এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  ধারাবাহিক  ইতিহাস

  • ধর্মাধর্ম - দ্বিতীয় পর্ব -  ষষ্ঠ ও  অন্তিম ভাগ  

    Kishore Ghosal লেখকের গ্রাহক হোন
    ধারাবাহিক | ইতিহাস | ২৭ মে ২০২২ | ৩০৬৫ বার পঠিত | রেটিং ৩ (১ জন)
  • দ্বিতীয় পর্ব - ১২,০০০ থেকে ৬০০ বি.সি.ই –ষষ্ঠ ও অন্তিম ভাগ
     
    ২.৬.১ জনপদ ও মহাজনপদ

    মোটামুটি ৬০০ বি.সি.ইতে উত্তর-পশ্চিম এবং প্রায় সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে বেশ কিছু রাজ্য গড়ে ওঠার মতো পরিস্থিতি সৃষ্টি হল। রাজ্য এবং রাজ্য-ব্যবস্থা বলতে ঠিক কী বোঝায় সেটা একবার দেখে নেওয়া যাক।

    যথেষ্ট বড়োসড়ো নির্দিষ্ট একটা এলাকা নিয়ে রাজ্য গড়ে উঠতে পারে। সেখানে প্রয়োজনমত জনবসতি থাকতে হবে। সেখানকার মানুষ যথেষ্ট উদ্বৃত্ত সম্পদ উৎপাদন করবে। শুধু মাত্র কৃষি সম্পদ নয়, আরও অনেক কিছু। খনিজ সম্পদ, ধাতু, কিংবা মূল্যবান পাথর, অরণ্য সম্পদ, কাঠ, পশুসম্পদ  ইত্যাদি। এক কথায় সম্পদ হল সব কিছু, যা থেকে রাজ্যবাসীদের জীবনধারণ হয়ে যাবে এবং উদ্বৃত্ত সম্পদের পরিবর্তে বাণিজ্য করে অন্য রাজ্য থেকে অন্যান্য সম্পদও আমদানি করা যাবে। এর সঙ্গে শিল্প-সম্পদও যুক্ত হবে, যেমন ধাতব যন্ত্রপাতি, অস্ত্র–শস্ত্র, বাসন-কোসন, কাঠের আসবাবপত্র, মাটির তৈজসপত্র, খেলনা, মূর্তি। অতএব একটি রাজ্যে সর্বস্তরের যথেষ্ট সংখ্যক দক্ষ ও কুশল কর্মী থাকা আবশ্যিক।

    কিন্তু এই সব কিছু থাকা সত্ত্বেও একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল রাজ্য হয়ে উঠতে পারবে না, যতক্ষণ না তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে দক্ষ প্রশাসন। একজন কৃষক অকারণ খেটে কেন উদ্বৃত্ত শস্য ফলাবে, যদি সেই উদ্বৃত্ত থেকে তার বাড়তি কোন স্বার্থ পূরণ না হয়? প্রশাসনের কাজ উদ্বৃত্ত সম্পদ সংগ্রহ করাই নয়, আরও বেশি উদ্বৃত্ত সম্পদ উৎপাদনে উৎসাহ দেওয়া। সাধারণ মানুষ এবং কর্মীরা যাতে নিরাপদে এবং নিশ্চিন্তে তাদের কাজে মনোনিবেশ করতে পারে, সেদিকে লক্ষ্য রাখা। বাইরের আক্রমণ, লুঠ-তরাজ থেকে তাদের রক্ষা করা। প্রশাসনের আরও কাজ রাজ্যের সম্পন্ন বণিকদের রাজ্যের ভিতরে এবং অন্য রাজ্যের সঙ্গেও বাণিজ্যে উৎসাহ দেওয়া।

    এই সবের সঙ্গে সমান্তরাল জরুরি শুল্ক বা কর আদায়। প্রশাসনিক কাজকর্মের যে ব্যয়ভার – রাজ্য সুরক্ষার জন্যে সেনাবাহিনী, অজস্র স্তরের আধিকারিক ও কর্মচারী, করণিকের বেতন, রাজ্যের পরিকাঠামো উন্নয়নের ব্যয় - রাস্তাঘাট, সেচ ব্যবস্থা। এই সমস্ত ব্যয়ভার বহন করার পরেও, প্রশাসন এবং প্রশাসনিক প্রধানের হাতে পর্যাপ্ত সম্পদ গচ্ছিত থাকা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের বন্যা, খরা, মহামারি কিংবা কোন বিপর্যয় বা জরুরি অবস্থার জন্যে। এর পরেও যে উদ্বৃত্ত সম্পদ, সেই সম্পদও জরুরি - প্রশাসনিক প্রধান বা রাজা এবং তার পরিবারের রাজকীয় আবাস, জাঁকজমক, অলংকার-ভূষণ, বিলাস-ব্যসন, উৎসব, অনুষ্ঠান, যজ্ঞের জন্যে।

