এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ব্লগ

  • বিজ্ঞানের অ(নেক?)-ক্ষমতা # পর্ব-২

    Ashoke Mukhopadhyay লেখকের গ্রাহক হোন
    ব্লগ | ২৯ মার্চ ২০১৯ | ২২৭৭ বার পঠিত
  • [২] তুমি আর আমি . . .

    তাহলে, যুক্তিতর্ক এবং ইতিহাসের সাক্ষ্য, দুদিক থেকেই বোঝা গেল—কোনটা শেষ হলে কোনটা শুরু হয়। সুতরাং ধর্ম ঈশ্বর আত্মা ইত্যাদিকে আর বিজ্ঞানের উপরে চাপিয়ে দেওয়া যাবে না। থাকতে হলে পেছনেই অপেক্ষা করতে হবে। যে সমস্ত দূরদর্শী ধর্ম দার্শনিক এটা বুঝে ফেলেছেন, তাঁরা এর পর থেকে একটা নতুন বাণী শোনাতে লাগলেন: বিজ্ঞান আর ধর্মের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। বিজ্ঞান মানুষের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ইহজাগতিক বাস্তব জগতের শরীরের চাহিদা মেটায়; সুখ শান্তি এনে দেয়। জীবনকে উপভোগ্য করে তোলে। আর ধর্ম মানুষের মনের খিদে মেটায়, অমরত্বের আকাঙ্ক্ষা ও নৈতিক দাবিসমূহ পূরণ করে। কেউ কেউ বললেন, ধর্মশাস্ত্রে এতদিন যে সব শাশ্বত নিত্য সত্যের কথা বলা হয়েছিল, বিজ্ঞান এখন তার খণ্ড খণ্ড জ্ঞানের পথ ধরে সেই দিকেই এগোচ্ছে। জ্ঞানের নিম্নতর দশায় ধর্ম ও বিজ্ঞান আলাদা, পরস্পর বিরোধী; উন্নততর সোপানে উভয়েই এক কথা বলে। শুধু ভাষার অন্তর্নিহিত বাণী বুঝতে শিখতে হবে। বিজ্ঞান থেকেই এখন ঈশ্বর বা আত্মার ধারণায় পৌঁছনো সম্ভব।

    সম্প্রতি একদল নামকরা বিজ্ঞানী ও বিজ্ঞান লেখক এই সব কথা বলার জন্য উঠে পড়ে লেগেছেন। সাম্প্রতিক অতীতে এই প্রবণতার জন্ম হয়েছিল পদার্থবিদ ফ্রিৎজফ কাপ্রা রচিত Tao of Physics (১৯৭৫) নামক একখানি বই দিয়ে। সেখানে তিনি প্রাচীন ভারতীয় চিনা জাপানি আধ্যাত্মিক মরমিয়াবাদের সঙ্গে আধুনিক বিজ্ঞানের আবিষ্কারগুলির নাকি দারুণ মিল দেখতে পান এবং দাবি করেন: “Eastern thought, more generally mystical thought, provide a consistent and relevant philosophical background to the theories of contemporary science; a conception of the world in which man’s scientific discoveries can be in perfect harmony with his spiritual aims and religious beliefs.” [Capra 1978, 24]
    তারপর থেকে এই ধরনের বইয়ের বেশ দ্রুত বংশবিস্তার হতে লাগল। গ্যারি জুকাভ লিখলেন The Dancing Wu Li Masters [Zukav 1979]; অ্যামরি দ্য রিনকোর্ট লিখলেন The Eye of Shiva [Riencourt 1980]; পল ডেভিস সোজা ঢুকে পড়লেন ভগবানের কাজ কারবার এবং মনের গহনে তাঁর God and the New Physics [Davies 1984] The Mind of God [Davies 1984; 1992] শীর্ষক দুটো বইতে; মাইকেল ট্যালবট তাঁর Mysticism and the New Physics বইতে মেতে উঠলেন পদার্থবিজ্ঞানের রহস্যবাদী ব্যাখ্যায় [Talbot 1993]; ফ্র্যাঙ্ক টিপলার আবার Physics and Immortality বইটিতে দেখালেন মানুষের আত্মার অমরত্ব আর পুনর্জন্ম পদার্থবিজ্ঞান দিয়েই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় [Tiplar 1995]; ইত্যাদি। তা এই অবস্থায় ভারতই বা পিছিয়ে থাকবে কেন? রামকৃষ্ণ কুলের স্বামী জিতাত্মানন্দ লিখে ফেললেন দুখানা গুরুগম্ভীর বই Modern Physics and Vedanta [Jitatmananda 1986], আর Holistic Science and Vedanta [Jitatmananda 1991]; নৃসিংহ চরণ পাণ্ডা বসলেন Maya in Physics [Panda 1991] দর্শন করাতে; মণি ভৌমিক তাঁর Code Name God বইতে দাবি করলেন, বিজ্ঞানের যাবতীয় সমস্যার সমাধানের চাবিকাঠি হচ্ছে—হে ঈশ্বর, হে ভগবান, প্রার্থনাদ [Bhaumik 2006]; এমনি ধারা আরও অনেকে। এই জাতীয় সব গ্রন্থেই ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দাবি করা হচ্ছে যে বিজ্ঞান তথা আধুনিক পদার্থবিজ্ঞান থেকেই নাকি ভগবানের ক্রিয়াকলাপ এবং ধর্মশাস্ত্রের যাবতীয় অলৌকিক বিবরণের নানা রকম প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে।

