১। বদ্ধ
প্রেক্ষিত বুঝলে ভায়া, সব-ই হচ্ছে গিয়ে প্রেক্ষিত। কথা কওয়ার আগে বোলনেওয়ালা আর শুননেওয়ালা, দুজনের প্রেক্ষিত বুঝতে হবে। তা না হলেই গন্ডগোল।
যেমন এই যে আমাদের কাটজু স্যার। সম্প্রতি তিনি তাঁর ফেসবুকের দেওয়ালে 'গে ম্যারেজ'-এর বিরুদ্ধে লিখেছেন। গে ম্যারেজ ঠিক নয় কেন না এতে প্রজন্ম পয়দা হয় না। লিখতেই পারেন, ওনার দেওয়াল, উনি সেখানে লিখুন, টাইলস বসান, পোস্টার সাঁটুন কি হিসি করুন সেটা তাঁর ব্যাপার। কিন্তু তাঁর মত একজন প্রায় সেলেব্রিটি স্ট্যাটাসের মহান মনিষ্যি যদি এক কথায় "উচ্চ ফলনশীল নহে" অতএব পরিত্যাজ্য এই বলে গে ম্যারেজকে দাগিয়ে দেন তবে তো কথা উঠবেই। ভারতীয়্ সংস্কৃতির প্রেক্ষিতটা ভাবতে হবে না? মা ষষ্ঠীর আশির্বাদই সব হল? ভগবান কৃষ্ণ না হয় আক্ষরিক অর্থে বানের জলেই ভেসে বৃন্দাবন পৌঁছেছিলেন, তা বলে তার কথার একটা ভ্যালু নেই? তিনি না বলে গেছিলেন, মা ফলেষু কদাচন? এখন ফল দিয়ে বৃক্ষবিচার করলে সেটা ভারতীয় সংস্কৃতির খিলাফ হয়ে যাবে না? ফল ফলুক আর নাই ফলুক, আজ বসন্ত।
আপাতত কাটজু স্যারের কথা মুলতুবি থাক। আগের পর্বে কথা দিয়েছিলাম এই বার কোনো ঘ্যানঘ্যান করব না, কিছু মজার ঘটনা শেয়ার করব। অতএব তাই করা যাক...কিঁউ কি ম্যায়নে হাস্নে কা ওয়াদা কিয়া থা কভি।
গণেশ আমাদের বাড়িতে আসার পরের থেকে বাড়িটা আরো বেশি জমজমাট হয়ে উঠেছে। যারা আমাদের বাড়ির ডেমোগ্রাফি ভুলে গেছেন, তাদের জন্য একটু রিক্যাপ করে দেই। আমাদের এই দোতালা বাড়িটায় পাঁচটি শোবার ঘর, আমরা পাঁচজন ভাড়াটে। রান্না-খাওয়া আর হ্যাজানোর জায়গা কমন। এই পাঞ্চজন্য বাড়ির জনবিন্যাস নিম্নরূপ- আমি আর গণেশ দেশি বাকি তিনজন ফিরং। ড্যান এবং আইলীন স্ট্রেট এবং কাপল, বাকি তিনজন সমপ্রেমি। আইলীন এবং মারিয়া মহিলা, বাকি তিনজন পুরুষ। মারিয়া এবং আমি গোমড়াথেরিয়াম, বাকি তিনজন হাসিখুশি আড্ডাবাজ। আমি আর ড্যান শরীর বানানোর থেকে আয়েশ করায় বিশ্বাসী, বাকি তিনজন জিম করবেট।
গণেশ আসার পরের থেকে ড্যান, আইলীন, আর কাবাব মে হাড্ডী গণেশের সান্ধ্য আড্ডা একটা নিয়মিত ব্যাপার হয়ে দাঁড়াল। আমার শোওয়ার ঘরটা যেহেতু সার্বজনীন বসার ঘরের পাশেই তাই আড্ডা পার্টির নজর এড়িয়ে ঘরে সেঁধিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ড্যান-আইলীনকে তবুও টায়ার্ড লাগছে বলে কাটানো যেতে পারে কিন্তু গণেশ আমাদের খাঁটি ভারতীয় আতিথেয়তায় বিশ্বাসী। একবার ডাকলে আর রক্ষে নেই। আরে আ যাও, টায়ার্ড-ফায়ার্ড গুলি মারো, কাজ তো কর রিসার্চ, তাও কোনো সত্যি মেহনতের কাজ করলে বুঝতাম, বসো বসো। মাইক্রোস্কোপে চোখ লাগিয়ে বসে থেকে আবার কেঊ ক্লান্ত হয় না কি? আর সেই কথা শুনে আমার খাণ্ডবদাহন হয়ে যেত। করিস তো সোশিওলজিতে