এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি

  • বিজ্ঞানের অ(নেক?)-ক্ষমতা # পর্ব-৪

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি | ০৭ এপ্রিল ২০১৯ | ৩৩০৬ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • [৬] সবজান্তা বনাম জ্ঞানার্থী

    উপরের আলোচনায় আমি এটা দেখাতে চেয়েছি, বৈজ্ঞানিক চিন্তাধারার সাথে অধ্যাত্মবাদের বিরোধটা অত্যন্ত কঠোর বাস্তব। কী জানতে হবে তাতেও, কীভাবে জানতে হবে তা নিয়েও—বিরোধ এই উভয় মৌল বিন্দুতেই। তথ্য যুক্তি তর্ক সংশয় প্রমাণ অপ্রমাণ পরীক্ষা নিরীক্ষা পরিমাপন তুলনা বিচার বিশ্লেষণ—এই সমস্ত ব্যাপার ধর্মীয় চিন্তার পক্ষে শুধু অপাংক্তেয় নয়, বিপজ্জনকও বটে। “তাঁর ইচ্ছাতেই সব”, “তিনি যা করাচ্ছেন তাই হবে”, “মেলাবেন, তিনি মেলাবেন”—এই রকম ধারণা বা বিশ্বাস কোনো প্রমাণ অপ্রমাণের ধার ধারে না। মেনেই চলে। মেনে চলতেই চায়।

    রামকৃষ্ণ (১৮৩৪-৮৬) কথিত উপদেশামৃত পাঠেও এর প্রমাণ পাওয়া যায়: “বাগানে কত গাছ, গাছে কত ডাল—এসব হিসাবে তোমার কাজ কী? তুমি বাগানে আম খেতে এসেছ, খেয়ে যাও।” [রামকৃষ্ণ ১৯৮৬, ৩৬৭] অর্থাৎ, ভক্তের পক্ষে ঈশ্বর বা ঠাকুর-দেবতায় ভক্তি থাকাই যথেষ্ট। যুক্তি তর্ক প্রশ্ন কৌতূহল এখানে অবান্তর। সমস্ত ধর্মের ক্ষেত্রেই এটা সত্য। ঈশ্বর আছেন, তিনি সর্বশক্তিমান, সর্বজ্ঞ এবং সর্বত্র বিরাজমান, তিনি পরম করুণাময়—এটা ধরে নিয়েই তার যাত্রা শুরু। ভক্তের কাজ শুধু এটা মনে রাখা এবং সময় সুযোগ মতো ঈশ্বর বা তার নিজস্ব উপাস্য দেবতাকে ভক্তি নিবেদন করে যাওয়া। ধার্মিক মানুষ মাত্রই এই ভাবে ভাবেন। নৈতিক সততা ও আন্তরিক বিশ্বাস থাকলে সকলেই ব্যক্তিগতভাবে সত্যের সন্ধান পাবেন। ইউরোপে মধ্যযুগে খ্রিস্ট ধর্মেও লাতিন ভাষায় সন্ত আনসেম (১০৩৩-১১০৯) কথিত এক অনুরূপ বাণীর অনুরণন হত: Credo ut intelligam; যার মানে হল, “আমি বিশ্বাস করি, যাতে জানতে পারি”। এই রকমই ছিল সেদিনের সকলের মূল মনোভাবনা। ধর্ম বিশ্বাসীরা কেউ কখনই তাঁদের বিশ্বাসের সপক্ষে কোনো প্রমাণ চাননি বা দেননি। অন্তত পুরনো বইপত্রে কোনো প্রমাণের কথা নেই। আছে কিছু অলৌকিক ঘটনা প্রচার করে অবিশ্বাসীর মনে বিশ্বাস উৎপাদনের প্রচেষ্টা।

    অন্য দিকে, সেই প্রাচীন কাল থেকেই ঈশ্বর দেবদেবীর অস্তিত্বে, আত্মা পরমাত্মার ধারণায়, তাদের নিয়ে তৈরি লোককথা লোকপুরাণে, সন্দেহ পোষণ করেছে, প্রমাণ চেয়েছে অবিশ্বাসীরা, নিরীশ্বরবাদীরা, বাস্তববাদীরা। কপিল চার্বাক সোক্রাতেস এপিকিউরাস লুক্রেতিয়াস (খ্রিঃপূঃ ৯৯-৫৫) প্রমুখর এখনও বেঁচে থাকা বিখণ্ডিত কথাগুলোতেই তার সাক্ষ্য আছে। কিন্তু প্রাচীন কালে তাঁদের দাবি মতো প্রমাণ দাখিল করবার দায় ইচ্ছা বা নীতিবোধ সে যুগের ধর্ম তাত্ত্বিকদের ছিল না। সংখ্যাধিক্য, গায়ের জোর, নির্বাসনের ভয়, জাতিচ্যুত ও একঘরে করে দেবার ক্ষমতা ও হুমকি, খড়্গ কৃপান এবং আগুনের সাহায্যেই অবিশ্বাসের মোকাবিলা করা হত। এই ভাবেই বোঝানো যেত যে ঈশ্বর আছেন এবং তিনি মানুষের মনোরাজ্য শাসন ও পরিচালনা করে চলেছেন।

    বৃহদারণ্যক উপনিষদের নিজস্ব সূত্রে প্রদত্ত খবর থেকে জানা যায়: বিদুষী গার্গী যখন রাজা জনকের দরবারে প্রকাশ্য বিতর্ক তুলে মহর্ষি যাজ্ঞবল্ক্যকে প্রশ্ন ঝড়ে বিব্রত করে দিচ্ছিলেন, তখন সেই ব্রহ্মজ্ঞ ঋষি সেই সব প্রশ্নের উত্তর দিতে না পেরে শেষ পর্যন্ত বলে উঠেছিলেন:

    “গার্গি মাতিপ্রাক্ষীর্মা তে মূর্ধা ব্যাপপ্তদনতিপ্রশ্ন্যাং।
    বৈ দেবতামতিপুচ্ছসি গার্গি মাতিপ্রাক্ষীরিতি।।” [বৃহদারণ্যক উপনিষদ, ৩/৬/১]