    বুঝুন ঠেলা!

    কেন না, প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রের “আবিষ্কার”গুলির “পুনরাবিষ্কার”-এর কৃতিত্ব বিজ্ঞানকে দেওয়া হচ্ছে এমন একটা সময়ে যখন বিজ্ঞান নিজেই তিনশ বছর আগেকার বেকনীয় “সব জানেগা, সব করেগা” ভাবখানা ঝেড়ে ফেলে নিজের ক্ষমতার সীমানা দেখে ফেলেছে। গত দেড়শ বছরে বিজ্ঞানে এসেছে এক নতুন সোক্রাতীয় অভিজ্ঞতা—কী কী জানা যাবে না, কী কী করা যাবে না, বিজ্ঞান তাও বুঝতে শুরু করেছে। এই সময়ে বিজ্ঞান, বলা যায়, শুধু তার ক্ষমতা নয়, অক্ষমতার ব্যাপারেও বোধ হয় ভালো রকম ওয়াকিবহাল হয়ে উঠেছে।

    কিছু নমুনা দিলে বুঝতে সুবিধা হবে।

    রবার্ট বয়েল এবং জ্যাক্‌স চার্ল্‌স (১৭৪৬-১৮২৩)-এর সূত্র ধরে গ্যাসের ভৌত-রাসায়নিক ধর্ম অনুধাবন করতে গিয়ে বিজ্ঞানীরা সন্ধান পেয়েছেন সেই তাপমাত্রার (—২৭৩ সেলসিয়াস), যার নীচে পৃথিবীর কোনো জিনিসকেই ঠান্ডা করা যাবে না। তাপগতিবিদ্যার গবেষণায় তাঁরা জানতে পেরেছেন, যে কোনো যন্ত্রকে—তা যতই নিখুঁত হোক না কেন—একটা বিশেষ কাজ করার জন্য যতটা শক্তি প্রদান করা হবে, সেটি কখনই সেই শক্তির পুরোটা কাজে লাগাতে পারবে না; অন্য দিকে কিছু না কিছু শক্তি ব্যয় হয়ে যাবে। গত শতাব্দের শুরুতেই (১৯০০) মাক্স প্লাঙ্ক (১৮৫৮-১৯৪৭) দেখিয়েছিলেন, যে কোনো প্রকারের শক্তির বিকিরণ বা শোষণ এক অতিক্ষুদ্র কিন্তু নির্দিষ্ট এককের হিসাবে ধাপে ধাপে ঘটে, তার চেয়ে কম মাত্রায় বা নিরবচ্ছিন্নভাবে ঘটতে পারে না। তার কিছুদিনের মধ্যেই আলবার্ট আইনস্টাইন (১৮৭৯-১৯৫৫) আবিষ্কার করলেন, শূন্য মাধ্যমে কোনো ভৌত বস্তুর গতিবেগ কখনই আলোকের বেগের সমান (সেকেন্ডে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার) বা তার বেশি হতে পারে না। তারপর ১৯২০-এর দশকের শেষে হ্বারনার হাইজেনবার্গ (১৯০১-৭৬)-এর এক ছোট্ট অসমীকরণ থেকে জানা গেল, অণু-পরমাণু কিংবা ইলেকট্রন জাতীয় আরও সূক্ষ্মকণাদের আচরণে এমন এক অশৃঙ্খল অস্থিরতা নিহিত রয়েছে যে তাদের বর্তমান অবস্থা দেখে পরবর্তী অবস্থার একেবারে সঠিক পূর্বানুমান করা কখনই যাবে না। সব সময়েই তাতে কিছু অনিশ্চয়তা থাকবে এবং অঙ্কের নিয়মেই তাকে একটা ন্যূনতম হিসাবের থেকে কমানো যাবে না। প্রায় তার গায়ে গায়ে কুর্ট গ্যোডেল (১৯০৬-৭৮) একটা গাণিতিক উপপাদ্য প্রমাণ করে দেখালেন, কোনো একটা যুক্তিকাঠামোয় কতকগুলি প্রদত্ত বা স্বীকৃত স্বতঃসিদ্ধ থেকে গাণিতিক যুক্তির নিয়মে প্রাপ্ত সিদ্ধান্ত সমূহকে সেই কাঠামোর সীমানার মধ্যে থেকে প্রমাণ বা অপ্রমাণ, কিছুই করা যায় না!

