গত বছর এই ডিসেম্বর মাসেই সুপ্রীম কোর্টের রায় আবার নতুন করে আমাকে ক্রিমিনাল করে দিয়েছিল।যবে থেকে বুঝতে শিখেছি তখন থেকেই জেনে এসেছি এই ভারতে আমার বা আমাদের মত মানুষদের কোনো আইন্সন্মত জায়গা নেই। ঝোপের আড়ালে, পার্কের কোনায়, পাবলিক টয়লেটে অথবা ভিড় ট্রেনের কামরায় আমরা চাইলে থাকতে পারি কিন্তু তোমাদের নাটকে, গল্পে কবিতায় সিনেমার ডিসকোর্সে আমরা নেই। তোমাদের বেডরুমে আমরা সবসময় থেকেছি, কিন্তু তোমাদের ড্রয়িংরুমের আলোচনায় আমাদের ডাক পড়েনি। বরং বিভিন্ন সময়ে বন্ধুদের মুখে শুনেছি ‘ওইসব করতে হলে আমেরিকায় গিয়ে কর, ইন্ডিয়াতে করলে পুলিশে ধরবে’। তারা অনেক সময়েই কথাগুলো মজা করে বলেছে। আমি জানি, আমার যৌনপরিচয় না জেনেই বলেছে, কিন্তু কতটা ব্যথা দেওয়া সত্যি কথা বলে ফেলেছে সেটা তারা নিজেরাও বোঝেনি। তারা কখনো বোঝেনি, যে দেশকে ভালবাসার শিক্ষা ছোটবেলা থেকে সারাক্ষন দেওয়া হয়, সেই দেশকে ছেড়ে চলে যেতে বললে কতটা আঘাত লাগতে পারে। দেশ মানে তো আর শুধু এক ভূখন্ড নয়, দেশ মানে কখনো ছেড়ে আসা গ্রাম, কখনো স্কুলবাড়ী, কখনো গলির মোড়ে তেলেভাজার গন্ধ, কখনো বা একলা ঘরে আমার অভ্যেসহীন একলা থাকা। দেশ মানে কখনো নিবিড় ভালবাসা, কখনো দুশ্চিন্তা, কখনো একরাশ বিরক্তি। এই সব নিয়েই তো আমার সাথে আমার দেশের লেপ্টে থাকা সম্পর্ক। তাকে অস্বীকার করে কি দূরে সরে থাকা যায়?
কিন্তু সেই মানুষটি, সেই দেশটি, যাকে তুমি ভালবাসো, যদি তার চোখেই তুমি অপরাধী হও, তখন? যদি সে তোমার দি্কেই আঙ্গুল তুলে বলে, তুমি নষ্ট, তখন? সেই যদি তোমাকে বলে তফাত হঠো, তখন?
এইরকমই ভালোবাসার টানাপোড়েনে কেটেছে আমাদের জীবনের অনেকগুলো বছর। এইটা জেনেই বড় হয়েছি যে আমার দেশের আইনের চোখে আমি অপরাধী। আমার অপরাধ এতটাই সাঙ্ঘাতিক যে আমার শাস্তি আর খুনি আসামীর, ধর্ষকের শাস্তি প্রায় সমান। এইরকম ভাবে থাকতে থাকতে যখন প্রায় অভ্যস্ত হয়ে গেছি, তখনি ২০০৯ সালে দিল্লী হাইকোর্টের রায় এসে সবকিছু হঠাৎ করে পালটে দিল। জানতে পারলাম, আমার দেশ আর আমাকে অপরাধী বলে মনে করে না। আমার দেশ বোঝে যে আমার কোনও দোষ নেই, কখন ছিল না। কিন্তু সে আনন্দ বেশীদিন রইল না। সর্বধর্মসমন্বয়ের কল্যাণে শুরু হল আবার এক চার বছরের দীর্ঘ আইনি লড়াই আর যার শেষে গত বছর ডিসেম্বরে এল সুপ্রীম কোর্টের রায়। মাত্র চার বছরের মধ্যেই আমি আবার ক্রিমিনাল হলাম।
সুপ্রীম কোর্টের রায় নিঃসন্দেহে হতাশ করেছিল কিন্তু তার থেকেও বেশি আঘাত দিয়েছিল সেই রায়ের ভাষা। সে সম্পর্কে অন্যত্র লিখেছি তাই এখানে আর লিখছি না। তবে দুঃখ, কষ্ট হতাশার সঙ্গে যেটা যোগ হয়েছিল, সেটা একটা রাগ, একটা হতাশাজনিত ক্ষোভ। শুধু আমার মধ্যে নয়, আমার মত চারপাশের অনেক মানুষের মধ্যেই দুঃখর থেকেও বেশী ফুটে উঠেছিল রাগ, দেশের প্রতি প্রবল অভিমান। সেই সময় সেই অভিমানের অভিঘাত থেকে একটা লেখা লিখেছিলাম। প্রকাশের অযোগ্য ভাষার কারণে সেই লেখাকে সেই সময় প্রকাশ করা যায় নি। আজ এক বছরের মাথায় সেই লেখাটাকেই একটু কাঁচি চালিয়ে সভ্য করে দিলাম। মনে হল, সেই যে প্রবল রাগের অনুভূতি সেটাও ডকুমেন্টেড হয়ে থাকা দরকার।
কে জানে, যখন আমরা কাউকে পাকিস্তানে চলে যেতে বলি, তারও হয়ত একইরকম মনে হয়। মনে হয় সত্যিই একদিন চলে যাব যেদিকে দুচোখ যায়...
এক ক্রিমিনালের জবানবন্দি
লেখকঃ কয়েদি নাম্বার ৩৭৭ (তারিখঃ ১১ই ডিসেম্বর, ২০১৩, রাত্রি ১১টা ৩০ মিনিট)
লিখব? কী লিখব? সবই তো জানেন। যত্ত ভালো ভালো কথা হয়, সব ভদ্রলোকেরা বলে দিয়েছে আর আপনারাও পড়ে নিয়েছেন। যেসব আন্ডু বান্ডুরা বোঝে নি, তাদের তেল মাখানো বাঁশ দিয়ে বোঝালেও বুঝবে না।
গতকাল থেকে আমি ক্রিমিনাল। ইয়েস সার, এই দেশের মহামান্য আদালত আমাকে যাবজ্জীবন কারাদন্ড দিয়ে দিয়েছেন। অতএব ভালো থাকার, ভদ্র কথা বলার কোনো দায় আমার নেই। ইন ফ্যাক্ট কোন কথাই নেই। শালা, ক্রিমিনালের আবার কথা।
কি বলব? এইসব প্রাকৃতিক, মানবাধিকার ইত্যাদি? এতকাল শোনেন নি? পড়েন নি? এখন আবার নতুন করে মাজাকি হচ্ছে?
মানবাধিকারের মুখে ইয়ে করি। যা করেছি বেশ করেছি, আবার করব। যার সাথে ইচ্ছে শোব, আমার বিছানায়, আমার রান্নঘরে, আমার বাথরুমে, জোরজবরদস্তি না করে, যার সাথে ইচ্ছে তার সাথে সেক্স করব, না ইচ্ছে হলে করব না। কার বাপের কী?
বেশ করব, হাজারবার করব। বাপের জমিদারি নাকি যে আমাকে বলে দেবে আমি কাকে নিয়ে বিছানায় যাব?
অনেক ভালো ভালো কথা হয়ে গেছে। আমার আনন্দ দেখে যদি তোমার চুল্কুনি হয়, তো বসে বসে খুজলাও, আমার ছেঁড়া গেল।
আমার জীবন, আমার সঙ্গী আমি ঠিক করব। তাতে যদি আইন ভাঙ্গে, সেই আইনকে লাথি মেরে চলে যাব। খুললাম খুল্লা না করতে পারলে লুকিয়ে করব। যে আইন তার মান্যতা রক্ষা করতে পারে না, সেই আইনকে অমান্য করব।
আমার অধিকারের জন্য, কারোর কাছে হাত পাতব না। নাকি কান্না অনেক হয়েছে, আর পারব না স্যার।
শালা, ম্যারাইটাল রেপ আটকানোর ধক নেই, বড় বড় পৌরুষের কথা। অমন পৌরুষে আমার মাঝের আঙ্গুল।
কি লজিক মাইরি। আমরা পুরো জনগনের একটা ছোট্ট অংশ, তাই আমাদের শোওয়ার ঘরে কাঠি করলে নাকি মানবাধিকার নষ্ট হয় না। ছোট্ট অংশ? তোমার ছোত্ত অংশটা তোমার পুরো বডির কত পারসেন্ট, হিসেব করে দেখেছ কোনোদিন? সেটা বেগড়বাই করলে কোনো কে সি লোধ, কোনো ভামদেব বাবার ঠাকুদ্দাও তোমাকে সাম্লাতে পারবে না। হয় ভাদ্রমাসের কুত্তার মত ঘুরে বেড়াবে, নয়ত ভায়াগ্রা বগলে পুরে বসে থাকবে। কবে থেকে পারসেন্ট হিসেব করে মানবাধিকার লাগু করা শুরু হল, বাওয়া?
রায়ের কি ভাষা? “সো কল্ড রাইটস অফ এলজিবিটি পিপ্ল”। “সো কল্ড”? আজকের দিনে?
দিন পালটে গেছে। ২০০৯-এর দিল্লি হাইকোর্ট আর আপনাদের মত অনেক অনেক মানুষের সমর্থন সময় পালটে দিয়েছে। আমার বস আমাকে ই-মেল করে জানিয়েছেন, কোর্ট যাই বলুক, তিনি আমার, আমাদের সঙ্গে আছেন। কাজের জায়গার স্ট্রেট বন্ধুরা খবর শুনে ছুটে এসেছে। রাগে, ক্ষোভে ফেটে পড়েছে। আমার সাথে প্রতিবাদ মিছিলে হেঁটেছে। আমাদের আর পেছনে লাথি মেরে ঘরে ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে না। হাইকোর্টের খোলা হাওয়ায় আমরা রাস্তায় যখন একবার নেমেছি, তখন শেষ অব্দি হাঁটব।
অনেক ভালো ভালো কথা অনেকদিন বলেছি। ফেসবুকে, পত্র-পত্রিকায়, সিনেমায়, লেখায়। যারা তাতেও না বুঝে, আমাকে ক্রিমিনাল বলে দাগিয়ে দিতে চান তাদের বলি, ভালো চান তো শুধরে যান, নয়তো…
এইবার ক্রিমিনাল কথা বলবে।
সুপ্রীমকোর্টের রায়ের পরের দুঃখ, হতাশা, রাগ, ক্ষোভ এবং সংকল্পের কিছু খন্ডচিত্র।
----------------
নির্লজ্জ
কিছুদিন আগে ব্যাঙ্গালোরে ভিক্ষা করার ‘অপরাধে’ পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছিল প্রায় একশ জনের মত হিজড়াদের। পরের দিন অনেক দৌড়ঝাঁপের পর মানবাধিকার কর্মীরা তাঁদের জামিনে মুক্ত করতে পেরেছেন।
এই খবরটা পড়ে অনেককেই বলতে শুনলাম, পুলিশ ভালো কাজই করেছিল। এরা যেভাবে অত্যাচার করে, কিছু একটা করা দরকার। এদের কাজ দিলেও এরা কাজ করবে না, আরামের জিন্দেগী আর হারামের কামাইতে অভ্যেস হয়ে গেছে যে।
এদের জীবন কতটা আরামের সে প্রশ্ন আজ থাক। সে বর্ণনা পড়লে শিউরে উঠতে হয়। কজন সেই আরামের জীবন গ্রহণ করতে তৈরি আছেন সে প্রশ্নও আজ করছি না। আজ বরং একটা অন্য প্রশ্ন করি। ভিক্ষা করার বাইরে অন্য কি করার পথ আমরা খোলা রেখেছি আমাদের এই সহনাগরিকদের জন্য?এই ২০১৪ পর্যন্ত নারী-পুরুষের বাইরে অন্য কোনো লিঙ্গকে আমরা আইনের স্বীকৃতি পর্যন্ত দেই নি। যার ফলে ট্রান্সজেন্ডার মানুষেরা না পেয়েছেন শিক্ষার অধিকার, না নিতে পেরেছেন সরকারি চিকিৎসার সুযোগ। পাসপোর্ট, ড্রাইভিং লাইসেন্স, ব্যাঙ্ক একাউন্ট কিছুই করা সম্ভব ছিল না এনাদের পক্ষে। এমনকি ভোটাধিকার পাওয়ার জন্যও এদেরকে বেছে নিতে হত নারী/পুরুষ যেকোনও একটা অপশন, শরীর চিহ্ন অনুযায়ী। অনেক সময় সেই কাজটাও সহজ ছিল না। এই সব কথা থাক, যাদের জন্য রাষ্ট্র আজ পর্যন্ত গোটা দেশে একটা পাব্লিক টয়লেট বানিয়ে দিতে পারল না, তাদেরকে সেই রাষ্ট্র শাস্তি দেয় কোন নির্লজ্জতায়?
ভাত দেওয়ার মুরোদ নেই, কিল মারার গোঁসাই।