    সরল বাংলায় এর মানে হল, “দেবতাদের ব্যাপারে অতি প্রশ্ন কোরো না গার্গী; এমন প্রশ্ন কোরো না যাতে তোমার মাথাটা খসে পড়ে।” মোক্ষম উত্তর। আমাদের বিদ্যেয় কুলোয় না, আমরা বিব্রত হব, এরকম প্রশ্ন কেউ করলে তার মুণ্ডুটা—ঘচাৎ। তায় তুমি আবার মেয়েছেলে। প্রকাশ্য দরবারে ঢুকতে পেয়েছ, এই তো ঢের। মাথায় দেড় হাত ঘোমটা টেনে সুবোধ ও সুবাধ্য ছাত্রীর মতো বসে আমাদের গুরুগম্ভীর বক্তিমে শোনো।

    এই সব খবর না পড়ে বা না জেনেই একদল লোক আমাদের দেশে দাবি করে থাকেন—ভারতবর্ষে নাকি কখনই বিরুদ্ধ মতের লোকেদের উপর ইউরোপের খ্রিস্টীয় চার্চের মতো অত্যাচার নিপীড়ন করা হয়নি। বেদ-উপনিষদ রামায়ণ মহাভারতের সব কথাকেই যাঁরা বাস্তব ইতিহাস ভূগোল বলে মনে করেন, তাঁরাই আবার অনেকে এই সব অসুবিধাজনক শাস্ত্রোক্ত ঘটনার উল্লেখ করলে বলেন, “আরে বাপু, এ তো আর সত্য ঘটনা নয়, এসব রূপক কাহিনি মাত্র!” বেশ, তাও যদি হয়, আমাদের প্রশ্ন হচ্ছে, এগুলো কাদের সম্বন্ধে এবং কোন ঘটনার সম্বন্ধে রূপক?

    তখন, আর শুধু তখনই বা বলি কেন, একেবারে শঙ্কর বিজয়ের কালেও ধর্মতাত্ত্বিকরা জানত না, তর্ক বিতর্ক কেন করব, অন্যমতসহিষ্ণুতা কাকে বলে, মত বিনিময় জিনিসটা কেমন, ভিন্ন এমনকি বিরোধী চিন্তাধারা থেকেও কীভাবে শেখা যায় এবং নিজের চিন্তা ভাবনাকে উন্নত করা যায়, ইত্যাদি। আসলে সেদিনকার মানুষদের বুদ্ধির পরিধির মধ্যে তা জানা শেখা সম্ভবও ছিল না। তাদের চেনা জানা পৃথিবীটা এখনকার তুলনায় খুবই ছোট। দেশ বলতে তারা বুঝত নিজেদের গ্রাম, পৃথিবী মানে অনেকগুলো চেনা জানা গ্রাম সমষ্টি। পৌরাণিক কালের সসাগরা পৃথিবী মানে সিন্ধু-গঙ্গা অববাহিকা। মোগল যুগে অর্ধেক ভারতের অধিপতি ভাবেন, তিনিই তখন জাহাঁপনা, অর্থাৎ, পৃথিবীর রাজা। স্বভাবতই সেই কালে মানুষের—এমনকি অত্যন্ত জ্ঞানীগুণী দার্শনিক পণ্ডিতদের মনেও—এরকম সন্দেহ জাগত না যে, তিনি যা জানেন, অথবা, তাঁর পঠিত শাস্ত্রগ্রন্থে যা লেখা আছে, তার বাইরেও জানার আরও অনেক কিছু থাকতে পারে।
    সেই জন্যই প্রাচীন ও মধ্য যুগে সমাজ কর্তৃপক্ষ অর্থাৎ, রাজতন্ত্র ও রাজধর্ম অনুমোদিত বা প্রচলিত বিশ্বাসের বাইরে অন্যমত বা বিরুদ্ধমত পোষণকারীদের শুধু যে শারীরিকভাবে নিগ্রহ করা হত তাই নয়, তাঁদের রচনাকেও আগুনের খাদ্য হিসাবে ব্যবহার করা হত। কি ইউরোপে, কি ভারতে।

    খ্রিস্টীয় লোককথা অনুযায়ী, যিশুকেও নাকি প্রাণ দিতে হয়েছিল প্রচলিত ধর্মমতের বাইরে গিয়ে নতুন কথা বলার অপরাধে। পরে আবার সেই যিশুর শিষ্যরাই অন্য মতাবলম্বীদের উপর একই রকম আচরণ অনেক বেশি দিন ধরে ফিরিয়ে দিয়েছে। তাদের হাতে প্লাতো আরিস্ততল রচিত বইপত্র রক্ষা পেয়েছে, কিন্তু সোক্রাতেস এপিকিউরাস দেমোক্রিতাস লুক্রেতিয়াস প্রমুখর রচনা ছাড়পত্র পায়নি। তাঁদের লেখার টুকরো টাকরা কোনো ভাবে টিকে গেছে সমালোচনার জন্য প্রদত্ত অন্যের উদ্ধৃতিতে। যেমন করে আমাদের দেশে চার্বাক মতবাদ টিকে রয়েছে ব্রাহ্মণ্যবাদীদের গালাগালির উপলক্ষে ব্যবহৃত বাক্যবন্ধ রূপে। এমনকি, বেদ কর্তৃত্ব না মানার অপরাধে বৌদ্ধগ্রন্থগুলিও, রবীন্দ্র নাথ ঠাকুর (১৮৬১-১৯৪১)-এর ভাষায়, ব্রাহ্মণ্যবাদী রাজা ও রাজভক্তরা “সপিল যজ্ঞ অনল আলোতে”। কেন না, সেকালের উদার হিন্দু শাস্ত্র মতে, “বেদ ব্রাহ্মণ রাজা ছাড়া আর/ কিছু নাই ভবে পূজা করিবার”। [ঠাকুর ১৯৬১খ, ৬২৩]

    পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অগাধ পাণ্ডিত্যের অধিকারী হওয়ার অপরাধে খ্রিস্টীয় সাম্রাজ্যে যখন জ্ঞানী রমণী হাইপেশিয়া (৩৭৫-৪১৫)-কে রোমের রাস্তায় আক্রমণ করে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে, প্রায় একই সময়ে ভারতের গুপ্ত যুগের তথাকথিত স্বর্ণময় হিন্দু রাজত্বে প্রখর বিদুষী খনা (৬ষ্ঠ শতাব্দ)-র জিহ্বা কেটে দিয়ে অনধিকার বিদ্যাচর্চার শাস্তি দান করা হয়েছে।

    এই সাদৃশ্য কি নিতান্তই আকস্মিক সমাপতন?