    এগুলো হল কয়েকটি মৌলিক তত্ত্বগত ক্ষেত্রে জ্ঞানের সীমা। বাস্তব জীবনে বিজ্ঞানের জ্ঞান প্রয়োগ করার ক্ষেত্রেও এরকম বেশ কিছু অসাধ্যতা চোখে পড়েছে। বাস্তুবিদ্যার আলোকে এটা স্পষ্ট যে জীবন ধ্বংসকারী অপ্রত্যাবর্ত্য নিরন্তর দূষণ না ঘটিয়ে পৃথিবীতে ক্রমাগত কল-কারখানার বিকাশ ঘটানো সম্ভব হবে না। রসায়নশাস্ত্র থেকে জানা গেছে—মনুষ্য জীবন ধারণের সুবিধার্থে প্লাস্টিক জাতীয় পলিমার ও কীটনাশক হিসাবে যে সমস্ত জৈব-অপচ্য (non-biodegradable) দ্রব্য ও আধুনিক (কম্পিউটার-মোবাইল ইত্যাকার) যন্ত্রপাতির বর্জ্য-দ্রব্য ব্যবহার করে পৃথিবীর বুকে নিয়মিত ফেলা হচ্ছে, তা-ও শেষ পর্যন্ত সেই জীবন রক্ষার পক্ষেই মারাত্মক সর্বনাশ হিসাবে দেখা দেবে। এও জানা গেছে, পৃথিবীর অভ্যন্তরে তেল জল ধাতুর মতো কোনো প্রাকৃতিক সম্পদই অফুরন্ত বা অনিঃশেষ্য নয়। বর্তমান উপভোগ-হার বজায় থাকলে অচিরেই সেই সবই ব্যবহার্য সীমার নীচে চলে যাবে। অ্যালুমিনিয়াম তো প্রায় ফুরিয়ে এল বলে (ছত্তিসগড় উপপাদ্য দ্রষ্টব্য)! পৃথিবীতে জনসংখ্যা এবং মানুষের মাথাপিছু ভোগের হার যত বাড়ছে, প্রাকৃতিক সম্পদের পরিমাণ তাদের গুণফলের ব্যস্তানুপাতে তত কমে যাচ্ছে। বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রয়োজনে পরমাণু শক্তির তেজস্ক্রিয় দূষণ মুক্ত ব্যবহার যে সম্ভব নয়—সেটাও ইতিমধ্যে পরিষ্কার হয়ে গেছে। বাঁধ দিয়ে জলস্রোত নিয়ন্ত্রণ ও নদীশাসন যে মানুষের ইচ্ছা ও প্রয়োজন মতো করা অসম্ভব, প্রভূত মূল্য দিয়ে তা আমাদের শিখতে হচ্ছে। বিশ্ব উষ্ণায়ন দেখিয়ে দিয়েছে যে প্রাকৃতিক ব্যবস্থার উপর মানুষের যথেচ্ছ হস্তক্ষেপ কখনই একতরফা সুবিধা উৎপাদন করে যাবে না। আজ যা পাওয়া যাবে, আগামী প্রজন্মের জন্য তার তুলনায় অনেক বড় ক্ষতির ক্ষতচিহ্ন রেখে যেতে হবে। জানা গেছে এমন আরও অনেক কিছুই না পারার কথা।

