এই লেখার শুরুতে একটি রাইডার থাকুক। রাজনৈতিক বিশ্বাসে আমি মাওবাদীদের থেকে স্বতন্ত্র। আমি সংসদীয় গণতন্ত্রে বিশ্বাসী এবং অল্প কিছু মানুষের সশস্ত্র সংগ্রামের ফলে মুক্তি আসবে এটাও বিশ্বাস করিনা । কিন্তু রাজনীতিহীন মানুষ আমি নই । আমার রাজনৈতিক বোধ আমাকে শিখিয়েছে শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে সরব হতে, গরীব আদিবাসীর জল জঙ্গল জমি কর্পোরেটের স্বার্থে বিকিয়ে দেওয়ার বিরুদ্ধে গলা তুলতে, বিশেষত যদি পোষ্য মিডিয়া এবং নাগরিক পরিসরে সেই অন্যায়ের বিরুদ্ধে টুঁ শব্দটি না শোনা যায় । তাই এটিকে এক রাজনীতি সচেতন সাধারণ নাগরিকের প্রতিক্রিয়া হিসেবে নিলেই ভালো ।
মাওবাদীর জন্ম
বাইশে এপ্রিল, দুহাজার আঠার । মহারাষ্ট্র এবং ছত্তিশগড়ের সীমান্তঘেঁষা এবং মাওবাদী অধ্যুষিত এক গ্রামে বিবাহবাসর। জেলার নাম গড়চিরোলি ।মাওবাদী নেতা সাইনাথের নিজের গ্রাম গাট্টেপল্লীর কনে আর লাগোয়া কাসানসুরের বর । ্নাকি এই বিবাহ উপলক্ষেই মাওবাদীরা জড়ো হয়েছিল ইন্দ্রাবতী নদীর ধারে একটুকরো দুর্গম অরণ্য ঘেরা জমিতে । মতান্তরে এরা প্রায়ই টহলে থাকত , গ্রামবাসীদের অসুবিধেগুলো নিয়ে আলোচনার জন্য । এবার বিভিন্ন দলম ( ওখানে দশ পনেরজন মাওবাদীর এক একটি গ্রুপকে বলে দলম ) জড়ো হয়েছিল তেন্ডুপাতা বিক্রিজনিত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতে। বিয়ে বা তেন্ডুপাতা যাইই হোক না কেন, বাইশের ভোর ভোর তাদের ঘিরে ফেলে সিআরপিএফ এবংমহারাষ্ট্রের সি-60 কম্যান্ডোরা । আন্ডার ব্যারেল গ্রেনেড লঞ্চার দিয়ে আক্রমণ এবং ১৬ জন খতম। পরদিন কিছুদূরে আর এক বনভূমিতে খুন করা হয় ছ জনকে । দুর্জনেরা বলছে সাজানো এ্নকাউন্টার, কারণ ঐদিন মৃত মাওবাদী নেতা নন্দুকে নাকি ইন্দ্রাবতীর তীরে মূল দলমের মধ্যে আরো বড় নেতা সাইনাথের সঙ্গে দেখা গিয়েছিল ।
গল্প তো এখানেই শেষ নয়। বাঁচার জন্য যারা কুমীরভর্তি ইন্দ্রাবতীর জলে ঝাঁপ দিয়েছিল , দুদিন পর তাদের ফুলে ঢোল লাশ ভেসে উঠতে লাগল । কি আশ্চর্য তাদের শরীরেও বুলেটের ছ্যাঁদা, পোড়ার দাগ ।এক নিহতের বাবার চোখ ছেলের দেহে খুঁজে বার করল বিশাল গভীর কুঠারের ক্ষত । এবার মোট নিহত পনের । গ্রামবাসীদের বাধ্য করা হয়েছে কুমীরভর্তি নদীতে নেমে মাছধরা জালে মৃতদেহ তুলতে।সেভাবে ওঠে আরো তিন লাশ । দুটো এনকাউন্টার ,চল্লিশটা লাশের ঢের ! সাধে হিন্দু কাগজে হেডিং ছিল দা পারফেক্ট এমবুশ । অপর পক্ষের সবাই জ্যান্ত, কোন ক্ষয়ক্ষতি নেই। আলহাদে জওয়ানরা মারাঠি আর হিন্দিতে গানবাজনা করছিল, নাচছিল ,গ্রামবাসীরা সাক্ষী।