    একেবারেই না।

    প্রাচীন ও মধ্য যুগে কোনো দেশে কোনো ধর্মেই নারীর বিদ্যানুশীলনকে সুনজরে দেখা বা অনুমোদন করা হয়নি। ধর্মের উদারতার কথা যারা বলেন, ধর্মও চিরদিনই সত্যের অনুসন্ধানে মানুষকে উৎসাহিত করেছে—এই রকম গল্পকথা যারা শোনান, তারা ইতিহাসের পছন্দসই জায়গা থেকে অর্ধেক পাঠ করেন, আর বাদ বাকি এই সব তথ্য ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় ভুলে যান।

    প্রাচীন কালের মানুষ যা কিছু জেনেছিল, তার মধ্যে অনেক কিছু যেমন সঠিক ছিল, আবার অনেক কিছুই ছিল ডাহা ভুল (আজও তাই হয়; আমরা যা কিছু জানি বলে ভাবি, তার মধ্যেও সব কিছুই ঠিক থাকে না, অনেক কিছুই ভুল বলে পরে জানা যায়)। সমস্যা হচ্ছে, সেই কালে সেই সব ভুলগুলোকে ধরার কোনো উপায় জানা ছিল না। উপজাতি ভিত্তিক সমাজে ওঝা গুনিন বাইগা সর্দার জানগুরু ইত্যাদি নামে পরিচিত ও জ্ঞানীগুণী বলে সম্মানিত মানুষদের কথায় এক একটা গোষ্ঠীর সমবেত জ্ঞানের বা ধ্যান ধারণার প্রকাশ ঘটত এবং তাকে সেই সব গোষ্ঠীর লোকেরা বিনা প্রশ্নে মেনে চলত। পরবর্তীকালে ধর্মের আবির্ভাবের পর ঈশ্বরের আদেশ এবং ধর্মগুরুদের নির্দেশ হিসাবে ধর্মগ্রন্থ এবং পবিত্র গ্রন্থে যা লেখা আছে বা যা লেখা আছে বলে পাদ্রি পুরোহিত ইমামরা বোঝাত, তাকেই সমাজের বেশির ভাগ লোক গভীরভাবে বিশ্বাস করে চলত। বেদ বাইবেল ত্রিপিটক কোরান না পড়েই লোকে মনে করত: (১) এই সব বইতে দুনিয়ার যা কিছু জ্ঞাতব্য সবই লেখা আছে: (২) এগুলোতে যা কিছু লেখা আছে তার সবই নির্ভুল, অভ্রান্ত এবং অলঙ্ঘনীয়; এবং (৩) এই সব শাস্ত্রের বক্তব্য ঈশ্বরের সরাসরি নির্দেশ হিসাবে অথবা দৈবানুভূতির মাধ্যমে প্রাপ্ত। এই সমস্ত গ্রন্থের একটা বাক্য সম্পর্কেও অবিশ্বাস তো দূরের কথা, সন্দেহ করাও পাপ। ফলে, ইতিহাসের একটা বড় সময় ধরে পৃথিবীর কোথাওই উপজাতীয় বিশ্বাস আর ধর্মশাস্ত্রের বাইরে জ্ঞানচর্চার আর কোনো সুযোগই ছিল না।

    এই গণ্ডীবদ্ধ সীমানার বাইরে বেরিয়ে এসে আরও জানার আগ্রহটা একটা মানসিক ক্ষুধায় পরিণত হল রেনেশাঁসের সময় থেকে। যেমন পশ্চিমে তেমনই পুবে। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার, মানুষের পর্যটন বৃদ্ধি, কলম্বাস ভেসপুচি ম্যাগেলানের ভৌগোলিক অভিযান, সওদাগরদের বাণিজ্য, জলদস্যুদের লুটপাট, ইত্যাদি ঘটনা ইউরোপের মানুষদের কাছে পুরনো পৃথিবীর সংকীর্ণতাকে ক্রমশ উন্মোচন করে দিল। তারপর আধুনিক বিজ্ঞান এল নতুন জিনিস জানার আগ্রহ কৌতূহলী দৃষ্টিভঙ্গি এবং পদ্ধতি নিয়ে। তারই ভিত্তিতে প্রযুক্তি নিয়ে এল মুদ্রণ যন্ত্র ও জ্ঞান বিস্তারের অন্যান্য নিত্য নতুন উপায়। বিজ্ঞানের আলোকেই মানুষ প্রথম জানল—জানার অনেক কিছু বাকি আছে; জানতে হবে ধীরে ধীরে, অনেকে মিলেমিশে। জানতে গেলে ভুল ভ্রান্তিও ঘটবে অনেক; তাতে ভয় পাওয়ার কিছু নেই; পাঁচ জনে মিলে বসে, তর্কবিতর্ক করে একে অপরের অজ্ঞতার ফাঁক ভরাট করে দেবে, ভুল ধরিয়ে দেবে। এই ভাবেই জানার পরিমাণ বাড়তে থাকবে।