পিএচডি, বায়ো-রিসার্চের তুই কি বুঝবি র্যা, বাচ্চা ছেলে? আমার রাগ দেখে গণেশ আর আইলীন আরো হাসাহসি জুড়ত। ওদের সন্মিলিত পেছনে লাগা থেকে একটা ব্যাপার বুঝেছিলাম, একজন সুন্দরী মহিলা আরেকজন পুরুষের সঙ্গে দল পাকিয়ে তোমার লেগ পুলিং করলে গে হও বা স্ট্রেট , জ্বলবেই। তবে মুখে যাই বলি না কেন, একটা কথা স্বীকার করতেই হবে, মিনিট পাঁচেক গপ্পে বসলেই সারাদিনের ক্লান্তি উধাও হয়ে যেত। তারপর এক দু ঘন্টা যে কোথা দিয়ে কেটে যেত বোঝা যেত না। বিশেষত শুক্রবার বা শনিবার হলে তো কথাই নেই, আড্ডা রাত দেড়টা দুটো অবদিও গড়াত। মাঝে মাঝে গণেশ উঠে গিয়ে এটা ওটা বানিয়ে আনত সঙ্গে কিছু একটা পানীয়, আড্ডার ফুয়েল। আইলীনের ধারনা ছিল আমার আর গণেশের মধ্যে কিছু একটা চলছে। সেতো ওর ধারনার কোনও অভাব নেই। ওর ধারনা আমি ক্যান্সার নিয়ে কাজ করি, আর একটু কাজ করলেই ক্যান্সারের ওষুধ বার করে ফেলব আর তারপর আমার নোবেল পাওয়া ঠেকায় কে? বহুবার বলেও ওর এই ধারনা আমি পাল্টাতে পারি নি। ওর আরো ধারনা ছিল যে পৃথিবীতে খুব তাড়াতাড়ি সমস্ত মানুষের সাম্য প্রতিষ্ঠা হবে, ছোটবড় বলে কিছু থাকবে না এবং সেই সাম্যের নেতৃত্ব দেবেন ওবামা। তবে যতই সাম্য হোক না কেন জগতসভার শ্রেষ্ঠ আসনটি কিন্তু থাকবে আমেরিকার দখলে। সাম্যেরও প্রেক্ষিত থাকে ভায়া। আমেরিকার সাম্য আর কোস্টারিকার সাম্য কি এক হবে? সে যাই হোক, জগতজোড়া সাম্যও প্রতিষ্ঠা হল না আর আমারও গণেশের কলাবৌ হওয়া হল না। বেচারা আইলীনের যাবতীয় ঘটকালি আমি আর গণেশ আড়ালে আবডালে হ্যা হ্যা হি হি করে ভেস্তে দিলাম।
গণেশের সঙ্গে আমার প্রায়ই এটা ওটা নিয়ে তর্ক হত। কখনো কখনও মনে হত ও ইচ্ছে করে মজা নেওয়ার জন্য আমার সাথে তর্কে জুড়ত। সেইসব অকারন তর্কের বিষয় কুম্ভকর্ণ থেকে কেজরিওয়াল, সব কিছুই ছিল। আমি আমার জ্ঞানের বোঝা উপুড় করে তর্ক করতাম। আমার সমস্ত বক্তব্য শেষ হওয়ার পর ওই এম আই টিতে সোশিওলজি নিয়ে পড়াশুনো করা হতচ্ছাড়া কোথা থেকে কি সব থিওরি এনে উপস্থিত করত। যা কিছু আমি এতক্ষণ ধরে বললাম এই সবই যে অন্তঃসারহীন, সেলফ কন্ট্রাডিকটরি অথবা ভুল তা নাকি অমুক সালে তমুক সমাজবিজ্ঞানী একেবারে জলের মত পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। অতএব এই বিষয়ে আর কোনো কথা থাকতে পারে না। আমি আরো কিছুক্ষণ এঁড়ে তর্ক করার চেষ্টা করতাম। গণেশ খানিকবাদে আমাকে একেবারে তুচ্ছু করে দিয়ে বলত, “বাদ দাও, তোমাকে আমি আর বোঝাতে পারব না, বরং বইটা দেব পড়ে নিও”। তবে অনেক সময় আমি ড্যানের সাহায্য পেয়ে যেতাম। ড্যান ইতিহাসের শিক্ষক, বেশ কিছু বছর প্রাচ্যে কাটিয়েছে, ফলত জানাবোঝার পরিধিটা অনেক বড়। ড্যানের আরেকটা গুণ ছিল ওর ধৈর্য আর স্থিরতা। তাই যখন আমি আর গণেশ বাকযুদ্ধ করতাম, আইলীন গোল গোল চোখ করে তাকিয়ে থাকত, তখন ড্যান শান্তভাবে হাসতে হাসতে এমন একটা কিছু বলত যেটা আমরা দুজনেই মেনে নিতে বাধ্য হতাম।
