
গত এক বছরে আমাদের চারপাশে হিংসা ও অসহিষ্ণুতার এক দুর্ভাগ্যজনক ঊত্থান লক্ষ্য করছি। জানি না, সেটা হয়ত সব সময়ই ছিল, হতে পারে আজকাল মিডিয়ার কল্যাণে সেটা বেশি করে নজরে পড়ছে। ধর্ষণ তো কখন যে গা সওয়া হয়ে গেছে, নিজেরাই বুঝতে পারি নি। এখন যেন ‘গন’ না হলে বিবেকে তেমন ধাক্কা লাগে না। তার ওপর যদি আক্রান্ত মানুষটি প্রানে বেঁচে যান, তাহলে এমনকি প্রাইম টাইমেও তাঁর বরাদ্দ কমে যায়।
শুধু মেয়েদের ওপরেই বা বলি কেন, যেকোনো রকম ‘অপর’-এর প্রতি আমাদের হিংসা যেন বেড়েই চলেছে। আর সব থেকে আতঙ্কের বিষয় হল কোন হিংস্রতা আমাদের মনকে নাড়া দেবে তা ঠিক করে দিচ্ছে কর্পোরেট মিডিয়া। কোন ‘অপর’ বেশি আপন আর কোন ‘অপর’-কে উপেক্ষা করা চলে, তা যেন কোনও এক অদৃশ্য সুতোয় নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছে। যে সময়ে আমাদের আরো ধৈর্য্যশীল, আরো মমতাময় হয়ে ওঠার কথা ছিল, সেই সময়েই আমরা আরো বেশি করে অসহিষ্ণুতার চর্চা করে চলেছি।
আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, এই অসহিষ্ণুতার পেছনে এক পৌরুষ-সাধনার চালচিত্র রয়েছে। মানিয়ে নেওয়া, নরমভাবে সমাধানের পথ খোঁজা, ক্ষেত্র বিশেষে মেনে নেওয়া এইসব মিনমিনে ভাব আমরা সজ্ঞানে বর্জন করেছি। আমাদের সমাজজীবনে আমরা একটা সহজ সমীকরণ করে নিয়েছি, নমনীয়তা ইক্যুয়াল টু মেয়েলি ইক্যুয়াল টু দুর্বলতা। মেয়ে মাত্রই দুর্বল, তাই যা কিছু মেয়েলি তাই পরিত্যাজ্য। আমরা প্রথমে আবেগপ্রবণতা আর চোখের জলকে মেয়েলি বলে দাগিয়ে দিয়েছিলাম, ক্রমে মায়া-মমতা-সহানুভুতি এগুলোও আস্তে আস্তে সেই তালিকায় ঢুকে গেছে। সেই কারনেই আমরা নেতা হিসেবে দেখতে চাই এমন একজনকে যিনি নির্মম, কঠোর, বলদর্পী হয়ত বা হিংস্রও। তাই যখন ইন্দিরা গান্ধী দয়াহীন, কঠোর হন তখন তাঁকে তাঁর ক্যাবিনেটের “ওনলি ম্যান” বলে ভূষিত করা হয়, সাহসের বীরগাথা রচিত হয়। কিন্তু আমাদের শেখান হয় না সাহস মানে শুধুই আক্রমণ নয়, সাহস মানে সহিষ্ণুতাও। কিন্তু দেখুন, সহিষ্ণুতাও কখন যেন মেয়েলি তালিকায় ঢুকে গেছে। আমরা ভুলে গেছি, সহিষ্ণুতা যদি মেয়েলি হয় তবে যীশু এবং গান্ধী দুই সর্বোত্তম মেয়েলি পুরুষ, যাদের সামনে পৌরুষের যাবতীয় দম্ভকে নতজানু হতে হয়।
এ লেখা পুরুষদের বিরুদ্ধে নয় এমনকি পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধেও নয়। এ লেখা পৌরুষের যে নিষ্ঠুর সামাজিক নির্মাণ তার বিরুদ্ধে। সমস্যা হল, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে আমরা সবাই সেই অকমনীয় পৌরুষকেই আমাদের আদর্শ বলে ধরে নিয়েছি। তাই শেয়ারিং আর কেয়ারিং-এর বদলে ফাইটিং স্পিরিট আমাদের মূলমন্ত্র হয়ে উঠেছে। মাঝে মাঝে মনে হয়, সমাজটা যদি শুরু থেকে পুরুষতান্ত্রিক না হয়ে নারীতান্ত্রিক হত, তাহলে কি আমরা আরো একটু নমনীয়, কমনীয়, মায়াময় সমাজ-ব্যবস্থা দেখতাম, না কি সেই ব্যবস্থাতেও শেষ পর্যন্ত যুদ্ধবীরত্বই আদর্শ নারীত্বের অভিজ্ঞান হয়ে উঠত? শুনেছি দিনের শেষে সব ক্ষমতাই একই ভাষায় কথা বলে।