    বিজ্ঞানই মানুষকে শেখাল: প্রথমেই কোনো কিছুকে সত্য বলে মেনে নিও না—খুব প্রাচীন ও পবিত্র শাস্ত্রগ্রন্থে লেখা থাকলেও না, অত্যন্ত বড় মাপের জ্ঞানী মানুষ বললেও না। এমনকি কথাটা নিজের খুব পছন্দসই হলেও না। তোমার মাথায় যে ধারণাটা ঢুকতে এবং বসতে চাইছে, তাকে সামনে টেনে আন, উপযুক্ত পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষার মধ্যে ফেলে দাও, অন্য তথ্য ও তত্ত্ব দিয়ে যাচাই কর, বিচার কর। অন্যদের বিচার ও সমালোচনার সামনে ঠেলে দাও। তার পরও যদি সেই ধারণাটা টিকে যায়, খুব ভালো কথা। আর যদি তা এই সব প্রক্রিয়ায় না টেকে, বাতিল হয়ে যায়, তুমি কিন্তু খুব জোর বেঁচে গেলে। একটা ভুল ধারণার জঞ্জাল তোমার মগজকে বেশি সময় ধরে নোংরা করে রাখতে পারল না!

    বিজ্ঞান শহিদ দার্শনিক ব্রুনো ঠিক এই কথাটাই বলেছিলেন: “যিনি জ্ঞানচর্চা করতে চান তাঁকে প্রথমে সব কিছুতে সংশয় প্রকাশ করতে হবে। কোনো বিষয়ে বিভিন্ন মতামত শোনার আগে এবং পক্ষে ও বিপক্ষে উত্থাপিত যুক্তিগুলি দেখে শুনে বিবেচনা করার আগে তিনি ঐ বিতর্কে কোনো মত দেবেন না। কানাঘুসোয় কী শোনা গেছে, অধিকাংশ লোক কী বলছে, বা যে বলছে তার বয়স বিদ্যা বা সামাজিক প্রতিপত্তি কেমন, তার ভিত্তিতে কোনো মতামত বিচার বা গ্রহণ করবেন না। যুক্তি দিয়ে যে সত্য যাচাই করা যায়, বাস্তব জগতের সঙ্গে যে চিন্তাধারা মেলে, তিনি তার ভিত্তিতে অগ্রসর হবেন।” [Cited by Gaglioti 2000, available on-line]

    ধর্মের ক্ষেত্রে আরও জানার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, ধর্মের অঙ্গনে দুনিয়ার সার সত্য যা কিছু জানার তা তো প্রাচীনকালের মুনি ঋষি পির পয়গম্বর ঈশ্বরের দূতগণ ধ্যানে বসে গভীর আধ্যাত্মিক অন্তরবলোকন (introspection)-এর সাহায্যে জেনে গিয়েছিলেন এবং তার খানিকটা অংশ ভক্তদের জানিয়েও দিয়েছিলেন। বিভিন্ন ধর্মশাস্ত্রে তা জমা হয়ে আছে। এখন ধর্মবিশ্বাসীর কাজ শুধু তাকে আবৃত্তি করে যাওয়া, আর, ধর্মতাত্ত্বিকের কাজ তাকে বর্তমান যুগোপযোগী করে নানা ভাবে ব্যাখ্যা করতে থাকা। কিন্তু আধুনিক ব্যাখ্যাকাররা শুধু ধর্মের গণ্ডীতে নিজেদের সীমাবদ্ধ রাখছেন না। প্রাচীন মুনি ঋষিরা সবই জানতেন—এই বিশ্বাস থেকেই আমাদের দেশে একদল লোক মনে করেন, প্রাচীন ভারতীয় বেদান্ত দর্শনে আধুনিক বিজ্ঞানের সমস্ত ধারণার সন্ধান পাওয়া যাবে। মেঘনাদ সাহার বিখ্যাত গল্প “সবই ব্যাদে আছে” আজকাল সকলেই জানেন। তারপরেও এঁদের অনেকে দাবি করছেন, বিজ্ঞান যেমন খণ্ড খণ্ড সত্য থেকে অখণ্ড পূর্ণতর সত্যের দিকে এগোচ্ছে, একীভূত ক্ষেত্র, আদি ক্ষেত্র, একীভূত বলের সন্ধান করছে, অদ্বৈত বেদান্ত দর্শনের “তত্ত্বমসি” “অহম ব্রহ্মাস্মি” “অয়মাত্মা ব্রহ্ম” “সোহহং” ইত্যাদি মন্ত্রের মধ্যেও নাকি সেই অখণ্ড সত্যের ইঙ্গিত রয়েছে। কেউ কেউ আর এক ধাপ এগিয়ে গিয়ে বলছেন, আধুনিক বিজ্ঞানের সিদ্ধান্ত এতে পাওয়া না গেলেও একই quality of thought নাকি এতে ব্যক্ত হয়েছে। [গুপ্ত ১৯৯৩]

    এরকম একটি হাস্যাস্পদ দাবি উত্থাপনের পেছনে রয়েছে এক বিচিত্র মনস্তত্ত্ব। সৎ ধর্মপ্রাণ ভক্তিবাদী বুদ্ধিজীবী হিসাবে এঁরা ভাবতেই পারেন না যে সময়ের সমান্তরালে মানুষের জ্ঞানের অগ্রগতি হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। জ্ঞান বাড়ছে। আগে অজানা ছিল এমন অনেক কিছু মানুষ এখন জানতে পারছে। তাঁরা মনে করেন, আমরা এখন যা জানছি, প্রাচীন মুনি ঋষিরা তা আগে থেকেই জানতেন। জানতেন না, এটা হতেই পারে না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই ধর্মপ্রিয় ব্যক্তিবর্গও সাধারণ কথার ছলে স্বীকার করেন যে আজকালকার শিশুরা তাঁদের নিজেদের শৈশবের তুলনায় অনেক বেশি খবরাখবর রাখে। অন্তত মোবাইল এবং কম্পিউটার আসার পর আমার মতো বয়স্ক লোকেরা যে কী বিপুল পরিমাণে ছোটদের কাছে প্রতিদিন ছোট প্রমাণিত হচ্ছে তা আর বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখে না। ফলে, তখন তাঁরাও নিজেদের অজান্তেই স্বীকার করতে বাধ্য হন যে এক প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্মে জ্ঞানের বৃদ্ধি তথা বিকাশ হয়ে চলেছে।

