দেখা যাচ্ছে ধর্ষণ কী করিলে কমিবে তা আমাদের কারোরই জানা নেই। আন্দাজেই পথ হাতড়াচ্ছি আমরা , মেয়েদের পোশাক হাবভাব ব্যবহার ইত্যাদির দিকে তর্জনী তুললে অন্য চারটে আঙুল বেঁকে থাকে নিজেদের দিকে অথবা আর্থসামাজিক এবং রাজনৈতিক ফ্যাক্টরের দিকে। পিতৃতন্ত্রের বলদর্প আর কতো মেয়েদের জীবন তছনছ করে দেবে সে প্রশ্নও ওঠে খুব সঙ্গত ভাবেই।
ডঃ প্রিয়াঙ্কা রেড্ডির মৃত্যুর পর ফেসবুকে ধর্ষণের প্রবণতা কমাবার যে কটি পদ্ধতি চোখে পড়েছে সেগুলো শোক এবং হতাশার বিস্ফোরণ হলেও আমাদের মানসিকতা যাচাইয়ের ভালো স্যাম্পলও বটে। কারণ এই একই প্রতিক্রিয়া অন্তর্জালে প্রত্যেকটি ধর্ষণের ঘটনার পর দেখতে পাই। এতে কেউ দোষী নয়,যেহেতু বার বার এই ধরণের ঘটনা ঘটতে থাকে, লোকে বার বার একইভাবে বিস্ফারিত হয়।ফলে প্রতিক্রিয়াগুলিকে খুব তাৎক্ষণিক বলা যাবে না। বরং এইগুলির একধরণের লাস্টিং ভ্যালু বা দীর্ঘমেয়াদী মূল্যমান আছে। এরা মোটামুটি দুরকম - আক্রমণাত্মক এবং আত্মরক্ষামূলক।
প্রথম ভাগে পড়ে এইগুলি-
১) ফাঁসি বা মৃত্যুদন্ড
২) লিঙ্গচ্ছেদ
৩) মব লিঞ্চিং
আত্মরক্ষামূলক ধাপ-
১) কন্যা ভ্রূণ জন্মাতে না দেওয়া
২) মার্শাল আর্ট শেখা
৩) ব্যাগে ছুরি কাঁচি পিপার স্প্রে রাখা
৪) মেয়েদের ‘সমাজের’ প্রত্যাশামতো বাঁচতে শিখে নেওয়া
এর বাইরে আছে পুরুষবাচ্চাকে সেন্সিটাইজ করে বড় করা ,যেন তারা নারীকে সম্মান করা শেখে। পিতৃতান্ত্রিক ধ্যানধারণাকে জীবনচর্যার মধ্যে না আনে।
একটু তলিয়ে ভাবলে বোঝা যাবে প্রথম দুধরণের পদক্ষেপ নারীর ভালোর চেয়ে মন্দ করে বেশি। কোনো ওষুধে কোনো রোগের উপশম হচ্ছে না দেখলে আমরা তো ডাক্তার এবং ওষুধ পাল্টাই। তাহলে দীর্ঘকাল ধরে মৃত্যুদন্ড এ অপরাধ কমাতে পারলো না কেন একথা বলতে যাওয়ামাত্র কেন ধেয়ে আসে তীব্র শ্লেষযুক্ত বাক্যবাণ ,আপনার বাড়ির লোক হলে এইরকম বলতে পারতেন ? অথচ আপনার আমার বাড়ির বাইরে পড়ে আছে একটা বিশাল দেশ আর তার পরিসংখ্যান। এ কথাও প্রমাণিত যে দেশে বিচারের পদ্ধতি অহিংস সেখানে হিংসা কম।
