
উর্মিমালা বসুকে 'কামপন্থীদের নতুন যৌনদাসী' অভিধায় অভিহিত করা হয়েছে। এত শুদ্ধ একটা বাংলা বানান-টানান ঠিক রেখে লেখার জন্য লেখককে অভিনন্দন। তবে কিনা লোকের কালো মনে সাদা নেই – লেখককে বা লেখকের অভাবে তাঁর পোষিত রাজনৈতিক দলকে ফুলের তোড়া পাঠানোর বদলে আমরা রেগে উঠলাম। এত অপমান! মেয়ে বলেই এসব শুনতে হবে!
আমরা বলতে থাকলাম রাজনীতি নির্বিশেষে সবাই প্রতিবাদ করুন। কিঁউ ভাই? শোনো নি কি, প্রেমে আর যুদ্ধে আনফেয়ার বলে কিছু হয় না? এ তো যুদ্ধের দিন। এসবই তোমাকে –আমাকে-আমাদের ভয় দেখান’র কৌশল। যাতে শিক্ষিত বাঙ্গালী ঘেন্নায় কুঁকড়ে যায়, দলে দলে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করে। বিশেষতঃ মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্ত বাড়ীর মেয়েরা, যারা যৌনতাকে ফিনাইল নিয়ে ভোকাব্যুলারি থেকে মুছে দিয়েছে, তারা এসব শুনলে প্রকাশ্যে মুখ খোলার আগে দুবার ভাববে। সেটাই তো একটা রণকৌশল। সেই জন্যেই ঘোষ-মশাই যাদবপুরের মেয়েদের গায়ে যৌন-ব্যবসার ট্যাগ লাগান। সেজন্যেই এই সব মিম তৈরি হয়।
যাদবপুরের মেয়েরা চিরকালই খুব সহজ টার্গেট। তারা সিগারেট খায়, গাঁজা টানে, তাদের জামা-কাপড়ের ঠিক থাকে না ইত্যাদি ইত্যাদি, অপরাধের তো শেষ নেই। আর তারা অবশ্যই সিগারেটটি খায় অন্যের বাড়ি থেকে তোলা সংগ্রহ করে, তাই তাতে অন্যের এত ক্ষোভ! বা তাদের জামাকাপড়ের খরচটাও নিশ্চয় আমার-আপনার বাড়ী থেকে যায়, তাই আমাদের তাই নিয়ে বক্তব্য রাখার অধিকার আছে। যাদবপুরের মেয়েদের যৌন-জীবন নিয়ে গাছে-ওঠা গল্পের গরুর টাকনা দিয়ে ভাত খেলে বেশি স্বাদ লাগে। এসবই হরবখত শোনা যায়। কেন? কারণ আমাদের যাবতীয় সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক হতাশা উগরানোর একটা চিরস্থায়ী জায়গা তো দরকার – তাই “যাদবপুরের মেয়ে”রা আমাদের রোজ সন্ধ্যেবেলার পাঞ্চিং ব্যাগ। আর যে দেশে মুখ্যমন্ত্রী স্বয়ং অশ্লীল মিমের থেকে রেহাই পান না, সেখানে এসব তো তুচ্ছ কথা!
যাদবপুরের মেয়েরাও এসব জানে । আর এও তারা জানে যে এসবই হল আদতে ক্ষমতার লড়াই। মেয়েদের মেধার সঙ্গে, অর্থনৈতিক ক্ষমতার সম্ভাবনার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে পেরে না ওঠা পুরুষের দল এই সব নিয়ে ঘোটল্লা করবে। তার উপর যদি সেই মেয়েদের রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সঙ্গে নিজের চিন্তা-ভাবনার কোন বিরোধ থাকে তাহলে তো সোনায় সোহাগা! শুধু তো পুরুষরা নয়, তাদের চোখে জগত দেখা মেয়েরাও একই কথা বলবে তোতাপাখিরবে । তস্মিন তুষ্টে জগত তুষ্ট।
তবে তারা এও জানে রাস্তার কুকুর ঘেউ ঘেউ করেই, তাতে কান দিতে নেই। প্রতিবাদ তো করতে নেই-ই। ক্ষমতার লড়াই লড়তে হয় বিকল্প ক্ষমতা দিয়ে। সেই বিকল্প ক্ষমতা হল চিন্তার ক্ষমতা, চিন্তার মোড় ঘোরানোর ক্ষমতা। যৌনদাসী কথাটিতে বা যৌন-ব্যবসার প্রসঙ্গে আমরা অপমানিত বোধ করছি , তার কারণও তো সেই পিতৃতন্ত্রেই প্রোথিত। যাতে হাজার হাজার বছর ধরে আমাদের মাথায় গজাল ঠোকা হয়েছে যে মেয়েদের যৌনতা পবিত্রতার আধার । তাকে রক্ষাকবচে ঘিরে পরম যত্নে একজন মাত্র পুরুষের জন্য রক্ষা করাই মেয়েদের পূত-পবিত্র দায়িত্ব। তার অন্যথা হলেই নারীত্ব বৃথা। এই ভাবনাটাকে যদি সম্মিলিতভাবে প্রতিরোধ করা যায়? যদি আমরা ভাবতে শিখি আর শেখাই যে আমাদের হাত-পা-নাক-কানের মত ভ্যাজিনাটাও