    বিজ্ঞানের এতগুলি অক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা জানার পর সেই বিজ্ঞানের থেকে ধর্ম ঈশ্বর অধ্যাত্মবাদ অতীন্দ্রিয়বাদের সমর্থন খুঁজতে চাইলে যে সেই সব ধারণার অর্থ আদি আরোপিত তাৎপর্যের তুলনায় সঙ্কুচিত হয়ে পড়বে, এটা বোধ হয় সেই সমন্বয়বাদীরা গুছিয়ে ভেবে দেখেননি।

    আসুন, আমরাই ওঁদের দেখানোর চেষ্টা করি।

    ধরা যাক, পদার্থবিজ্ঞানের সূত্র ধরেই ঈশ্বর ধারণায় পৌঁছনো যাচ্ছে। সেই ঈশ্বর কেমন হবেন? তিনি যদি বৈজ্ঞানিক নিয়ম অনুযায়ী চলেন তাহলে ধর্মীয় ধ্যান ধারণার সাথে বিজ্ঞানের কোনো বিরোধ হচ্ছে না ঠিকই। কিন্তু, সেই সঙ্গেই সমস্যা হচ্ছে, সেই ইশ্বর তখন আর সর্বশক্তিমান থাকতে পারবেন না। কারণ, তাঁর পক্ষেও তো তাপগতিবিদ্যার দ্বিতীয় সূত্র লঙ্ঘন করা সম্ভব নয় তখন। ফলে তাঁকে জগতস্রষ্টা হিসাবে আর মেনে নেওয়া যাবে না। আসলে যা নেই, শূন্য, যা অসৎ (চরম নাস্তিত্ব), তা থেকে তিনিই বা কোনো সদ্‌বস্তু সৃষ্টি করবেন কীভাবে? বিজ্ঞানের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশি থেকে কমের দিকে তিনি যেতে পারেন, কম থেকে বেশির দিকে যাবেন কী করে? আর, তা না পারলে, নেই-অবস্থা থেকে এই-বিশ্ব সৃষ্টিই বা হবে কীভাবে?

    বাইবেলও তখন নতুন করে লিখতে হবে। কেন না, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, ভূবিদ্যা, জীববিদ্যা, ইত্যাদির সমস্ত নিয়মকানুন মেনে স্বয়ং ঈশ্বরের পক্ষেও মাত্র ছয় দিনে বস্তুজগত এবং জীবজগত সৃষ্টি করা সম্ভব হতে পারত না। এই কাজে তাঁর বেশ কয়েক কোটি বছর লাগার কথা। মণি ভৌমিক অবশ্য মাথা খাটিয়ে এর একটা আপাত সমাধান বের করেছেন: “God can make a day as long as he wants” [Bhaumik 2006, 188-89]—অর্থাৎ, বাইবেল মানুষের পার্থিব ভাষায় যেটাকে “একদিন” বলেছেন, তাকে বুঝতে হবে কোটি বছর হিসাবে। তাতেও বহুবিধ মুশকিল আছে। বাইবেলের ভগবান একদিন গাছপালা বানিয়েছেন, আর একদিন তৈরি করেছেন পশুপাখি। বিজ্ঞানে আবার তা নয়, গাছপালা আর পশুপাখি পাশাপাশি একই সময়ে তৈরি হয়ে বিবর্তিত হয়ে চলেছে। তারপর, জীবজগত সৃষ্টি করতে গিয়ে তিনি যত ভালো ভালো জীব তৈরি করেছিলেন, তার চাইতে অনেক বেশি উদ্ভিদ ও প্রাণী ধ্বংস করে ফেলেছেন। এই কাজে তাঁর দক্ষতা নিয়েই তাই প্রশ্ন দেখা দেবে।

    আর নয়ত কবি কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬)-এর ভাষায় বলতে হবে,
    “খেলিছ এ বিশ্ব লয়ে, বিরাট শিশু আন মনে,
    প্রলয় সৃষ্টি তব পুতুল খেলা, নিরজনে প্রভু নিরজনে।” ইত্যাদি।

    সে আর তবে বিজ্ঞান থাকবে না!