এই লেখাটা লিখতে লিখতে কেন জানিনা, বার বার করে ঋতুপর্ণ ঘোষের কথা মনে হচ্ছে। নিখাদ মেয়েলিপনাও যে এমন নিরুচ্চার প্রতিবাদ হয়ে উঠতে পারে তা ঋতুকে না দেখলে বিশ্বাস করা যেত না। কোনও পাবলিক স্টেটমেন্ট নয়, এমনকি নিজের বিচরণভূমি চলচ্চিত্রেও বহুদিন পর্যন্ত কোনও বক্তব্য নয়, যাস্ট নিজের অদম্য মেয়েলিপনা দিয়ে সারাজীবন ধরে যাবতীয় ব্যঙ্গ-বিদ্রূপের প্রতিবাদ করে গেল। আমরা যত ওকে নিয়ে মশকরা করেছি, যত আকারে-ইঙ্গিতে ইশারা করেছি, যত মুচকি-মুখ ব্যাঁকানো-হা হা হেসেছি, ও তত বেশি করে আপন করে নিয়েছে মায়াবি কাজল, রঙ্গীন উত্তরীয়। আমরা যত ওর দোপাট্টার ফাঁক দিয়ে বোঝার চেষ্টা করেছি, ঋতুপর্ণ ঘোষ ‘বুক বানাচ্ছে’ কি না, ও ততই আরো কমনীয়, আরো নির্ভীক হয়েছে, আরো বেশি করে স্পষ্ট হয়েছে। ঋতু আমাদের শিখিয়ে গেছে গলার শিরা না ফুলিয়ে, হাতের আস্তিন না গুটিয়ে, কোনোরকম বাচিক বা শারীরিক হিংস্রতা ছাড়াও যুদ্ধ জেতা যায়। ঋতু আমাদের দেখিয়ে দিয়ে গেছে মেয়েলিপনা আর দুর্বলতা দুটি সম্পূর্ণ সম্পর্ক-বিযুক্ত শব্দ।
এই প্রসঙ্গে আরেকটি বহু আলোচিত শব্দের কথা মনে পড়ে গেল, অভিমান। পৌরুষের যে অভিমান তার সঙ্গে বলদর্পিতা এবং তার প্রদর্শন অঙ্গাঙ্গীভাবে যুক্ত। পৌরুষ অভিমানাহত হলে কুরুক্ষেত্র বা লঙ্কাকান্ড হয়ে যায়। নারীর অভিমান হলে সে বড়জোর খাওয়ার থালা ঠেলে দেয় অথবা কথা বলা বন্ধ করে। পৌরুষের অভিমান দাবি করে নির্ণায়ক যুদ্ধ, মেয়েলি অভিমান চায় স্নেহ, আদর, নিরাপত্তা। আশ্চর্যভাবে, পুরুষের অহং-অভিমান আমাদের সম্ভ্রম আদায় করে নেয়, মেয়েলি আবেগ-অভিমান আমাদের কাছে হয় জোলো অথবা নিছক ন্যাকামি।
এই যে আজকের দিনে যুক্তিনিষ্ঠ বিশ্লেষণের দাম আবেগজর্জরতার থেকে এত বেশি, তার কারন কি সামাজিক স্তরে পৌরুষের আরাধনা? ঐতিহাসিকভাবে, আমাদের দর্শন, ধর্ম, সমাজচেতনা, অর্থনীতি এমনকি বিজ্ঞানের পাঠনেও পুরুষদের আধিপত্য অনস্বীকার্য। আমাদের যাবতীয় জ্ঞানশাস্ত্র মূলতঃ পুরুষদের দ্বারা অধীত ও লিখিত। সেই কারনেই কি যুক্তির স্থান আবেগের ওপরে? সেই কারনেই কি আমাদের উন্নয়নের ভাবনায় কারখানার জায়গা চাষের জমির থেকে বেশি মুল্যবান? বহিঃশ্রম গৃহশ্রমের থেকে বেশি সম্মানের? বহুতলে থাকার স্বপ্ন, সন্তানের দুধেভাতে থাকার স্বপ্নের থেকে বেশি মনোলোভন?
