে দেন যে, ওম আর আগের মতো নেই, তার নাকের মতো সেও বড় হয়েছে, বয়ঃসন্ধি কালে পৌঁছেছে। এই কথা শুনে ফুলকুমারী তার নিজের রোদ্চশমা ওম এর চোখে পরিয়ে দেয়, তাকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, এবার সে ঠিকঠাক দেখতে পাবে। এর অন্তর্নিহিত অর্থ হল ফুলকুমারীর প্রতি ওম আকৃষ্ট, এবং ফুলকুমারী তাতে যারপরনাই ইন্ধন জুগিয়ে চলেছে। এই সব মেটাফর্-এ কিন্তু ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের কোনও ছাপ নেই। অবচেতন মনের প্রবৃত্তি বোঝাতে বেশির ভাগ পরিচালকই সাধারণত ফ্রয়েডীয় সিম্বলিজম-কে প্রধান হাতিয়ার করে থাকেন। তবে, কমল স্বরুপ এই পথে না হেঁটে, মৌলিক এক উপমাসমষ্টির সৃষ্টি করেছেন। এই স্বকীয়তার জন্য তিনি ভূয়সী প্রশংসাও পেয়েছেন।
• পুষ্করের উল্লেখ এই ছবিতে বারবারই এসেছে। এই পুষ্কর হিন্দুদের কাছে এক পবিত্র তীর্থস্থান। পদ্মপুরাণে কথিত আছে, বহুকাল আগে ব্রহ্মা এই জলাধারের সৃষ্টি করেছিলেন। পুরাণকথায় এও শোনা যায়, তিনি তাঁর পূজার প্রচলন করার জন্য এখানে একটি যজ্ঞ সম্পন্ন করেছিলেন। তাই পুষ্করের তীরেই ভারতবর্ষের একমাত্র ব্রহ্মার মন্দির দেখা যায়। প্রতি বছর কার্তিক মাসে শুক্লপক্ষের সময় দেশের নানান প্রান্ত থেকে পুণার্থীরা এসে পুষ্করমেলায় যোগ দেন। প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী, বছরের এই সময়েই ব্রহ্মা এখানে যজ্ঞ করেছিলেন, তাই এই সময়ে পুষ্করের জলে একবার ডুব দিলে, স্বর্গের পথ প্রশস্ত হয়। ছবিতে পুষ্করমেলার শুরু মজার ছলে বোঝানো হয়। “স্বর্গ পৃথিবীতে নেমে এসেছে”, এই কথা বিমানসেবিকার ঘোষণার আদলে বলা হয়, অর্থাৎ পুষ্করে স্নান করলেই স্বর্গলাভ। এই মেলার সময়, ওমের অলৌকিক ক্ষমতার দৌলতে স্থানীয় ব্রাহ্মণটির ভালই রোজগার হতে থাকে। ওম জলের তলা থেকে বিভিন্ন জিনিস তুলে এনে দেয় আর ব্রাহ্মণটি সেগুলো পুণার্থীদের কাছে বিক্রি করে। এর মাঝেই ‘প্রমিস’ টুথপেস্ট এর প্রচারের জন্যে ওমকে জল থেকে এই দন্তমঞ্জন-এর টিউব তুলে আনার অভিনয় করতে বলা হয়। ধর্মের অছিলায় বাণিজ্যিক কার্যসিদ্ধি করার এই প্রথা তো আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।
• এই ছবিতে কোনও এক যুদ্ধের আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। এই যুদ্ধের ভয়েই লালা লোটামল নিজের হিরেগুলি লুকিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। শুরুর দিকে বীর শঙ্কর বাড়িতে কাগজের রকেট উড়তে দেখে প্রশ্ন করেন, “রকেট কে ওড়াচ্ছে?”। উত্তরে ওম বলে, “আমেরিকা আর রাশিয়া”। এই উক্তি থেকে ধারণা করা যায় যে, এই ছবিতে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কাই ব্যক্ত হয়েছে। সেই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে, রুশ ও আমেরিকার ঠাণ্ডা লড়াই যে রকম চেহারা নিয়েছিল, তাতে এই ধরনের আশঙ্কা একেবারেই অমুলক ছিল না।
এই ছবি নিয়ে লিখতে লিখতে পাতার পর পাতা ভরিয়ে ফেলা যায়, তবুও হয়তো সব কিছু বলা হবে না। আমি যত বার এই ছবিটি দেখি, তত বারই নতুন কিছু খুঁজে পাই, যা আগে চোখে পড়েনি। এতগুলো বছর পেরিয়ে যাবার পরও, এই ছবি নিয়ে মানুষের উৎসাহ কমেনি। সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইট ফেসবুকে এখনও কমল স্বরুপের কাছে এই ফিল্ম নিয়ে বিভিন্ন প্রশ্ন আসে। তিনি খুবই যত্ন সহকারে তার উত্তরও দেন। এই সুত্রে জানাই, এই প্রতিবেদকেরও সৌভাগ্য হয়েছিল ওনার সঙ্গে ফেসবুকে এই ছবি নিয়ে আলোচনা করার। ভারতীয় ফিল্ম তত্ত্ব নিয়ে যদি কোনোদিন বই লেখা হয়, সেখানে ‘ওম দর ব দর’-এর উল্লেখ ভারতীয় ‘অ্যাভঁ গ্যর্দ’-এর পথপ্রদর্শক হিসেবে নিশ্চয়ই থাকবে; কারণ এই সম্মান কেবল কমল স্বরুপ ও তাঁর এই আশ্চর্য ছবিই পেতে পারে।