এই গণেশ আর আইলীনের মধ্যে একটা মজার ঘটনা ঘটল আর আমি ওকে জব্দ করার একটা ব্রহ্মাস্ত্র পেয়ে গেলাম। আবারও সেই প্রেক্ষিত না বোঝার ফল। ঘটনাটা খুলে বলি।
সেদিন শনিবার। বেশ অনেক রাত অব্দি বসে গণেশ, আইলীন আর আমার আড্ডা চলছে। এক সময় ঘুম পেয়ে যাওয়াতে আমি শুতে চলে গেলাম। তখনো ওরা দুজন প্রবল উতসাহে গপ্পো করে চলেছে। পরেরদিন ঘুম ভাঙলো দরজায় আইলীনের কড়া নাড়ায়। সাধারনত বেডরুমের দরজা ধাক্কানো শিষ্টাচার বিরোধী। তার ওপর আবার রোববার সকালে এইভাবে ঘুম থেকে তোলা তো রীতিমত মানবাধিকার লঙ্ঘন। বুঝলাম কিছু একটা গোলমাল হয়েছে। দরজা খুলতেই আইলীন বিষম চিন্তিত মুখে জানতে চাইল যে গণেশকে আমি কতদিন ধরে চিনি আর ওর সবকিছু নর্মাল কি না। আমি একটু ঠান্ডা মাথায় প্রেক্ষিতটা বোঝার চেষ্টা করলাম। সবকিছু তো নর্মাল নয়-ই। একে গে তার ওপর আবার আই আই টি থেকে ইঞ্জিনীয়ারিং পাশ করে চাকরি বাকরি না করে সমাজবিদ্যায় গবেষনা করছে। উন্মাদ আর কারে কয়। যে মানুষ গে বারে গিয়ে বার ড্যান্সারদের সামাজিক ইতিহাস বোঝার চেষ্টা করে, সে যে স্বাভাবিক নয় সেটা রামদেব বাবাও বলে দেবে। কিন্তু আইলীনের প্রশ্নের কারন নিঃসন্দেহে এইসব নয়, অন্য কোনও গুরুতর ঘটনা ঘটেছে। ওকেই জিজ্ঞেস করলাম ব্যাপারখানা কি। তাতে যা বলল তাতে আমার পেটের ভেতর হাসি গুড়গুড়িয়ে উঠলেও বাইরে গম্ভীর থাকতে হল। ঘটনাটা হল এই, রাত্রে ওদের গপ্পো চলতে চলতে কেমন করে যেন ইরাক-আফগানিস্থানে পৌঁছে গেছিল। তাতে গণেশ বলেছে যে লাদেনকে ওইভাবে বিনা বিচারে মেরে ফেলাটা ঠিক হয় নি। কিন্তু আইলীনের ব্রেন 'বিনা বিচারে' শব্দদুটোকে বিনা বিচারে ছেঁটে দিয়েছে। ব্যাস, আর যায় কোথায়? লাদেনকে হত্যার বিরোধিতা করেছে অর্থাৎ লাদেনকে সমর্থন করেছে, অর্থাৎ সন্ত্রাসবাদীদের সমর্থক অর্থাৎ নিজেই সন্ত্রাসবাদী। সহজ সরল ইকুয়েশান। বেচারি আইলীনের সারা রাত টেনশানে ঘুম হয় নি। সকাল হতেই ছুটে এসেছে আমার কাছে। একবার ভাবলাম খেলাটা আরেকটু জমাই। তারপর ভয় হল হয়ত পুলিশ টুলিশ ডেকে বসবে। সে হবে আরেক মুশকিল। তাই ওকে ধীরে সুস্থে সময় নিয়ে বোঝালাম। ওর ভাষাতে। বললাম যে আমেরিকার মত এমন মহান, এমন মহাশক্তিধর, এই বিশ্বের পরিত্রাতা, বিশ্বশান্তির প্রতিষ্ঠাতা, মানবাধিকারের উদ্গাতা দেশ যদি ওই ক্ষুদ্র চুনোপুঁটি লাদেনকে বন্দী করে আনতে পারত তবে পৃথিবী অবাক বিস্ময়ে দেখতে পারত আমেরিকার বিচারব্যবস্থা কত ত্রুটিহীন। লাদেনকে মেরে ফেলায় এই অভাবনীয় সু্যোগটা হাতছাড়া হয়ে গেল। আইলীন প্রেক্ষিতটা বুঝল এবং নিশ্চিন্ত হল। এর পরের থেকে যখনই আমার আর গণেশের তর্ক হত, ওকে এই ঘটনাটা নিয়ে খোরাক করতাম। 'এত বিদ্যে দিয়ে কি লাভটা হল, আরেকটু হলেই তো আইলীন জেলে পাঠিয়ে দিচ্ছিল। নেহাত আমি সময়মত রক্ষা করলাম, তাই'।