    সম্পূর্ণ এই ব্যবস্থা এবং তার নিবিড় অন্তর্জাল থেকেই গড়ে ওঠে রাজ্য। অতএব আর্যরা ভারতে আসার প্রায় হাজার বছর পরে, রাজ্য গড়ে তোলার মতো পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছিল।

    প্রথমদিকে এই রাজ্যগুলিকে “রাজ্য” নামে চিহ্নিত করা যায়নি। রাজা এবং রাজ্যের ধারণা আর্যদের মাথায় তখনও হয়তো দানা বেঁধে ওঠেনি। তারা এই ধরনের অঞ্চলগুলিকে বলত, মহাজনপদ। এর আগে অনার্য সমাজের অজস্র জনপদ তারা দেখেছে। তাদের মধ্যে অনেকগুলিই ছিল অত্যন্ত সম্পন্ন, যাদের প্রভাব-প্রতিপত্তি খণ্ডন করতে আর্য ক্ষত্রিয়দের কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি! সেই ছোট বড়ো জনপদগুলির সরল রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাও তারা দেখেছে। সেখানে একজন প্রধান এবং তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন বয়স্ক প্রতিনিধিই জনপদের প্রশাসন পরিচালন করত। কিন্তু এখন তারা যে মহাজনপদ গড়ে তুলল, তার প্রশাসন অনেক ব্যাপ্ত, জটিল এবং সামাজিক পরিস্থিতিও সম্পূর্ণ ভিন্ন – সংখ্যাগুরু বিজিত এবং সংখ্যালঘু বিজয়ীদের সমাজ।



    যে কটি মহাজনপদের নাম জানা যায়, তাদের মধ্যে অঙ্গ, মগধ, বৃজি এবং মল্ল মধ্য গাঙ্গেয় সমতলে। কাশি, কোশল এবং বৎস পশ্চিম গাঙ্গেয় সমভূমিতে। আরও পশ্চিমে ছিল কুরু, পাঞ্চাল, মৎস্য এবং শূরসেনা। উত্তর-পশ্চিমে কাম্বোজ ও গান্ধার। মধ্য ভারতে অবন্তী ও চেদি এবং দাক্ষিণাত্যের অশ্মক বা আসাকা। এই ষোলটি মহাজনপদ নিয়ে তৎকালীন “ষোড়শ মহাজনপদ” - ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় শুরু করল। এই ষোলোটি মহাজনপদ ছাড়াও আরও অনেক জনপদের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া গেছে। যেমন শাক্য, কোলিয়, লিচ্ছবি, মোরিয়, ইত্যাদি। পরবর্তী পর্যায়ে আমরা দেখব এই মহাজনপদ ও জনপদগুলির আমাদের দেশের গৌরবময় ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। এই সময়েই এই অঞ্চলের একত্র নাম ছিল আর্যাবর্ত – অর্থাৎ ভারতের আর্য প্রভাবিত অঞ্চল। ভারতের বিস্তীর্ণ অঞ্চল তখনও পড়েছিল তাদের প্রাধান্য বিস্তারের অপেক্ষায়।

    এই ষোলোটি মহাজনপদের মধ্যে তিনটি ছিল, মৈত্রী-সঙ্ঘ বা গণসঙ্ঘ (confederation)। মোট আটটি গোষ্ঠী যৌথভাবে প্রশাসনিক কাজ পরিচালনা করত বৃজি মহাজনপদে, তাদের রাজার সংখ্যা ছিল নাকি ৭,৭০৭। মল্লদের রাজা ছিল প্রায় ৫০০ জন এবং চেদিদের আরও বেশি।

    রাজতান্ত্রিক মহাজনপদগুলির বর্ণনা আমরা ইতিহাস এবং মহাভারতে সুবিস্তারে পেয়ে থাকি। পূর্ববর্তী ২.৪.৬ অধ্যায় থেকেই তাদের প্রশাসনিক ও সামাজিক বিন্যাস সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা তৈরি করা যায়। অতএব, সে প্রসঙ্গে আবার না গিয়ে আমরা বরং গণসঙ্ঘগুলির দিকে একটু নজর দিই। আমাদের সাধারণ ইতিহাসে এই জনপদগুলিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় না এবং মহাভারত ও অন্যান্য ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থগুলি এই বিষয়ে খুব সঙ্গত কারণেই উদাসীন।  

