ইদানিং বড় পর্দায় সিনেমা দেখা হয়না। খানিকটা স্থানমাহাত্ম্যে, খানিকটা আলস্যজনিত কারণে, অতএব, আমার চলচ্চিত্র অভিযান চার দেওয়ালের মধ্যেই আপাতত সীমাবদ্ধ। তবুও নানা প্রতিবন্ধকতা (যার অধিকাংশই সাজানো অজুহাত এবং কালের নিয়মে ফিকে হতে হতে একদিন আপশোষে মিশে যাবে) জয় করে অবশেষে দক্ষিণ কলকাতার একটি হলের শক্ত সিটে বসা গেল। একথা সেকথা ও আশপাশের দর্শকদের পপকর্ন-ঠান্ডাপানীয়-গজেন্দ্রগমন শান্ত হয়ে এলে, সিনেমা শুরু হলো।
ভারতীয় সিনেমা সাবালক হচ্ছে, হয়েছে বা হবে- মোটামুটি এই তিন ধরণের মত পোষণকারীদেরই আমরা চারপাশে দেখি বা তাঁদের কথা গল্পচ্ছলে শুনি। এখন, শিপ অফ থিসিয়াস এই তিন ধরণের দর্শককেই একাধারে আনন্দ দেবে, ও ধাঁধায় ফেলবে। কেন, সেকথা এই লেখার বিষয় নয়। বরং সবাই পারলে অন্তত একবার সিনেমাটা দেখে নিন। ঠকবেন না বলেই মনে হয়।
তিনটি গল্প, তিনটিই অঙ্গ প্রতিস্থাপনকে কোন না কোনভাবে কেন্দ্র করে, এইটুকু অবশ্য বলাই যায়। যে দ্বন্দ্ব এই সিনেমার প্রতি গল্পে বা শিরোনামে আছে, সেটা বললেও পাঠকের অসুবিধে হওয়ার নয়। এমনিতেই ইন্টারনেটের কল্যাণে আপনারা জানেন শিপ অফ থিসিয়াস নামের ইতিহাস। তো, ছোট করে, এই দ্বন্দ্ব বেশ খানিকটা, বা সবটাই, সত্যকেন্দ্রিক। নিজেকে, নিজের চারপাশের বস্তু বিষয় ও মানুষকে অন্য চোখে দেখার ব্যাকরণ শিপ অফ থিসিয়াস। যে অন্ধ মেয়েটিকে নিয়ে সিনেমা শুরু হয়, যে সন্ন্যাসী সিনেমার মধ্যভাগটা ভরিয়ে রাখেন, যে শেয়ারের কেনাবেচা করা ছেলেটি কাহিনীকে পরিণতির দিকে নিয়ে যান, আসলে যা পরিণতির অভাব, সেইটাই এই সিনেমার নতুনত্ব। ভারতীয় সিনেমায় যা দেখতে আমরা অভ্যস্ত নই। আশ্চর্যের বিষয়, এই তিনটি চরিত্রও তাদের নিজ নিজ জীবনে এমন সব কাজে জড়িয়ে পড়তে থাকে, যাতে তারা অভ্যস্ত তো নয়ই, বরং কোন কোন ক্ষেত্রে অপরিচিতও বলা চলে। নতুন চোখে জীবনকে দেখতে শুরু করার পরে মেয়েটি অন্ধত্বে নতুন সংজ্ঞা পায়। রোজ একটু একটু করে নেই হয়ে যেতে যেতে সন্ন্যাসীটি এবং তার গুণমুগ্ধ বন্ধুগণ নতুন নতুন দ্বন্দ্বের মধ্যে নিজেদের আবিষ্কার করে। যে যুবকের কাছে জীবনের একরকম মানে ইতিমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত, সেও খুঁজে পেতে শুরু করে অন্য সব নতুনতর মানে।
কিন্তু আমার তো ব্যক্তিগত কথা লেখার ছিলো। দিবাকর ব্যানার্জির মত পরিচালক শিপ অফ থিসিয়াসের রিভিউ লিখেছেন। তাই এই লেখাকে রিভিউয়ের সড়কপথে উঠতে দেওয়া চলবেনা। তাই টেকনিকালিটির কথা নমো নমো করে এখানেই শেষ হবে। প্রথমেই একটু অভিযোগ। ছবিতে কোথাও কোথাও সম্পাদনা আরো টানটান হলে আরো ভালো লাগত। এ বাদে চিত্রনাট্য নিখুঁত। সিনেম্যাটোগ্রাফি দুর্দান্ত, বিশেষ করে প্রথম দুটো গল্পে কখনো কখনো মনে হচ্ছিলো কোন নামী শিল্পীর আলোকচিত্রের প্রদর্শনীতে এসে বসেছি, সামনে স্লাইডে একের পর এক ছবি আসছে যাচ্ছে।
গত কয়েকবছরে পৃথিবীর নানা প্রান্তের সিনেমা দুয়েকটা যা দেখেছি, তাতে আমার কাছে সিনেমার জগতের বিভাজনগুলো কেমন থেকেও নেই হয়ে গেছে। একদিকে রুটি-ডাল-তরকারির মত "খোরাকি" সিনেমা, অন্যদিকে জীবনের সমস্ত হাসি-দু:খ-ক্লেদ সমন্বিত বিশ্ব সিনেমা (এই নামটা জুতসই কিনা জানিনা, তবে কি বলতে চাইছি তা চেন্নাই এক্সপ্রেস আর চিলড্রেন অফ হেভেনের তুলনা করলেই পেয়ে যাবেন), কিন্তু তার মধ্যে আছে অজস্র ফিকে-গাঢ় ধূসরের শেড, যেগুলো কোথাও কোথাও খাবার, কোথাও কোথাও মনের আরাম। অবশ্য কেউ কেউ বলবেন খাবারও মনের আরাম, আর তাদের কথাও একেবারে ফ্যালনা নয়।
তো, কথা হলো, শিপ অফ থিসিয়াস এই দ্বিতীয় শ্রেণীর। এখানে অতি স্পষ্টভাবে পরিচালক একটি ঝুঁকিপূর্ণ রাস্তায় নেমেছেন। সেখানে একদল মানুষ অভিনয়ের ছলে তার গল্পের চরিত্রগুলোর সাথে একাত্ম হয়ে যায়, আরেকদল মানুষ স্রেফ দেখতে দেখতে কোথাও কোথাও নিজেকে শনাক্ত করে ফেলে। ফলত: চরিত্রগুলোর রাগ, দু:খ, হতাশ ও সর্বোপরি দ্বন্দ্বগুলো ও অতি নির্মমভাবে বিঁধতে থাকে তার গায়ে। অবশ্য প্রাপ্তিগুলো ও আসে। ভারি চমৎকার কৌতূকে বেঁধেছেন পরিচালক ছবিটিকে। সংগীত আমার অশিক্ষিত কানে বেশ যথাযথ লাগে। অভিনেতারা আসলেই কেউ অভিনয় করেননি, ঐ জীবনগুলোয় ঢুকে পড়ে কয়েকদিন বাস করে গেছেন। তাই, কোথাও, কাউকেই বেমানান লাগেনা। অন্ধ মেয়েটিকে আমার সহপাঠিনীর মত লাগে, যে একইভাবে দিনান্তে বাড়ির লোকেদের সাথে কথা বলতো। শুধু তফাতের মধ্যে তার ভাষা ছিলো ফারসি। সন্ন্যাসীকে কার মত যেন লাগে, খুব চেনা, কিন্তু মনে করতে পারিনা। তার মৃদু হাসি, শান্ত ও স্নিগ্ধ প্রকৃতি যদিও চিনতে পারিনা। সর্বত্রই বিরক্তি দেখতে ও দেখাতে অভ্যস্ত আমি হয়রান হয়ে যাই তার অসীম ধৈর্য্য দেখে। "খোরাকি" সিনেমা হলে অবাস্তব বলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচতাম। কিন্তু পরিচালক আনন্দ গান্ধী সে রাস্তা রাখেননি। অতি কর্কশভাবে বাস্তব এই চরিত্রগুলো। তাদের আঙ্গিক। লিভার সিরোসিসে পঁয়তাল্লিশেই শেষ হয়ে যাওয়া আমার মাসির কথা মনে পড়ে, এবং গল্পটা চলতে চলতে একসময় আমি সেই ক্ষতস্থানে প্রলেপ পাই।
শেয়ারের খবর রাখা ছেলেটিকেও শনাক্ত করতে পারি। আমার সাথে সে রোজ খায়দায় অফিস যায়, ক্লাসে লেকচার দেয়। আমার চেয়ারের আশেপাশে ওরাই ছড়িয়ে থাকে। রাত হলে নি:শব্দে সে আমার মধ্যে শুয়ে ঘুমোয়। আর তার চেতনা হাসপাতালের বেডে শুয়ে থাকে, একইভাবে। তফাতের মধ্যে শুধু তার সর্বাঙ্গ পক্ষাঘাতগ্রস্ত।
তাই এই ভীষণ চেনা মানুষগুলোর ভালোমন্দ দুরু দুরু বুকে দেখতে দেখতে একটা গোটা বড়োসড়ো সিনেমা পুরো উপভোগ করে ফেলি। আমার মনে মালগুডি ডেজ, চাঁদমামায় দেখা জাতকের গল্প ও ছবি, প্রিয় বান্ধবীর অ্যাকসেন্ট, প্রিয় বন্ধুর অর্থপিশাচ হয়ে যাওয়া, তিনটি মহাদেশ ও তার মানুষের ভালোমন্দের ছাপ, দারিদ্র্য, দারিদ্র্যকে ছাপিয়ে উঠে মানুষ হওয়া ও না হতে পারার অসহায়তা, আর এ যাবৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির ডিভিডি সংগ্রহের সমস্ত প্রিয় অপ্রিয় স্বল্পপ্রিয় চরিত্র জট পাকিয়ে যায়। যে দ্বন্দ্ব নিয়ে এই সিনেমা তৈরী, আমি সেই দ্বন্দ্বেরই শিকার হই। সিনেমাটা দেখার পরের আমি সিনেমাটা দেখার আগের আমিই আছি কিনা বুঝতে পারিনা। এর উত্তর জানা অবশ্য ততটা জরুরি কিনা জানিনা।
হাস্যরসের কথাটা না বললে লেখা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে (যেন অন্যথায় লেখাটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হচ্ছে)। সেই চ্যাপলিনের আমল থেকে হেরা ফেরির পরেশ রাওয়াল হয়ে আজকের শিপ অফ থিসিয়াস, দর্শক এখনও দারিদ্র্য দেখলে হাসেন। একটা লোকের কিডনি চুরি করে কেটে বেচে দেওয়ার পরে সে কিডনিটা না, তার দাম বাবদ অনেক টাকা চায় --- এইটা ভারি হাসির ব্যাপার। সমবেত হাস্যরোলের পাশে বিব্রত আমি খানিকটা সন্দিগ্ধ হয়ে উঠি।
কেমন মনে হতে থাকে সমস্ত পরিবর্তনই হয়ত সাময়িক নয়।