ভারতের নির্বাচন চলছে। ৩ দফা হয়ে গেছে আরও ৪ দফা বাকি আছে। কিন্তু অনেকেই হয়তো জানেন না ভারতের নির্বাচন কি পদ্ধতিতে হয়। ভারতের নির্বাচন হয় এফপিটিপি বা ফার্স্ট পাস্ট দা পোস্ট পদ্ধতিতে। অনেকেই ভাবছেন এটা আবার কি বিষয়? সহজ করে বললে এই শব্দটার মানে দাঁড়ায় এই পদ্ধতিতে যে প্রার্থী সবচেয়ে বেশী ভোট পাবেন তাঁকেই জয়ী হিসেবে মান্য করতে হবে ভোটারদের। সে যদি কোনও ভোটার তাঁকে ভোট নাও দেন তাও। এই পদ্ধতিতে সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এখন ভোট হয়। দেখা গেছে যে যে সব দেশ বিভিন্ন সময়ে ইংরেজদের কলোনি ছিল যেমন কানাডা, সুদান, কেনিয়া , ভারত এবং অন্যান্যরা এখনো এই পদ্ধতিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত করে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই পদ্ধতিতে অসুবিধা কোথায় এবং এর সঙ্গে ইভিএমের কি সম্পর্ক?
এফপিটিপি ব্যবস্থায় সুবিধা অসুবিধাগুলো কি কি?
এই পদ্ধতিতে যথেষ্ট তাড়াতাড়ি ভোট করানো এবং গোণা সম্ভব। মূলত দ্বিপার্টি সিস্টেমে এই পদ্ধতি কার্যকরী। কিন্তু কয়েকটি বিষয় নিয়ে প্রশ্ন থেকে যায় । কম ভোট পেলেও এই পদ্ধতিতে যেকোনও প্রার্থী জিতে জেতে পারেন, এবং যেহেতু ভারতের গণতন্ত্রে মূলত নেগেটিভ ভোট দেওয়া হয়, মানে ভোটারদের যাকে অপছন্দ তাঁর বিপক্ষে মানুষ ভোট দিয়ে অভ্যস্ত সুতরাং এই পদ্ধতিতে কখনোই সর্বশ্রেষ্ঠ প্রার্থী নির্বাচিত হবেন না। যেই জায়গা থেকে আজকের শাসক দল ক্ষমতায় এসেছে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশকে কাজে লাগিয়ে, মিডিয়াকে সেই প্রচারের সঙ্গী বানিয়ে কারুর কারুর অপছন্দ হলেও বিজেপি ক্ষমতায় এসেছে। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন এর বিপরীতে কি আর কোনও পদ্ধতি আছে ? হ্যাঁ , আছে। রিপ্রেসেন্টেটিভ পদ্ধতি বা চয়েস বেসড পদ্ধতি। এতে কিভাবে ভোট হয়? প্রত্যেকটি ভোটার তাঁর নিজস্ব পছন্দমতো প্রার্থীকে ১ থেকে ১০ অবধি ( যদি ১০ জন প্রার্থী থাকেন) নম্বর দেবেন পছন্দ অনুযায়ী। সেই প্রাপ্ত নম্বর অনুযায়ী ভোট গোণা হবে। যে প্রার্থী ৫০ শতাংশ ভোটের বেশী পাবেন তাঁকে জয়ী ঘোষণা করা হবে। যদিও এই পদ্ধতিতেই জার্মানিতে হিটলার ক্ষমতায় এসেছিলেন তাও ভারতের মতো দেশে যেখানে মাল্টি পার্টি বা অনেক দলের রাজনীতি চলে সেখানে এই পদ্ধতিতে ভোট গ্রহণ করাটা কি বাঞ্ছনীয় নয়? যদিও এই ক্ষেত্রে ভোট গণনার কাজটা যথেষ্ট জটিল হয়ে যায়।
এফপিটিপি ব্যবস্থায় ভোটে কিভাবে ইভিএমকে প্রভাবিত করা হয়?
এফপিটিপির সঙ্গে ইভিএমের কি সম্পর্ক?