    ২.৬.২ গণসঙ্ঘী জনপদ ও মহাজনপদ

    গণসঙ্ঘী মহাজনপদগুলির ব্যবস্থা ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিপরীত। এই শাসনব্যবস্থা প্রাচীন পদ্ধতিরই নবীন রূপ।  আদিম সমাজে আমরা যেমন দেখেছি, পরিবার ভিত্তিক গোষ্ঠীর প্রধান হত পরিবারের বয়স্ক এবং অভিজ্ঞ কোন পুরুষ। গণসঙ্ঘ শাসন ব্যবস্থাও মূলত একই রকম। এখানে তফাৎটা হল, অনেকগুলি গোষ্ঠীর মৈত্রী জোট নিয়ে যে মহাজনপদ গড়ে উঠেছিল, তার প্রশাসনে থাকত, সবকটি গোষ্ঠীর এক বা একাধিক প্রধানেরা। এই কারণেই, বৃজি মহাজনপদে ৭৭০৭ জন এবং মল্ল মহাজনপদে ৫০০ জন রাজা(? আসলে প্রধান)-র উল্লেখ পাওয়া যায়, পরবর্তী কালের জৈন ও বৌদ্ধ গ্রন্থগুলিতে। এরকম গণসঙ্ঘী প্রশাসনের কথাই আমরা আলোচনা করেছি ২.৩.৭ অধ্যায়ে সিন্ধু সভ্যতার ক্ষেত্রে। এই মহাজনপদগুলির প্রশাসনিক স্তরে বেশ কিছু অনার্য গোষ্ঠীও যে সামিল ছিল, সে কথা অনুমান করতে, আমার কোন দ্বিধা নেই। বহু গোষ্ঠী মিলে পরমত-সহিষ্ণু প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ধারণা আর্যদের মস্তিষ্কে হঠাৎ করেই উদয় হয়েছিল, এমন ভাবার কোন কারণ নেই। যেখানে আমরা নিশ্চিতভাবেই জানি, আর্যরা আসার অন্ততঃ দুহাজার বছর আগে থেকেই অনার্যরা এই প্রশাসন পদ্ধতি অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে ব্যবহার করেছে।  
      
    যাই হোক, সকল গোষ্ঠীর সব প্রধানদের নিয়ে গড়ে তোলা হত বিধানসভা। এই বিধানসভাতেই রাজ্যের শাসন পদ্ধতি এবং রাজ্য পরিচালনার বিধি-বিধান স্থির হত। সভাতে সকল প্রতিনিধি সহমত হয়ে গেলে কোন সমস্যা ছিল না, কিন্তু মতবিরোধ দেখা দিলে, ভোট নেওয়া হত। যে মতে অধিকাংশের সমর্থন, বলা বাহুল্য, সে মতই বিধানসভার অনুমোদন পেত। তাই বলে, এটিকে গণতন্ত্র মনে করার কোন কারণ নেই। কারণ এই বিধানসভাতে দেশের সাধারণ জন সমাজের কোন প্রতিনিধি থাকত না, এবং তাদের সে অধিকার দেওয়াও হত না।
     
    অনেক গোষ্ঠীর মৈত্রী জোট নিয়ে গণসঙ্ঘ যেমন ছিল, তেমনই ছিল একটিমাত্র গোষ্ঠীর গণসঙ্ঘও। স্বাভাবিক ভাবেই সেগুলির আয়তন খুবই ছোট, অতএব সেগুলি মহাজনপদ নয়, সেগুলিকে বলা হত জনপদ, যেমন শাক্য, কোলিয়া, লিচ্ছবি, মোরিয় ইত্যাদি। 
     
    আর্য-অনার্য সম্মিলিত এই ধরনের মহাজনপদগুলিতে সামাজিক গঠন ছিল সরল এবং যথেষ্ট যুক্তিসম্মত। শাসক গোষ্ঠীগুলিতে - সে আর্য বা অনার্য যেই হোক, চতুর্বর্ণের কোন বিন্যাস ছিল না। যদিও জনপদ-প্রধান নিজেকে ক্ষত্রিয় বলেই পরিচয় দিত। এই গণসঙ্ঘী সমাজেও ব্রাহ্মণ ও পণ্ডিতদের সম্মান ছিল, কিন্তু আধিপত্য ছিল সীমিত। ব্রাহ্মণদের আধিপত্য না থাকায় এই সমাজ বিপুল আড়ম্বরে যজ্ঞের আয়োজন করত না। অতএব ব্রাহ্মণ্য সমাজের কটাক্ষে এই গণসঙ্ঘী সমাজ “বেদ-বিমুখ” হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিল। এবং এই কারণেই ব্রাহ্মণ্য শাস্ত্র ও মহাকাব্যগুলিতে এই সমাজগুলি ছিল অপাংক্তেয় এবং সে ভাবে কোন গুরুত্বই পায়নি।  যদিও আমরা পরবর্তী পর্বে দেখব, গণসঙ্ঘী সমাজের শিক্ষিত ও অভিজাত পরিবারগুলিতে বেদচর্চা আবশ্যিক ছিল।   