    সেই ঈশ্বরকে তখন আর সর্বজ্ঞও বলা চলবে না। তিনি যদি বিজ্ঞান অনুযায়ী চলতে চান, তাহলে হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তা নীতি অগ্রাহ্য করে তাঁর পক্ষেও একটা একক ইলেকট্রনের গতি সম্পর্কে পূর্বাভাষ করা বা এক খণ্ড রেডিয়ামের মধ্য থেকে ঠিক কোন পরমাণু এই মুহূর্তে তেজষ্ক্রিয়ায় ভেঙে যাবে বলে দেওয়া সম্ভব না। আপেক্ষিকতার সূত্র লঙ্ঘন করে তিনিও মহাবিশ্বের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় মুহূর্তে তথ্য সঞ্চারিত করতে পারবেন না। বেলের উপপাদ্যও তিনি অমান্য করে কিছু করতে পারবেন না। ফলে দুটি যুগ্ম কণার ক্ষেত্রে একটির উপর হস্তক্ষেপ করে অপরটিকে অপরিবর্তিত রাখা তাঁর পক্ষে অসম্ভব—সে তারা যে দূরত্বেই থাকুক না কেন।

    এইভাবে দেখা যাচ্ছে, বিজ্ঞানের সঙ্গে মানিয়ে চলতে হলে, ধর্মবিশ্বাসীরা এতদিন ভগবান সম্পর্কে প্রামাণ্য শাস্ত্রগুলিতে যা বুঝে এবং বুঝিয়ে এসেছেন, ভগবান তার ধারেকাছেও যেতে পারবেন না। অপর দিকে ঈশ্বর যদি সর্বশক্তিমান হন, তিনি যদি অল্প পরিমাণ শক্তি খরচ করে বেশি পরিমাণ কাজ উদ্ধার করতে পারেন, তাহলে তাঁর সেই ক্ষমতার সঙ্গে বিজ্ঞানের জ্ঞানের বিরোধ দেখা দেবেই। তিনি সর্বজ্ঞ হলেও একই সমস্যা। আসল কথা হল, বিজ্ঞানের নিয়মকানুন মেনে চলতে হলে ঈশ্বর আর ঈশ্বর থাকেন না। উল্টোদিকে, ঈশ্বরের উপর এতকাল ধরে চাপানো মহিমা বজায় রাখতে হলে, পদার্থবিজ্ঞান বা রসায়নকে পত্রপাঠ বিদায় জানাতে হবে।

    [৩] সূক্ষ্ম শরীর!

    আত্মা সংক্রান্ত বিশ্বাস সম্পর্কেও একই কথা। বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে ধর্মশাস্ত্রের আত্মার ধারণাকে রক্ষা করাও খুব দুষ্কর। প্রায় অসম্ভবই বলা চলে।

    ধর্মতত্ত্বে আত্মার যে পরিচয় দেওয়া হয়েছে, সেটা গীতায় স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণ কথিত বিবরণ থেকে দেখে নেওয়া যাক:

    “ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
    অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরানো ন হন্যমানে শরীরে।।
    . . .
    নৈনং ছিন্দন্তি শস্ত্রাণি নৈনং দহতি পাবকঃ।
    ন চৈনং ক্লেদয়ন্ত্যাপো ন শোষয়তি মারুতঃ।।” [গীতা—২/২০ এবং ২/২৩]

    অনুবাদ করলে এর মানে দাঁড়ায়, আত্মার জন্ম মৃত্যু নেই লয় নেই ক্ষয় নেই; আত্মা চিরবিরাজমান শাশ্বত। শরীরের মৃত্যু হলেও আত্মার মৃত্যু হয় না, . . ., কোনো অস্ত্র দিয়ে একে কাটা যায় না, আগুনে একে পোড়ানো যায় না, জলে এর কোনো বিকৃতি হয় না, হাওয়া একে শুষে নিতে পারে না, ইত্যাদি।

    প্রসঙ্গত বলে রাখি, আত্মার এই ধারণাটা গীতাতেই প্রথম পাওয়া গেল বা ভারতেই প্রথম উৎপন্ন হয়েছে—এমন নয়। সমাজতত্ত্ববিদ ও নৃতত্ত্ববিদরা অবিকশিত বা প্রাচীন নৃজাতি-সংস্কৃতির উপর অধ্যয়ন করতে গিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তেই এই রকম একটি সমতুল ধারণা প্রায় সর্বজনীনভাবে দেখতে পেয়েছেন। [Clodd 1905, 35-42]