মানুষের ভেতরের দানবটিকে বাইরে আনার ব্যাপারে প্রথম ক্যাটেগরির জুড়ি নেই। রক্তের বদলে রক্তই যদি কাম্য, তাহলে সে রক্তপাত থামবে কী করে ! উপরন্তু এর প্র্যাকটিকাল দিকটি আরো ভয়াবহ। ফিরে গিয়ে বলে দিলেই যদি মৃত্যু নিশ্চিত ,তাহলে ধর্ষিতাকে আর ফিরতে না দেওয়াই ভালো । পড়ে থাকুক তার আধপোড়া দেহ কোন ওভারব্রিজের নীচে,কিম্বা পুজোর নতুন সাজ পড়া দশবছরের বালিকাটির নিথর দেহ থ্যাঁতলানো ধানক্ষেতে। মা হিসেবে আমার তো ধর্ষককে চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে,তোরা প্রাণপুত্তলীদের শুধু ফিরতে দিস । তারপর আমরা নাহয় ্মেয়েদের শেখাব ঐ ঘটনা একটি এক্সিডেন্ট। ওটার জন্য কারো জীবন শেষ হয়ে যায়না। যারা ভাবে এবং বলে যে ধর্ষণে একটা মেয়ের জীবন শেষ হয়ে যায় তারাও কিন্তু প্রকারান্তরে মেয়েটির জীবন শেষই করে দিতে চায়। চর্তুদিকের কানাকানি ফিসফাস সমালোচনা,গায়ে পড়া উপদেশ চোখের জল মেয়েটিকে লজ্জায় অপমানে নিঃস্ব রিক্ত করে। নিজেকে দায়ী করে সে তার ওপর ঘটে যাওয়া অন্যায়ের জন্য।যে লজ্জা হওয়া উচিত সমাজের প্রত্যেকের এবং রাষ্ট্রের , তার ভারেই সে আত্মহননের রাস্তা বেছে নেয় অনেক সময়। আমরা ফেসবুকে কান্নার ইমোজি দিয়ে কাজ সারি। তার চেয়ে কী কালিঘাটের বস্তির হতদরিদ্র মায়ের কেজো দৃষ্টিকোণটিই বেশি কাম্য নয়, যে বলে নালিশ তো করা হয়ে গেছে ,এবার বিচার হোক ।কিন্তু মেয়ে ঘরে না ফিরলে খাব কী ! মেয়েটি তো অন্তত নিজেকে অচ্ছুত অকেজো ভাববে না।
কখনো কখনো মনে হয় ইংরেজি শব্দ ‘ রিডান্ডান্টে”র থেকে বড় গালি এক মানুষের জীবনে আর কিছু হতে পারে না । আমাদের সমস্ত বেঁচে থাকার চেষ্টার ভরকেন্দ্র ঐ রিডান্ডান্ট না হবার প্রচেষ্টা। লাঞ্ছিত মেয়েটির শুধু সে অধিকার নেই !
দ্বিতীয় ক্যাটেগরিটি আরো মারাত্মক। মেয়ে বাচ্চা জন্মাতে দেব না ,তার ফল কী হবে বুঝতে কষ্ট কী ! হরিয়ানার কোনো কোনো গ্রামে ঘুরে এলে মনে হবে প্রতিটি মেয়ে জন্মেইছে ধর্ষকের খাদ্য হবে বলে। নারীপুরুষের রেশিও আরো নষ্ট করে দিলে ধর্ষণ বাড়ে না কমে ? ফিল্মি অভিজ্ঞতার দরকার হলে মাত্রুভূমি সিনেমাটা দেখা যায়।
কোনো মেয়ের যদি মার্শাল আর্টের বদলে নাচ শিখতে ইচ্ছে হয় তাহলেও তার নানকু চাকু চালানো বাধ্যতামূলক হবে ? যারা ব্লেড চালাতে বলেন তারা জানেন মদ্যপের হাত মণিবন্ধে এঁটে বসলে হাত নড়ানো যায় না? মার্শাল আর্ট যার শিখতে ইচ্ছে হবে সে অবশ্যই শিখবে,কিন্তু জোর করে চাপিয়ে কোনো লাভ নেই। চার পাঁচজন মিলে পিস্তল দেখিয়ে বাপমার সামনে থেকেও তুলে নিয়ে গেলে কিসসু করা যায় না । যা হওয়া উচিত সমাজ এবং রাষ্ট্রের যৌথ দায়িত্ব সেই গুরুভার আমরা চাপিয়ে দেব আমাদের আত্মজাদের কাঁধে ?
