পুষ্পেনকে গাড়িতে তুলে ভুলই করে ফেলেছি। প্রথমে বেশ খোরাক দিচ্ছিল, ক্রমে মাতলামিটা বেহেড হয়ে যাচ্ছে। সৌরভের ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে মাল বলল– বাড়ি গেলে কেস খাবে; একে তো বউয়ের ভয় তার ওপর বাবা মা এখন এসে আছে। আমিও ভাবলাম, চিনার পার্কের ফ্ল্যাটটা তো ওকে দেখানোও হয় নি। রাতে দুজন ওখানেই কাটিয়ে দিই। কাল সকালে ফ্রেশট্রেশ হয়ে বাড়ি ফিরব। ফ্ল্যাটটাও একটু দ্যাখাশুনো করে রাখা হবে। ইনভেস্টমেন্টের জন্যে কিনে ফেলে রেখেছি, উইকেন্ডে একদিন কাটালে তো ভালোই। কিন্তু, এদিকে গাড়িতে উঠে থেকে খেউড় চালিয়েই যাচ্ছে এ মাল।
– ‘অনি, বল তো সৌরভ মাল খাওয়ালো কেন আজ?’
– ‘কেন?’
– ‘আবে! জানিস না? সঞ্চিতা অনসাইটে। বউ নেই, তো মাল খাও, মাল খাওয়াও। আর মাল ফুরিয়ে গেলে, ঐযে– জয়নী। আহ!’
– ‘জয়নী আবার কী করল?’
–‘কেন বাল! সৌরভ আজ ডেকেছিল কাদের? আমি তুই আর জয়নী। আমরা কেটে পড়লাম। এবার রাতভোর এনজয়!’
–‘ধুর্! জয়নীর বর তো ওকে পিক আপ করতে আসবে বলল!’
–‘ল্যাও! তুই ওসব বিশ্বাস করলি? ফোন ধরে ফিস ফিস করে মামণি বললেন – বর তুউলতে আসবে! ও বালের ফোন! ওকে তুলবে সৌরভ। বর-ফর নেই সিনে। আমরা ঢপ খেয়ে বেরিয়ে এলাম, এরপর সৌরভ ওকে নিয়ে ঢিকঢিক করবে, ঢিকঢিক ঢিকঢিক!’
–‘কী ভাট দিচ্ছিস! ফ্যান্টাসির লেভেল আছে’
–‘কে ভাট দিচ্ছে! পুষ্পেন মাইতি বাজে ভাট দ্যায় না! তুই গাড়ি ঘোরা, চল গিয়ে দেখি।’
–‘ধ্যাত ’
–‘মাইরি বলছি অনি! চল ব্যাক কর। কলিং বেল দিবি আর জয়নী তোয়ালে পরে বিরিয়ে আসবে। থাইয়ের দিকটা খোলা’
–‘উফফ’
–‘কীসের উফফ বাঁড়া! চল তুই গাড়ি ঘোরা। দে বাঁড়া আমি চালাচ্ছি গাড়ি। ঢিকঢিক ঢিকঢিক––’
–‘মাতাল শালা’
–‘কেউ মাতাল না!’ পুষ্পেন প্রায় স্টিয়ারিং-এর ওপর হামলে পড়ছে।
নেশা আমারও হাল্কা হয়েছে, তার ওপর মাতাল সামলানো! দাবড়ে সিটে বসিয়ে দেখি ছোট্টো করে একটা ছড়িয়ে ফেলেছি। টাটা মেডিকেল থেকে বাঁদিক না ঘুরে গাড়ি এগিয়ে নিয়েছি ইউনিটেকের সামনে দিয়ে। আইটির ব্যস্ততা মিটিয়ে ফাঁকা হয়ে গেছে চারদিক, ঝুপড়িগুলোও আলো নিভিয়ে দিয়েছে মনে হচ্ছে। রাস্তার আলোও বেশ কম।
অচেনা খালের ওপর একটা অচেনা ব্রিজ, সেটা পেরিয়েও কিছুটা এগিয়ে এসেছি, গাড়ি ঘোরানোর কাটও পাচ্ছি না। ইকোস্পেসটা এইদিকেই তো পড়ার কথা!
