কালো টাকা না কালো ব্যবসা?
যখন দেশের কালো টাকা নিয়ে হা হুতাশ করি সেটা কি বেআইনি টাকার বান্ডিল নিয়ে করি? না, যে কারণ থেকে কালো টাকা জমা হয়েছে তার ওপর রাগ করি? এনডিএ সরকারের কাজকম্মো দেখে এই খটকাটা লাগতেই পারে।
বেআইনি রাস্তায় রোজগার করা টাকা নিয়ে রাগ থাকা স্বাভাবিক। সে টাকা বাজেয়াপ্ত করা উচিত এ ব্যাপারে দ্বিমত নেই। কিন্তু একটু চিন্তা করলে বোঝা যাবে, স্রেফ টাকা বাজেয়াপ্ত করলে কাজের কাজ বিশেষ হবে না।
কালো টাকা আসে বেআইনি আর্থিক গতিবিধি থেকে। ধরুন, প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে ডাক্তারবাবু যত রোজগার করছেন, ট্যাক্স বাঁচাতে তার পুরোটার হিসেব সরকারের কাছে দিচ্ছেন না। হিসেবের বাইরের এই রোজগারকে কালো টাকা বলব। ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, চার্টার্ড এ্যাকাউন্টান্ট, প্রাইভেট টিউটার, উকিল – সবাই কালো টাকা রোজগার করতে পারেন। ব্যবসায়ী, শিল্পপতিদের কাছে অবশ্য এনারা তুশ্চু। লক্ষ্য করুন এদের কারো পেশা বেআইনি নয়। কিছুটা লুকোনো হচ্ছে, সেটা বেআইনি।
আবার অনেক আর্থিক কাজ আছে যা শুধু কালো টাকা উৎপাদন করে। যেমন ড্রাগ বেচা, ডাকাতি, ঘুষ। আর্থিক গতিবিধিগুলোই বে-আইনি, তাই পুরোটা কালো টাকা।
যে কালো টাকা জমা হয়েছে কালো ব্যবসায়ীর কাছে সরকার তা বাজেয়াপ্ত করে নিলে সরকারের ঘরে কিছু টাকা আসবে। কালো টাকার স্রোত কিন্তু তাতে থামবে না। কেননা যে সমস্ত আর্থিক গতিবিধির ফলে কালো টাকার জন্মাচ্ছিল তার ওপর আঁচ পড়ছে না। পোষাকি অর্থনীতির ভাষায় স্রোত বা ফ্লো (flow)-এর ওপর ঘা পড়ছে না। শুধু জমাপুঁজি বা স্টক (stock) বাজেয়াপ্ত করা হচ্ছে। কালো টাকা ধ্বংস হল, তার জনক কালো ব্যবসা অক্ষত থাকল। সেখান থেকে আবার স্রোত বেরিয়ে ভবিষ্যতে নতুন কালো টাকার স্টক তৈরি হবে।
সার্জিকাল স্ট্রাইকে কী লাভ হতে চলেছে?
নরেন্দ্র মোদিজির সরকার ৮ নভেম্বর রাত থেকে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোটের বৈধতা শেষ করে দিয়েছেন। পোষাকি ভাষায় নোটগুলো আর লিগ্যাল টেন্ডার থাকছে না। অর্থাৎ, নোটগুলোর যে মূল্য ছিল তার দায় আর রিজার্ভ ব্যাঙ্ক বা সরকার নিচ্ছে না। যাদের কাছে ৫০০, ১০০০ টাকার নোট আছে ৩০ ডিসেম্বর পর্যন্ত ব্যাঙ্ক, পোস্ট অফিসে গিয়ে তারা পুরোনো নোট বদলে নতুন নোট নিয়ে আসতে পারবে। তবে ঊর্ধ্বসীমা আছেঃ ৪০০০ টাকা জনপ্রতি। এর ফলে নাকি কালো টাকার হাত থেকে নিস্তার পাওয়া যাবে। যুক্তি এই যে, যাদের কাছে কালো টাকা আছে, তারা টাকা বদলাতে ব্যাঙ্কে যাবে। নোট জমা করতে গেলেই সরকার বাহাদুর টের পেয়ে যাবেনঃ এইয়ো, হিসেবমত ওর কাছে তো এতো টাকা থাকার কথা নয়! ক্যাঁক।
বলা হচ্ছে, দুটো সুফল পাওয়া যাবে। এক, দোষিদের জরিমানা থেকে সরকারের হাতে দুটো টাকা আসবে। দুই, কালো টাকা দেশ থেকে ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যাবে। যারে কয়, স্বচ্ছ ভারত।
যুক্তিগুলো পরীক্ষা করে দেখা যাক। মোদিজি যাকে নিশানা করছেন সেটা স্টক, জমা কালো টাকা। কালো ব্যবসাকে তিনি নিশানা করেন নি। ফলে এর থেকে কোনো দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ আছে। দীর্ঘস্থায়ী ফল পেতে গেলে এরকম ঘনঘন সার্জিকাল স্ট্রাইক করতে হবে। মনে হয় না সরকারের সেরকম পরিকল্পনা আছে।
দীর্ঘকালীন ফল না পাওয়া যাক, স্বল্পকালীন সুফল পাওয়া যাবে কি? কালো টাকার জমা পরিমাণকে ধাক্কা দেওয়া যাবে না ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট তুলে দিয়ে?
