আন্দোলন্ শুরু হয়েছিল এবছরে এপ্রিল মাসে । ঝাড়খন্ডের আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এক অভূতপূর্ব আন্দোলন ~ পাথালগড়ি আন্দোলন । রাষ্ট্র ও সংবিধানকে অস্বীকার করার আন্দোলন ।
২০১৭ সালে বিজেপি যখন থেকে অরণ্যের ওপর আদিবাসীর অধিকারের শতাব্দী প্রাচীন আইন বদলাবার জন্য কোমর বাঁধল, কিন্তু বিরোধী দলগুলির মিলিত প্রতিবন্ধকতায় এখনই সেই আইনের কোন সংস্কার করতে পারল না , তখন থেকেই পাথালগড়ি আন্দোলনের ভাবনাচিন্তা। প্রায় একই সঙ্গে ২০০ আদিবাসী গ্রাম সামিল হয় এই বিদ্রোহে , আরও ছত্রিশ হাজার গ্রাম শীগগিরি যোগ দেবে বলে আন্দোলনকারীদের আশা ছিল ,কিন্তু তার আগেই নেমে এল অকথ্য দমনপীড়ন একটি গণধর্ষণকে কেন্দ্র করে । সেটায় বিস্তারিত যাবার আগে পাথলগড়ি নিয়ে আরও দু চার কথা ।
মুন্ডা জনজাতির মধ্যে এই প্রথা বহুল প্রচারিত যে কোন পূর্বজের মৃত্যু হলে তার সম্মানে পাথর পোঁতা হয় ভূমিগর্ভে। সম্প্রদায়ের মৃত গুরুজনদের সম্মান জানাবার এই প্রথা নতুন ভাবে ব্যবহার করল আদিবাসীরা । তারা গ্রামের সীমানায় পুঁতে দিল মস্ত মস্ত প্রস্তরখন্ড যাতে নিজেদের ভাষায় উতকীর্ণ রইল প্রাচীন বিধান । দিকু বা বহিরাগতের প্রবেশ সম্পূর্ণ বারণ হল । একমাত্র সার্বভৌম বলে স্বীকৃতি পেল গ্রামসভাগুলো । এগুলোতে খোদিত অবস্থায় শোভা পেতে লাগল ১৯৯৬ সালের পঞ্চায়েত আইনের ( Extension to Scheduled Areas ) নানা বিধান যেখানে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে যে গ্রামগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ এক একটি ইউনিট। বলা হয়েছে গ্রামসভা যা গঠিত হয় ইলেকশনে নয় , সিলেকশনে , গ্রামের ইউনিটে সেগুলোই সর্বেসর্বা।
এই নতুন আন্দোলনে আধার কার্ড ও ভোটার আইডিকে বর্জন করবার ডাক দেওয়া হল , বাইরের স্কুল কলেজ ,চাকরির প্রলোভন বর্জন করতে বলা হল আর সবচেয়ে বেশি জোর দেওয়া হল যে কথাটির ওপর তা হল আদিগন্ত জল জমিন জঙ্গলের অবিসংবাদিত মালিক ভূমিপুত্ররাই , আর কেউ এগুলির মালিকানা কখনো কেড়ে নিতে পারবে না । কোন বহিরাগত ( সরকারী কর্মচারীরাও ) গ্রামের ভেতর ঢুকলে , বাস করলে বা থেকে যাবার চেষ্টা করলে তা হবে ভীষণ অবাঞ্ছিত ।
এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ার আগেই ঘটে গেল এক ভয়ংকর লজ্জাজনক ঘটনা । খুন্তী জেলার কোচাং গ্রাম, যা নাকি পাথালগড়ি আন্দোলনে আগেই যোগ দিয়েছিল, সেখানে একটি এনজিও এবং আর সি মিশন নামে চার্চের অধীনস্থ একটি প্রতিষ্ঠান থেকে মানুষ পাচার এবং মাইগ্রেশনের কুফল নিয়ে পথনাটিকায় ব্যস্ত ছিলেন পাঁচজন আদিবাসী মহিলা। নাটক শেষ হবার আগেই কিছু দুষ্কৃতি মোটরবাইকে এসে পুরুষ সহকর্মীদের সঙ্গে এই মহিলাদের মিশনের একটি গাড়িতে তুলে নিয়ে কয়েক কিলোমিটার দূরে একটি নির্জন জঙ্গলবেষ্টিত