[আর কিছুদিনের মধ্যেই আমরা শুরু করতে চলেছি বর্ন ফ্রী-র ধারাবাহিক লেখা "বস্টনে বঙ্গে"।আজকের একটি ঘটনায় আমরা ধারাবাহিক প্রকাশের নিয়ম ভেঙ্গে সেটির চতুর্থ পর্ব প্রকাশ করলাম।]
এ লেখার শুরুতে বলেছিলাম, এই লেখা হবে আমার বস্টনবাসের অভিজ্ঞতার কথা। কিন্তু আজ সে কথা রাখতে পারছি না। আজ আমি লিখছি কলকাতার কথা, পশ্চিমবঙ্গের কথা, বাংলার কথা।
এই মাত্র, আমার সন্ধ্যেবেলা আর কলকাতার সকালবেলায়, খবরের কাগজে একটা খবর পড়লাম। সে খবরটা পড়ে অব্দি আমার কষ্ট হচ্ছে, অস্বস্তি হচ্ছে, বুকের ভেতর যন্ত্রণা হচ্ছে, কান্না পাচ্ছে, রাগ হচ্ছে আর একটা প্রচন্ড লজ্জা আমাকে গ্রাস করছে। আমার কিছু একটা করতে ইচ্ছে হচ্ছে, কিন্তু কী করব, জানি না, তাই লিখছি, মনকে হাল্কা করার চেষ্টা করছি, ক্ষমা চাওয়ার চেষ্টা করছি। সত্যি বলছি, লেখার জন্য লিখছি না, নিজেকে শান্ত করার জন্য লিখছি। খবরটা পড়ার পর এক তাৎক্ষণিক, অত্যন্ত অস্থির প্রতিক্রিয়া থেকে লিখছি। অনেক জায়গায় হয়ত বাক্যবিন্যাসে, শব্দচয়নে ত্রুটি থাকতে পারে। থাকতে পারে আবেগের বাহুল্য। এ ঘটনা সাজিয়ে গুছিয়ে লেখার মত নয়। তাই আশা করি পাঠকরা আমার সে সব দোষ-ত্রুটি, আবেগজর্জরতা ক্ষমা করে দেবেন। আগাম ধন্যবাদ।
এই মাত্র পড়লাম, পশ্চিমবঙ্গের বুকে বাবা, দাদা আর মা মিলে একটি ছোট্ট মেয়েকে কুপিয়ে মেরে ফেলেছে। ছোট্টই বললাম, আঠেরও পেরোয়নি এখনও, ছোট্ট ছাড়া আর কি? মাম্পি, তোকে তুই করেই বলি, তুই আমার আদ্ধেক বয়সি, আমি তোর কাছে ক্ষমা চাওয়ার জন্য এ লেখা লিখছি। তোর অপরাধ ছিল, তুই পরিবারের অমতে গিয়ে পাশের বাড়ির গরিব ছেলেকে ভালবেসেছিলি। তার জন্য, শুধুমাত্র তার জন্যই তোর বাবা, দাদা, মা মিলে তোকে কুপিয়ে মেরে ফেলল? হে ভগবান। আর আমি? আমাকেও তো তুই রাখি বেঁধেছিলিস, আমিও তোকে বাঁচাতে পারলাম না? ছিঃ।
না, তুই সরাসরি আমার হাতে রাখি বাঁধিসনি ঠিকই। বাঁধবিই বা কি করে, তুই তো আমাকে চিনিসই না। কিন্তু ওই যে, যে রাখি তুই তোর দাদার হাতে বেঁধেছিলি, আর যে রাখি আমার দুই দিদি প্রত্যেক বছর আমার হাতে বেঁধে দেয়, সে তো একই রাখি, তাই না? আমরা, মানে আমি, তোর দাদা, আমরা সব ভাইয়েরা যে প্রত্যেক বছর ওই দিনটাতে তোদের কাছে প্রতিজ্ঞা করি, যত ঝড়-বাদল আসুক না কেন, আমরা সবসময় তোদের পাশে থাকব, সেই সব প্রতিজ্ঞা, শপথ সব ফাঁকি? সব মিথ্যে? এত মিথ্যে নিয়ে মানুষ বাঁচে কি করে? তুই তো মরে বেঁচেছিস, আমরা এ লজ্জা, এ গ্লানি নিয়ে আরো কিছু দিন, কিছু বছর বেঁচে থাকব। সেই আমাদের উপযুক্ত শাস্তি।
কাগজে পড়লাম, তোর দাদার প্রথম কোপ পড়েছিল তোর আঙ্গুলের ওপর। তোর আঙ্গুল কেটে গিয়ে ঝুলছিল। কোন আঙ্গুল রে? যেই আঙ্গুল দিয়ে তুই গত ভাইফোঁটায় আমাকে ফোঁটা দিয়েছিলি? যমরাজের দুয়ারে কাঁটা বিছিয়ে দিয়ে আমার দীর্ঘায়ু কামনা করেছিলি? সেই চন্দনের দাগ এখনও আমার কপালে লেগে। কাল অব্দি যা আমার ভালবাসার তিলক ছিল, আজ তোর খবরটা পড়ার পর থেকে সেই ফোঁটা আমার কপালের কলঙ্কচিহ্ন হয়ে গেছে। আমি হাজারবার চেষ্টা করেও সে ফোঁটা মুছতে পারছি না। চন্দনের গন্ধ, তোর শুকিয়ে যাওয়া রক্তের আঁশটে গন্ধে ঢাকা পড়ে গেছে। তুই এ ফোঁটা ফিরিয়ে নে, এর যোগ্য নই।
কাগজের মনস্তত্ববিদরা আলোচনা করেছেন মায়ের নিষ্ঠুরতা নিয়ে। কিন্তু আমার মনে পড়ছে আমার দিদিদের কথা। যারা আমাকে অনেক বড়বেলা অব্দি ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছে, আমার স্কুলড্রেস ইস্ত্রি করে দিয়েছে, কেমিস্ট্রি বুঝতে না পারলে বুঝিয়ে দিয়েছে, আমার পরীক্ষার সময় রাত্রে উঠে আমাকে চা করে দিয়েছে, আমার জ্বরের সময় মাথার কাছে বসে জলপট্টি দিয়েছে, আমার অসুস্থতার সময় হাতে করে আমার মল-মূত্র-বমি পরিষ্কার করেছে। আমার দিদিরা আমার জন্য করেছে, দুর্গারা অপুদের জন্য করেছে, আমি নিশ্চিত জানি, তুইও তোর দাদার জন্য এই সব কিছুই করেছিলিস। করতে হয় বলে করিস নি, ভালবাসতিস বলেই করেছিলিস, যেমন আমার দিদিরা করেছিল আমার জন্য। তোর ঘাড়ে কোপ মারার আগে তোর দাদার কি একটি বারের জন্যও মনে পড়ে নি, এই সব কিছু?