জবাব খুঁজতে গেলে জানতে হবে বে-আইনি সম্পদের কত অংশ নোটে রাখা থাকে; কেননা নোট ছাড়া অন্য কোনোভাবে সম্পদ রাখা থাকলে তা কিন্তু মোদিজির জালে ধরা পড়ছে না। কালো ব্যবসার অবস্থান যেহেতু সরকারি হিসেব বহির্ভুত এক ছায়াজগতে, তাই এই নিয়ে নিশ্চিতভাবে বলা মুশকিল। আমরা একটা কাছাকাছি, গোদাগোছের, হিসেব করতে পারি। বিভিন্ন সরকারি এজেন্সি তল্লাশি চালিয়ে কালো টাকা বাজেয়াপ্ত করে। লুকিয়ে রাখা আয়ের কত পরিমাণ নোটে ছিল তার তথ্য আছে। মাত্র ৬%। অর্থাৎ কালো কারবারিরা মাত্র ৬% নোটে রাখেন। বাকিটা অন্যান্য সম্পদের মাধ্যমে রাখা হয়। জমি, সোনা ইত্যাদি। তাহলে ৫০০, ১০০০ টাকার নোট বন্ধ করে কালো টাকার মোট পরিমাণের খুব ছোট্ট অংশকে ধরা যাচ্ছে। লক্ষ্য করুন এখানে বিদেশে সুইস ব্যাঙ্কে রাখা মণি মানিক্য ধরছি না। ধরলে সংখ্যাটা ৬%-এর থেকে আরো কমবে।
দ্বিতীয়ত, ওই ৬%-ও তার মালিকরা তো বিনাযুদ্ধে ছেড়ে দেবেন না। বাজারে কালো টাকা সাদা করার নানান পদ্ধতি দেখা যাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে সোনার বাজার হঠাৎ তেজি যাচ্ছে, সম্ভবত কালো টাকা দিয়ে সোনা কিনে নেওয়া হচ্ছে। কারখানার মালিকরা তাদের শ্রমিকদের নাম করে টাকা সাদা করে নিচ্ছেন। জনপ্রতি ৪০০০ টাকা বদলানো যাচ্ছে। মানে ৫০ জন শ্রমিকের নামে দিনে ২ লাখ সাদা করা সম্ভব। এক মাসে ৬০ লাখ। আবার, নিয়ম অনুযায়ী ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্টে জনপ্রতি আড়াই লাখ টাকার নিচে পুরোনো নোট জমা দেওয়া যাবে। অন্যের ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট ভাড়া করে এই রাস্তায়ও টাকা সাদা করার কারবার চলছে। ট্রেন টিকিট কাটতে গেলে পুরোনো নোট ব্যবহার করার ছাড় আছে। ফলে অনেকে ট্রেন টিকিটে কালো টাকা লগ্নি করতে লেগেছেন। পরে টিকিট ক্যানসেল করে টাকা উঠে আসবে।
সংক্ষেপে, যেটুকু কালো টাকা জালে ধরা পড়ার কথা (যা কালো সম্পদের ৬%) তার কতখানি হাতে আসবে স্পষ্ট নয়। উপরন্তু, দেখা গেছে ৮ নভেম্বরের ঠিক আগের মাসগুলোতে হঠাৎ ব্যাঙ্কগুলোতে টাকা জমা দেওয়া হিড়িক পড়েছিল। সন্দেহ হয়, সার্জিকাল স্ট্রাইকের খবর গুপ্ত ছিল না, সুযোগ ভাজপা ঘনিষ্ঠরা তুলেছেন।
সন্ত্রাসবাদী যোগ ও জাল নোট নিয়েও কিছু কথাবার্তা কানে এসেছে। জাল নোট নির্মূল করা যদি উদ্দেশ্য হয় ধীরে ধীরে পুরোনো নোটকে নতুন নোট দিয়ে প্রতিস্থাপন করা যেত। আজকের অরাজকতা দেখতে হত না।
কাদের ওপর সার্জিকাল স্ট্রাইক?
এবার আসা যাক এই অপ্রত্যাশিত ঘোষণার লোকশানে। ভারত গরিব দেশ। কেনাবেচার সিংহভাগটাই নগদ নোটে হয়। ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড, নেট ব্যাঙ্কিং জাতীয় নোটহীন কেনাবেচা মোট লেনদেনের মূল্যের মাত্র ১৪%। এই সংখ্যাটা বাড়ছে, তবে এখনো ৮৬% কেনাবেচা কাগজের নোটেই হয়।
কারা নগদে কেনাবেচা করেন? একটা অংশ অবশ্যই অসাধু ব্যবসায়ীরা, কেননা বৈদ্যুতিন কেনাবেচাতে রেকর্ড থেকে যায়। তবে অনুমান করা শক্ত নয় দুর্বল আর্থিক সামর্থের ক্রেতা বিক্রেতাদের “ক্যাশলেস ইকনমিতে” উত্তরণ হয় নি। তাঁরা ওই ৮৬%-এ আছেন। কেন এতো লোক নগদে কেনাবেচা করেন? কারণ খুব কম লোক ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন। মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৪%-এর ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট আছে। আবার মোট এ্যাকাউন্টের ৪৩ % সুপ্ত (ডরম্যান্ট) অবস্থায় পড়ে আছে। অর্থাৎ, মাত্র ৩০% লোক ব্যাঙ্ক এ্যাকাউন্ট ব্যবহার করেন। এদের মধ্যে একটা ছোট ভগ্নাংশের কাছে আছে প্লাস্টিক টাকা কিম্বা নেট ব্যাঙ্কিং। অর্থাৎ এক বিশাল সংখ্যাগুরু জনতা নগদ দিয়ে কাজকারবার চালাচ্ছে। যাদের কার্ড আছে তারাও অনেক কেনাবেচা নগদে করতে বাধ্য থাকেন। ক্রেডিট কার্ড থাকলেও খুব কম লোকই ক্রেডিট কার্ড দিয়ে পাড়ার বাজার থেকে তিন মুঠো পালং শাক কেনেন, বা রিক্সাওয়ালার ভাড়া চোকান।
এই আম জনতা যারা নগদের ওপর নির্ভরশীল তাদের ওপর মোদিজির সার্জিকাল স্ট্রাইক পড়েছে। ৫০০, ১০০০-এর নোট উঠে যাওয়াতে গ্রাহকের হাতে বৈধ নগদ নেই যে খুচরো বাজারে মাল কিনবে। ফলে দোকানদারের হাতে টাকা নেই পাইকারের থেকে কেনার। ফলে পাইকারের হাতে টাকা থাকছে না, ও ফলে উৎপাদকের গুদামে মাল জমে যাচ্ছে। সার্জিকাল স্ট্রাইকের ফলে অর্থনীতির শিরা-ধমনী বন্ধ হয়ে দেহে পক্ষাঘাত দেখা দিচ্ছে।
কতটা অংশ প্রভাবিত হচ্ছে একটা ছোট্ট হিসেবে দেখা যাক । দেশের মোট লেনদেন মূল্যের ৮৬% নগদে চলে। আর নগদ জগতের মোট মূল্যের প্রায় ৮৫% ধারণ করছে ৫০০ আর ১০০০ টাকার নোট; বাকি ১৫% ৫, ১০, ২০, ৫০, ১০০ টাকার নোট ও বিভিন্ন মুদ্রা। অর্থাৎ, দেশের মোট লেনদেনের প্রায় চারের তিন ভাগ মোদিজির সার্জিকাল স্ট্রাইকে থমকে গেছে (৭৩% ~ ৮৬% * ৮৫%)। এই থমকে যাওয়া অংশের মূল্য ১৫ লাখ কোটি টাকা। অংশটা সচল হবে যদি ১৫ লাখ কোটি টাকা মূল্যের ৫০০, ২০০০-র (বা ১০০) নতুন নোট বাজারে আসে। এটা রাতারাতি হওয়ার কথা নয়। এতো বিশাল পরিমাণ টাকা অর্থনীতির ধমনীতে সঞ্চারিত হতে সময় লাগে। ওই পরিমাণের নোট তৈরি আছে কিনা তাও একটা জরুরি প্রশ্ন। উপরন্তু সরকার এটিএম বা ব্যাঙ্কের মাধ্যমে টাকা তোলার ওপরে ঊর্ধ্বসীমা জারি করেছে। ফলে বড় পরিমাণে নতুন টাকা ঢুকতেই পারছে না।
সামনের দিনগুলোতে ব্যাঙ্ক, এটিমের লাইন ছোট হবে না। যদি ভবিষ্যতের লাভের পরিমাণ আজকের যন্ত্রনার সমানুপাতিক হত তাও বোঝা যেত। সে হওয়ার নয়। প্রভাত পট্টনায়েক একখানি উপমা দিয়েছেন। কেউ খুন হলে পুলিশ নিশ্চয়ই গোটা অঞ্চলের মানুষকে থানায় নিয়ে হাজির করে তল্লাশি চালায় না কার হাতে, জামায় রক্ত লেগে আছে দেখতে। কেসটার তদন্ত করে। মোদিজির কালো টাকা শিকার অভিযান গাঁশুদ্ধু লোককে পুলিশ হয়রানির সামিল।