আমরা এমাজন বা মেক্সিকোর ভূমিপুত্রপুত্রীদের জল জঙ্গল জমি রক্ষার লড়াইকে সঙ্গতভাবেই বাহবা দিই, কিন্তু নিজের দেশে কর্পোরেট- হাঙরের বিরুদ্ধে জনজাতির এইরকম বীরত্বপূর্ণ জানকবুল লড়াইয়ের খোঁজ রাখি কম। অথচ তাদেরই পাশে দাঁড়ানো এখন আশুকর্তব্য।
যেমন উড়িষ্যার নিয়মগিরির ডোঙ্গরিয়া কন্ধ উপজাতি। বহুদিন হলো প্রবল পরাক্রমী বেদান্ত ইন্টারন্যাশনালের বিরুদ্ধে এদের মরণপণ লড়াই চলছে নিজের ও পূর্বপুরুষের বাসভূমি রক্ষায়। পরিবেশের পবিত্রতা রক্ষা, তাদের দেবতার বাসভূমি পবিত্র পাহাড়ের দায়িত্ব, নদী ঝোরা ওষধিপূর্ণ বনভূমির রক্ষণবেক্ষণ সবই এই জনজাতির কাঁধে চাপিয়ে আমরা দর্শকমাত্র হয়ে থেকেছি। তাদের পাশে দাঁড়াতে যাইনি।
তাই এদের যুদ্ধ ও জয়ের কথা নিয়ে সচেতনতা খুব বেশি দিনের পুরনো নয়।
অধ্যাপক পরিমল ভট্টাচার্য প্রথম এদের কথা নিয়ে বাংলায় একটি বই লেখেন, হয়তো ইংরেজিতেও তার অনুবাদ এতোদিন বেরিয়ে গেছে। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় অন্যরাও হালে এই নিয়ে লেখালিখি করেছেন, এই অধমও তাদের মধ্যে একজন।
কিন্তু এ লড়াই তো শেষ হবার নয়। হাঙর একবার হাঁ করলে না গেলা অব্দি সেই হাঁ বোজে না, অরণ্যের প্রাচীন প্রবাদ। এক ফার্লং পেছনে সাঁতরা্তে বাধ্য হলে পর মূহুর্তে একশ ফার্লং এগিয়ে আসে। ঠিক তাইই হয়েছে এখন বেদান্ত এবং ডোঙ্গরিয়া কন্ধ উপজাতির লড়াইয়ের বর্তমান অবস্থা। ২০০৭ সালে কোঅর্ডিনেশন অব ডেমোক্রাটিক রাইটস অরগানাইজেশন (CDRO) নামে সারা ভারতে গণতান্ত্রিক অধিকার এবং রাষ্ট্রের নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই করা আঠারোটি সংস্থা এক ছাতার তলায় সংগঠিত হয়। গত জুলাই মাসে তা্রা নিয়মগিরির যুদ্ধ নিয়ে একটি বিস্তারিত রিপোর্ট পেশ করে। বর্তমান প্রবন্ধে ব্যবহৃত ও উদ্ধৃত সমস্ত তথ্য এই রিপোর্ট থেকে নেওয়া।
~পূর্বকাহিনী~
উড়িষ্যার দুর্ভিক্ষপীড়িত কালাহান্দি থেকে রায়গড় অব্দি টানা নীল পাহাড়শ্রেণির নাম নিয়মগিরি। এইখানেই কন্ধ উপজাতির বাস যাদের এক শাখার নাম ডোঙরিয়া কন্ধ। নিয়মগিরি পাহাড়ই দেবতা। তিনি এবং সমস্ত অরণ্য এই মানুষদের পূজ্য, কারণ বনাঞ্চল তাদের জীবনধারণের সমস্ত উপকরণ সরাবরাহ করে,পাহাড়ের মাথা থেকে নেমে আসা ঝরণা এবং নদী তৃষ্ণার এবং সেচের জল যোগায়। আর দেয় আত্মিক শান্তি, দুর্লভ জাতিগত সত্ত্বা অর্জনের অনুভূতি। ফলে পূর্বজদের আশির্বাদধন্য এই ভূমি তাদের স্বর্গসমান ।
পাহাড় তাদের রক্তে এমন ভাবে মিশে আছে যে ডোঙ্গরিয়ারা যেন পাহাড়ময়। তাদের মন্দিরের চুড়ো, অভ্যন্তরের নানা মোটিফ, এমনকি হাতে বোনা শাল অব্দি পাহাড়ের তেকোণা ডিজাইনে ভর্তি। তাদের জাতিনামটি এসেছে ডোঙ্গার কথাটি থেকে যার অর্থ হলো পাহাড়। শান্তিপ্রিয় এই মানুষগুলির স্নেহচ্ছায়ায় এই অঞ্চলে টিঁকে রয়েছে বন্যপ্রাণির জন্য দু দু খানা অভয়ারণ্য--কার্লাপট ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙচুয়ারি এবং কোটগড় ওয়াইল্ড লাইফ স্যাঙচুয়ারি। ডোঙ্গারিয়াদের বিশ্বাস নিয়মগিরির ঢালে চাষবাস করবার অধিকার তাদের অর্পণ করেছেন স্বয়ং নিয়মরাজা। এই ঐশ্বরিক অধিকার কেড়ে নেবার হিম্মত পৃথিবীর কোন মানুষের নেই। বন তাদের দেয় দুশোর বেশি খাদ্যবস্তু এবং নিজেরা চাষবাস করে ফলায় আরো একশ রকম। আনারস, কাঁঠাল,আ্ম,কলা,কমলালেবু, মধু ,ভেষজ উদ্ভিদ ভর্তি বনভূমিতে আশ্রয় পায় অনেক পশুপাখি। এতো স্বয়ংসম্পূর্ণ এই উপজাতি, নিজেদের ভেষজ চিকিৎসার ধারা বহন করে নিয়ে যাচ্ছে তারা, নিরাময় করছে আর্থরাইটিস,আমাশা,ম্যালেরিয়া হাড়ভাঙা এবং সর্পদংশন। বোঝাই যায় এই কন্ধভুমি নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে বিস্তীর্ণ এলাকার বাস্তুতন্ত্র এবং পরিবেশের অপূরণীয় ক্ষতি হওয়া।
ঠিক তাইই হতে যাচ্ছিল ২০১২ সালে যখন নিয়মগিরি রেঞ্জের মাটিতে প্রচুর জমে থাকা বক্সাইটের লোভে এই অঞ্চলে নজর পড়ে বিশিষ্ট কর্পোরেট-শকুন, বেদান্ত রিসোর্সের মালিক অনিল আগরওয়ালের। ভারতে নিও লিবেরাল অর্থনীতির আগমন তখন এদের সামনে সদ্য তুলে ধরেছিল অবাধ লুন্ঠনের অধিকা্র। তারই সদব্যবহারে কালক্ষেপ না করে ডোঙ্গারিয়াদের বাসভূমিতে শুরু হয়ে যায় সার্জিকা্ল স্ট্রাইক ,বক্সাইট থেকে ছেঁকে এলুমিনিয়াম তোলবার কারখানা।
প্রথমেই দখল হয় লাঞ্জিগড়। কতো দুঃসাহস এই আধুনিক বানিয়াদের যে বক্সাইট খননের নিয়মমাফিক সরকারি অনুমতি পাবার আগেই সংশোধনাগার খুলে বসে সবুজ ডোঙ্গরিয়া গ্রামটির বুকের ওপর। সরকারকে কিন্তু তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে এই সংশোধনাগারের জন্য বনভূমিকে বিন্দুমাত্র ধ্বংসকরবে না। কিন্তু প্রথম খেপেই বেদান্ত ৬০ হেক্টর বনভূমি ধ্বংস করে সংশোধনাগার তৈরি করে এবং সরাসরি পাহাড় থেকে বক্সাইট আনবার জন্য দৈত্যাকৃতি কনভেয়ার বেল্ট বসায়। চিরতরে ধ্বংস হয়ে যায় লাঞ্জাগড় এবং কিনারি গ্রাম। রিহ্যাব কলোনিতে পুনর্বাসন দেওয়া হয় কন্ধদের । নদী ঝর্ণা পাহাড়বিহীন কুৎসিত কংক্রিটের খুপরি,না্না রোগের ডিপো আর স্বরাট সম্রাট প্রকৃতির সন্তানের পরিবর্তন হয় কিছু শোষিত কুলিকামিনের কংকালে । বাদবাকিরা সব-হারানো দিন আনি দিন খাইয়ের দলে। লোক দেখিয়ে কন্ধ বাচ্চাদের জন্য স্কুল খোলা হয়, কিন্তু উপজাতীয় শিশুরা সেই স্কুলে ঢুকতে পারে না। চড়া হারে বেতন দেবার সামর্থ্য তাদের নেই।
সংশোধনাগার থেকে দূষিত বর্জ্য অন্যান্য গ্রামেও নানা চর্মরোগ নিয়ে আসে,সঙ্গে গবাদিপশুর মড়ক। ভূগর্ভে সঞ্চিত জলও রেহাই পায়না দূষণের হাত থেকে। বংশধারা নদী যা কন্ধদের জীবনরেখা, লাল হয়ে যায় দূষিত বর্জ্যে। বেদান্ত কিন্তু আশ্বাস দিয়েছিল খনন সম্পূর্ণ হবার পর অনেক গাছ পুঁতে বনভূমি ফিরিয়ে দেবে। তবে সে কেমন খনন? দিনে ১৬ ঘন্টা,সপ্তাহের ৬ দিন, ২৩ বছর ধরে চলবে গাছপালা উৎপাটিত করে, মানুষ পশু মেরে বক্সাইট তোলার নামে ধরিত্রীর এই লাগাতার ধর্ষণ। সেসবের শেষে গুটিকয়েক ইউক্যালিপটাসের সদ্য পোঁতা চারা গরম বাতাসে কচি মাথা নাড়াবে - এইই হয়তো ছিল বেদান্তের ক্ষতিপূরণ আর বনভূমিসৃজনের ধারণা ! পয়সা হজম তো খেলও খতম ! হারিয়ে যাওয়া নদী ঝর্ণা ,বাস্তুতন্ত্রের কি হবে সে ব্যাপারে বেদান্ত চুপ। পরিবেশের এই অপূরণীয় ক্ষতি আর একটা দুর্ভিক্ষপীড়িত কালাহান্ডির জন্ম দেবে কিনা উড়িষ্যায়, সে প্রশ্নে তার মাসতুতো ভাই সরকার বাহাদুরও চুপ।এ সবই বোধহয় কোল্যাটারাল ড্যামেজ। প্রকৃতি লুন্ঠনের সময় এসবই হয়, বারবারই হয়েছে।
~ডোঙ্গরিয়াদের সংগ্রাম ও তার পরে।~
সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল তখনি যখন নিয়মগিরির কুয়াশাঘেরা চূড়োয় যেখানে নিয়মরাজার বাস, ঠিক সেইখানে জমি জরিপ করতে পৌঁছে গেল বেদান্তের জিপ। এইবার বিক্ষোভ, প্রতিবাদ এমন মাত্রায় পৌঁছলো যে চিরকালের শান্তিপূর্ণ ডোঙারিয়া কন্ধরা সেই জিপে আগুন ধরিয়ে দিল। ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম শুরু হলো। ২০১৩ সালে নিয়মগিরি অঞ্চলের ১৩টি গ্রামসভা বেদান্তের বক্সাইট মাইনিং সাম্রাজ্য সম্প্রসারণের বিরুদ্ধতা শুরু করে। দলবদ্ধ ভাবে আওয়াজ তোলে তাদের এলাকা থেকে দূরে হটে যেতে হবে এই পরিবেশ ধ্বংসকারী মুনাফাখোরদের। সুপ্রিম কোর্টও জনজাতি গ্রামসভার এই সিদ্ধান্তকে মান্যতা দেয়। তারপর ছ’ বছর কেটে গেছে। কেমন আছে নিয়মগিরি আর তার সন্তানসন্ততিরা ? ভাবলে চূড়ান্ত ভুল হবে যে পরিবেশ দূষণ বন্ধ হয়ে গেছে, ডোঙ্গরিয়ারা বনের ফল মধু খেয়ে, নিয়মগিরির পুজো করে রূপকথার মতো চিরসুখের রাজ্যে বাস করছে। বরং তারপর থেকে শুরু হয়েছে চোরাগোপ্তা লাঞ্ছনা, খুন ও ষড়যন্ত্রের এক ভয়াবহ কাহিনী।
মিডিয়াতে যখন উপচে পড়তে লাগলো দৈনন্দিন জীবনে এবং সাপ্তাহিক হাটের দিনগুলিতে ডোঙারিয়াদের ওপর নেমে আসা অত্যাচারের কথা, তখন পূর্ব উল্লিখিত CDRO এবং গণতান্ত্রিক অধিকার সুরক্ষা সংগঠন বা GASS মানবাধিকার লঙ্ঘনের ব্যাপারটি সরেজমিনে তদন্ত করতে ঐ অঞ্চলে যায়। লাঞ্জাগড় এবং বক্সাইট মাইনিং সম্প্রসারণ হবে এমন এলাকাগুলির অধিবাসীদের কথা বলবার জন্য ডাকা হয়।
এর মধ্যেই ঘটে যায় দুটি ঘটনা। গত ৬ ই মার্চ মাইনিং বিরোধী নেতা লিঙ্গরাজ আজাদকে হঠাৎ গ্রেপ্তার করা হয় এবং তার বারদিন পরে বেদান্ত রিফাইনারি প্লান্টের চুক্তিভিত্তিক কর্মী দানি বাত্রাকে কারখানার গেটে লাঠিপেটা করে মেরে ফেলা হয়। ঘটনাপ্রবাহ এখানেই থেমে থাকে না। কারখানার চার দেওয়ালের ভেতরেও ঘটে যায় এক নিষ্ঠুর হনন। সুজিত মিনজ নামের এক তরতাজা তরুণ সিকিউরিটি গার্ডের রক্তাক্ত দেহ কারখানা চত্বরে আবিষ্কৃত হয়।