আর সমাজের বিধিনিষেধ মেনে লক্ষ্মী নারীর পুরনো ছক থেকে সবদিকে যোগ্যতা প্রমাণ করে কালের নিয়মে যে মেয়েরা স্বয়ংভর হয়েছেন তাদের আর শত বলপ্রয়োগেও সেখানে ফেরত পাঠানো যাবে না। ধর্ষণেও না।
তৃতীয় প্রস্তাবে তাও সুস্থ যুক্তি ছায়া ফেলে । এখানে ধর্ষণ বলতে যেহেতু আমরা পুরুষ কর্তৃক অনিচ্ছুক নারীদেহের দখল নেওয়া বোঝাচ্ছি, পুরুষের মনোভাব এবং চিন্তাধারার পরিবর্তন খুবই গুরুত্বপূর্ণ।তবে সে কতো যুগের কতো সাধনার ফল তা জানা নেই । তথাকথিত শিক্ষার দৌড় দেখা হয়ে গেছে মি টুর দৌলতে। অন্তর্জালে যে পরিমাণ রেপ থ্রেট দেখা যায় তাতে মনে হয় মেয়েদের শায়েস্তা করার ঐ একটি পদ্ধতিই আমাদের শেখা। খুবই লজ্জা হয় যখন দেখি রেপিস্টের ধর্ম তুলে সেই ধর্মের নিরপরাধ মেয়েদের ধর্ষণ করবার ডাক দেওয়া হয়। চিত্তশুদ্ধির প্রচেষ্ট জারি থাকুক, আপাতত আর কিছু করতে না পারি রাষ্ট্র প্রশাসন এবং সমাজের ঘাড় নোয়ানোর জন্য আমরা সমস্বরে চিৎকার তো করতে পারব। সমস্ত ট্যাবু ভেঙে ফেলে প্রত্যেকটি ধর্ষণের ঘটনা নিয়ে প্রবল আলোচনা,উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়, চেঁচামেচি । ধর্ষণকে ঘিরে থাকা বোবা নৈশব্দকে ভেঙে ফেলে একেবারে অনর্থ করা যাকে বলে। আমরা এখন পরিষ্কার জানি ধর্ষণ শুধু লালসার কারণে হয়না । মেয়েদের ওপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখবার একটি হাতিয়ার এটি। মেয়েরা পুরুষের সমকক্ষ হতে পারবে না ,এটাই পরম্পরা। অতএব উচ্চশিক্ষিতা নারী যে উপার্জন করে, পুরুষের মতোই স্কুটার চালিয়ে বেশি রাতে বাড়ি ফেরে তাকে ধর্ষণ কোরে মেরে ফেললে আর পাঁচটা মেয়ে তাঁবে থাকবে।
এক বিচারক এক রায়ের সমালোচনায় ঘরোয়া আলোচনায় ফুঁসে উঠেছিলেন ,আপনারা ঘরে বসে করছিলেন কী ? দলবল জুটিয়ে শুনানির সময় আদালত চত্বরে চ্যাঁচামেচিও তো করতে পারতেন । অন্তত বোঝা যেত জনমত লাঞ্ছিতার পক্ষে আছে ।
ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা নেই, সে ব্যাপারে ফেসবুকের বাইরে কোন কাজে যুক্ত হওয়া নেই শুধু ঘরে বসে নানা প্রবল হিংসাত্মক কল্পনায় দিন কাটে আমাদের । এমন কল্পনা যে একজন দাগি অপরাধীকেও তা ভাবার জন্য অনেক সময় অতিবাহিত করতে হবে। এইরকম একটি ফেসবুক কুড়োনো মণিমুক্তো দিয়ে গেলাম উপসংহারে - চার ধর্ষকের গায়ে কেরোসিন তেল প্রথমে আধপোড়া করুন। তারপর ফেলে রাখুন। ডাক্তাররা এদের চিকিতসা করতে অস্বীকার করুন।আর কোন উকিল এদের হয়ে কেস লড়বেন না।
এদেশে ধর্ষণ কমবে ?