একটা অঙ্গ মাত্র। আমার কানে যেমন একজন এসে বিনা-অনুমতিতে একটা কান-খোঁচানি কাঠি ঠেসে দিতে পারে না, তেমনি একজন মেয়ের ভ্যাজিনাতেও কেউ এসে তার বিনা- অনুমতিতে নিজের যৌনাঙ্গ বা স্টীলের রড বা মদের বোতল কিছুই ঢোকাতে পারে না। সেটা ক্রিমিন্যাল অফেন্স। নাথিং লেস, নাথিং মোর। ধর্ষণের সামাজিক লজ্জাকে বর্জন করতে শেখাই বোনদের, মেয়েদের। একটি মেয়েকেও যেন ধর্ষনের পরের সামাজিক চাপে ঘর ছাড়তে না হয়, গায়ে কেরোসিন ছড়াতে না হয়। তাহলেই একমাত্র এই নারীদেহের তথা নারীর যৌনতার উপর গোষ্ঠীর অধিকার, আর এক গোষ্ঠীকে নতজানু করতে অন্য গোষ্ঠীর লোকেদের তাদের মেয়েদের যৌন-লাঞ্ছনার অভ্যাস কমানো যাবে।
যৌন-ব্যবসাতে যারা আসেন, সনাতনী সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে যেহেতু তারা বহু-পুরুষকে ধারন করছেন, অর্থাৎ শুধুই একজনের জন্য নিজের জীবন-পণ করে নিজের যৌনতাকে আগলে রাখেন নি, তাই তাঁরা অস্পৃশ্য এটা ভাবার থেকে বেরিয়ে আসি। তাঁদের অসহায়তাটুকু বরং দেখতে শিখি – কি পরিস্থিতিতে পড়ে তাঁরা এ পথে এলেন বা আসতে বাধ্য হলেন, তার বিশ্লেষণ করতে শিখি। সে বিশ্লেষণ থেকে হয়ত সামাজিক- রাজনৈতিক সমস্যার বাবদে গভীরতর জ্ঞান জন্মাবে, হয়ত বা কোন ধীমতি, করিতকর্মা, ক্ষমতার অধিকারিনী সীমিত ক্ষমতার মধ্যেও কিছু কিছু সমস্যার সমাধানের পথও বাতলাতে পারবেন। মেয়েদের সামগ্রিক ক্ষমতায়নের পথটি আরেকটু সুগম হবে। আর যেটা হবে তা হল যৌনদাসী কথাটার গা থেকে অপমানের শেকল খসে পড়ে জাতিগত লজ্জার তকমা লাগবে।
এই ভাবনার বদল না ঘটিয়ে শুধু প্রতিবাদ করার অর্থ একটা অসমযুদ্ধে নামা। যতদিন ভাবনাচিন্তার ট্রাডিশনালিটি বজায় থাকবে ততদিন কিন্তু যৌন-গন্ধী গালাগালিও বজায় থাকবে। আর তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা অপমানের জ্বালাও কমবে না। আর সত্যি কথা বলতে কি, এই অপমান তো কোন রাজনীতির রং এর থেকে আসে না, আসে পিতৃতন্ত্রের সামাজিক কোডিং থেকে। যে দলে পিতৃতন্ত্রের প্রভাব বেশি জোরদার, সেখানে খুল্লামখুল্লা কথা হয়- যে দলে পালিশ বেশি, সেখানে কার্পেটের আড়ালে ঢাকা থাকে। আচমকা মুখ ফস্কে কখনো কখনো বেরিয়ে যায়, তাই বামপন্থাও সময় বুঝে বারবণিতার ধর্ষণকে ততটা গুরুত্ব দেয় না। রং দেখতে গেলে তাই ঠগ বাছতে গাঁ উজাড় হয়ে যাবে। আর রং বাছার সমস্যা হল সব মেয়েদেরও পাশে পাওয়া যাবে না। যুদ্ধকালে পক্ষ বাছতে হলে একটি মেয়ে তাঁর নিজের দলের পতাকার পাশেই দাঁড়াবে না নিজের মেয়ে পরিচয়কে প্রাধান্য দেবে সেটি তাঁর নিজের চয়েস। ঘোষবাবুর বা ওই অজ্ঞাতনামা লেখকের এইসব নোংরা কথার পরিপ্রেক্ষিতে কি আমরা দাবী করব যে এবিভিপির যাদবপুর ইউনিটের মেয়েরা এবিভিপি করা ছেড়ে দেবে? বা লকেট চ্যাটার্জি নিজের পদ ছেড়ে দেবেন। নাকি যে মেয়েরা জম্মুতে আসিফার ধর্ষকদের সমর্থনে মিছিল করেছিল, তারাই এর প্রতিবাদে মুখর হবে? সে বোধহয় অলীক কল্পনা।
তার থেকে আসুন, চিন্তার বদল ঘটাই। টেবিল উল্টে দিয়ে খেলাটাই পালটে দিই। আর দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই-তে টিকে থাকি। কেউ যেন কোনো ছল করে “যাদবপুরের মেয়েদের” মাঠ থেকে বের করে দিতে না পারে।
দ | unkwn.***.*** | ৩০ সেপ্টেম্বর ২০১৯ ১০:৪৮78042
বিপ্লব রহমান | unkwn.***.*** | ০৩ অক্টোবর ২০১৯ ১২:৩৯78043
স্বাতী রায় | unkwn.***.*** | ৩০ অক্টোবর ২০১৯ ০৭:১৯78044