    এই সমাজের আর্য এবং অনার্য মানুষরা নিজ নিজ দক্ষতা অনুযায়ী, নানান কাজে নিযুক্ত থাকত। গণসঙ্ঘী সমাজে এই কর্মী মানুষদের বলা হত কর্মকার, যারা বাণিজ্য করত তাদের বলা হত বণিক বা শ্রেষ্ঠী। ব্রাহ্মণ্য সমাজের মতো সম্পন্ন কৃষক, বণিক বা শিল্পীদের বৈশ্য বানিয়ে তাদের সামাজিকভাবে গুরুত্বহীন তৃতীয় স্তরে নামিয়ে দেওয়া হয়নি। প্রশাসনিক স্তরেও তাদের যথেষ্ট সম্মান ও গুরুত্ব দেওয়া হত। ভূমিহীন ও অদক্ষ শ্রমজীবি মানুষদের বলা হত দাস – তাদের মধ্যে স্বাধীন শ্রমিক যেমন ছিল তেমনি ক্রীতদাসও ছিল। ক্রীতদাসরা সাধারণতঃ গার্হস্থ্য কাজেই নিযুক্ত হত। আর কৃষি ও পশুপালনের কাজে সাধারণ স্বাধীন শ্রমিকদের নিয়োগ করা হত।  

    অবস্থানের দিক থেকে গণসঙঘ মহাজনপদগুলি কিছুটা দুর্বলই ছিল বলা চলে। গাঙ্গেয় সমভূমির অত্যন্ত উর্বর অঞ্চলের ব্রাহ্মণ্য মহাজনপদগুলি থেকে তাদের অবস্থান ছিল কিছুটা দূরে হিমালয়ের তরাই অঞ্চলে অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত কম উর্বর অঞ্চলে। এর কারণ হতে পারে, তারা শক্তিশালী ও আগ্রাসী আর্যগোষ্ঠীদের থেকে কিছুটা নিরাপদ দূরত্বে নিরিবিলি শান্তিতেই থাকতে চেয়েছিল। অথবা ব্রাহ্মণদের একাধিপত্য বিষয়ে, প্রধান আর্যগোষ্ঠীদের সঙ্গে তাদের মতভেদ হওয়াতে, তারা ওই সব অঞ্চলে সরে গিয়েছিল।

    প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যায়, ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে দ্বারকার কোথাও কোন উল্লেখ নেই। কিন্তু দ্বারকাও সম্ভবতঃ এমনই আরেক গণসঙ্ঘী জনপদ ছিল। মথুরায় কংস নিধনের পর, কংসের শ্বশুর প্রবল পরাক্রমী চেদিরাজ জরাসন্ধের সঙ্গে বারংবার সম্মুখ সমরের বিপদ এড়াতে, শ্রীকৃষ্ণ সুদূর দ্বারকায় সরে গিয়েছিলেন। তাঁর সঙ্গে ছিল, যদু, বৃষ্ণি, শূরসেন, ভোজ[1] ও অন্ধক গোষ্ঠী। যদিও দ্বারকাধীশ ছিলেন শ্রীকৃষ্ণ, কিন্তু রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক কারণে তাঁকে বেশির ভাগ সময় বাইরে থাকতে হত বলে, দ্বারকা জনপদের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন, তাঁর পিতা বসুদেব এবং মাতামহ উগ্রসেন। এই গোষ্ঠীগুলির সংক্ষিপ্ত পরিচয় হল, শ্রীকৃষ্ণ-পিতা বসুদেব হলেন বৃষ্ণি বা শূর বংশীয়। শ্রীকৃষ্ণ-মাতা দেবকী হলেন, যদু[2], ভোজ ও অন্ধকদের অধিপতি উগ্রসেনের কন্যা। এই উগ্রসেনের পুত্র অর্থাৎ মাতা-দেবকীর ভাই কংস – একটি দৈববাণী শুনেছিলেন, বসুদেব ও দেবকীর অষ্টম সন্তান তাঁর মৃত্যুর কারণ হবে। অতএব, তিনি নিজের মৃত্যু রোধ করতে বোন দেবকী ও ভগ্নীপতিকে কারারুদ্ধ করলেন। কিন্তু পিতা উগ্রসেন কংসের এই সিদ্ধান্ত অনুমোদন না করাতে, তিনি পিতাকেও বন্দী করে, নিজেই সব কটি গোষ্ঠীর অধিপতি হয়ে বসেছিলেন। কংসের দুই পত্নী – অস্তি ও প্রাপ্তি ছিলেন চেদি (মগধ) -র অধিপতি জরাসন্ধের কন্যা এবং কংসের মিত্ররা ছিল বাণ ও ভৌম নামে দুই রাক্ষস(অনার্য)-রাজ। [শ্রীমদ্ভাগবত/ দশম স্কন্ধ/প্রথম অধ্যায়।]    

