আমার পুজোনামচা
ভোকাট্টা: নীল পাটভাঙা শাড়ি পরে, মিহি শিউলির সাদা টিপ কপালে, গায়ে কাশের গন্ধ নিয়ে সেই যে বিশ্বকর্মা পুজোর সাথে সাথে শরতের 'পুজো আসছে'র আইভরি আমেজ- সে আমার বর্ষা পরবর্তী চিরকালীন 'উৎসব অনুভূতি'র প্রাক নির্মলি।
এই ঋতুকালীন হুল্লোড় : কালো কালো মেঘের ছড়ি ঘোরানো হঠাৎ থেমে গিয়ে আকাশের নিঃশ্বাস ফেলার দু'দন্ড ফুরসৎ, পুকুরের জলের শাপলা-পদ্ম নিয়ে সবজেটে স্বপ্ন দেখার খুব ধুমধাম, রাস্তাঘাটে-পিচে জমা পুরু কাদার পরত ধুয়ে গিয়ে শ্যাওলাহীন মুখ বের করার খুশি মেহনত, খোলা মাঠে একগুচ্ছ কাশের ধীর লয়ে রোদে লুকোচুরি - এসবেই কোথাও পুজোর নৈবেদ্য, প্রসাদ, নতুন জামা, আরতি, ধুনুচি নাচ, ঢাকের বাদ্যির আগমন সমাচার, অদৃশ্য ফিতে কেটে দেয় যেন প্রকৃতি শারদাগমের।
'পথের পাঁচালী'র রেললাইনের ধারে কাশফুল কিংবা 'জয় বাবা ফেলুনাথ'এ "পরশু তো ষষ্ঠী, আপনার কাজ পরশুর মধ্যে শেষ হবে?" বাঙালির ল্যাজে সুড়সুড়ি-সেন্টুতে ফুক্কুড়ি কাটার বহু আগে থেকেই মা দুর্গা আমাদের ওপর বিশেষ প্রসন্ন, আমাদের ঘরের মেয়ে, তাই ভেজ-ননভেজের পিট্টু 'চু-কিৎ কিৎ' ফেলে এ পুজো 'পুজো'র রীতি ছড়িয়ে উৎসবের ডেফিনিশনকে নার্ভফেল করিয়ে ছেড়েছে এক ছক্কায়। অতএব জাতি হিসেবে এই 'পুজো-পুজো ইয়ে' ই আমাদের ধরাধামে ফুর্তি - হুল্লোড় জুড়তি।
তা এই আমাদের মধ্যেও ফুটাস্কোপ দিয়ে ছেঁকে পাওয়া 'আমরা', যারা বিশুদ্ধবাদি কচকচানিতে ধর্মের পরিসংখ্যান মেপে 'সংখ্যালঘু' আওতায় পড়ি, হ্যাঁ, তাদের কাছেও এটা উৎসব - ভিড়ে ঘামের গন্ধ হজমে - পায়ের ফোস্কা মলমে হাউমাউ প্রগালভতার আমুদে সেলিব্রেশন বচ্ছরকার এই চারটে দিন এবং তা আমি পুজো সংখ্যার বর্ষাকালীন টুকি মারারও বহু আগে থেকে আশায়-অপেক্ষায় আঙুল গুনি। যেহেতু লঘু-গুরুর প্রসঙ্গ হাঁটি-হাঁটি-পা-পা করে এসে থেবড়ে বসেই পড়ল, তখন বলেই ফেলি, অফিস- কাছারিতে একটা দিনও যে ঈদের জন্য বরাদ্দ নেই (ফ্লেক্সি আছে খালি) - এইটা সারারাত পুজোয় ঘুরে রোল-বিরিয়ানি-আইসক্রিম-চাউমিন-ফুচকা একসাথে হজম করার থেকেও সত্যি বেশ কষ্টকর। শুধু এটুকুই 'অভিযোগ' ভেবে যেসব চরমপন্থী হনুর আঁতে হওয়া ঘা'য়ে কয়েক চিমটে নুন পড়ে গেছে বলে রে-রে করতে আসবেন ভেবে আস্তিন গুটাচ্ছেন, তাদের বলি, বাংলাদেশে এই লঘু-গুরুর হিসেবটা এ বঙ্গদেশের মাপে এক্কেরে লুডোর গুটি - ছক্কা আর পুঁটের মাপজোখ : সেখানে পুজোর বদলে তাই ঈদসংখ্যা বেরোয়, তিনদিন ছুটি বরাদ্দ, সাথে টিভিতে বিশেষ অনুষ্ঠান এবং 'দ্য কাউন্টডাউন বিগিন্স' জাস্ট লাইক বঙ্গদেশের পুজো। কিন্তু তবুও ঈদ, দুর্গাপুজোর মতো 'সার্বজনীন' হয়ে উঠতে পারেনি ধর্মীয় বেড়াজালে অক্সিজেন লেভেল কমিয়ে।