    তবে প্রাচীন কাল থেকে শুরু করে অষ্টাদশ শতাব্দ পর্যন্ত বিজ্ঞানের কোনো ধারণার সাথে এর কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। যখন পদার্থবিজ্ঞানে আলোর তরঙ্গ গতি ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তরঙ্গ উৎপাদনের বাস্তব মাধ্যম হিসাবে ইথার-ধারণা প্রস্তাবিত হল এবং তার উপর নানা রকম অসম্ভব বৈশিষ্ট্য আরোপিত হল (অদৃশ্য, অস্পৃশ্য, বাধাহীন, নিখুঁত স্থিতিস্থাপক, সর্বত্র প্রসারিত, ইত্যাদি), তখন জনৈক ব্রিটিশ যাজকের মতো অনেকেই বলতে লাগলেন, এই পেয়েছি, “Ether is the basis of the soul”! [Cited by Clodd 1905, 39]

    কিন্তু মুশকিল হল, ১৮৬০-এর দশকে জেম্‌স ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল (১৮৩১-৭৯) যেই আলোকের তড়িচ্চুম্বকীয় তরঙ্গ গতির রহস্য উদ্ঘাটন করে গাণিতিক সমীকরণ লিখে ফেললেন—দেখালেন, শূন্য মাধ্যমেও এই গতি অব্যাহত থাকে, এতে ইথার ধারণায় সংশয় দেখা দিল। তারপর ১৮৮০-র দশকে অ্যালবার্ট মাইকেলসন (১৮৫২-১৯৩১) ও এডওয়ার্ড মর্লি (১৮৩৮-১৯২৩)-র বিভিন্ন পরীক্ষায় ইথারের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন উঠে গেল। আর বিশ শতকের গোড়াতেই আইনস্টাইনের দেশ-কাল তত্ত্বে ইথার সরাসরি বাতিল হয়ে গেল। এই মুহূর্তে এমন কোনো বৈজ্ঞানিক ধারণা বা সংজ্ঞা নেই যার সাথে আত্মার ধারণার সমন্বয় ঘটানো যায়, কিংবা যার সাহায্যে আত্মা-টাত্মা আছে বলে এক-আধটু আন্দাজ পাওয়া যায়!

    সমস্যা আরও গভীরে। আগেকার কথা যদি বাদও দিই, ম্যাক্সওয়েলের সময়ে পৃথিবীর লোকসংখ্যা ছিল ১০০ কোটি। এখন বিশ্বে লোকসংখ্যা ৭০০ কোটির উপরে। প্রশ্ন হচ্ছে, জীবাত্মার মোট পরিমাণ কি এই দেড়শ বছরে বেড়েছে, না, একই আছে? যদি গীতায় প্রদত্ত বর্ণনা অনুসারে জীবাত্মার মোট পরিমাণ একই থেকে গিয়ে থাকে, তাতে তাপগতিবিদ্যার প্রথম (শক্তির সংরক্ষণ বিষয়ক) সূত্র রক্ষিত হয় ঠিকই; কিন্তু ব্যক্তির মাথা পিছু আত্মার পরিমাণ কমে যাচ্ছে।