    যাই হোক, আর্য-অনার্য সহাবস্থান এবং পরমতসহিষ্ণু উদারনীতির জন্যেই গণসঙ্ঘী মহাজনপদ ও জনপদগুলির মানুষরা অনেকটাই মুক্তচিন্তার অবকাশ পেয়েছিল। আর সেই কারণেই সে যুগে যে দুজন যুগন্ধর মহাপুরুষের আবির্ভাব হয়েছিল, তাঁরা দুজনেই এমনই দুই গণসঙ্ঘী জনপদের বাসিন্দা ছিলেন। বৃজি গণসঙ্ঘ থেকে এসেছিলেন মহাবীর এবং শাক্য গণসঙ্ঘ থেকে এসেছিলেন গৌতম বুদ্ধ। দুজনেই ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরোধী দুই ধর্মের সৃষ্টি করেছিলেন এবং ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ভিতকে নাড়িয়ে দিতে পেরেছিলেন। তাঁদের, বিশেষ করে গৌতমবুদ্ধের প্রত্যক্ষ প্রভাবে, প্রায় এক হাজার বছর রাজশক্তি থেকে দূরে থাকতে হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মকে। পরবর্তীকালে তারা আবার যখন হারানো আধিপত্য ফিরে পেল, দেখা গেল, ততদিনে ব্রাহ্মণ্য ধর্ম নিজেদের ধর্মভাবনাকে আমূল বদলে জনমুখী নতুন এক ধর্মে রূপান্তরিত হয়ে উঠেছে, যার নাম হিন্দু ধর্ম। কিন্তু সেই আলোচনা আসবে যথা সময়ে, এখন নয়। এখন সমকালীন, ব্রাহ্মণ্য ধর্মের বিরুদ্ধ মতগুলির দিকে একটু নজর দেওয়া যাক।

    ২.৬.৩ প্রতিবাদী কণ্ঠ, বিরোধী মতামত

    ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ব্রাহ্মণ এবং ক্ষত্রিয় - এই বর্ণযুগলের দাপটে ব্রাহ্মণ্য ধর্মের অদ্ভূত সামাজিক সংস্কৃতি মেনে নিল আমাদের মতোই ভীত ছাপোষা সাধারণ মানুষ। কিন্তু কখনোই মনে নেয়নি, সেকথা বলাই বাহুল্য। তাদের প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর শোনা গেছে বারবার। সেই কণ্ঠস্বর তেমন দুর্বলও যে নয়, তার প্রমাণ পাওয়া যায় সমকালীন ও পরবর্তী সময়ের সংস্কৃত শাস্ত্রগুলিতে এবং মহাকাব্যে। বিভিন্ন ব্রাহ্মণ্য গ্রন্থে তাদের সমালোচনা, নিন্দা, আক্ষরিক অর্থে গালাগাল, ব্যঙ্গ, বিদ্রূপ থেমে থাকেনি, বহুদিন পর্যন্ত। এমনকি অসামান্য প্রতিভাবান পণ্ডিত শঙ্করাচার্যকেও (যাঁর সময়কাল ৭৮৮-৮২০ খ্রীষ্টাব্দ) এ বিষয়ে বেশ কড়া করে দুচার কথা শোনাতে হয়েছিল। অতএব সহজেই অনুমান করে নেওয়া যায়, বিরুদ্ধ এই কণ্ঠস্বরগুলি ব্রাহ্মণদের পক্ষে যথেষ্ট মাথাব্যথার কারণ ছিল।

    খুব স্বাভাবিকভাবেই এই ধরনের বেদ-বিরোধী প্রতিবাদী মানুষগুলিকে “নাস্তিক” অর্থাৎ নিরীশ্বর বলা হয়েছে। শুধু নাস্তিকই নয়, তাদের বিকৃত আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি ও নিষ্ঠুরকর্মা বলা হয়েছে। যদিও তাদের মধ্যে অনেকেই ছিল  তপস্বী, কিন্তু ক্রোধে এবং বিদ্বেষে রাক্ষস বলেও উল্লেখ করা হয়েছে। এই প্রতিবাদী মানুষগুলিকে ব্রাহ্মণেরা কতখানি ভয় পেত, তার কয়েকটি উদাহরণ দিলে বিষয়টি বুঝতে সুবিধে হবে।
     
    শ্রীমদ্ভাগবত গীতার ষোড়শ অধ্যায় (দৈবাসুরসম্পদবিভাগযোগ)-এর ৬, ৭, ৮ ও ৯ সংখ্যক শ্লোকে তাঁরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে দিয়ে বলালেন,

    দ্বৌ ভূতসর্গৌ লোকেঽস্মিন্‌ দৈব আসুর এব চ।
    দৈবো বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুরং পার্থ মে শৃণু।। ১৬/৬
    [সন্ধি-সমাসের বিচ্ছেদে শ্লোকটি বুঝতে কিছুটা সুবিধে হয় –
    দ্বৌ ভূত-সর্গৌ লোকে অস্মিন্‌ দৈবঃ আসুরঃ এব চ। দৈবঃ বিস্তরশঃ প্রোক্ত আসুর[3]ম্‌ পার্থ মে শৃণু।।]
    সরলার্থ - হে পার্থ, এই জগতে দৈব এবং আসুর, এই দুই প্রকার স্বভাবেরই জীব ও মানুষ সৃষ্টি হয়েছে। দেবসুলভ মানুষের কথা তোমাকে আগেই সবিস্তারে আমি বলেছি, এখন, অসুরসুলভ মানুষের কথা বলছি, শোন।