    এই অভিজ্ঞতাকে ইতিহাসের পাতায় সম্প্রসারিত করলে তাঁরা দেখতে পেতেন—মানুষের ইতিহাসের মতোই মানুষের জ্ঞানেরও ইতিহাস আছে, বিকাশ আছে। আজ আমরা জ্ঞান বিজ্ঞানের জগতে যা জানতে পারছি তা অতীতের কোনো লোকের পক্ষেই—এমনকি তথাকথিত ত্রিকালজ্ঞ মুনিঋষিদের পক্ষেও জানা সম্ভব ছিল না। একই বিষয়ে নতুন জিনিস জানছি, নতুন নতুন বিষয়েও জ্ঞানলাভ করছি। এক বিষয়ের জ্ঞান থেকে অন্য বিষয়ের জ্ঞানের প্রসার ও গভীরতা বাড়ছে। [এই প্রশ্নে আরও বিস্তৃত আলোচনার জন্য দ্রষ্টব্য: মুখোপাধ্যায় ২০১৩, ৯০-৯৬]

    এখানে একটা মজার ব্যাপার ঘটছে, যেটা লক্ষ করা দরকার। বিভিন্ন ভারতীয় ভাষায় বিজ্ঞানের তত্ত্বগুলিকে প্রকাশ করতে গিয়ে যখন এক একটা শব্দের অনুবাদ বা পরিভাষার দরকার হচ্ছে, বহু ক্ষেত্রেই প্রাচীন সমৃদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য থেকে শব্দ চয়ন করা হচ্ছে। যথা: কণা, শক্তি, ক্ষেত্র, ভর, ভার, গতি, সরণ, বল, ত্বরণ, আকর্ষণ বল, আবর্তন, কক্ষপথ, ইত্যাদি। এই সব দেখে একদল ভাবছেন, শব্দগুলো যখন সংস্কৃত ভাষায় ছিল, তখন তাদের সহরূপ (corresponding) বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপাদানগুলিও নিশ্চয়ই সেকালের লোকেদের জানা ছিল। এটা আর তাঁরা একই সঙ্গে ভেবে দেখছেন না, জানাই যদি ছিল, তবে গেল কোথায়? যে সব পুঁথিতে শব্দগুলো আছে, সেখানে সেই জ্ঞান নেই কেন? কীভাবে হারিয়ে গেল? পুঁথি এবং শব্দগুলোকে রেখে জ্ঞান কীভাবে পালিয়ে গেল?

    আর একটা জিনিসও তাঁদের ভেবে দেখতে বলি। শব্দগুলো বাংলায় যা, পনের আনা ক্ষেত্রেই হিন্দি বা তেলুগুতে তা নয়। সকলেই ভারতে সংস্কৃত ভাষা থেকেই যার যার নিজস্ব ভাষায় পরিভাষা নির্মাণ করছেন। অথচ, শব্দগুলো এক হচ্ছে না। বাংলায় যাকে ভার বলা হচ্ছে, হিন্দিতে তাকেই বলা হয় গুরুত্ব। বাংলায় যা মহাকর্ষ, হিন্দিতে তাই গুরুত্বাকর্ষণ। বাংলায় আমরা যাকে বলেছি রাষ্ট্র, হিন্দিতে তাকে বলে রাজ্য অথবা রাজসত্তা, তেলুগুতে তারই প্রতিশব্দ হল প্রভুত্ব। অর্থাৎ, যে পুঁথি থেকে আপনি যে শব্দটা পাচ্ছেন, সেখানে সেই সংশ্লিষ্ট জ্ঞানবিন্দুগুলি নেই।

    এবার অন্য একটা দিক থেকে দেখা যাক।

    মনে করুন, আপনি প্রাচীন শাস্ত্রে একটা এমন শব্দ বা শব্দবন্ধ পেলেন, যাকে দেখে মনে হচ্ছে আধুনিক জ্ঞানেরই যেন বাচনিক প্রকাশ। বেশ। এবার আপনি চেষ্টা করে দেখুন, সেই বাচনভঙ্গি থেকে আধুনিক বিজ্ঞানের যে কোনো একটা অতি সাধারণ এবং সরল সমীকরণ বা কোনো সূত্রও বের করে আনা যায় কিনা। আমি অবশ্য আজ অবধি কাউকেই এই ধরনের চেষ্টাটা করতে দেখিনি। কিন্তু একবার করলেই তাঁরা নিজেদের দাবির অসারতা বুঝে ফেলতে পারতেন।

    আর যে কোনো দেশ কালে যে কোনো বিষয়ে quality of thought তো আর সেই বিষয়ের content of thought থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বিরাজ করে না। আবার এই দুটো জিনিসের কোনোটাই হঠাৎ করে আকাশ থেকে পড়ে না। দুটোরই ক্রমবিকাশের একটা হাত-ধরা-ধরি ইতিহাস আছে। এরকম কখনই হয় না যে একটা বিষয়বস্তু জানার আগেই তাকে জানা বোঝার জন্য প্রয়োজনীয় চিন্তার গুণগত মানটা মানুষ আয়ত্ত করে ফেলল। জ্ঞান অর্জনের পথে ধীরে ধীরে মানুষের অধীত জ্ঞানের বিষয়বস্তুর বিকাশের সাথে সাথেই তার চিন্তার গুণগত মানও উন্নত হয়ে চলেছে।