যেহেতু এই পদ্ধতিতে কৌশলগত ভোট হয় এবং নেগেটিভ ভোট দেওয়া হয় তাই ইভিএমকে যদি প্রভাবিত করা যায় তাহলে জেতাটা সহজ হয়ে যায়। এটা যদিও প্রমাণিত হয়নি যে ইভিএমকে প্রভাবিত করা সম্ভব কিন্তু তৃতীয় দফা নির্বাচনে দেশের বিভিন্ন কোণা থেকে ইভিএম গোলমালের খবর এসেছে। একটি ইভিএমে ধরা যাক ১০০০ ভোট নেওয়া হবে। দেখা গেছে যেখানে শাসক দল শক্তিশালী সেখান থেকে কম অভিযোগ এসেছে, বরঞ্চ যেখানে শাসকদল কম শক্তিশালী সেখান থেকে এই বিষয়ে বেশী অভিযোগ এসেছে। এরও একটা কারণ আছে। যেখানে দলের শক্তিশালী সংগঠন সেখানে ভোট করানো যায় সংগঠন দিয়ে আর যেখানে শক্তিশালী নয় বা তুলনামূলক ভাবে কম শক্তিশালী, সেখানে যদি মেশিনকে প্রভাবিত করা যায় তাহলে সারা দেশে জেতাটা নিশ্চিত করানো যায়। অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন কম শক্তিশালী জায়গায় মেশিনকে প্রভাবিত করলে তো ধরা পড়ার সুযোগ বেশী, কিন্তু হিসেব করলে দেখা যাবে এই পদ্ধতিতেই জেতাটা বেশী সহজ। যদি ধরাও পড়ে যায় তাহলে কোনও ক্ষতি নেই বলা যাবে মেশিন বিভিন্ন কারণে কাজ করেনি আর ধরা না পড়লে তো লাভই লাভ। নির্বাচন কমিশন যদিও এবারের ভোটে ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট মেশিন যুক্ত করেছেন কিন্তু তাতেও কি খুব কিছু লাভ হয়েছে? উল্টে দেখা গেছে আসামে একজন প্রাক্তন ডিজি যখন দেখেন যে তাঁর ভোট তাঁর অনিচ্ছা সত্ত্বেও শাসকদলের পক্ষে দেখাচ্ছে প্রতিবাদ করতে গিয়ে তাঁকেই উল্টে বলা হয় গ্রেপ্তার হতে পারেন কিন্তু। যখন একজন প্রাক্তন পুলিশ অফিসারের কথারই কোনও গুরুত্ব নেই তখন একজন সাধারণ মানুষের কথার আর কি গুরুত্ব থাকতে পারে? যারা এই মুহূর্তে ইভিএমের মক পোল করছেন মানে পরীক্ষা করে দেখছেন তাঁদের থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী এক একটি ইভিএমের মাত্র ৫০ থেকে ১০০ টি ভোট দিয়ে পরীক্ষা করতে দেওয়া হয়। সুতরাং এমন যদি হয় যে ২৫০টি ভোটের পরে ১টি অন্তর ১টি শাসক দলের পক্ষে যায় তাহলে কি ভাবে বলা সম্ভব যে ইভিএমকে প্রভাবিত করা সম্ভব নয়? এই প্রশ্নগুলি করেছেন ওয়াশিংটন বিশ্ববিদ্যালয়ের বৈজ্ঞানিক অধ্যাপক ভোরা প্রাক্তন নির্বাচন কমিশনার নাসিম জাইদিকে কিছু প্রশ্ন করেন। উত্তরে যথারীতি নির্বাচন কমিশন নির্বিকার ভাবে বলে ‘ইভিএম প্রভাবিত করা সম্ভব নয় ব্যাস’। এখন ধরা যাক ৫% ইভিএমকে ১০০০ ভোট দিয়ে পরীক্ষা করতে দেওয়া হলো , কিন্তু বাকি ৯৫% মেশিনকে তো আর পরীক্ষা করা হলো না সুতরাং যদি দেখা যায় মাত্র ২৫% ইভিএমকে প্রভাবিত করার বন্দোবস্ত করা হয়েছে সুতরাং অঙ্কের নিয়মে ১.২৫% মেশিনে এটা ধরা পড়ার সম্ভাবনা থাকে বাকিগুলোতে পরীক্ষা করা সম্ভব নয়। যে কারণে এবার নির্বাচন কমিশন ইভিএমের সঙ্গে ভিভিপ্যাট মেশিন যুক্ত করলো । যুক্ত করলেও কিন্তু আইনের ফাঁক রেখে দিল। কেউ অভিযোগ করতে গেলে উল্টে তাঁকেই গ্রেপ্তার করা হবে এবং জরিমানা দিতে হবে, যে উদাহরণ আগেই দেওয়া হয়েছে। এটা অনেকটা ওইরকম ঘটনা যে সিগারেট খেলে ক্যান্সার হতে পারে অনেকেই জানে। তার মানে ঘুরিয়ে বললে ক্যান্সার হলে সিগারেট খাওয়ার অসুখ সেরে যায় তেমনি ভিভিপ্যাট দিয়ে ইভিএম প্রভাবিত করার রোগ সারানো যায় তাই নয় কি ?
তাহলে কি এই এফপিটিপি পদ্ধতিতে শাসকদলকে হারানোর কোনও উপায় নেই ?
ভারতের নির্বাচনে এই লোকসভা নির্বাচন কি শেষ নির্বাচন? অনেকেই এটা বলছেন। আসলে এর পরের নির্বাচনে হয়তো বা আধারকে বাধ্যতামূলক করে দেওয়া হবে। যে আধারের কোনও ভিত্তি নেই যেই আধারের তথ্যভাণ্ডার কারুর দ্বারা প্রত্যয়িত নয়, পরীক্ষিত নয় , যে আধারে কারুর সই নেই , জানা নেই কত ভুয়ো আধার এই মুহূর্তে আছে, যে আধার নাগরিকত্বের প্রমাণ নয় আধার কতৃপক্ষের কথায়, সেই আধারকে বাধ্যতামূলক করলে যে কেউ পৃথি্তহায়,জে কোনও প্রান্ত থেকে ভোট দিতে পারবেন এবং ভারতের বৈধ নাগরিকেরা যেহেতু তখন একটা সংখ্যা ছাড়া কিছু নয় সেই সংখ্যারা প্রতিবাদও করতে পারবেন না। তাহলে উপায় কি ? উপায় একটাই আপাতত যদি বেশী সংখ্যায় মানুষকে এবার ভোট দেওয়ানো যায় এবং সমস্ত নির্বাচককে যদি সচেতন করা যায় তাহলেই একমাত্র গণতন্ত্র রক্ষা করা সম্ভব। না হলে প্রতিটি নাগরিকের অবস্থা কিছুদিন আগে প্রকাশ পাওয়া একটি হিন্দিতে ডাবড হওয়া তামিল ছবি “ রিটার্ন অফ অভিমন্যুর’ মতো অবস্থা হবে। একটা কথা মনে রাখা সবসময়ে জরুরী গণতন্ত্রে শাসকদল যাকে সবচেয়ে বেশী ভয় পায় সে হলো মানুষ।