    প্রবৃত্তিঞ্চ নিবৃত্তিঞ্চ জনা ন বিদুরাসুরাঃ।
    ন শৌচং নাপি চাচারো ন সত্যং তেষু বিদ্যতে।। ১৬/৭
    [প্রবৃত্তিম্‌ চ নিবৃত্তিম্‌ চ জনা ন বিদুঃ আসুরাঃ। ন শৌচম্‌ ন অপি চ আচারঃ ন সত্যম্‌ তেষু বিদ্যতে।।]
    সরলার্থ - আসু্রী মানুষের না ধর্মে প্রবৃত্তি থাকে, না অধর্মের নিবৃত্তি জানে। তাদের শুচিতা থাকে না, সদাচার থাকে না, এমনকি সত্যও থাকে না। 

    “অসত্যমপ্রতিষ্ঠং তে জগদাহুরনীশ্বরম্‌।
    অপরস্পরসম্ভূতংকিমন্যৎ কামহৈতুকম্‌।। ১৬/৮
    [অসত্যম্‌ অপ্রতিষ্ঠম্‌ তে জগৎ আহুঃ অনীশ্বরম্‌। অপরঃ-পর-সম্ভূতম্‌ কিম্‌ অন্যৎ কামহৈতুকম্‌।।]
    সরলার্থ - তারা বলে, জগৎ মিথ্যা, এখানে ধর্ম বা অধর্মের কোন সংস্থান নেই এবং ঈশ্বরও নেই। এই জগৎ সৃষ্টিতে স্ত্রী ও পুরুষের পারষ্পরিক কাম সংযোগ ছাড়া আর কী কারণ থাকতে পারে?

    “এতাংদৃষ্টিমবষ্টভ্যনষ্টাত্মানোঽল্পবুদ্ধয়ঃ।
    প্রভবন্ত্যুগ্রকর্মণঃক্ষয়ায়জগতোঽহিতাঃ।। ১৬/৯
    [এতাম্‌ দৃষ্টিম্‌ অবষ্টভ্য নষ্ট-আত্মানঃ-অল্পবুদ্ধয়ঃ। প্রভবন্তি-উগ্রকর্মণঃ ক্ষয়ায় জগতঃ-অহিতাঃ।।]
    সরলার্থ - বিকৃত আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি ও নিষ্ঠুরকর্মা এই ব্যক্তিরা, এই দর্শন অনুসরণ ক’রে, জগতের অমঙ্গল ও বিনাশের জন্যেই জন্মগ্রহণ করে। (শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলায় অনুবাদ- লেখক)

    এই বিকৃত আত্মা, স্বল্পবুদ্ধি ও নিষ্ঠুরকর্মা লোকগুলি কারা, যাদের কথা প্রিয়বন্ধু, পিসতুতো ভাই ও ভক্ত অর্জুনকে বললেন, স্বয়ং ভগবান?

    আরেকটি উদাহরণ দিই রামায়ণের অযোধ্যা কাণ্ডের ১০৮ সর্গ থেকে, যেখানে জাবালি ভগবান শ্রীরামচন্দ্রকে বলছেন, “...পিতার অনুরোধে পৈতৃক রাজ্য পরিত্যাগ করিয়া দুঃখজনক দুর্গম সঙ্কটপূর্ণ অরণ্য আশ্রয় করা তোমার কর্তব্য হইতেছে না। এক্ষণে তুমি সুসমৃদ্ধ অযোধ্যায় প্রতিগমন কর। সেই একবেণীধরা[4] নগরী তোমার প্রতীক্ষা করিতেছে। তুমি তথায় রাজভোগে কালক্ষেপ করিয়া দেবলোকে সুররাজ ইন্দ্রের ন্যায় পরমসুখে বিহার করিবে। দশরথ তোমার কেহ নহেন, তুমিও তাঁহার কেহ নও, তিনি অন্য তুমিও অন্য, সুতরাং আমি যেরূপ কহিতেছি তুমি তাহারই অনুষ্ঠান কর। দেখ, জন্মবিষয়ে পিতা নিমিত্তমাত্র বলিয়া নির্দিষ্ট হন, বস্তুতঃ মাতা ঋতুকালে গর্ভে যে শুক্রশোণিত ধারণ করেন, তাহাই জীবোৎপত্তির উপাদান। এখন দশরথ যেস্থানে যাইবার গিয়াছেন, ইহাই মনুষ্যের স্বভাব। কিন্তু বৎস! তুমি স্ববুদ্ধিদোষে বৃথা নষ্ট হইতেছ। যাহারা প্রত্যক্ষসিদ্ধ পুরুষার্থ পরিত্যাগ করিয়া কেবল ধর্ম লইয়া থাকে, আমি তাহাদিগের নিমিত্ত ব্যাকুল হইতেছি, তাহারা ইহলোকে বিবিধ যন্ত্রণা ভোগ করিয়া অন্তে মহাবিনাশ প্রাপ্ত হয়। লোকে পিতৃদেবতার উদ্দেশে অষ্টকা শ্রাদ্ধ করিয়া থাকে। দেখ, ইহাতে কেবল অন্ন অনর্থক নষ্ট করা হয়, কারণ কে কোথায় শুনিয়াছে যে, মৃত ব্যক্তি আহার করিতে পারে? যদি একজন ভোজন করিলে অন্যের শরীরে উহার সঞ্চার হয়, তবে প্রবাসীর উদ্দেশে এক ব্যক্তিকে যদি আহার করাও, উহাতে কি ঐ প্রবাসীর তৃপ্তিলাভ হইবে? কখনই না। যে-সমস্ত শাস্ত্রে দেবপূজা, যজ্ঞ, দান ও তপস্যা প্রভৃতি কার্যের বিধান আছে, ধীমান মনুষ্যেরা কেবল লোকদিগকে বশীভূত করিবার নিমিত্ত সেই সকল শাস্ত্র প্রস্তুত করিয়াছেন। অতএব, রাম! পরলোক-সাধন-ধর্ম নামে কোন পদার্থই নাই, তোমার এইরূপ বুদ্ধি উপস্থিত হউক। তুমি প্রত্যক্ষের অনুষ্ঠান এবং পরোক্ষের অননুসন্ধানে প্রবৃত্ত হও। ভরত তোমাকে অনুরোধ করিতেছেন, তুমি সর্বসম্মত বুদ্ধির অনুসরণপূর্বক রাজ্যভার গ্রহণ কর”।

