অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায় নোবেল জেতার পর থেকেই সামাজিক মাধ্যমে সমালোচনার ঝড়। তাঁর জীবন ও কর্ম সম্পর্কে জানা যাচ্ছে নানা অজানা কথা। নোবেল পুরষ্কার ঘোষণার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই দেশপ্রেমী নেতা দিলীপ ঘোষ জানান, অভিজিৎ আসলে আধা-বাঙালি। অর্থাৎ বাঙালিদের এত ফুর্তির কিছু হয়নি। এই তথ্যটি আগে কারো জানা ছিলনা, যেমন জানা ছিলনা দিলীপবাবু আসলে শখের নৃতত্ববিদ। কেউ কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলে ভক্তদের পক্ষ থেকে বিশ্বস্ত সূত্রে জানানো হয়, এর জন্য নৃতত্বের ডিগ্রি লাগেনা। এন-আর-সি করে করে দিলীপবাবু এমনই পোক্ত হয়ে গেছেন, যে, দেখলেই বলে দিতে পারেন, কে কত ইঞ্চি বাঙালি, কত ফুট অনুপ্রবেশকারী, কত কিলো ভারতীয় আর কত পাউন্ড দেশদ্রোহী।
দিলীপবাবুর বক্তব্য আরও পোক্ত হয়, যখন এক ভক্ত আচমকাই আবিষ্কার করে ফেলেন, অভিজিৎ আসলে জে-এন-ইউ পাশ। অর্থাৎ কানহাইয়া কুমারের সহপাঠী। এই খবরটিও আগে কারও জানা ছিলনা। ইউটিউব দেখে জানা যায় অভিজিৎ পরিষ্কার বাংলায় মোদী সরকারের সমালোচনা করছেন, মানে, জাতে আধা হলে কী হবে, তালে পুরো বাঙালি। গুগল সার্চে এও দেখা যায় যে তিনি এমন এক ল্যাব খুলেছেন, যার নাম 'আব্দুল লতিফ জামিল পভার্টি ল্যাব'। পুরোটাই সৌদির প্রভাব। দেশদ্রোহী, অনুপ্রবেশকারী এবং জিহাদি এই নিয়ে আর কোনো সন্দেহ থাকেনা। আধা বাঙালি ব্যাপারটাও এতে পরিষ্কার হয়ে যায়, অর্থাৎ কিনা ভদ্রলোক অর্ধেক জে-এন-ইউ, অর্ধেক দেশদ্রোহী, আধা বাঙালি এবং বাকিটা বাংলাদেশী। বাংলাদেশীরা বাংলায় কথা বললেও আসলে যে সৌদির দালাল এবং একেবারেই বাঙালি নয়, এই নিয়ে কারো কোনো সন্দেহ থাকার কথাই নয়।
কলম্বাসের এই নতুন করে আমেরিকা আবিষ্কার (মনে রাখতে হবে অভিজিৎবাবু আমেরিকা-নিবাসী) এ পর্যন্ত শান্তিপূর্ণভাবেই চলছিল। কিন্তু গোলমাল বেধে যায় তৃণমূলের এক কাউন্সিলারের কান্ডে। কোথাও কিছু নেই তিনি ফেসবুকে হঠাৎ লেখেন 'এক রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছজন নোবেল জয়ী। অন্য এক রাজ্যের সঙ্গে যুক্ত ছজন চোর, যারা দেশের টাকা মেরে বিদেশে পালিয়েছে'। এই সস্তা রসিকতায় সাড়ে তিনশোর বেশি লাইক পড়েনি। কিন্তু সমস্যা হল কিছু পুরোনো বামও শত্রুতা ভুলে সেই সঙ্গে হ্যাহ্যা করতে শুরু করে। সংখ্যায় সাত হলে কী হবে, ধানি লঙ্কার তেজ বেশি। বাবুল সুপ্রিয়র সঙ্গে যাদবপুরে বামদের দুর্ব্যবহার ভক্তরা ভোলেননি। ফলে রাজ্যে লঙ্কাকান্ড বেধে যায়। হনুমানরা ল্যাজে আগুন লাগিয়ে কলকাতা শহরে দাপিয়ে বেড়াতে শুরু করেন। এক ভক্ত স্লোগান দেন,'জেনু-ম্যান নেহি হনুমান চাহিয়ে'। স্লোগানটি ভাইরাল হয়ে যায়। সঙ্গে পুরোনো স্লোগান 'হার্ভার্ড নেহি হার্ডওয়ার্ক চাহিয়ে' তো ছিলই। সব মিলিয়ে সামাজিক মাধ্যম দাপাদাপিতে বানরের বারানসী হয়ে ওঠে।
এর পরে রাম-রাবনে যুদ্ধ লাগতেই পারত, কিন্তু তৃণমূল-সিপিএমের মুখ একেবারে বন্ধ হয়ে যায়, এক প্রখ্যাত দেশপ্রেমী সাংবাদিকের দুর্দান্ত আবিষ্কারে। তিনি এর আগে টাকার নোটে জিপিএস চিপ আবিষ্কার করেছিলেন, এবার আবিষ্কার করেন, যে, অভি ব্যানার্জি আসলে মমতা ব্যানার্জির ভাইপো। মমতার কুকীর্তির কোনো শেষ নেই। তিনি মাথায় চাদর জড়িয়ে মমতাজ বেগম হয়েছেন, দুর্গাপুজোয় আজানের সাউন্ড দিয়েছেন, কাজি নজরুল ইসলামকে দিয়ে শ্যামাসঙ্গীত লিখিয়েছেন, এবার ভোটার লিস্টে কারচুপি করে অভিজিৎকে অভিষেক করে দেওয়া আর এমন কী। শুধু নাগরিকপঞ্জি নয়, একমাত্র নতুন নাগরিক বিল আনলেই এই ছদ্মনামে লুকিয়ে থাকা ছুপা ইসলামী সন্ত্রাসীদের সপরিবারে তাড়ানো সম্ভব।
এই বৈপ্লবিক বক্তব্যে সামান্য আপত্তি উঠলেও ভক্তরা সেসব দাবড়ে থামিয়ে দেন। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে, এই লোকটির গুরুর তিনটে বিয়ে, এঁর দুটো। নোয়াখালিতে যখন গণহত্যা হচ্ছিল তখন দুজনে হার্ভার্ডে বসে বেহালা বাজাচ্ছিলেন, জে-এন-ইউতে স্লোগান ঝাড়ছিলেন, নির্ঘাত ভারত-পাকিস্তান ম্যাচে পাকিস্তান জিতলে মেটিয়াবুরুজে গিয়ে বাজিও পোড়ান। বিধর্মী হবার এর চেয়ে বড় প্রমাণ আর কী হতে পারে? কোন দেশপ্রেমী ব্রাহ্মণ হিন্দু-কন্যাদের ত্যাগ করে ম্লেচ্ছ বিয়ে করে?