জায়গায় নিয়ে যায়। সেখানে পুরুষদের গাড়িতেই বেঁধে রেখে মহিলাদের উপর গণধর্ষণ চালায় ওই দুষ্কৃতিরা। নারকীয় অত্যাচার চলে এবং নিপীড়িতাদের মূত্রপান করতে বাধ্য করা হয়। তাদের ছেড়ে দেবার আগে এই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয় যে যদি তারা কোথাও অভিযোগ করে তাহলে ভিডিওকৃত ধর্ষণের ঘটনা চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া হবে।
আর সি মিশন প্রাঙ্গনে যেখানে পথনাটিকাটি অনুষ্ঠিত হচ্ছিল সেখানে সিসিটিভি ফুটেজে পরিষ্কার ধরা পড়েছে মোটরবাইক বাহিত ওই নরপশুদের মুখচ্ছবি। কিন্তু পুলিশ তদন্তে নেমেই নিপীড়িতাদের নিজেদের কাস্টডিতে নিয়ে নেয়। তাদেরকে এমনকী নিজের পরিবারের লোকোদোর সঙ্গেও দেখা করতে দেওয়া হয় না উপরন্তু আর সি মিশনের যাজক ফাদার আলফোনসো এবং কয়েকজন নানকে গ্রেফতার করা হয়। ঘটনাপ্রবাহ এখানেই থেমে থাকেনি। আরক্ষা এবং সুরক্ষা বাহিনীর হাজার হাজার সদস্য অবর্ণনীয় সন্ত্রাস নামিয়ে আনে কোচাং এবং তার সন্নিহিত এলাকায়। তাদের লক্ষ্যে আছে পাথালগড়ি আন্দোলনের পরিচিত নেতা এবং সদস্যরা। সিসিটিভি ফুটেজ থাকা সত্ত্বেও এই ব্যাপক অত্যাচার বিস্ময় এবং সন্দেহের সৃষ্টি করেছে। যেহেতু মিডিয়াও তোতাপাখীর মত আউড়ে চলেছে পুলিশ এবং প্রশাসনের দেওয়া বয়ান, সত্য অনুসন্ধানের জন্য WSS (Women Against Sexual Violence And State Repression And Sexual repression) একটি কমিটি গঠন করে। এই কমিটির মধ্যে রয়েছেন বিভিন্ন রাজ্যের নারী সংগঠনের সদস্য এবং ঝাড়খন্ডের স্থানীয় অ্যাক্টিভিস্টরা। ২৮শে জুন থেকে ৩০ শে জুন এই তিনদিন ধরে তদন্ত চালান হয় খুন্তী, কোচাং, রাঁচি এবং আশেপাশের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে। ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্যসংগ্রহ এবং তার ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ যাচাই করাই ছিল মূল উদ্দেশ্য, কেননা প্রশাসনিক বয়ান ছাড়া ওই নারকীয় ঘটনার আর কোনও নির্ভরযোগ্য বিবরণ অলভ্য। মিডিয়াও সমান দোষী। কারণ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন না করে তারা প্রশাসনের হয়েই প্রচার চালিয়েছিল। তদন্ত চলাকালীন ওই টিম ঘটনার সঙ্গে জড়িত অনেক ব্যক্তি ও প্রশাসনের সঙ্গে কথা বলে প্রচুর তথ্য সংগ্রহ করে। পুলিশ কাস্টডিতে থাকা নিপীড়িতাদের সঙ্গে দেখা করার চেষ্টাও করে, কিন্তু, খুন্তি পুলিশ প্রশাসন তাদের সেই অনুমতি দেয়নি। জেলাশাসক ও এসপি দেখা করার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করছেন। WSS এর তদন্তে এমন অনেক তথ্য বেরিয়ে এসেছে যা কোচাং-ঘটনার প্রশাসনিক বয়ানকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেবে। নীচে তাদের রিপোর্টের একটি বঙ্গানুবাদ দেওয়া হল।