    জাবালির এই প্রস্তাবে ক্রুদ্ধ হয়ে, ভগবান শ্রীরামচন্দ্র তাঁকে তীব্র ভাষায় ধিক্কার এবং তিরষ্কার করেছিলেন, কিন্তু জাবালিকে তিনি “তপোধন” বলে সম্বোধনও করেছিলেন। তপোধন কথার অর্থ তপস্বী, মুনি বা ঋষি! অতএব জাবালি বড়ো সামান্য লোক নন, তিনি ভগবান রামচন্দ্রকেও মুখের ওপর এমন সব কথা বলার ক্ষমতা রাখতেন! ভগবান রামচন্দ্র এবং জাবালির মধ্যে এমন কোন কথোপকথন যদি সত্যিই হয়ে থাকে, মহাকবি বাল্মীকি সেটুকু অনায়াসে পরিত্যাগ করতে পারতেন। তাতে রামায়ণের কাহিনী বা কাব্যের এতটুকুও হানি হত না। কিন্তু তিনি তা করেননি, তাঁর মনে হয়েছিল, রামায়ণের মতো জনপ্রিয় কাব্যে এই ঘটনার উল্লেখ থাকলে, ব্রাহ্মণ্য-বিরোধীদের বিরুদ্ধে জনগণকে সজাগ করা যাবে। তাদের খুব স্পষ্ট বার্তা দেওয়া যাবে, দেখ, ওই দুষ্ট তপস্বীকে ভগবান রামচন্দ্রও কীভাবে ধিক্কৃত করেছিলেন।

    আরেক জন মুনির কথা পাওয়া যায় মহাভারতে, তাঁর নাম চার্বাক। চার্বাক সম্বন্ধে আর কিছু না জানলেও, বাঙালী তাঁর নামে প্রচলিত “ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ” প্রবচনটি খুব ভালোভাবেই জানে এবং সর্বদাই বিদ্রূপ অর্থে ব্যবহার করে থাকে।

    মহাভারতের শান্তিপর্বে রাজা যুধিষ্ঠির যখন কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধজয় করে রাজধানীতে ফিরছেন, “...সহস্র সহস্র ব্রাহ্মণ প্রীতি প্রফুল্লচিত্তে ধর্মরাজকে আশীর্বাদ করিতে লাগিলেন। ঐ সমুদয় ব্রাহ্মণের মধ্যে দুর্য্যোধনের সখা দুরাত্মা চার্ব্বাক রাক্ষস ভিক্ষুকরূপ ধারণ করিয়া অবস্থান করিতেছিল। ঐ পাপাত্মা পাণ্ডবগণের অপকার করিবার বাসনায় ব্রাহ্মণগণ নিস্তব্ধ হইলে তাঁহাদিগকে কোন কথা জিজ্ঞাসা না করিয়াই নির্ভীক চিত্তে উচ্চৈঃস্বরে গর্ব্বিত বাক্যে[5] যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধনপূর্বক কহিল, “মহারাজ! এই ব্রাহ্মণগণ আপনাকে জ্ঞাতিঘাতী ও অতি কুৎসিত রাজা বলিয়া ধিক্কার প্রদান করিতেছেন। ফলতঃ এইরূপ জ্ঞাতি-সংক্ষয় ও গুরুজনদিগের বিনাশসাধন করিয়া আপনার কি লাভ হইল? এক্ষণে আপনার মৃত্যুই শ্রেয়ঃ। জীবন ধারণ করিবার আর কিছুমাত্র প্রয়োজন নাই”।