ঈদের সকালে বাড়ির ছেলেরাই শুধু নামাজ পড়তে যায় (কিছু 'প্রগতিশীল' ঈদগাহে মেয়েরা অবশ্যি হাল আমলে নামাজ পড়ে তবে ওই আর কী, 'পর্দা মেনে')। আব্বু মসজিদে রওনা হওয়ার আগে আম্মি মিষ্টিমুখ করাতে ভোর ভোর উঠেই ( নামাজ মোটামুটি ৭-৮ টা নাগাদই শুরু হয়ে যায়) সিমাই-লাচ্ছা বানিয়ে রাখে। এরপর বাড়িতে বন্ধু-বান্ধব-আত্মীয় আসার পালা, সুতরাং একটু বিশ্রাম নিয়েই শুরু হয় বিরিয়ানি-চাপ বানানোর তোড়জোড়। আমরা ছেলেপুলেরা টুকটাক ফাই-ফরমাশ খেটে দিই আর ভাবি নতুন জামা কখন পরব। কিন্তু তারপর আর কতদূরই বা যাব, অগত্যা ফটোসেশন শেষ হলে দু'এক বাড়ি ঘুরে এসে বন্ধুদের সাথে আম্মির বানানো বিরিয়ানির ওপর হামলে পড়া আর ঢেঁকুর তোলার ফাঁকেই ঈদ কেমন ফুরিয়ে যায়।
পুজোয় ঠাকুর দেখা - না দেখার প্ল্যান আপডেটেড হোক বা না হোক বাড়ির সবাই একদিন-বন্ধুরা একদিন- পাড়ায় আড্ডা একদিন-মিষ্টি নিয়ে আত্মীয়ের বাড়ি একদিন : এই অলিখিত গোলকধাঁধা, ম্যারাপ বাঁধার বহু আগে থেকেই শরতের খুশি খুশি রোদ্দুরপালকে আঁকা হয়ে যায় মরশুমি পীরিত।
কলকাতার ভিড়ভাট্টা থেকে যে বছর পালাতে মন চায়, পাততাড়ি গুটিয়ে চলে যাই সুন্দরবনের কাছে কোনো এক গ্রামে। মেকমাইট্রিপে টেনশনকে মুড়ি-বাতাসা খাইয়ে জলপট্টি দেওয়ার রিস্ক কাটাতে নয়, শিমলা-মানালি-গোয়ার যে বহুচর্চিত 'ভ্রমণপিপাসু' সাইকেল, যেখানেই যাইবে বাঙালিই পাইবে - ধারণাকে এবেলা স্রেফ বেরসিক দশেরার তুবড়িবাজি থেকে কানে তুলো দিয়ে মনকে লেবুজল খাওয়াতেই বাংলায় থাকা। একটা ছোট্ট গ্রাম : হিন্দু-মুসলিম মিলে গুটিকয়েক বসত, সন্ধ্যে কাটে যেখানে চাঁদের আলোয়, পুজোর চারদিন ছেলেমেয়ে সব দল বেঁধে নতুন জামা পরে গ্রামের ছোট্ট বাঁশের প্যান্ডেলের সামনে জড়ো হচ্ছে, কিশোর কুমার এই হানি সিং এর গুঁতানো টপকে এ কলিকালেও দিব্যি গাইতে পারছেন 'শিং নেই তবু নাম তার সিংহ' - এই হল বাংলায় দুর্গা মায়ের মাহাত্ম্য।
বারাসতের মেয়ে, তাই পুজোপ্রসঙ্গে মা কালীকে না টানলে, অভিশাপে, কানে বিরাশি সিক্কার চড়ের জন্য এবার থেকে টেনিদা প্যালারামের বদলে আমাকে টার্গেট করতেই পারে, অতএব সে বিষয়ে বলি, বেশ ধুপধুনো - থিম - লাইটিং - গাজরমার্কা তুবড়ি - উৎসাহ ভিড়, আয়োজনে কোথাও এতটুকু কমতি না থাকলেও এটা আমার কাছে স্রেফ পুজো : ঠাকুর দেখা - ঘুরে বেড়ানো পুজো। দুর্গাপুজোর মতো এমন দিলদার ফুর্তি আঁচলে নিয়ে 'উৎসব' হয়ে ওঠেনি, উঠতে পারেনি, যেভাবে ঈদ সার্বজনীন উৎসব হয়ে উঠতে পারেনি আপামর বাংলায়।
উৎসব ফুরোলেই ইতিবৃত্তের শুরু। একই রুটিন, একই একঘেয়েমি। বিসর্জনের আগে এত যে শিউলি, এত যে মুহূর্তের আনন্দমাখা, নবমীর রাত থেকেই সেসব কেমন বিষণ্ণ হতে শুরু করে - জ্যোৎস্নায় অন্ধকার ধুয়ে গেলেও যে মনোগত আঁধার ছোঁয়াচে লেগে থাকে চোখে : ঠিক তেমনি এক নিথর মনখারাপিয়া, বিষাদ- আহ্লাদী গুফতাগু বুকে নিয়ে শুরু হয় আরও এক অপেক্ষার; স্নিগ্ধ, বছরভর, প্রহর গোনা এক আগমনী উৎসবের।