    আবার নতুন আহরিত সেই সব চিন্তা প্রকাশের ভাষাও একই সঙ্গে একই রাস্তাতে বিকশিত হয়। ব্যবহৃত শব্দটা এক হলেও তার মধ্যে নিহিত content of thought-ও এক নয়, তার দ্বারা ব্যক্ত quality of thought-ও এক রকম নয়। প্রাচীন কালের কণাদ মুনির কণার ধারণার সাথে আধুনিক যুগের মেঘনাদ সাহার কণার ধারণা কোনো দিক থেকেই মিলবে না। বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচিন্তার এই ভাবে বিকাশ হয় বলেই আর্কিমেদিসের পক্ষে নিউটনের তত্ত্ব বলে যাওয়া সম্ভব হয়নি। নিউটনের পক্ষেও আইনস্টাইনের তত্ত্ব আবিষ্কার করা সম্ভব ছিল না। ধাপে ধাপে, আগেকার অর্জিত জ্ঞানের ভিত্তিতেই, কিন্তু তাকে অতিক্রম করে সমকালীন সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই, বিজ্ঞানের পর্যায়ক্রমিক বিকাশ ঘটেছে।

    মনে রাখতে হবে, জ্ঞানের প্রশ্নে স্থাণুবৎ বলেই ধর্মীয় সাহিত্যে যে শাস্ত্র যত প্রাচীন তত পবিত্র, তত তার মর্যাদা ও আধ্যাত্মিক জ্ঞানমূল্য বেশি। প্রায় চিরস্থায়ীই বলা যেতে পারে। পক্ষান্তরে, জ্ঞানের নিরবচ্ছিন্ন বিকাশের কারণে, বিজ্ঞানের সাহিত্য যত আধুনিক, তত তার জ্ঞানমূল্য ও গুরুত্ব বেশি।

    হ্যাঁ, একথা ঠিক যে ধর্মের জগতেও সম্প্রতি একটা অগ্রগতির ব্যাপার ঘটেছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের চৌহদ্দিতে ছিল না, এরকম অনেক কিছুই সেও এখন একটু একটু করে আত্মস্থ করার চেষ্টা করছে। যেমন, ধর্মের আদিতে না থাকলেও ক্রমপ্রসারমান বিজ্ঞানচিন্তা ও আধুনিক গণতান্ত্রিক চেতনার প্রভাবে ধর্মবিশ্বাসীরাও অনেকে অবশেষে উনিশ শতকের শেষার্ধ থেকে পরমত সহিষ্ণুতার বাণী গ্রহণ করেছেন। তার ফলে বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে কিছু কিছু বাক্য বিনিময় শুরু হয়েছে। তবে ওই কথা চালাচালি পর্যন্তই হচ্ছে, মত বিনিময় শুরু হয়নি। পারস্পরিক শিক্ষা গ্রহণ চালু হয়নি।

    পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত কোনো ধর্মমত—জ্ঞানবিজ্ঞানের অন্যান্য শাখাপ্রশাখার কথা না ছেড়েই দিলাম—অন্য ধর্মমতের কাছ থেকেও কোনো ধারণা বিশ্বাস বা আচার স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে স্বীকৃতি সহ গ্রহণ করেছে বলে জানা যায়নি। হিন্দু ধর্মের অতি বড় উদার প্রবক্তাও কখনও বলতে পারেননি, “আমরা ইসলামি চিন্তার কিছু কিছু বিন্দু গ্রহন করে আমাদের ঈশ্বর কিংবা ব্রহ্মের ধারণাকে আরও উন্নত করতে পেরেছি।” একজন অত্যন্ত উদারচেতা ইসলামি উলেমাও কখনও দাবি করবেন না, “গির্জায় খ্রিস্টানদের সমবেত উপাসনা করতে দেখেই আমরাও সেই পদ্ধতি ইসলাম ধর্মে প্রবর্তন করেছি।” কিংবা, একজন খ্রিস্টান ধর্মনেতা উদারতার চরম মুহূর্তেও স্বীকার করবেন না, “মঠের ধারণা আমরা দক্ষিণ পশ্চিম এশিয়ায় বৌদ্ধদের সঙ্ঘ-বিহার দেখেই লাভ করেছিলাম।” কেন না, সমস্ত ধর্ম প্রবর্তকরাই ঈশ্বর আল্লাহ্‌ গডের কৃপায় প্রথম থেকেই ত্রিকালের জ্ঞাতব্য সবই জানতেন বলেই ধর্মবিশ্বাসীরা মনে করে। সব ধর্মই সমান, সবই এক। সুতরাং কারোরই তো অজানা বলে কিছু পড়ে নেই। কে কার থেকে কীই-বা জানবে?

    হয়ত আপত্তি উঠবে, প্রতিটি ধর্ম সম্প্রদায়েরই ধর্মীয় বিশ্বাস এবং আচার পালনে অন্য সম্প্রদায়ের কিছু না কিছু আচার বিচার প্রথা প্রকরণ সংমিশ্রিত হয়েছে। হ্যাঁ, তা হয়েছে। কিন্তু সেটা ধর্মীয় নেতাদের সক্রিয় উদ্যোগ এবং বিচার বিবেচনার মধ্য দিয়ে ঘটেনি। বরং তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই ঘটেছে। তাঁরা চাননি, সাধ্য মতো বাঁধা দিয়েছেন, তবুও ঘটেছে। পাশাপাশি বসবাসকারী সাধারণ মানুষের মধ্যে ধর্মের বিভিন্নতা সত্ত্বেও বাস্তব জীবন যাত্রার আবর্তে যৌথ জীবন সংগ্রামের বহমান ধারায় অবিরাম ভাবে যে সামাজিক সাংস্কৃতিক আদান প্রদান চলতে থাকে সেই প্রক্রিয়াতেই এটা সম্ভব হয়েছে। দুনিয়াভর মানবজাতির বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে আবহমানকাল ধরে যে সাংস্কৃতিক বিমিশ্রণ ও বিনিময় ঘটে চলেছে, এ তারই একটা সহজ স্বাভাবিক পরিণাম। একটা সময় পর্যন্ত এটাই ছিল ধর্মের সীমানার মধ্যেই ধর্মীয় বৃত্তকে অতিক্রম করে আসার প্রস্তুতি। আমাদের কালে এই অতিক্রান্তির সন্ধিক্ষণ যত এগিয়ে আসছে, এই প্রক্রিয়াকে অবরুদ্ধ করার প্রচেষ্টাও ততই বৃদ্ধি পাচ্ছে। প্রচারে না হলে দাঁত নখ বের করে।

    কেন?

