ষোল বছর / উনিশ বছর, সময়ের হিসেবে অনেক অনেক বছরের পার। সেদিনের শিশু আজ যৌবনে, যুবকযুবতীরা প্রৌঢ়ত্বের দোড়গোড়ায়। এক যুগেরও বেশী সময়, অনেক কিছুই বদলে যায়। শুধু বদলায়না এই পোড়া দেশের বিচার ব্যবস্থা, আইনকানুনের কানাগলি। উনিশবছর আগে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছিল এক বালিকা, অপরাধী এক উচ্চপদস্থ পুলিশ অফিসার। ষোলবছর আগে মেয়েটি নিজের জীবন শেষ করে দেয়। কি তার কারণ, সে প্রশ্ন এখনও বিচারাধীন। তাই সেটা উহ্য রেখেই যাই। আজ এত বছর পরে আদালত পুলিশ সিবিআই সবার দরজায় ধাক্কা দিয়ে দিয়ে বিফল হয়ে শেষে মিডিয়ার দ্বারস্থ মেয়েটীর আত্মীয় বন্ধুরা।
মিডিয়া এখন অন্যরকম, ষোল বছরে অনেক বদল হয়েছে চারপাশের মাধ্যমের। মিডিয়া মানে আর কয়েকটি সংবাদপত্র বা এক আধটি সরকারী নিউজ চ্যানেল নয়। অগুন্তি নিউজ চ্যানেল, অঢেল পত্রিকা, সংবাদপত্র ও সর্বোপরি ওয়েব দুনিয়া। টিকে থাকার লড়াইয়ে তাই মিডিয়া এখন সেলিব্রিটি, হেভিওয়েট পলিটিশিয়ান ইন্ডাস্ট্রী ওয়ালা বা অন্যান্য চিরাচরিত খবরের বাইরে গিয়ে সাধারণ মানুষের হাঁড়ির দিকে মন দিয়েছে। তবে মানুষগুলো তো সাধারণ, তাদের খবর কি করে অসাধারণ হবে? আমরা আমজনতা যারা খবরের খদ্দের তারা এমনিতে তো চাই যে খবর আমাদের নিয়ে হোক, আমাদের দুনিয়ার হোক কিন্তু তাতে রঙচঙ মাল মশলা যেন কম না হয়! অর্থাৎ আমীর খান আর শারুখ খানের ঝগড়া নিয়ে আমাদের আজকাল আর মাথাব্যথা নেই, আমরা পাড়ার যদু ঘোষের সাথে মধু ঘোষের ঝগড়ার খবর চাই কিন্তু বিষয়বস্তু, টার্ণ অ্যান্ড ট্যুইস্ট যেন আমীর শারুখ বা মমতাবুদ্ধ ঝগড়ার চেয়ে কোন অংশে কম না হয়। মানে চিকেনের বদলে উপাদানে পনীর দিলেও আমরা স্বাদগন্ধ বাটার চিকেনেরই চাই।
অতএব মিডিয়ার নতুন অবতার, সাধারণ মানুষের মসীহা রূপে। বিচার যেখানে আইনের ভুলভুলাইয়াতে পথ হারিয়ে ফেলে সেখানে দন্ড হাতে নিচ্ছে মিডিয়া ট্রায়াল। আর সঠিক মশলা ও স্বাদগন্ধের জন্যই বোধহয় শুধু সেইসব ঘটনাই মিডিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করছে যাতে ভিকটিম সাধারণ হলেও অপরাধীরা ওজনধারী।
প্রথমে একটি দুটি করে চ্যানেলে সংবাদপত্রে খবর হয়। লোকে জানে,উৎসুক হয় আরো জানার জন্য। প্রথমে খবরের ভেতরের দিকে, সংক্ষিপ্ত ইন্টারভিউ ইত্যাদি। তার জেরে অল্পবিস্তর সাড়া জাগে আধিকারিকদের মধ্যে। আস্তে আস্তে শুরু হয়ে যায় চাপান উতোর, বিশেষজ্ঞের মতামত, পাবলিকের এস এম এস। এরপর হেডলাইনে এসে যায় খবর। আর এই ধরণের ঘটনার একটা সুবিধে হল একবার শিরোনামে এসে পড়লে তার পরে বেশ কিছুদিনের হেডলাইনের সমস্যা মিটে যায়। মামলা প্রসঙ্গে রোজই নামীদামীরা কেউ না কেউ কিছু না কিছু বলতেই থাকে, অমুক মন্ত্রী তমুক মন্ত্রী, সিবিআই, পুলিশ, নানা কমিশন ইত্যাদিরা, কিছু না কিছু নতুন ব্যবস্থা নেওয়া হয় প্রায় প্রত্যেক দিনই। সেরকম অন্য কিছু খবর না থাকলে এগুলোই হেডলাইন হয়ে যায়। একটু আম ভাষায় বলতে গেলে,সাধারণ পাবলিকে ভাল খায়!