গল্প চলছে মৃত্যুর আর রক্তের হোরিখেলার । একটু পেছন ফিরে না তাকালে এই রক্তপাতের তাৎপর্য পরিষ্কার হবে না । ২০০৭ সালে গড়চিরোলিতে লয়েড মেটাল খনি লিজ নিতে শুরু করে।সঙ্গে সঙ্গে শকুনের মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে সরকারী বদান্যতাপ্রাপ্ত অন্যান্য কর্পোরেট হাউজ । আদিবাসীদের জঙ্গল জমি জলের ওপর অধিকার স্বীকার করে কি কি আইনও আছে আমাদের দেশে। সেসবকে কলা দেখিয়ে ,স্থানীয় মাড়িয়া গোন্দ ও অন্যান্য আদিবাসীদের ইচ্ছে অনিচ্ছেকে দুপায়ে মাড়াতে কর্পোরেট-বান্ধব শাসক চিরকালই চেয়েছে পুঁজির কখনো-না-বোজা-হাঁ মুখে বনস্থলী বিসর্জন দিতে। ফলে কে মনে রাখে সুরজগড় পাহাড় মারিয়া গোন্দদের দেবস্থান , ১৮৫৭ র মহাবিদ্রোহের স্মৃতিপূত এইসব এলাকা , স্থানীয় উপজাতীয় স্বাধীনতাসংগ্রামী বাবুরাও শেদমেক চষে বেড়াতেন এইসব পাহাড়ের মাথা। আদিবাসীর কাছে মাইনিং সাইটগুলি যেন তাদের বসতির ওপর “গভীর রক্তচিনহ’”। এগুলি তাদের সব হারানোর প্রতীক । এই সবের মধ্যে আছে তাদের খাদ্য এবং জল , স্বাস্থ্যকর প্রাকৃতিক পরিবেশ, নিজস্ব সংস্কৃতি । কিছু নিস্ব, শোষিত সরল একগুঁয়ে স্বজাত্যাভিমানী মানুষ হাতে অস্ত্র তুলে নিল এই অন্যায়ের মোকাবিলায়, কোন সাম্যবাদী সংগঠনের ছত্রচ্ছায়ায় সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে হারানো জমি পুনরুদ্ধারের চেষ্টা করল , জন্মালো মাওবাদী । আর শাসক বলল, এই দরিদ্র দেশের উন্নয়নের পথে বিরাট বাধা এই বিপথগামী সশস্ত্র যুবকের দল । সরল উপজাতীয়দের ভুল বুঝিয়ে বিপথগামী করছে এরাই । দেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার শাস্তি কি তা এদের বোঝাতেই হবে। নাগরিক সমাজ এবং মিডিয়াকে বুঝতেই হবে যে ওই অঞ্চলের দৈন্যদশা এবং বেকারিত্ব ঘোচাবার পথে কাঁটা একমাত্র মাওবাদীরা।
সে অবশ্য বোঝানো গেছে ভালোভাবেই। যুদ্ধক্ষেত্র এবং ভয়াল প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া দুদিনে কোথায় চল্লিশজন মানুষ মরে ? অথচ কোন আলোচনা নেই এই রাষ্ট্রীয় খুন নিয়ে। মিডিয়া তো দূরস্থান, মেধা পাটেকর, স্বামী অগ্নিবেশ, যারা এই রাজ্যের বাম জমানার সমালোচনায় মুখর ,তারাও মুখে কুলুপ এঁটেছেন।ন্যায্য পাওনা চাওয়া বড় অপরাধ। অস্ত্রের চ্যালেঞ্জ আরো মস্ত বড় অপরাধ । তাই গড়চিরোলিতে নিহত মাওবাদী নেতা সাইনাথের মাথার দাম ধার্য হয়েছিল ষোল লাখ টাকা। ভেণুগোপাল, তেতুম্বে এবং নারমডাক্কা—প্রত্যেকের মাথার দাম ৬০ লক্ষ টাকা জানিয়ে মহারাষ্ট্রে খবরের কাগজগুলিতে বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে জনগণের টাকায় । অথচ দেশের টাকা তছরুপ করে লন্ডনে ডঙ্কা বাজিয়ে বিজয় মাল্য তৃতীয়বারের জমকালো বিবাহবাসর বসায় , নীরব মোদি যত টাকা মেরেছে তার কণামাত্রও উঠে আসবে না ফেলে যাওয়া সম্পত্তি আর নকল হীরে ক্রোক করলে। কাঠুয়ার সঞ্ঝিরামের মতো অভিযুক্তও আইনী সহায়তা পায় । রাম রহিম, আশারামের থেকেও বড় অপরাধ কি নিজের গাঁওখেতি , ভালোবাসার মেয়েটির সম্ভ্রম ফেরত চাওয়া? রাষ্ট্র যেনতেনপ্রকারেণ এদের খুন করতে চায় । এদের একমাত্র অপরাধ এরা সশস্ত্র সংগ্রামে বিশ্বাসী, এরা মাওবাদী। নিরন্তর প্রচার এইটুকু খুব ভালোভাবেই করতে পেরেছে যে নাগরিক সমাজেরও বড় অংশই এখন বিশ্বাস করে মাওবাদীনিধন জায়েজ ।বুলেটের জবাব বুলেট, রাষ্ট্র যা করছে ঠিকই করছে। কোন কৈফিয়ত দেবার দায় তার নেই।