–‘কী যে করিস না! তোর জন্য ভুল রাস্তায় চলে এলাম! একগাদা ঘুরতে হবে এবার।’ পুষ্পেনের জন্যই ফালতু এই রাস্তায় ঢুকে পড়লাম!
–‘বলছিলাম না! কে মাতাল! গাড়ি না চললে রাস্তা ভুল। দে স্টিয়ারিং দে জয়নীকে দেখে আসি।’
–‘উফফ! শাট আপ। সোজা যাই বরং, কিছুটা ঘুরেই আলিয়া ইউনিভার্সিটির ক্যাম্পাসের পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাব।’
–‘যা বাল ছেঁড়ার ছেঁড়! আলিয়া ভাটের থেকে জয়নী ভট বেটার।’
–‘চুপ করে বোস, রাস্তা গুলিয়ে যাচ্ছে।’
এখন সত্যিই মনে হচ্ছে পিছিয়ে যেতে পারলে ভালো হত, একদমই ফাঁকা এই দিকটা। ঘুমন্তপুরীর মতন কয়েকটা আধখ্যাঁচড়া কন্সট্রাকশন আর ফাঁকা মাঠ, কুকুরের জটলা। পুষ্পেন ওর সাইডের জানলাটা খোলার চেষ্টা করছে দেখছি!
–‘অ্যাই পুষ্পেন! তোর কী হল আবার?’
–‘কাঁচ নামা। আমি বমি করব।’
–‘মারিয়েছে, চেপে থাক। দাঁড়াচ্ছি আমি’
কিন্তু, জায়গাটা অচেনা, নির্জন টাইপের। একটা দোকান ঘর মতন কিছু দ্যাখা যাচ্ছে। অল্পরাতেই হয়ত সব এখানে বন্ধ হয়ে যায়। হয়ত বা উঠেই গ্যাছে দোকানটা। একটা টিউবওয়েলও আছে পাশে, চমৎকার। গাড়ি থামালাম।
–‘যা! বমি করে আয়, মুখে জলটল দিয়ে নিস।’
–‘অনি, তুইও নাম। ব্যাপক জায়গা এটা’
দোকান ঘরটার পেছনে একটা পুকুর। তারপর ছড়িয়ে পড়া মাঠ, ধোঁয়ার মতন কিছু কুয়াশা জড়িয়ে আছে। আজ পূর্ণিমা না, তবু চাঁদের আলোয় চারদিকটা বেশ দ্যাখা যাচ্ছে।
–‘কী নাম দ্যাখ, ইসমাইলপুর’ মোবাইলের আলোয় দোকানের সাইনবোর্ড পড়ছে পুষ্পেন। –‘কাটাদের পাড়া মনে হচ্ছে। ঐ জন্য আর ডেভেলপ করেনি জায়গাটা’
–‘আবার আলবাল বকছিস। বমি করলি?’
–‘নাঃ, দরকার নেই। এখন ফ্রেশ লাগছে। টিউবওয়েলটায় বাঁড়া জল নেই। পুকুরে দেখব?’
–‘আবে যাস না! একে তো ফুল মাতাল হয়ে আছিস। তারপর পুকুরে পড়লে শিওর মরে যাবি’
পুষ্পেন এগিয়ে গিয়েছে পুকুরের পাশ দিয়ে, যেটুকু দেখতে পাচ্ছি, পুকুরেও জল নেই বিশেষ। পুকুরের কিনার ধরে মেঠো রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে পুষ্পেন, অগত্যা আমিও চলেছি। তাড়াতাড়ি গাড়িতে উঠতে হবে। বড্ডো বেশি নির্জন এইজায়গাটা। চাঁদের আলোয় মাঠের দিকে যতটা দেখা যায়, সেটা ছাড়িয়েও যেন জনশূন্য চারদিক। ওই দোকানঘরটাই ছিল, তারপর আর বাড়িঘর কিছু দ্যাখা যাচ্ছেনা। এমন কী গাড়ির আলোটালোও কিছু দেখতে পারছি না। পুষ্পেন আঙুল দেখিয়ে বলল–
–‘আরে, ওই দ্যাখ, দুটো বাচ্চা আসছে। গ্রামট্রাম কিছু থাকলে এরাই খোঁজ দেবে। ডাকি দাঁড়া।’
–‘কাটা। সেফ লাগছে না জায়গাটা, ফিরি চ’
–‘কেন বে! ভূতের ভয় নাকি। বালটা!’ পুষ্পেন হাত নেড়ে বাচ্চাদুটোকে ডাকল
–‘এই শোন শোন। একটু জল পাই কোথায় বলতে পারেন? ওরে বাবা আরও দুটো’
অদ্ভুত সাজ করে চারটে বাচ্চা এদিকে আসছে। বাচ্চা, নাকি বেঁটে মানুষ? গায়ে কম্বলের মতন জড়ানো কিছু–
–‘পিলপিল করে বাচ্চা বেরোবে এবার! নেড়েদের পাড়া এটা অনি! মাইনরিটির ইয়ে মারছে সব’ মদ জড়ানো গলায় বলে চলছে পুষ্পেন। ‘ভিক্ষেটিক্ষে চাইবে মনে হচ্ছে। খুচরো আছে?’
বাচ্চাগুলো কাছে এলো; রোগা, কালো, গরিব লোকের বাচ্চা যেমন হয়। লিউকোপ্লাস্টের মতন, প্লাস্টারের মতন একটা কিছু দিয়ে বুকের নিচ থেকে তলপেট অবধি জড়ানো। তবে ভিক্ষে চাওয়ার অ্যাটিচুড না। কোনও রিচুয়াল পরব আছে নাকি এখানে?
–‘অনি রে, এরা ভূত সেজেছে। হ্যালুইন না আজ?’
–‘আশেপাশে তো কোনও কমপ্লেক্স দেখছি না, হ্যালুইনের বাচ্চা কোত্থেকে আসবে? এরা লোকালই’
–‘এখানে লোকাল বলে কিচ্ছু নেই। সব গ্লোবাল। গ্রামবাসী-ফাসি সব হাওয়া এখন।’ বাচ্চাগুলোর দিকে এগিয়ে গেল পুষ্পেন – ‘কীরে কী বলিস তোরা? ট্রিক অর ট্রিট? ট্রিট আর কী দেব এই জঙ্গলে? ট্রিকই কর’
–‘নাঃ, চল গাড়িতে উঠি। বাওয়াল ফাওয়াল হতে পারে’
কিন্তু পুষ্পেন তখন বাচ্চাগুলো নিয়ে পড়েছে।
‘তোরা থাকিস কোথায়?’
লেঃ– চারটে বাচ্চা চার দিকে হাত দ্যাখালো। বয়স অনুমান তিন থেকে ছয়ের মধ্যে হবে। চুল দেখে মনে হচ্ছে একটা ছেলে, তিনটে মেয়ে। মুখগুলো আলাদা করে বোঝা যাচ্ছেনা চাঁদের আলোয়। তবু খটকার মতন পেটে প্লাস্টার করা।
–‘তোদের সাথে কেউ নেই? একা একা অন্ধকারের মধ্যে বেরিয়েছিস? ভূতে ধরবে তো’
–‘আছে তো, উই যে–’ বড়টা উত্তর দিল– –‘ও নেয়ামুল চাচা!’ বাকি তিনটেও সঙ্গে সঙ্গে নেয়ামুল চাচা বলে ডাক জুড়ল। আর, মাঠের দিগন্ত থেকে বেরিয়ে এল লুঙ্গি–গেঞ্জি পরা একটা লোক।
কখনও আর চারপাশ ফ্রিজ করে যায়, একটা ঘটে চলা বর্তমান, সময়কে চিরে এগিয়ে আসতে থাকে। সেরকমই এগিয়ে এল নেয়ামুল চাচা নামের লোকটি। খোঁচাখোঁচা দাড়ি গালে, আবছা চাঁদের আলোয় মাথার আধপাকা চুল চকচক করছে। গরিব মানুষের গায়ে ঘামের গন্ধ থাকে। কাছে এলে বোঝা গেল নেয়ামুলের হাতে একটা খুরপি বা ওরকম নামের কোনও মাটি খোঁচানোর যন্ত্র।
–‘অ কচি, ডাকো ক্যান?’
এইসময়ে আমি বুঝতে পারি নেশা আমারও হয়েছে, এবার কেটে পড়তে হবে। নিউটাউনের কোণাকাঞ্চিতে ছোটছোট জটের মতন পুরোনো রাজারহাট আটকে রয়েছে। তারই কোনও এক খণ্ডে ঢুকে পড়েছি আমরা। এসব জায়গায় বিপদের সম্ভাবনা থাকতে পারে। কেটে পড়া উচিৎ তাই।
কিন্তু পুষ্পেন ইন অ্যাকশন –‘তুমি নিয়ামৎ? তুমি এখানে থাকো?’
–‘নিয়ামৎ না গো, নেয়ামুল, তা থাকি ইদিকেই। আপনারা কোত্থিকে?’
–‘আমরা যাচ্ছিলাম সিটি সেন্টারের দিকে, ঐ ইকো পার্ক ছাড়িয়ে, এইখানে একটু দাঁড়ালাম, বেশ জায়গাটা’ আমি উত্তর দিই।
–‘হ্যাঁ গো বাবু, বড় ভালো জায়গা এ। তিনফসলি জমি শুনিছেন, এ হইল চারফসলি’
–‘আপনার জমি নাকি এখানে?’
–‘এত জমি কি একা মানষির হয়? কিছু ছিল, কিছু ভাগে নিইছি। অন্যদের জমিও আছে’
–‘কী চাষ করো তুমি? দেখাবে?’ পুষ্পেন আমাকে সাইড করে দিয়েছে
–‘এই তো এখানিই সব’
ধোঁয়া ধোঁয়া আবছা বিস্তীর্ণ ফাঁকা জমির দিকে তাকিয়ে আমি বললাম– –‘এই তোমাদের খেত? সব ফসল কেটে নেওয়া হয়ে গ্যাছে?’
–‘না গো, কিছুই এখনো তুলতি পারিনি। ধরে রাখবার চেষ্টা করতিছি, তাও থাকছে না’
নেয়ামুলের স্বরে কী যেন এক শিউরানি ছিল। অস্বস্তি হতে লাগল, লোকের দুঃখ কষ্টের জমিতে আচমকা পা ফেললে যেমন হয়। চাষী মানেই খরা, মাজরা পোকা, ফসলের দাম না পেয়ে আত্মহত্যা– এইসব। আমরা সবজি বাজার থেকে কিনি। তার আগের গল্প জানতে ভয় হয়। তবু, ভদ্রতার খাতিরে পরের প্রশ্ন করতেই হয়–
–‘কেন এখন চাষের কোনও অসুবিধে হচ্ছে?’
–‘ওই যে বললাম, থাকছে না। ওই যে মাঠ, ওতিই সব ছিল, এই তো সন্ধের দিকিই ছিল। এখন দ্যাখেন, নাই।’
–‘পাগল মনে হচ্ছে, একটু বাজিয়ে দেখি’, পুষ্পেন এগিয়ে এল এবার।
আমি থামাই –‘তোমাদের এখানে অধিগ্রহণ হয় নি? পুরো রাজারহাটের তো চেহারা পালটে গ্যাছে’
–‘ওই তো সমস্যা গো, হচ্ছি বললিই কি আর হয়? এই যে কচিরে দ্যাখো, ঐ হরেন বৈরাগীর মেয়ে। এর ঠাকুদ্দার ঠাকুদ্দাও এই জমিতি চাষ দিছে। সেই শেকড়বাকড় মাটির কোথায় ঢুকি গ্যাছে, সে কি আর অধিগ্রহণ করা যায়?’
– ‘এগুলো তোমার বাচ্চা নয়?’
– ‘ঐ মাঠের দিকি যায়, ছোটটি, ঐটা আমার। বাকিগুলো হরেনদার। সে থাকত এগুলা আমার ভিটেতেই। আমার বউডারে চাচি চাচি করি ডাকত। সেও এদের...’