    কারণ, একালে সম্মানের সাথে টিকে থাকতে হলে ধর্মকে অতীতের অসংখ্য ভুল ভ্রান্তি স্বীকার করে নিতে হবে। অথচ, ভ্রম সংশোধন ধর্ম বিশ্বাসের পক্ষে একেবারে অসম্ভব। গ্যালিলেওর বিচারে রোমান ক্যাথলিক চার্চের কর্তাদের যে ভুল হচ্ছিল, এটা বুঝতে সেকালে যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানীদের লেগেছিল খুব জোর কয়েকটা দিন। এমনকি ১৬২২ সালে তোমাসো ক্যাম্পানেলা তাঁর Apologia pro Galilaeo (গ্যালিলেওর সমর্থনে) বইতে গ্যালিলেওর প্রথম বিচার পর্বের ঠিক পরে পরেই পোপতন্ত্রকে সাবধান করে দিয়ে বলেছিলেন, “গ্যালিলেওর বিজ্ঞানচর্চায় বাধা দিয়ে ভবিষ্যতের কাছে নিজেদের হাস্যাস্পদ করে তুলবেন না।” [Cited by Bonansea 1986, 232-33]

    এই সাবধান বাণীর বিনিময়ে এবং গ্যালিলেও তথা তৎকালীন বিজ্ঞানকে সমর্থন করার অপরাধে ক্যাম্পানেলা পেয়েছিলেন খেপে খেপে দীর্ঘ সাতাশ বছরের কারাবাস যাপনের সুযোগ! এর পাশাপাশি, খ্রিস্টান ধর্মনেতাদের দিব্য দৃষ্টিতে ভুলটা ধরতে লেগে গেল পুরো ৩৬০ বছর। সত্য ধরবার কী বিরাট ক্ষমতা! তবু যা হোক, দ্বাদশ কি চতুর্দশ প্রজন্ম বাদে অন্তত পূর্বপুরুষদের ভুলটা তাঁরা বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তারপর যদি চার্চের সেই কর্তাব্যক্তিদের বলা যায়, “আপনারা এবার জ্যোতির্বিজ্ঞান ভূতত্ত্ব জীববিদ্যা ইত্যাদি বিজ্ঞানের নানা শাখায় আহরিত জ্ঞান ও তথ্যের সাথে মিলিয়ে (অর্থাৎ, সমন্বয় করে) একটা নতুন সম্পাদিত বাইবেল রচনা করুন”—তাঁরা কি কেউ রাজি হবেন? মনে তো হয় না।

    আমাদের নিজেদের ঘরের দিকেও তাকানো যাক। বিভিন্ন সময়ে হিন্দু ধর্মের এত বড় বড় দার্শনিক তথা প্রবক্তা এসেছেন। কিন্তু কাউকেই আজ পর্যন্ত বলতে শোনা যায়নি, “আমাদের শাস্ত্রের বর্ণভেদ জাতিভেদ অস্পৃশ্যতার প্রস্তাবনাগুলি এক একটা বিরাট ভুল, অন্যায় এবং অমানবিক। সর্বসমদর্শী ঈশ্বর বা একমেবাদ্বিতীয়ম ব্রহ্মতত্ত্বের সঙ্গে এগুলো খাপ খায় না! এগুলো আমাদের সংশোধন এবং বর্জন করে নিতে হবে।” ঠিক উলটো। সেদিনকার শঙ্করাচার্য থেকে শুরু করে একালের রাধাকৃষ্ণান গান্ধী প্রমুখ পর্যন্ত সমস্ত চিন্তাবিদ চেষ্টা করে গেছেন এই অমানবিক প্রথাকে সমর্থন এবং যুক্তিসিদ্ধ করে যেতে। শঙ্কর সকলের সঙ্গে এবং সব কিছুর মধ্যে ব্রহ্মের অভিন্নতা—“সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”—দেখানোর পরও ব্রাহ্মণ-শূদ্র পার্থক্য বোঝাতে শব্দের মারপ্যাঁচ খাটিয়ে প্রচুর চালাকি করে গেছেন। স্বামী বিবেকানন্দ পর্যন্ত এনাদের কুসংস্কার ও জাতপাতের “দালাল” বলে গাল দিয়েছেন। [বিবেকানন্দ ১৯৮৯খ, ১৮৬ এবং ১৮৯]

    আবার আধুনিক কালে বসে এই বিবেকানন্দ সহ গান্ধী এবং রাধাকৃষ্ণান হিন্দুদের মধ্যে প্রচলিত অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে অনেক কথা বলার পরও বোঝানোর চেষ্টা করে গেছেন, প্রাচীন ভারতের বর্ণভেদ বা জাতিভেদ প্রথাটা নাকি সেকালে খুবই যুক্তিসঙ্গত ন্যায়সঙ্গত বিজ্ঞানসম্মত ও সাম্যবাদী ব্যবস্থা ছিল। বিবেকানন্দের মতে এ ছিল আমাদের দেশের এক “আশ্চর্য কীর্তি”, এবং ঈশ্বর প্রদত্ত “শ্রেষ্ঠ সম্পদ”। এতে নাকি সমাজের সকলেরই মঙ্গল হত। [বিবেকানন্দ ১৯৮৯গ, ২১-২২ এবং ২৯৭]