দায় না থাকলেও প্রশ্নগুলো কিন্তু থেকেই যায় । এই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিচালক নির্বাচিত সরকার। সে সংবিধান এবং আইন মানতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। রাষ্ট্র আইনী প্রতিষ্ঠান, ফলে দেশের বিপথগামী বা সুপথগামী নাগরিকদের কোন কাজে শাস্তি দিতে হলে সে আইনী সীমা লঙ্ঘন করতে পারবে না। মাওবাদীদের ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য নয়, কারণ তারা দেশের সংবিধানকে অস্বীকার করে এবং তাদের প্রতিষ্ঠান ও কার্যকলাপ ঘোষিতভাবে বেআইনি । তারা যদি দেশের শত্রু হয়ে থাকে , তাহলে দেশদ্রোহ আইনে তাদের সাজা দিতে হবে। মিথ্যে এনকাউন্টারে মেরে ফেলা চলবে না , আত্মসমর্পণ করতে চাইলে বুলেটে তার জবাব দেওয়া যায় না । এক্সট্রা জুডিশিয়াল কিলিং বা বিচারবহির্ভূত হত্যা যদি সবক শেখাবার সহি রাস্তা হতো তাহলে পঞ্চাশ বছর ধরে এই সমস্যা চলে আসছে কিভাবে ? ইন্দ্রাবতীতে যারা ঝাঁপ দিয়েছিল প্রত্যেকের শরীরে বুলেট অথবা অন্য অস্ত্রের দাগ আছে। অন্য শরীরগুলোতে বেধড়ক অত্যাচারের ছাপ । জেনিভা কনভেনশন অনুযায়ী শ্ত্রুদেহের বিকৃতিও আইনবিরুদ্ধ । মৃতকে মৃতের মর্যাদা দিতে হবে এটাই প্রত্যেক সভ্যদেশ মনে করে। ইনক্লুসিভ গ্রোথ বা সবার জন্য উন্নয়ন ছাড়া পথ নেই তা কাশ্মীর কিন্তু ইতোমধ্যেই বুঝিয়ে দিয়েছে।
তবু যারা বুঝতে চায়না তারা ক্ষমতার মদে মত্ত । কারন শুধু অন্য ধর্মাবলম্বী হবার কারণে তারা এক বিপুল জনগোষ্ঠীকে খুন করেও আইনিপ্রক্রিয়ার ফাঁকফোকর দিয়ে নিজেদের বেকসুর খালাসের বন্দোবস্ত করে উঠতে পারে। দেশের সব অরণ্য ,সব জনজাতি ,সব আইন এখন তাদের পদানত । তাই সরকারী নথি বলছে ওরকম কোন গভীর রক্তচিহ্ন ্মেরিয়া গোন্দদের বাসস্থানে নেই , মেনে নিতে হবে। তারা বলছে গড়চিরোলিতে যতো মানুষ মরেছে এলিট সেনাদের বুলেটে তারা সকলেই মাওবাদী , মেনে নিতে হবে ।
তাহলে এবার দেখে নেওয়া যাক , মাওবাদী মরে কিভাবে।
মাওবাদীর মৃত্যু
পাঁচদিন ধরে গড়চিরোলির গাট্টেপল্লী গ্রামের আটজন তরুণ তরুণীকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছিল না। কয়েকজন আবার নাবালক। বাকীরা সবে কৈশোরের সীমানা ছাড়িয়েছে। যেমন ষোল বছরের মঙ্গেশ বিজ্জা। ক্লাস টেনের রেজাল্ট বেরোবার পর বাড়ি এসেছিল , ইট্টাপল্লীর কলেজে ভর্তি হবার পর। যেমন সতের বছরের রাসসু চাকো মাধবী। কখনো বড়ি থেকে কিছুদিনের জন্য উধাও হয়ে যাওয়া, মাধবী এসবের মধ্যে কখনো ছিলনা , যেমন থাকে দলমে যোগ দিতে ইচ্ছুক ভবিষ্যতের মাওবাদীরা। আসলে তারা বেরিয়েছিল কাসানসুরের বিয়ে বাড়িতে যাবে বলে । ব্যাগে ভালো পোশাকও ্নিয়েছিল বিয়ের আসরে পরবে বলে। আর নিয়েছিল আধার কার্ড। মাওবাদীঅধ্যুষিত এলাকায় প্রত্যেক আদিবাসীর সঙ্গে পরিচয়পত্র রাখতেই হয় , চাওয়ামাত্র না দেখাতে পারলে খুলি ফুটো হয়ে যেতে পারে যখনতখন।
বাচ্চাগুলো না ফেরায় পুলিশে রিপোর্ট হবার পর জানা গেল গড়চিরোলিতে হত মাওবাদীদের তালিকায় এরা প্রত্যেকেই রয়েছে। তারা নাকি প্রত্যেকেই ছিল নিউ রিক্রুট ,যারা প্রথমবারের মতো দেখা করতে এসেছিল কম্যান্ডারের সঙ্গে । অভিভাবকরা মিডিয়াকে জানান মৃতদেহগুলো অত্যধিক গরমেও ফেলে রাখা হয়েছিল একট গুমোট ঘরে । প্রত্যেকটি লাশই ঢোকানো ছিল শক্ত মোটা পলিথিনের ব্যাগে, দেখা যাচ্ছিল শুধু মুখটুকু । সে মুখ ফোলা, বিকৃত, রক্তজমা। চেনা যায়নি বলেই আধারের কথা মনে হয় । পুলিশ বলে তদন্তের খাতিরে আধার কার্ডগুলি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। এখনও সে তদন্ত শেষ হয়নি , হবেও না। অভিভাবকরা কি করে সন্তানের হারিয়ে যাওয়াটুকু প্রমাণ করবেন সেই চিন্তায় কাতর। তাঁরা সন্তানের পরিচয়পত্র ফেরত চান , নিরপেক্ষ তদন্ত চান , অপরাধীর শাস্তি চান , নিরপরাধের ওপর থেকে অপরাধের তকমা ওঠাতে চান । কিন্তু একমাস পেরিয়ে গেলেও পুলিশ প্রশাসনের মুখে কুলুপ আঁটা ।
মহারাষ্ট্রের বিদর্ভ রিজিয়নে এইভাবেই দশকের পর দশক জন্ম মৃত্যু বিবাহ প্রায়ই একতারে বাঁধা পড়ে। যুধ্যমান দুইপক্ষের মধ্যে পড়ে নিরীহ মানুষ হয়ে যায় দেশদ্রোহী , নিরপরাধ মূহুর্তে লাশ হয়ে যায় । ঘরছাড়্রারা মৃতদেহ হয়েও ঘরে ফিরে আসে না । অথচ আদিবাসীদের দাবী ছিল এইরকম – ভারী শিল্পের বদলে বনজ সম্পদ্ভিত্তিক ক্ষুদ্রশিল্পের প্রসার যার মালিকানা থাকবে গ্রামসভার হাতে । লাগু হবে ২০০৬ সালের আইন অনুযায়ী বনের ওপর শিডিউল ট্রাইব ও অন্যান্য জনজাতির মালিকানা ও ১৯৯৬ সালের পঞ্চায়েত আইন । তারা চায় বনভূমিকে উন্নয়ন ভূমিতে বদলে দেবার আগে সরকার নিবিড় যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করুক গ্রামসভার সঙ্গে , যেমন হয়েছিল ওড়িষ্যার নিয়মগিরিতে । এইগুলির মধ্যে কোনটাকেই অন্যায্য বলে মনে হচ্ছে কি?
কিন্তু এসবের বদলে কর্পোরেটের মাস্তুতো ভাইরা চাপিয়ে দেবে মিথ্যে কেস , লাঞ্ঝনা , মৃত্যু ,রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস । আভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা রক্ষার নামে চলবে চরম মানবাধিকার লঙ্ঘন । আমরা নীরব থাকব এবং ভুলে যাব নিরস্ত্র জনতার ওপরও গুলি চালানো যায় , যদি কর্পোরেটের গায়ে আঁচ লাগে , যেমন লেগেছিল তুতিকোরিনে । এদেশের জনতার ৮% আদিবাসী। তাদের ওপর অত্যাচার রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করবে আর আমাদের নীরবতা দিয়ে আমরা হব সেই হত্যা ও ধ্বংসের পূর্ণ ভাগীদার।