এই ভাবে সমালোচনায় নারীর দৃষ্টিকোণ চলে আসে এবং বিতর্ক অভূতপূর্ব মোড় নেয়। নারীদরদীরা সমালোচনায় অংশগ্রহণ করেন এবং আপামর বঙ্গজাতিকেই নারীবিরোধী আখ্যা দেন, কারণ ভদ্রলোকের ফরাসী বৌকে নিয়ে কেউ লাফাচ্ছেনা। কেউ কেউ একে 'গৃহহিংসার জাতিগত অবচেতন' ও আখ্যা দেন। কিন্তু কথাটি অভিজিতের বইয়ের মতোই খটোমটো হওয়ায় তেমন জনপ্রিয় হয়নি। কেউ কেউ আরও এক ধাপ এগিয়ে বলেন, দিলীপ ঘোষই আসলে ঠিক বলেছেন। আধা-বাঙালিকে স্রেফ পিতৃপরিচয়ের কারণেই পুরো বাঙালি বানিয়ে দেওয়ার চেয়ে বড় পিতৃতান্ত্রিক ব্যাপার আর অন্য কিছু হতে পারেনা। এক বিখ্যাত কবি তো জ্বালাময়ী কবিতাই লিখে ফেলেনঃ
অবলা কেন সদাই পুরুষরথের তলায় পড়বে?
সেই রথেরই মাথায় কেন নোবেল প্রাসাদ গড়বে?
কবিতাটি হোয়াটসঅ্যাপে প্রতিটি শিক্ষিত বাঙালির কাছে ছড়িয়ে পড়ে। মনুবাদ বিরোধীরাও সঙ্গে খাপ খুলে ফেলেন। নোবেল জয়ী হিন্দু-বাঙালিরা সবাই কেন উচ্চবর্ণের হবেন, এই নিয়ে তুমুল হট্টগোল শুরু হয়। নোবেল কমিটি ক্ষমা চাওয়া না পর্যন্ত এই আন্দোলন চলছে চলবে বলেও হুমকি দেওয়া হয়।
এতেও হয়তো সমালোচনার ঝড় কমে যত। কিন্তু ঠিক এই সময়েই খবর আসে, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু মানব ও মানবী জাতির শত্রু, একাধারে ছুপা ইসলামী ও উচ্চবর্ণের হিন্দুই নন, জেলখাটা দাগী আসামীও বটে। যে সে জেল নয়, রীতিমতো তিহার। কোন এক কাগজে সেটা তিনি স্বীকারও করেছেন। তিহার গমনের কারণ আরও ভয়ঙ্কর। দেশদ্রোহী কানহাইয়া কুমারের মতো তিনিও জে-এন-ইউতে স্লোগান দিচ্ছিলেন, কারো জন্য আজাদি চাইতে গিয়েই হবে, এমন সময় পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে জেলে ভরে দেয়। বামৈস্লামিক কানেকশানে মুক্তি পেয়ে তিনি সিধে আমেরিকা পালান। এই খবরের পর আর দেশদ্রোহিতা নিয়ে কোনো সন্দেহ থাকেনা। দেশে আন্দোলনের ঝড় বইতে শুরু করে।
সর্বশেষ পাওয়া খবর অনুযায়ী সুইডেনের নোবেল কমিটি এই সর্বাত্মক নোবেল বিরোধিতায় খুবই বিব্রত। অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়ও ভারতীয়ত্বের এই হঠাৎ উত্থানে এমআইটিতে বসে থরথর করে কাঁপছেন। আর দ্বিতীয়বার নোবেল পাওয়ার সাহস তাঁর হবেনা, এমনকি একবার পাওয়ার জন্য ক্ষমা চেয়েও নিতে পারেন বলেই ওয়াকিবহাল মহল আশাবাদী।