    এই সবের পেছনে কারন একটাই। ধর্মের পক্ষে কোনো ভুল সংশোধন করা সম্ভব নয়। কেন না, ভুল যে হয়েছিল এটা স্বীকার করাটাই এর ধাতে নেই। এখানে ধরেই নেওয়া হয়েছে, অতীতের সাধুসন্তরা, মুনি ঋষিরা এখনকার পণ্ডিত লোকেদের চেয়ে অনেক বেশি জানতেন। এতে ধরেই নেওয়া হয়েছে, ধর্মগ্রন্থ বা শাস্ত্রে যা যা লেখা আছে সেগুলো সরাসরি ঐশ্বরিক প্রত্যাদেশ রূপে বা ধর্মগুরুদের গভীর আধ্যাত্মিক প্রজ্ঞা উপলব্ধি ও অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রাপ্ত জ্ঞান। এতে কীভাবে ভুল থাকবে? এর যে কোনো বিবৃতিতে ভুল হয়েছিল ভাবলেই গোটা ধর্মতত্ত্বের ভিত ধসে যেতে বাধ্য। তাই যাঁরা ভুল ধরছেন, তাঁরাই বরং ভুল করছেন বলা ভালো। তাঁদের কণ্ঠ রোধ করে, অথবা, তাঁদের বক্তব্যকে অসার অনিত্য সীমাবদ্ধ এবং জড়বাদ প্রসূত বলে ঘোষণা করে দিয়ে ভ্রান্ত বুনিয়াদকে আঁকড়ে ধরে রাখাই সুবিধাজনক এবং নিরাপদ। আর আসল কথা হল—“ধর্মের নিগূঢ় তত্ত্বের নিহিতার্থ আমরা কতটুকুই বা বুঝি!”

    ইতিহাসে দেখুন, যাঁরাই কোনো ধর্মকে ভুল সংশোধন করে পরিশুদ্ধ করতে গিয়েছেন, শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে পারলে তাঁদের বক্তব্যের ভিত্তিতে একটা নতুন ধর্মমতের সৃষ্টি হয়েছে। যাকে সংশোধন করতে গিয়েছেন সে কিন্তু স্বগৌরবে স্ব-ঐতিহ্যে অনড় অটল অসংশোধিত অপরিমার্জিতই থেকে গেছে। মার্টিন লুথার বা জন ক্যালভিনের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের ফলে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন প্রোটেস্টান্ট সম্প্রদায়ের সৃষ্টি হয়েছে, আদি রোমান ক্যাথলিক খ্রিস্টধর্ম তার ধ্রুপদী অবস্থান থেকে এক চুলও সরেনি। বৌদ্ধধর্ম কিংবা ইসলাম—সেখানেও একই ব্যাপার। সংস্কার করতে গিয়ে সংস্কারপন্থীরাই বরং আলাদা হয়ে গেছে, আদি বৃক্ষ বহাল তবিয়তে থেকেছে। ইসলাম ধর্মের ভেতর থেকেই সুফি মতবাদের জন্ম হয়েছে, আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়েছে। কিন্তু আদি ইসলাম ধর্মের অনুসারীরা এদের থেকে কিছুই গ্রহণ করতে রাজি নন। বরং “কাদিয়ানি” আখ্যা দিয়ে এদের খতম করতে বেশি আগ্রহী। কবির, নানক, প্রমুখ সাধকরা ইসলাম সুফিমতের প্রভাবে চেয়েছিলেন হিন্দু ধর্মকেও জাতপাত মুক্ত এক পরিশীলিত উদার রূপ দিতে। ফলে শেষ অবধি শিখ ধর্মের উৎপত্তি হয়েছে, সনাতন হিন্দু ধর্ম যেখানে ছিল, সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে।

    প্রায় আমাদের কালে এসে রাজা রামমোহন রায় একটা বড় উদ্যোগ নিয়েছিলেন খ্রিস্টীয় ও ইসলামি একেশ্বরবাদের অনুসরণে পৌত্তলিকতা ও জাতিভেদ মুক্ত অসংখ্য আচার বিচারের বেড়াজাল ভাঙা উপনিষদ ভিত্তিক আধ্যাত্মিক চর্চার মাধ্যমে এক নতুন ধর্মের আবাহন ঘটাতে; বহু দেব দেবীর বদলে একমাত্র ঈশ্বর বা ব্রহ্মের উপাসনা প্রবর্তন করতে। সেই ব্রাহ্মরাই ভারতের নবজাগরণে সাহিত্য শিল্প বিজ্ঞানের বিকাশে এবং স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশাল ভূমিকা পালন করেছেন। রবীন্দ্রনাথ জগদীশ বসু প্রফুল্ল চন্দ্রের মতো মনীষীর জন্ম দিয়ে গেছেন। হিন্দু ধর্ম তার বিশ পঞ্চাশ জন দেবতা, একশ বিরাশি খানা সম্প্রদায়, সাড়ে তিন হাজার জাত, সাতশ আটান্নটা শাস্ত্র এবং এগারশ বত্রিশ প্রকারের আচার বিচার সংস্কার নিয়ে যথাস্থানে স্থিতু হয়ে আছে। রামকৃষ্ণ আন্দোলনের “যত মত তত পথ” শঙ্খনাদ যে আসলে এই হিন্দুধর্মের শাক্ত শৈব বৈষ্ণবাদি আমিষ-নিরামিষ ভোজী বারো ঘাটের বিচিত্র অপসারী ভক্তদের এক ছাতার তলায় কোনো মতে ধরে বেঁধে রাখার প্রয়াস—তাও আজ অবধি কজন বুঝতে পেরেছেন?

    এই সব ঘটনা থেকেও বোঝা উচিৎ, কোনো ধর্মমতের নিজস্ব পরিকাঠামোর অভ্যন্তরে কোনো ভুল আবিষ্কার স্বীকার ও সংশোধন করে নিজেকে এতটুকু পরিবর্তিত করা বাস্তবেই সম্ভব নয়। আর ঠিক এই কারণেই একজন সৎ ও নিষ্ঠাবান ধর্মবিশ্বাসীর পক্ষে সেই বিশ্বাসের আওতায় থেকে কেবলমাত্র প্রাচীন কালের অচল ধ্যান ধারণা বিশ্বাস আচার বিচারের রোমন্থন করে যাওয়াই সম্ভব; কিন্তু—তার বাইরে বেরিয়ে আসতে না পারলে—তিনি নতুন করে আর এক কণাও জ্ঞানামৃত মন্থন করতে পারবেন না।

    [চলবে]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ০৭ এপ্রিল ২০১৯ | ৩৩০৬ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন