দেশের সপ্তদশ সাধারণ নির্বাচন। প্রত্যেক ভোটেই কিছু নতুন শব্দের জন্ম দেয়। তার কিছু টিকে যায়, বাকিটা হারিয়ে যায়। যেমন ২০১৪-এ ছিল সারদা, নারদা।এবারের ভোটে কতগুলো নতুন শব্দ বা বাক্যবন্ধ কানে আসছে।তার কয়েকটি এরকম। নকুলদানা, ঘুষপেটিয়া, চৌকিদার, এক্সপায়ারিবাবু, স্পিডব্রেকার দিদি, এ-স্যাট, নাকাতল্লাশি, জুমলা।
দলবদলেরও একটা নতুন ঘটনা এবারে চোখে পড়ছে। বৃহস্পতিবার প্রথম দফা ভোট কোচবিহার এবং আলিপুরদুয়ার কেন্দ্রে। কোচবিহারে এবার তৃণমূল প্রার্থী একসময়ে বামফ্রন্টের মন্ত্রী পরেশ অধিকারী। উল্টো দিকে বিজেপির প্রার্থী নিশীথ প্রামাণিক এই সেদিনও ছিলেন তৃণমূলের নেতা, এবারে বিজেপির প্রার্থী। আলিপুরদুয়ারেও ছবিও প্রায় এক। তৃণমূল প্রার্থী দশরথ তির্কে একসময়ের বামফ্রন্টের দাপুটে নেতা, এবারে তৃণমূলের প্রার্থী। অন্যদিকে জন বার্লা, ছিলেন আদিবাসী পরিষদের বড় মাপের নেতা, হয়ে গেলেন বিজেপি প্রার্থী। বঙ্গ পলিটিক্সে এই যে যখন তখন রুমাল থেকে বেড়াল হওয়া, আবার বেড়াল থেকে রুমাল হয়ে যাওয়া, এই ব্যাপারটা ছিল না। এটা আমদানি করেছে পশ্চিমবঙ্গের বর্তমান শাসকদল। এরা বোধহয় ভুলে যান, কোথাও না কোথাও কাক্কেশ্বর স্লেট-পেনসিল নিয়ে সব হিসেব লিখে রাখছে। কে না জানে, হজবরল-র কাকের ওই হিসেবে দু’এক ফোঁটা চোখের জলও পড়েছিল।
ইলেকশন ওয়াচ এবং অ্যাসোসিয়েশন অফ ডেমক্র্যাটিক রিফর্মস, সব প্রার্থীদের সম্পত্তির রহিসেব, তাদের পুরোনো ইতিহাস, এইসব খুঁজে বের করে। তাদের রিপোর্টে দেখা যাচ্ছে, ২০১৪ লোকসভা ভোটে জয়ী সাংসদদের মধ্যে ৪৩০ জন কোটিপতি সাংসদ। দেশ এগোয়নি কে বলবে! কিন্তু সেই তালিকায় একজনও কোটিপতি বামপন্থী সাংসদ নেই। বামেদের এই দুর্দিনে, এটা কিঞ্চিৎ আশার কথা।
কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো আর বাইবেলকে বলা হয় পৃথিবীর সব থেকে বেশি বিক্রি হওয়া বইগুলির মধ্যে অন্যতম। বাইবেলের কথা বলতে পারব না, কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর যে ‘দিন গিয়াছে’ অন্তত আপাতত, সে বিষয়ে সন্দেহ নাই। দেশের দুটো বড় দল তাদের ইলেকশন ম্যানিফেস্টো প্রকাশ করেছে। রাজ্যে রাজ্যে বিভিন্ন আঞ্চলিক দলও তাদের নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করেছে। এখনও শুনিনি কোনও দল তাদেরর ম্যানিফেস্টোতে বলেছে যে তারা ক্ষমতায় এলে মিড ডে মিলে বরাদ্দ অন্তত একটাকা বাড়াবে। অনেক দূরের গ্রামের স্কুলটাকে হিন্দু বা হেয়েয়ারের মতো সম মানের করে গড়ে তোলা হবে, এমন কথা অতীতেও কখনও কোনও ইস্তেহারে আসেনি, এবারও নয়। ২৫-২৬ বছর আগে, বামফ্রন্ট জমানার পূর্তমন্ত্রী অশোক ভট্টাচার্য একবার আমাকে বলেছিলেন, তিনি কলকাতায় বেশ কিছু নাইট শেলটার গড়ে তুলতে চান, যাতে শীতে বা বৃষ্টির মধ্যে কোনও ফুটপাথবাসীকে খোলা আকাশের নীচে পড়ে থাকতে নমা হয়। সে কাজ আজও হয়নি। নির্বাচনী ইস্তেহারে এসব কথা এখনও জায়গা পায় না। নরকের মতো যে সব ‘হোম’ আমাদের রাজ্যে আছে, যেখান থেকে মাঝে মাঝেই ভয়ঙ্কর সব খবর সংবাদপত্রের পাতায় ছিটকে আসে, তা নিয়ে কোনও ভাবনা কোনও দলের ইস্তেহারে নেই। আর্সেনিকমুক্ত জল নিয়ে কোনও প্রতিশ্রুতি নেই। কয়েক দিন আগে সবুজ মঞ্চ কলকাতা প্রেসক্লাবে বিভিন্ন দলের নেতাদের ডেকেছিল, ভোটে জিতলে পরিবেশ নিয়ে কার কী ভাবনা জানতে। সকলেই এসে প্রায় গোল গোল কথা বললেন। মনে পড়ে যাচ্ছিল, মাস কয়েক আগে কলকাতার মেয়র সংবাদ মাধ্যমকে বলেছিলেন, পূর্ব কলকাতার জলাভূমিতে কী ভাবে নির্মাণ কাজ করা যায় তা নিয়ে তিনি ভাবছেন। এমন ভয়ঙ্কর একটি কথা বলার পরেও সংবাদ মাধ্যমে তা নিয়ে খুব একটা হইচই হয়নি। তবে কংগ্রেসের ইস্তাহারে এমন কিছু কথা আছে যা তেমন ভাবে সংবাদ মাধ্যমে জায়গা পায়নি। কিন্তু বিষয়টি আলোচনার যোগ্য।
২০১৯-এর কংগ্রেসের ম্যানিফেস্টোতে ঘোষণা করা হয়েছে বিচারাধীন বন্দিদের মুক্তির (শর্ত আছে) কথা। যার সুফল পাবেন বহু রাজনৈতিক বন্দি। স্বাধীনতার আগে কংগ্রেস এই সব দাবি করত। তার পর এসব কথা কংগ্রেস ভুলে গিয়েছিল। ইস্তাতাহারে বলা হয়েছে, দেশদ্রোহ বা সেডিশন আইন, যেটা, ইংরেজরা তৈরি করেছিল, মূলত ভারতীয় লেখকদের ইংরেজ বিরোধী লেখা বন্ধ করতে, যে আইন এতদিন কংগ্রেস সব জেনেও লালন-পালন করেছে, সেই আইন বাতিলের স্পষ্ট ইঙ্গিত রাহুল গান্ধীর ম্যানিফেস্টোয়। এই আইনেই মামলা হয়েছিল কানহাইয়া কুমারের বিরুদ্ধ। এই আইনেই মহারাষ্ট্র সরকার মামলা রুজু করেছে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলির প্রাক্তন সম্পাদক গৌতম নওলখা, বামপন্থী কবি ভারভারা রাও মানবাধিকার কর্মী শ্রমিক নেত্রী সুধা ভরদ্বাজদের বিরুদ্ধে।আফসপা আইনে ‘উপদ্রুত’ এলাকায় নিরাপত্তা রক্ষার জন্য বিশেষ আইনে এতদিন সেনাকে যে ছাড় দেওয়া হত, যার বিরুদ্ধ শর্মিলা চানু অনশন করে সারা পৃথিবীর কাছে ‘প্রতীক’ হয়ে আছেন, সেই আইন সংস্কারের কথা বলা হয়েছে এই ইস্তাহারে। এছাড়াও মানবাধিকার আইনের কথা উল্লেখ করে,যে ভাবে বন্দির অধিকারের কথা বলা হয়েছে, বন্দির উপর পুলিশের নির্যাতন বন্ধের কথা বলা হয়েছে।যদিও এত কিছুর পরেও কংগ্রেস ক্ষমতায় আসবে এমন মনে করার মতো মনের জোর ক’জনেরই বা আছে। আর বামপন্থীরা?
অনেকেই দেখা হলে জানতে চান, এবারে বামপন্থীরা কি কোনও আসন পাবে? ইতিমধ্যে দুটো সমীক্ষা বামেদের ভাগে শূন্যই দিয়ে রেখেছে। মহম্মদ সেলিম ২০১৪-এ রায়গঞ্জ আসন জিতেছিলেন কয়েকশো ভোটে। এবার পারবেন বলে মনে হয় না। তবে জোট হলে সম্ভাবনা ছিল। বিজেপি কিন্তু জোট রাখতে জেতা আসন ছেড়রছে বিহারে। সিপিএম সোমেন মিত্রদের অন্যায়, অন্যায্য মানেনি। বোধহয় মেনে নিলে ভালো হত। তাতেও হয়তো আসন জুটত না, কিন্তু বহু আসনে বিজেপিকে তৃতীয় স্থানে, অনেক কম ভোটে আটকে রাখা যেত। জোট না হওয়ায় বিজেপির সুবিধে হল।