বাচ্চাগুলো আমাদের থেকে দূরে সরে গ্যাছে কিছুটা এখন। মাঠের ভিতর দিকে জমাট বেঁধে আছে অন্ধকার। হয়ত ফসল কেটে নেওয়া হয়ে গ্যাছে এখন বা হয়ত ফসলই হয়নি এখানে। এইসব মাঠের পর আরেকটা গ্রাম থাকে। প্রচন্ড দুপুরের মধ্যে লোকে জলতেষ্টা নিয়ে গ্রামান্তরে যায় গল্প সিনেমায়। আর মাঠের মধ্যে যে পথ পেতে দেওয়া থাকে, রাতের বেলা সে দিকে তাকালে গা শিরশির করে। বাচ্চাগুলো সেই অন্ধকারটায় ঢুকে যাচ্ছে। তবে এখন মনে হয় সাপখোপের ভয় নেই।
– ‘অধিগ্রহণের ব্যাপারটা কী হয়েছে? তোমরা জমি ছাড়ো নি তাহলে? তা পার্টি, প্রোমোটার, পুলিশ, এসবে ঝামেলা করে না?’
– ‘ঝামেলা বলি ঝামেলা গো! ছাড়িও তো দিল কতজন। পুরোপুরিই ছাড়ি দিল। আবার ছাড়তি পারলও না। তোমারে কী করি বুঝাই বল তো। দ্যাখেন বাবু, এই যে জমিটা, এইটা তো হরেনের চারপুরুষের। ঐ বাম দিকি রাস্তা, ওরও বামপাশে, ঐখানে মনসুরালির জমি ছিল। ঐখানে ফুল হত, সে কত ফুল আর সূর্যমুখীর উপর ভাসি থাকত টিয়াপাখির ঝাড়। সে তো ছাড়ি চলি গেল, ক্যানিং না কোথায় যেন। জমির দিকি যাও, দেখবে জঞ্জালের স্তূপ পড়ে আছে। আর এই হরেনের জমি, তারপর মিঠু সরদারের পুকুর, ড্যাঙা, ঐ সব ধোঁয়া ধোঁয়া দ্যখায় এখন। কত কী হল এখানে। হরেনরে তো গুমই করি দিল। মিঠুর পুকুরে বিষ ঢালতি সব মাছ পেট ফুলি ড্যাঙায় উঠল। সে ও পালাল বউবাচ্চা নিয়ে। ওঃ! কেমনে কেমনে কী যে হল, সে বুঝানও যায় না।’
– ‘আর তুমি থেকে গেলে? তোমার কয় পুরুষের জমি?’ পুষ্পেনের প্রশ্ন।
আমার কিন্তু মনে হচ্ছে এই গল্পটা বেশি চালিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। শেষে টাকাপয়সা চাইতে পারে। আরও বড়ো কথা, পরে যখন এসব বঞ্চনাটঞ্চনার কথা মনে পড়বে, ভারি অস্বস্তি হবে। বেশ আছি, লোনের গাড়ি, ইনভেস্টমেন্টের বাড়ি, অনসাইট আর ফ্রাইডে মালপার্টি নিয়ে। সুস্থ শরীরকে ব্যস্ত করে কী দরকার! কিন্তু, নেয়ামুলের ব্যাখ্যান এগিয়ে চলছে–
– আমার তো সব শুন্যি গো। শূন্যতে শুরু, ঐ জন্যি আঁকড়ি আঁকড়ি থাকি। বাপ থাকত খুলনোয়, তা সত্তরে খান সেনা মেরে দিল তারে, আমি পালিয়ে নদী পাইরায় এলাম নদীয়ায়। মামার ঘর ছিল। জমি তো জুটোতি পারলাম না, কিন্তু চাষের কাজ শিখি নিলাম পুরা। তারপর বিয়েশাদি করি জামাই হয়ে আসি এইখানে। শ্বশুর দান দেলো দেড় বিঘা, নিজে জোটালাম দেড় বিঘা। ঐ যে –’
– ‘ও জমি কই গো নেয়ামুল? ও তো ফাঁকা পুরো! গর্ত হয়ে আছে’
নেয়ামুলের আঙুলের দিকে তাকিয়ে বিরাট খাদের মত জায়গা দেখতে পাচ্ছি। চাঁদের ওপর মেঘের পরত পড়েছে বলে ভালো করে সবটা বোঝা যাচ্ছেনা। মনে হচ্ছে কনস্ট্রাকশন শুরু হয়ে গ্যাছে এখানে। গর্ত টর্ত খুঁড়ে হয়ত ভিত বানানো হচ্ছে কোনও স্কাইস্ক্র্যাপারের।
– ‘অনি রে! কী ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরই উপর! নেয়ামুল ভাই, তো এবারও তো শূন্যেই ফিরে গেলে গো হাসন রাজা!’
পুষ্পেনের ঠাট্টাটা নির্মম লাগল এখানে– কিন্তু নেয়ামুলের সঙ্গে আমরাও এগিয়ে এসেছি জমির দিকে। গর্তের পাশের জমিটা দেখতে পাচ্ছি। একটা চৌখুপি উঠোনের মতন জায়গা, সার দিয়ে কোনও চারাগাছের মেট্রিক্স বসানো।
– ‘সে তো শুন্যিই সব ফিরি যায়। ঘরবাড়ি, হরেনদা, আমার অমন দাপুটে শ্বশুর সবই শুন্যি এখন। এই দ্যাখ বাবু, এইখানি শালগম বুনিছি। খাদের গ্রাস থিকে আটকে রাখছি এই জমি। বাঁচায়ে রাখতি পারলি, তোমাদের শীতকালের খোরাকি আসবে, তাই না? নয় তো সবই শুন্যি গো’
– ‘ওরেব্বাস! হেভি ফিলোজফি! পুরো মাটির বুকের দর্শন রে! তা বাঁচালে কী করে?’
– ‘ওয়েট পুষ্পেন। নেয়ামুল, একটা কথা বল। ভোটের পর তো সরকার বলেছিল যে আর জমি অধিগ্রহণ হবে না? এখনও হচ্ছে কী! খাদ এগিয়ে আসছে বলছ!’
– ‘বাবু, ভোটের হিসিবি কি পেট চলে? যার জমি নিতি হবে সে তো দখল নিয়েই বসিছে। এখন গর্ত বাড়িয়ে তাকে ইঁট বালি দিয়ে না ভরলি কি তার পেট চলবে? আর চাষ উঠি গেলে আমার [পেট চলেনা। আপনার মতন এই চকচকে শার্ট পড়া বাবুরা আসে, বলি যায় জমির লড়াই, ভোটের লড়াই। আমরা তো লড়তিটড়তি চাই না। আমরা থাকতি চাই, বাঁচতি চাই। ঐ পেটের লড়াই আর কী! ’
– ‘তা একটা কথা বল, হয়েছিল কী এখানে?’
– ‘সে কেমনে বলি গো! এত কিছু, এত কিছু হল, যে মনেও রাখতে পারিনা। কোনটি আগে আর কোনটি পরে’
– ‘তাও’
– ‘সে তো মিটিং হল, বলি দিল জমি দিতি হবে। টাকা দেবে নাকি! যারা টাকা নিতি গেল, কেউ টাকা নিয়ে ফিরল, কেউ না নিয়ে আর কেউ ফিরলই না। তারপর সেচের জল বন্ধ করি দেলো। এই মাঠে, চারা বুনতি দেখে পরের দিন রাবিশ ফেলে দিয়ে গেল। পুকুরে দেলো বিষ। এই। আস্তে আস্তে অনেকে গ্রাম ছাড়ি চলি গেল।’
– ‘গ্রাম ছেড়ে গেল কোথায়? কলকাতা?’
– ‘কলকাতা! সেখানে গিয়ে করবটা কী আমরা, খাব কী? কেউ গেল সুন্দরবনের দিকি, কেউ যে কোথায় গেল! আর তো দেখতি পাই না কারুরে’
– ‘তাও সবাই চলে গেল কেন? ঘরবাড়ি ভেঙে দিল?’
– ‘না গো। মিছে কথা বলব না। ঘরে কারুর হাত দেয় নি। সে দু চারটে মারামারি কি গ্রামে আগে হত নি? এখেনে তার চাইতে বেশি কিচ্ছু হয়নি গো। কোনও ঘরে আগুন দেয় নি, মেয়েছেলের গায়েও কেউ হাত তোলেনি। যা সব হত, মনি হত ভূতে করে। কে যে খালের জল বন্ধ করে দেলো কেউ কি দেখতি পেত? আর কী বন্যা! বর্ষার জল এখানে আগে দাঁড়াত না মোটে। এখন চত্তিরে জল হলে মাঠে পাঁচদিন জল দাঁড়ায়। ধানচাষের মাঠ হয়ে গেল পানিফলের ডোবা। তো বল, এরা সব চাষী মানুষ। চাষ না থাকলি পড়ি থাকবে কেন আর চাষ না করলি খাবই বা কী! তাই গ্রামটাই উঠি গেল!’
– ‘তুমি পড়ে আছ তাও। ভালো। তোমার ঘর কোন দিকে?’
– ‘নাই’
– ‘মানে?’ পুষ্পেন জিগেশ করল, – ‘বাচ্চাটাকে তো দেখলাম। বউ আছে তো? থাকে কোথায়?’
– ‘সেও নাই।’
চাঁদের পুরোটাই মেঘে ঢেকে গ্যাছে মনে হচ্ছে। গ্রাম আমি আগে বিশেষ দেখিনি, ট্রেন থেকে ছাড়া। রাতের গ্রামে কি চারপাশে এরকম করেই বিহ্বলতা ছড়িয়ে পড়ে? আমাদের চুপ থাকার সময়টা ভীষণ অন্ধকার লাগছে। ফেরা উচিৎ। এবার ফেরা উচিৎ।
– ‘জিগেশ করছিলে না? কী করে বাঁচিয়ে রাখি? বড় মায়া দিয়ে বাবু। মায়া না থাকলি এ দুর্যোগে কিছুই রাখা যায় না। ঐ কচিগুলো, এত নেওটা আমার, এত মায়া যে ছাড়ি যেতি দিলাম না। এই মাঠও তাই। তোমাদের ফেলাট বানানোর গর্ত রোজ এসে গিলে ফেলতি চায় এই জমি। খুরপি নিয়ে লড়াই করি বাবু, মায়া দিয়ে আটকে রাখি যেটুকু জমিজমা পারি। আবার হেরে যাই যখন সব গর্তে ঢুকি যায়। রাবিশের নিচে ঢেকে যেতি থাকে বীজতলা, চার, ফসল সব। আবার খুরপি দিয়ে খুঁচোই। ফিরিয়ে আনি কিছু। লড়াই চলে গো বাবু। আমার ছেলেগুলো কই গেল দেখি! ’
গা শিরশির করে উঠছে আমার– গর্তের দিকে তাকিয়ে দেখি মাঠ সেদিকে বড় হয়ে গেছে। কনস্ট্রাকশন সাইটের একটা অংশ ঢেকে দিয়েছে কুপিয়ে রাখা জমি।
– ‘দশবচ্ছর হল গো, লড়ে যাচ্ছি বাবু! এই ফসল বাঁচিয়ে রাখলে তবে আপনারা খেতি পাবেন। এও মায়া। চোখটাএকটু লেগে আসে আর ঘড়ঘড় করি যন্ত্রপাতি এগিয়ে আসে জমির উপর। এখন তাই রাতের দিকি কাজ এগিয়ে রাখি। ওদের মিস্ত্রিমজুর রাতে থেমে যায়...’
– ‘ইশ, বেচারার মাথাফাথা খারাপ হয়ে গ্যাছে। সত্যি যা হয়েছে এদিকটায়। যাক গে ভালো লাগল কথা বলে। আসব আবার। তোমাকে সাহায্য করব কিছু?’ পুষ্পেন সামলে নিতে চায়। একটা অদ্ভুত ভূতুড়ে পরিবেশ হয়ে গ্যাছে সব মিলিয়ে। বেরিয়ে পড়া উচিৎ। নেয়ামুল মনে হয় আটকাবে না।
কিন্তু বাচ্চাগুলো পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। নাকি আমরাই খাদের মধ্যে নেমে গেছি, বা যেটা খানিকক্ষন আগে কনস্ট্রাকশনের গর্ত মনে হয়েছিল। এখন নেয়ামুলের বীজতলা। আলুর চারা লাগিয়েছে হয়ত। তুলে নিয়ে মাঠে সারিবেঁধে মেট্রিক্স আকারে বসাবে। চন্দ্রমুখী না জ্যোতি? আমি খাব? মাছের ঝোলে না পটাটো ওয়েজেস? বাচ্চাগুলোকে অন্তত কিছু পয়সাটয়সা দিয়ে যাওয়া উচিৎ। কিন্তু, এদের এরকম সাজিয়ে রেখেছে কেন? পুষ্পেনের হ্যালুইন ড্রেস?
– ‘তা নেয়ামুল? এদের এরকম ব্যান্ডেজ জড়িয়ে রাখ কেন? শীত করে?’
– ‘এরাই তো আমার এসিস্টেন গো, যত্ন করি রাখতি হবে না? ইস্কুল তো উঠি গেল। এরা যায় কোথায় আর খায় কী? তো আমার সঙ্গে মাঠেরই কাজ করতিছে এখন’
– ‘থাকে কোথায়?’
– ‘এই মাঠেই’
– ‘খাওয়া দাওয়ার পায়?’
– ‘না পায় না। ফসল তো রোজ ওঠে না। ঘর নেই, কিছুই নেই। কিছু না থাকলি খাবে কী! ’
– ‘সে কী!’
– ‘না খাতি খাতি কী হল, পেটটা ফাঁকা হয়ে গেল একদিন। একদম শুন্যি। ঐটূকু তো মানুষ। তাদের উদোম থাকতি লজ্জা নাই। কিন্তু পেট না থাকলি তাদের লজ্জা হয়। তো একটা হেলসেন্টার ছিল গ্রামে, সেও তো উঠি গেছে। সেখানে ব্যান্ডেজ প[ড়ি ছিল অনেক, তাই জড়িয়ে নিয়েছে। দ্যাখেন’
নেয়ামুল একটানে সবচেয়ে ছোটছেটার, যেটা নাকি তার নিজের ছেলে, তার ব্যান্ডেজটা খুলে ফেলেছে। ভয়ে সিঁটিয়ে আছে ছেলেটা আর বাকি বাচ্চাগুলো হো হো করে হেসে যাচ্ছে তার দিকে তাকিয়ে।
মাটির ওপর খালি গায়ে দাঁড়িয়ে বাচ্চাটা, ঠিক খালি গা না। নগ্নপদ, হাঁটু, শিশুশিশ্ন, তার ওপরটা– একদম ফাঁকা। আবার কিছুটা ওপর থেকে চামড়ার নিচে হার জিরজিরে পাঁজরা হয়ে শুরু হয়েছে। সবকটা বাচ্চা, এই নেয়ামুল, এরা সবাই কি তাই? কারুরই পেট নেই?
আমার পায়ের নিচটা মনে হচ্ছে মাটির হয়ে গ্যাছে। চারপাশের নিষ্পেট মানুষগুলো আমাকে গেঁথে ফেলছে জমি বা কনস্ট্রাকশোনের গর্ত কোথাও একটা। এখান থেকে ফিরে যাওয়া যাবে না মনে হচ্ছে। যতক্ষণ ন ভোর হয়। যদি ভোর না হয় আর? অন্ধকারের মধ্যে আমরা এক এক করে ভুল পথে আসি আর জমাট বেঁধে যাই? একরকম করে!
ঘাড়ের কাছে হ্যাঁচকা টান পাচ্ছি। পুষ্পেন আমাকে টেনে তুলছে, দৌড়ে ফিরে আসছে রাস্তার দিকে
– ‘গাড়ির চাবিটা দে অনি! তোর নেশা হয়েছে! তুই ভূত দেখছিস’
– ‘ভূত? না না ওরা ভূত না! পুষ্পেন দাঁড়া। বুঝতে চাই একটু’
– ‘তুই বাল বুঝবি! তোর নেশা হয়েছে। তুই গাঁড় মারা এখানে। আমি সৌরভের ফ্ল্যাটে ফিরে যাচ্ছি। জয়নী আছে ওখানে। ওরা লাগাচ্ছে– ঢিকঢিক ঢিকঢিক’
আর্তনাদের মত শোনাচ্ছে পুষ্পেনের গলা!