আমি জানি, আমার পোড়া দেশে এ কিছু নতুন খবর নয়। তবু এতদিন ভাবতাম এই সব পাঞ্জাব-হরিয়ানা-দিল্লি-উত্তরপ্রদেশ-বিহার-অন্ধ্র-কর্নাটক-তামিলনাড়ু-গুজরাট-মহারাষ্ট্রে হয়। আমার বাংলায় হয় না। আমার বাংলায় একটা রিজওয়ানুর হলে, সরকারি মসনদ কেঁপে ওঠে, সমস্ত বাংলা লজ্জায় অধোবদন হয়। যখনই আমার অবাঙ্গালি কোনো বন্ধু কলকাতা, বাংলাকে নিয়ে খারাপ কিছু বলেছে, নিজের মনে ভেবে নিয়েছি, নাই বা থাকল আমাদের শপিং মল, ফ্লাইওভার, ঝাঁ চকচকে রাস্তাঘাট, না হয় আমরা একটু অগোছালোই থাকলাম, তবু তো আমার বাংলায় দাঙ্গা হয় না, কন্যাভ্রূণ হত্যা হয় না, অনার কিলিং হয় না। তোর সাথে সাথে সেই প্রগতির গর্বকেও আমরা আজকে খুন করলাম।
আজকে এখানে এত দূরে বস্টনে বসেও কোথায় যেন আমি তোর সাথে এক হয়ে যাচ্ছি। তোর আর আমার অপরাধ যে একই, তুই আর আমি দুজনেই যাদের ভালবাসি তাদেরকে আমাদের পরিবার-সমাজ মেনে নেয় না। নিজের ভালবাসাকে জলাঞ্জলি দিয়ে বাবা-মার পছন্দ করে দেওয়া জীবনসঙ্গীকে তুইও মানতে পারলি না, আমিও মানতে পারব না। আমাদের দুজনেরই চুলের মুঠি ধরে আমাদের বাবা-মা-ভাই-দাদা-বন্ধুরা বলে, হয় আমাদের বানিয়ে দেওয়া নিয়ম মেনে ভালবাস অথবা সরে যাও, মুছে যাও। আমি জানি না, আমার সমপ্রেমকে তুই মেনে নিতে পারতিস কি না, আমি জানি না, আমার প্রিয় দিদিরা মেনে নিতে পারবে কি না। আমার ভয় লাগে, যেদিন জানতে পারবে আমার দিদিরাও কি তোর দাদার মত হয়ে যাবে? ভুলে যাবে, আমাকে পায়ে করে ওরা ঘুম পাড়াতো, আমার মেয়ে সাজার ইচ্ছে হলে ছোটবেলায় ওদেরই লিপ্স্টিক-কাজল দিয়ে ওরা আমাকে মেয়ে সাজিয়ে দিত? যে হাতে ওরা আমাকে রাখি পরিয়েছে, ফোঁটা দিয়েছে, ভাত মেখে খাইয়ে দিয়েছে, কষ্ট হলে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে, সেই হাতেই কি ওরা আমাকে মারবে? আমাকে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে ঘর থেকে বার করে দেবে? গালে চড় মেরে বলবে, আজকের পর থেকে তোর সাথে আমাদের আর কোনও সম্পর্ক নেই? ভয় হয়, তারপর মনে মনে ভাবি, না না সে সব কিছু হবে না, তোরা বোনেরা দিদিরা আমাদের ভাইদের অনেক অনেক বেশি ভালবাসিস। সেই ভালবাসার মুল্য দিতে পারলাম না। পারলে ক্ষমা করিস। জানি, জীবনের পরে আর কিছু নেই, তবু এরকম সময়ে নিজেকে সান্ত্বনা দিতে মনে হয়, মৃত্যুর ওপারেও কিছু আছে। যদি থাকে, তাহলে সেখানে ভাল থাকিস, সুখে থাকিস।