হালে দিল্লীতে এধরণের মিডিয়া দ্বারা হাইলাইটেড কেস জেসিকা লাল, নীতিশ কাটারা এবং প্রিয়দর্শিনী মাট্টু হত্যা মামলা সুবিচার পেয়েছে বা পাওয়ার মত অবস্থায় এসেছে। এভাবেই রুচিকা গিরহোত্রা মামলা আজ উনিশ বছর পরে লোকের নজরে এসেছে মিডিয়ার কল্যাণে। এই মামলার বিশদ সবাই জানে, যারা জানেনা তারাও জানতে পারে সংবাদপত্রে, টিভিতে, ইন্টারনেটে চোখ রাখলেই। সেসব আমার বিষয় নয়। অবশ্য ঠিক কি যে এই লেখার বিষয় তা লিখতে বসে খুব স্বচ্ছ নয় নিজের কাছেও। এ লেখা এই মামলার নানা আলোচনা শুনে মনে যা চিন্তা ভাবনা উঠে আসছে তার একটা কোলাজ মাত্র।
আজ উনিশ বছরে যা হয়নি সেরকম অনেক কিছু হচ্ছে বা হতে শুরু হয়েছে মিডিয়ার হস্তক্ষেপে। অপরাধ: একটি মেয়ের শ্লীলতাহানি, অপরাধী: একজন ক্ষমতাশালী লোক।
মিডিয়ার কাজ সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশন। অন্যায়ের বিচার ও প্রতিকার দেশের শাসন ব্যবস্থা, পুলিশ আদালত এসবের কাজ। যার যা কাজ তা তারা সঠিক ভাবে করাটাই বিধেয়। আমরা সবাই জানি ও বিশ্বাস করি মিডিয়া নি:স্বার্থ মানবদরদী নয়, তারা ব্যবসা করে, খবরের ব্যবসা। কিন্তু তাদের প্রভাব দেশের সাধারণ মানুষের ওপর বিরাট। আর সে কারণেই সরকার ও সরকারী মেশিনারী মিডিয়াকে সমীহ করে চলে। যেখানে যা অপরাধ হচ্ছে এবং সেইসব অপরাধকে কেন্দ্র করে যেসব অন্যায় হচ্ছে সিস্টেমের দ্বারা, সবকিছু মিডিয়ায় আসে না, আসা সম্ভব নয়। অতএব মিডিয়া ট্রায়ালে যেসব কেস ও সংশ্লিষ্ট তথ্যাদি আসবে তার অনেকটাই ফেল সেফ হবে, অর্থাৎ নিজেকে আইনীভাবে বা রাজরোষ থেকে বাঁচিয়ে বাজিমাত করতে যতটুকু করা দরকার মিডিয়া ততটুকুই করবে। তবু যদি লাখে একটাও এরকম কেস মিডিয়া ট্রায়ালে সুবিচার পায় সেটুকুও বড় পাওনা!
ধর্ষণ, শ্লীলতাহানি এধরণের অপরাধ এদেশের মেয়েদের ওপর আকছারই হচ্ছে। রোজকার যা খবরে আসে তার সংখ্যাই অনেক। এছাড়াও কত খবর যে অজানায় থেকে যায় তার কোন হিসাব কোথাও নেই। আজও সমাজে এসব ক্ষেত্রে আসল শাস্তি পায় ভিকটিম, অপরাধী নয়। তাই সবাই জানে এসব অপরাধের নালিশ হয়না বেশীরভাগই। রুচিকার ক্ষেত্রেও এর অন্যথা হয়নি। তাকে স্কুল থেকে বার করে দেওয়া হয় তুচ্ছ স্কুল ফি জনিত কারণ দেখিয়ে। উল্লেখযোগ্য হল স্কুলটি একটি মিশনারী স্কুল। ঈশ্বর নিবেদিতপ্রাণ, মানবদরদী মিশনারী গ্রুপের তৈরী স্কুল।
তাই মিশনারী স্কুলের ছাত্রী হিসেবে যে ধ্যান ধারণা মূল্যবোধ তিলতিল করে গড়ে উঠেছে, জীবনের অনেকটা জুড়ে আছে তা আজ কেমন যেন প্রশ্নচিহ্ন হয়ে যাচ্ছে। একবার মনে হচ্ছে যে না আমাদের স্কুল অন্যরকম ছিল, সেখানে এরকম হতনা। আবার মনে হচ্ছে যদি এরম হত তাহলে কি সেইসব সিস্টার মাদার সুপিরিয়র যাদের সান্নিধ্যে মনে হত ঈশ্বরের কাছাকাছি আছি, টীচাররা যারা এককালে রোল মডেল ছিল তারাও কি এমনিই করত?