এর মধ্যে বাড়িতে একদিন কয়েকজন বন্ধুবান্ধবকে খেতে ডেকেছিলাম। তার মধ্যে রেখা আর আলিশাও ছিল। ওদের আগেই ফুটফুটে দুটো যমজ হয়েছিল আলিশার গর্ভে, সাম্প্রতিক কালে রেখা অন্তসত্ত্বা। ওরা চলে যাওয়ার পর আমরা চারমূর্তি বসে গল্পগাছা করছিলাম। কথাবার্তা ঘুরতে ঘুরতে গে ম্যারেজ, লেসবিয়ান কাপল, আই ভি এফ, দত্তক ইত্যাদি হয়ে কিভাবে যেন কাটজুতে পৌঁছে গেল। আমি বললাম যে প্রাক্তন বিচারপতি কাটজু মনে করেন, বিয়ের কেন্দ্রীয় উদ্দেশ্য সন্তান উতপাদন ও প্রতিপালন। তাই যেহেতু গে কাপলদের সন্তান হবে না, তাই গে ম্যারেজ অর্থহীন। আইলীন হঠাৎ রেগে গেল। কাটজুর উদ্দেশ্যে কিছু বাছা বাছা গালাগাল দিয়ে শুতে চলে গেল। খানিকবাদে ড্যানও চলে গেল। আইলীন যদিও তুমুল এলজিবিটি সমর্থক তবু এরকম রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলাম না। সম্ভবত রেড ওয়াইন একটু বেশি হয়ে গেছে। ওরা দুজন চলে যাওয়ার পর আমি এই কথাটা গণেশকে বলতে ও অবাক হয়ে আমাকে বলল, ও তুমি জান না? আমি বললাম, কী জানব?
আইলীনের জরায়ুর ক্যান্সার হয়েছিল, তাই ওর জরায়ু বাদ দিতে হয়েছে। ও কখনও গর্ভধারণ করতে পারবে না।
-ওর সাথে তো ড্যানের বিয়ে আগামী জুলাইতে?
-তো?
এক মুহূর্তে আমার কাছে সমস্ত প্রেক্ষিতটা পরিষ্কার হয়ে গেল। কেন আইলীন রেগে গেল, কেন ও আমাকে ক্যান্সার গবেষক মনে করে আর কেনই বা ও বিশ্বাস করে যে আমার গবেষণার ফলে এক দিন না এক দিন সমস্ত ক্যান্সারের ওষুধ আবিষ্কার হয়ে যাবে এবং আর কাঊকে অপারেট করাতে হবে না। এটা ভেবেও লজ্জা লাগল যে আমি আইলীনের সঙ্গে আছি গণেশের থেকে অনেক বেশি দিন। তবুও এই কদিনে গণেশ যা জানে আমি সেটা জানি না। বুঝলাম, পাশাপাশি থাকাটাই সব নয়। চোখ, কান আর মন খোলা রাখাটাও দরকারি।
২। মুক্ত
অভিজিত রায়কে আমি চিনতাম না। তবুও অভিজিৎ ছিলেন আমার আরেক সিঁড়িওয়ালা। সমপ্রেম সম্পর্কে মুক্তমনায় তাঁর লেখা আমার বাংলা ভাষায় পড়া এই বিষয়ক প্রথম প্রবন্ধ। আমি ওই লেখাগুলোকে একসাথে রেখেছি। যদি কখনও এমন কাউকে পড়াতে হয় যিনি বাংলায় অধিকতর স্বচ্ছন্দ এই ভাবনায়। ঋতুপর্নর পর আমার আরেক সিঁড়িওয়ালা চলে গেল। চলে গেল বলছি কেন, শেষ করে ফেলা হল। সিঁড়িওয়ালাদের সমাজ এইভাবেই মেরে ফেলে, কখনও হাতে, কখনও ভাতে আর কখনও আঁতে ঘা দিয়ে। তারই ফাঁকে ওরা একটা দুটো ধাপ বানিয়ে দিয়ে যায়। আমরা নতুন ধাপ বানাতে পারি আর না পারি, ওদের বাঁচাতে পারি আর না পারি, অন্ততপক্ষে ওদের বানানো ধাপগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারব এই আশা করি। ভালো থেকো অভিজিৎ, ভালো থেকো সিঁড়িওয়ালা।
সুন্দর