    স্বামী বিবেকানন্দের বন্ধু সতীর্থ ও সহকর্মী এবং রামকৃষ্ণ মিশনের অন্যতম সংগঠক ও প্রচারক, স্বামী অভেদানন্দ (১৮৬৬-১৯৩৯) তাঁর একটি বিখ্যাত বই—“মরণের পারে”—তে দাবি করেছিলেন, মানুষের আত্মার ওজন নাকি ১/২ বা ৩/৪ আউন্সের মতো। [অভেদানন্দ ১৯৮৬, ১৬৯] হিসাবের সুবিধার জন্য আপাতত শুধু দ্বিতীয়টাই, অর্থাৎ, বড় সংখ্যাটাই, নেওয়া যাক। তাহলে একশ বছর আগে পৃথিবীতে মানবাত্মার মোট পরিমাণ ছিল ৭৫ কোটি আউন্স। ভগবদ্গীতার মতে যেহেতু এই আত্মার পরিমাণ ইতিমধ্যে বেড়ে যেতে পারেনি, সুতরাং এখন পৃথিবীর সাতশ কোটি মানুষের মধ্যে তা ভাগ হয়ে এক একজনের পাতে পড়ছে প্রায় ০.১১ আউন্স করে আত্মা। সেক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্ন হচ্ছে, বাড়তি মানুষদের মধ্যে অবিভাজ্য আত্মার এই ভাগাভাগিটা হচ্ছে কীভাবে? কে করে দিচ্ছে? তাছাড়া, দ্বিতীয়ত, অধ্যাত্মবাদী মতে আত্মার যা কিছু লক্ষণ, অর্থাৎ, প্রতিটি মানুষের জীবনীশক্তি, আয়ুষ্কাল, বুদ্ধি, চেতনা, ইচ্ছাশক্তি, চিন্তাশক্তি, স্মৃতিশক্তি, অধ্যবসায়, কর্মকুশলতা, ইত্যাদি, তাহলে তো কমে যাওয়ার কথা! সত্যিই তা কমছে কি? তৃতীয়ত, আত্মার জন্মান্তর তত্ত্ব মেনে নিলে একজনের পূর্বজন্মের কর্মফলই বা আবার নতুন বাড়তি লোকেদের ভগ্নাংশ আত্মার মধ্যে বণ্টিত কীভাবে হবে? একজনের পাপের দায় দু পাঁচজনকে খেপে খেপে ভোগ করতে হবে? নাকি, চতুর্থত, অভেদানন্দের বইটি রচনার পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া বাড়তি মানুষগুলোর কোনো আত্মা নেই?

    আর তা না হলে, এই সব কূট প্রশ্নের সামনে পড়ে বলতে হয়, এই সময়ে পৃথিবীতে লোকসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মোট আত্মার পরিমাণও বেড়ে গেছে। ৫২৫ কোটি আউন্স ছাড়িয়ে গেছে। তাতে মাথা পিছু আত্মার পরিমাণ মিলে যায় বটে, কিন্তু গীতা কথিত আত্মার সংরক্ষণ সূত্রের সঙ্গে তার বিরোধ হয়ে যায়। ফলে বিজ্ঞানের ভর ও শক্তির নিত্যতা সূত্রের সঙ্গেও তার আর মিল হয় না। আর একবার বাড়া কমা বা জন্ম মৃত্যু স্বীকার করে নিলে আরও অনেক সমস্যার দুর্ভোগ পোহাতে হবে। বিজ্ঞানের এই এক বেয়াড়া স্বভাব!
    তখন বিরক্ত হয়ে একজন আধ্যাত্মিক আত্মা-ধারণায় বিশ্বাসী বলতেই পারেন: “রাখ তো তোমার বিজ্ঞান! আত্মা হল গিয়ে আত্মা। সে কি আর তোমাদের ইট কাঠ পাথরের মতো অনিত্য জিনিস যে সে বিজ্ঞানের এই অর্বাচীন অশাস্ত্রীয় দুদিনের নিয়ম সকল মানতে যাবে? এর চরিত্রও আলাদা, এর নিয়ম-টিয়মও আলাদা।” এরকম ভাবে বললে বিজ্ঞান তা সানন্দে স্বীকার করে নেবে, কোনো আপত্তিই তুলবে না। শুধু আর দু একটা বাক্য এর সাথে যোগ করে দেবে: “তথাস্তু আর্য! অনুগ্রহ করে আপনাদের আত্মার এই গুরুগম্ভীর বৈশিষ্ট্যের দায়ভার বিজ্ঞানের দুর্বল ঘাড়ে চাপাতে যাবেন না। বিজ্ঞানের নিয়মগুলো বড়ই সংকীর্ণ। এর অঙ্কের হিসাব নিকাশও খুবই সোজাসাপটা। এর সাথে আপনাদের বড় বড় ধারণাগুলির সমন্বয় ঘটাতে গেলে গণ্ডগোল তো হবেই!”
    [চলবে]
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ব্লগ | ২৯ মার্চ ২০১৯ | ২২৭৭ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • dd | ***:*** | ৩১ মার্চ ২০১৯ ০৩:০৩49439
  • এতো বিশাল বিষয়কে খুবই সোজা সাপটা ভাষায় লিখছেন। সব বিষয়ে এক মত তো নই, কিন্তু ভালো লাগলো পড়তে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ক্যাবাত বা দুচ্ছাই প্রতিক্রিয়া দিন