আজকাল এমনটাই হয়, মিশনারী স্কুলের চরিত্র বদলে গেছে, এই বলে উড়িয়ে দিতেও পারিনা, এযে উনিশ বছর আগের কথা!
প্রশ্ন শুধু স্কুলকে নিয়ে নয় নিজেকে নিয়েও, নিজেদের মত অনেককে নিয়ে। আরাধনা, রুচিকার বন্ধু। রুচিকার প্রতি অন্যায়ের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী। মেয়েটির সাক্ষাতকার থেকে চোখ ফেরাতে পারা যাচ্ছিলনা। একটি অত্যন্ত সাধারণ মেয়ে, আমাদেরই আশেপাশে আর পাঁচটা মেয়ের মত। সাবরিনা লাল বা নীলম কাটারার মত উজ্জ্বল বা ব্যক্তিত্বশালী নয়। বিয়ে হয়ে গেছে, ছেলেপুলে নিয়ে সুখের সংসার। ছোটোবেলার ঘটনার কথা ভুলে গিয়ে বিশেষ করে বান্ধবী যখন আর এ জগতে নেই, সুখী জীবনে মেতে যেতে পারত। কিন্তু না, সে এখনও বান্ধবীর অপরাধীকে শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। তার মা বাবা, একটি অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবার। তারাই প্রথম মেয়ের বন্ধুর প্রতি অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন, তারপরে এই দীর্ঘ সময় ধরে পরিবারটি রুচিকার লড়াই লড়ে চলেছেন তার পরিবারের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। কেন? জানালেন একজন মেয়ের বাবা হিসেবে উনি চেয়েছিলেন একজন বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে করা এধরণের অপরাধে অপরাধী জঘন্য লোকটি শাস্তি পাক। কজন পারে? ক্ষতি বই লাভ কিছু হয়নি তাদের। আরাধনার বাবা আনন্দ প্রকাশকে চাকরি থেকে সময়ের আগেই অবসর নিতে হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে নানা কেস, পুলিশে রিপোর্ট ইত্যাদি করে তাকে উত্যক্ত করা হয়েছে। এতসব করেও এদের ফেরানো যায়নি।
আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়ত কত ধরণের ছোট বড় অন্যায় হচ্ছে প্রতিবেশীদের সাথে, বন্ধুদের সাথে, সহকর্মীদের সাথে। কজন আমরা অন্যের ওপরে হওয়া অন্যায় নিয়ে প্রতিবাদ করি, লড়াই করি যদি না তাতে আমাদের কিছু লাভ থাকে? আবার মনে সেই সন্দেহ নিজেকে নিয়ে, আমারও তো ছিল এইবয়সে এরকমই এক বন্ধু, দুজনে একসাথে সবখানে সবকাজে। তার সাথে কিছু হলে আমি বা আমার বাড়ির লোক কি পারতাম আরাধনাদের মত হতে!
এদেশে যেখানে রাস্তায় অ্যাক্সিডেন্টে আহত লোক পড়ে কাতরায় আর সব পাশ কাটিয়ে চলে যায় কেন না হাসপাতালে নিয়ে যেতে গেলে পুলিশ রিপোর্ট হবে, ঝ্ঞ্ঝাটের ব্যাপার। এ নিয়ে আলোচনা হলে শিক্ষিত বিবেকবান লোকেরা দেশের বাজে সিস্টেমকে আর সরকারকে গালাগালি দিয়ে নিজেদের বিবেক ধুয়ে ফেলি। সেই খানে আরাধনা ও তার বাবা মাকে দেখে অবিশ্বাস করব এ আর আশ্চর্য কি!
অপরাধীর উকিলরা আমাদের মত লোকেদের মানসিকতার সুযোগ নিয়েই এদের ওপর কাদা ছেটানোর জন্যে নিত্যনতুন ওজর খুঁজে বেড়াচ্ছে। কিন্তু তাও আজ পর্যন্ত আনন্দ প্রকাশের সার্ভিস রিপোর্ট সুবিধের নয় ছাড়া আর কোনো কিছু তার বিরুদ্ধে বলতে পারেনি। পারবে কি করে, এ ধরণের মানুষ তো ওদের আমাদের সবার হিসেবের বাইরের!
এখন আবার রুচিকার চরিত্রের দিকেও আঙুল তোলা শুরু হয়েছে। ওপক্ষের উকিলটির যুক্তিগুলি বেশ, শুনে অনুভূতিটা ঠিক কি হওয়া উচিৎ ভাবতে ভাবতেই রেশটা চলে যায়। যেমন তার ক্লায়েন্টের অপরাধের বিরুদ্ধে কোনো ডকুমেন্টাল এভিডেন্স কেউ দেখাতে পারেনি। যৌন নিগ্রহের ডকুমেন্টাল এভিডেন্স? বিশেষ করে যেখানে প্রত্যক্ষদর্শী সরব!
এছাড়া এত পুরনো কেস আজ কেন সংবাদে আসছে? বেশ তো কোর্টের আনাচেকানাচেই বদ্ধ ছিল পুরো ইস্যুটা। আইনের মারপ্যাঁচ করে আইনজীবিদের দুপয়সা হচ্ছিল। সিবিআই তো এ কেসকে পাত্তাই দেয়নি সেভাবে। খামকা মিডিয়াতে নিয়ে এসে জটিলতা বাড়ানোর কোনো মানে হয়! এ প্রশ্নের উত্তরে আনন্দ প্রকাশ জানান একাধিক সংবাদপত্রের একাধিক সাংবাদিকের বিরুদ্ধে সেইসময়ে এই কেস নিয়ে লেখার জন্য মানহানির মামলা করা হয়েছে। এভাবেই সেদিন সংবাদমাধ্যমের মুখ বন্ধ করা হয়েছিল। আজ একসাথে এত সংবাদমাধ্যমে এই কেস শিরোনামে, যে মানহানি কেস করতে গেলে হয়ত রাজার ধনেও কুলোবেনা।
টিভি খুলে একের পর এক নানা ভাষার এত নিউজ চ্যানেল দেখে বিরক্ত বোধহয় আর হওয়া যাবেনা!
------------------------------------------------------------------------------------------
একটি কুচকুচে কালো মুখমন্ডলে শুধু চোখে পড়ার মত দুটো চকচকে চোখ, সরল সে চোখের দৃষ্টি। সে ছিল ভূমিকন্যা। ঝাড়খন্ডের কোন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে পাটনার দালালের হাত ধরে দুমুঠো খাবার জোটাতে রাজধানীতে, আলোকপ্রাপ্ত পরিবারে কাজের মেয়ের ভূমিকায়। গৃহস্বামী বঙ্গসন্তান, বড় এক্সিকিউটিভ, স্ত্রী সরকারী কর্মচারী। চেহারাটা কোনোদিন বুঝিনি, রোগা না মোটা, বেঁটে না লম্বা। বার তের বছর বয়সী মেয়েটীর পরনে সবসময় স্বাস্থ্যবতী গৃহকর্ত্রীর পরিত্যক্ত বেঢপ সাইজের পোষাক। ওর নিজস্ব চেহারাটা তাতেই চাপা পড়ে যেত। আশেপাশের লোকজন তাকে খুব একটা চোখে দেখেনি। পড়শী হওয়ার সুবাদে আমার ওপর ভার পড়েছিল পরিবারের লম্বা ট্যুর গুলিতে মাঝে মাঝে কলিংবেল বাজিয়ে মেয়েটীর খোঁজ নেওয়ার। বাইরের জালের দরজায় চাবি থাকত, ভেতরের কাঠের দরজাটি খুলে আমার দিকে তাকিয়ে কালো মেয়ে ঝকঝকে সাদা দাঁতগুলো মেলে হাসত। কখনো সখনো জালের ফাঁক দিয়ে কিছু খাবার দিলে উজ্জ্বল হয়ে উঠত খুশীতে আর আমার মনে পড়ত চিড়িয়াখানার খাঁচা দিয়ে হাত বাড়িয়ে পশুদের খাবার দেওয়ার কথা। কোনোদিন বেশী কথা হয়নি, একটু অদ্ভুত উচ্চারণ ছিল, ভাল বোঝা যেতনা। আন্দাজে দু একটা কথা। এসব সুযোগেও কোনোদিন কোনো নালিশ জানায়নি আমার কাছে। আমরা শহুরে শিক্ষিত লোক, প্রতিবেশীদের অন্দরে উঁকি দেওয়া বেয়াদপি মনে করি। তাই কোনোদিন জানতে চাইনি দুবছরে মেয়েটিকে কোনো ছুটি দেওয়া হয়নি কেন, কোনোদিন সে বাড়ী যায়না কেন!
প্রায় বছরখানেক হয়ে গেছে ওদের বাসা বদলের, মনে পড়েনি মেয়েটির কথা। একদিন হঠাৎই শুনলাম মেয়েটি ফাঁকা বাড়ী ফেলে কাউকে কিছু না বলে চলে গেছে। তখন আবার মনে পড়ে গেল ওর কথা। সঙ্গে নিয়ে গেছে নিজের একটি বাক্স ও শ পাঁচেক টাকা। এত বছরে নানা সময়ে আসন্তি যাওন্তি লোকে যা দিয়েছে ওকে তাই জমা করে রোজগার। বাড়ির অন্য কিছু স্পর্শও করেনি। অনেক প্রশ্ন আমার মনের মধ্যে, সঠিক উত্তর পাইনা কারণ ভদ্র সমাজে সবসময় সবকথা বলা যায়না, জানতে চাওয়া যায়না। কাজের লোক চলে যাওয়ায় স্ত্রীকে কত অসুবিধা ভোগ করতে হচ্ছে তার বর্ণনা শুনতে শুনতে ভদ্রলোকের কাছে সহানুভূতি প্রকাশের বিনিময়ে যা জানা গেল।
মেয়েটি বিহারের রাজধানীর এক দালালের (ভদ্র ভাষায় এজেন্সী) কাছে পাওয়া। এতদিন ধরে সে যাদের বাড়িতে আছে তারা জানেনা মেয়েটির বাড়ী ঠিক কোথায় বা তার কে কে আছে। মাইনে দালালকে দেওয়া হয়েছে (তবে এ প্রশ্নের জবাবটা এতই আবছা যে সন্দেহ হয় দালালের পয়সাটা বোধহয় এককালীন বন্দোবস্ত)। মেয়েটীর কোন চেনা পরিচিত নেই শহরে। এই ক বছরে তাকে কাছাকাছি বাজার দোকান ছাড়া কোথাও নিয়ে বেরোয়নি এরা। পালানোর বিরুদ্ধে এত কিছু সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নেওয়ার পরও কি করে মেয়েটী অচেনা অজানা জায়গায় একা একা বেরিয়ে যেতে পারল তা ভেবে পুরো পরিবারই ক্ষুব্ধ।
একটা এরকম মেয়ের পক্ষে এ সত্যিই দু:সাহস! কিন্তু কি এমন হয়েছিল যার জন্য মেয়েটি এমন হঠকারী কাজ করার সিদ্ধান্ত নিল?
পুলিশে খবর দেওয়ার কথাটাও কেমন এদিক সেদিক করে ঘুরিয়ে দেওয়া হল। শুধুশুধু পুলিশে খবর দিলে ঝামেলা করবে। মেয়েটী নাকি কদিন ধরেই বাড়ি যাবার কথা বলছিল, অতএব ও বাড়িই গেছে সেটা নিশ্চিত। কি করে পাঁচশ টাকা নিয়ে একটা অশিক্ষিত মেয়ে অচেনা শহরে খুঁজে খুঁজে স্টেশনে গিয়ে ঠিকঠাক ট্রেন ধরে, বাস ধরে রাস্তা চিনে নিজের বাড়ী পৌঁছবে? নিজের সীমা ছাড়িয়ে একটু অভদ্রতা করে গায়ে পড়েই বলতে গেছি সেই দালালের সঙ্গে যোগাযোগ করে মেয়েটির বাড়িতে খবর নেওয়ার কথা। একথা ওকথায় মনে হয় সে দালালের সঙ্গেও যোগাযোগ আর নেই ( এথেকেই এককালীন ব্যবস্থার সন্দেহ!)।
আজও জানিনা, জিজ্ঞেস করেও সঠিক জবাব পাইনি মেয়েটি বাড়ি পৌঁছেছিল কিনা বা তার কোনো খবর শেষ অবধি এরা পেয়েছিল কিনা!
দিল্লী শহর ও আশেপাশে ছড়িয়ে আছে এক ধরণের এজেন্সী, কাজের লোক যোগান দেওয়ার। আজকালকার আধুনিক নিউক্লিয়ার পরিবারে এরা এক মস্ত ভরসা। এজেন্সীর সঙ্গে কনট্র্যাক্ট করে কাজের লোক পাওয়া যায়। মাইনে বাবদ টাকাও এজেন্সী পায়, এইসব কাজের লোক বা তাদের বাড়ির লোক কি পায়, কত বাদ দিয়ে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায়না। এইসব মেয়েরা বা মহিলারা বেশীরভাগই আসে বিহার ঝাড়খন্ড উড়িষ্যা ছত্তিশগড়ের প্রত্যন্ত পিছিয়ে পড়া অঞ্চল থেকে। বাঙালী কাজের লোক এসব জায়গায় প্রচুর হলেও এজেন্সী দিয়ে কমই আসে। দুরকমের কাজের লোক থাকে, স্কিলড ও আনস্কিলড। স্বাভাবিক ভাবেই স্কিলডের রেট অনেক বেশী হয়। স্কিলডরা মোটামুটি অনেক অভিজ্ঞ হয়, কিছুক্ষেত্রে অল্প লেখাপড়া জানাও। তাদের বাড়ীটাড়ীর সঙ্গেও যোগাযোগ থাকে, তারা নিয়ম করে বছরে বাড়ী যায়। যখন তারা ছুটি নেয় তখন এজেন্সী খদ্দেরকে পরিবর্তে অন্য লোকও দেয় কিছুদিনের জন্য।
কিন্তু এই আনস্কিলড কাজের লোকেরা একেবারেই অল্পবয়সী আনকোরা হয়, টাকাও কম লাগে। এরা যে কিভাবে আসে, এজেন্সী কি ভাবে এদের সংগ্রহ করে সেটা কখনই পরিস্কার নয়। চেনা লোকের অভিজ্ঞতা থেকে দুটি ঘটনা বলছি। এধরণেরই একটি মেয়েকে বাড়ী যাচ্ছে বলে নিয়ে গিয়ে এজেন্সী থেকে অন্য এক জায়গায় কাজে লাগায় রিপ্লেসমেন্ট হিসেবে কিছুদিনের জন্য। পরে মেয়েটীকে প্রশ্ন করে জানা যায় সে আদৌ বাড়ী যায়নি। বাড়ী সম্বন্ধে এরা পরিস্কার কিছু বলেনা। হয় বারণ থাকে নয় বলার মত কিছু থাকেনা। হয়ত অভাবী বাড়ি থেকে টাকার বিনিময়ে চিরতরেই দিয়ে দেওয়া হয়েছে কন্যাসন্তানটিকে!
আমার দ্বিতীয় জানা ঘটনাটি আরও ভয়ংকর।
কথা বলে জেনেছি লোকে এজেন্সী থেকে রাতদিনের লোক নিতে পছন্দ করে তার কিছু কারণ আছে। প্রধান হল দরকারে রিপ্লেসমেন্ট পাওয়া যায় আর দ্বিতীয়ত মালিকদের সপরিবারে কোথাও যাওয়ার থাকলে কাজের লোককে এজেন্সীর দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়া যায়, একা বাড়ীতে রেখে যাওয়ার ঝুঁকি নেই। এও চুক্তির মধ্যেই থাকে। এক বান্ধবী এরকমই ভাবে তার কাজের মেয়েটিকে এজেন্সীর কাছে রেখে গিয়ে ফিরে এসে মেয়েটির কাছে জানতে পারে এজেন্সীর লোক এই কদিন তাকে দেহব্যবসায় ভাড়া খাটিয়েছে!
আমাদের আশেপাশে এরকম কত কত ঘটনার দিকে আমরা চোখ বন্ধ করে থাকি বা থাকতে বাধ্য হই আধুনিকতা আর সভ্যতার দোহাইয়ে। আরাধনাদের পরিবারের মত পরিবারকে কেউ কোনো পুরস্কার দেবে কিনা জানিনা, মিডিয়া কতটা মাতামাতি কতদিন করবে তাও জানতে চাইনা। তবু এদের মনে করব আমরা না করা অনেক প্রতিবাদের কথা ভাবলে, অন্যায় দেখে চোখ বন্ধ করে নেওয়ার মুহূর্তগুলোতে, ভাবব এদেরই কথা!
২৫ জানুয়ারী, ২০১০