এখন তো কর্পোরেট দুনিয়াই আমাদের সব কিছু শেখায়। কিছুকাল যাবত সেই দুনিয়াই হঠাৎ করে অনুধাবন করেছে যে আবেগাঙ্ক (ই-কিউ) বুদ্ধ্যাঙ্কের (আই কিউ) মতই সমান গুরুত্বপূর্ন। তাই এখন তারা হা রে রে রে করে চলেছে ই-কিউ শিক্ষার ক্লাসে। এই ই-কিউটাই খুব সহজে শিখে নেওয়া যেত নিজের চারপাশ থেকেই যদি আমরা তাকে যথাযথ সম্মান দিতাম।
তাই এই চতুর্দিকে ঘটে চলা অসহিষ্ণু হিংস্রতার মাঝে দাঁড়িয়ে মনে হয়, আমরা সবাই যদি আজ একটু মেয়েলি হই, তাহলে বোধ হয় এই পুরুষ-পরুষ সমাজটার উপকার-ই হয়। কিছু পুরুষ দোষ ছেড়ে চলুন না কিছু মেয়েলি গুণ রপ্ত করি, একটু অর্ধনারীশ্বর হই, একটু ‘ছক্কা’ হয়ে উঠি।
nina | unkwn.***.*** | ১০ মার্চ ২০১৪ ০৫:৪৪88704
dd | unkwn.***.*** | ১০ মার্চ ২০১৪ ০৬:১৮88700
de | unkwn.***.*** | ১০ মার্চ ২০১৪ ০৭:৪৩88701
sosen | unkwn.***.*** | ১০ মার্চ ২০১৪ ০৭:৫৬88702
Pramit | unkwn.***.*** | ১০ মার্চ ২০১৪ ১১:৩৭88703
ব | unkwn.***.*** | ১১ মার্চ ২০১৪ ০৩:৩২88707
রোবু | unkwn.***.*** | ১১ মার্চ ২০১৪ ০৪:১৩88708
Biplob Rahman | unkwn.***.*** | ১১ মার্চ ২০১৪ ১২:২২88705
সে | unkwn.***.*** | ১১ মার্চ ২০১৪ ১২:২৭88706
Chandan | unkwn.***.*** | ১৩ মার্চ ২০১৪ ০৪:৩৫88709
নীতা বিশ্বাস | unkwn.***.*** | ১৫ মার্চ ২০১৪ ০৪:২১88710
Ekak | unkwn.***.*** | ১৫ মার্চ ২০১৪ ০৪:৩১88711
chorki | unkwn.***.*** | ১৫ মার্চ ২০১৪ ০৫:০৬88712
Kausik Bhaduri | unkwn.***.*** | ১৬ মার্চ ২০১৪ ০৩:৫০88713
Kausik Bhaduri | unkwn.***.*** | ১৬ মার্চ ২০১৪ ০৩:৫০88714
Kausik Bhaduri | unkwn.***.*** | ১৯ মার্চ ২০১৪ ০২:০৩88716
Born Free | unkwn.***.*** | ১৯ মার্চ ২০১৪ ১২:০৯88715
অরুণাভ | unkwn.***.*** | ২৭ মার্চ ২০১৪ ০৬:২৭88717
Abhijit | unkwn.***.*** | ০২ এপ্রিল ২০১৪ ০৮:৪৫88718
Soumyadeep Bandyopadhyay | unkwn.***.*** | ১২ এপ্রিল ২০১৪ ০৯:২৬88719
Born Free | unkwn.***.*** | ১৯ মে ২০১৪ ০৬:২১88720
mou | unkwn.***.*** | ২১ মে ২০১৪ ০২:০৩88721
Born Free | unkwn.***.*** | ৩১ অক্টোবর ২০১৬ ০৬:০৬88722
pi | unkwn.***.*** | ০১ নভেম্বর ২০১৬ ০২:৩৬88723