    এই কথা শুনে উপস্থিত ব্রাহ্মণেরা ক্রোধে, দুঃখে লজ্জায় হতবাক হয়ে গিয়েছিল। তাদের চুপ করে থাকতে দেখে, রাজা যুধিষ্ঠির বলেছিলেন, ব্রাহ্মণেরা যেন তাঁর প্রতি প্রসন্ন হন, কারণ তিনি তখনই প্রাণ ত্যাগ করবেন। রাজা যুধিষ্ঠিরের কথায় ব্রাহ্মণেরা সম্বিৎ ফিরে পেল, বলল, “ধর্মরাজ! আমরা আপনাকে ধিক্কার প্রদান করি নাই। আপনার মঙ্গল হউক।...মহারাজ, যে ব্যক্তি আপনার প্রতি কটূক্তি করিল, ঐ দুরাত্মা, দুর্য্যোধনের পরম বন্ধু চার্ব্বাক নামক রাক্ষস। ঐ পাপাত্মা দুর্য্যোধনের হিতকামনায় আপনার প্রতি কুবাক্য প্রয়োগ করিয়াছে, আমরা কোন কথাই কহি নাই। অতএব আপনার কিছুমাত্র শঙ্কা করিবার প্রয়োজন নাই। আপনি ভ্রাতৃগণের সহিত কল্যাণভাজন হউন”।

    এরপরে সমবেত ব্রাহ্মণেরা চার্ব্বাকের ওপর ভয়ংকর ক্রুদ্ধ হয়ে শাপ-শাপান্ত এবং হুংকার ধ্বনি করতে লাগল এবং অচিরেই চার্ব্বাক বাজে-পড়া গাছের মতো ঝলসে মারা গেল। এই সব কিছু মিটে যাওয়ার পর ভগবান জনার্দন আসল রহস্যটি ফাঁস করলেন, বললেন, “সত্য যুগে চার্ব্বাক নামে এক রাক্ষস বদরী-তপোবনে বহুকাল অত্যন্ত কঠোর তপস্যা করেছিল। তার কঠোর তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে প্রজাপতি ব্রহ্মা তাকে বর দিতে উদ্যত হয়েছিলেন। তখন রাক্ষস বলেছিল, হে ভগবন, প্রসন্ন যখন হয়েছেন, তখন এমন বর দিন যে, কোন প্রাণীর থেকেই আমার কোনদিন যেন মৃত্যু না হয়। ভগবান ব্রহ্মা বলেছিলেন, তথাস্তু। কিন্তু তুমি কখনও ব্রাহ্মণদের অপমান করো না, ব্রাহ্মণের অপমান করলেই তুমি বিপদগ্রস্ত হবে”। অতএব সত্য যুগের কঠোর তপস্বী রাক্ষস দ্বাপরে এসে ব্রাহ্মণদের ক্রুদ্ধ অভিশাপে মারা গেল – ব্রাহ্মণদের কেউ মারেওনি, ধরেওনি, কিন্তু তাও মারা গেল, স্বয়ং ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এবং ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের সামনেই! এই বার্তাটি বেদ-বিমুখ মানুষদের পক্ষে যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ, তাতে আর সন্দেহ কি?

    ২.৬.৪ ভারতীয় দর্শনের সূচনা

    যে কোন দর্শনের মূলকথা হল মানব-মঙ্গল। ভারতীয় দর্শনের উদ্দেশ্য একই – এবং আমাদের দর্শনের ধারণা আরও সঠিক বললে মোক্ষ অর্থাৎ পরমমুক্তি। কোথা থেকে মুক্তি, না পুনর্জন্ম থেকে মুক্তি। ভারতীয় দর্শনের বক্তব্য মানুষের জীবন মানেই কিছুটা সুখ আর অনেকটা দুঃখ-শোক এবং ইহকাল ও পরকাল। একজন মানুষ সারা জীবনে এই যে সুখ-আনন্দ, দুঃখ-শোক ভোগ করে, তার কারণ, তার পূর্বজন্মের সুকৃতি এবং দুষ্কৃতি। গতজন্মের যত দুষ্কৃতি এই জন্মে দুঃখ-শোক-যন্ত্রণা হয়ে ফিরে আসে। অতএব ইহকালে অর্থাৎ এই জীবনে যদি নিশ্ছিদ্র সুকৃতি করা যায়, তাহলে পরকালে অর্থাৎ পরজন্মে বড়ো সুখের সময় আসে। যেমন এই জীবনে আপনি শূদ্র হয়ে নিখুঁত আনন্দে ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-বৈশ্যদের সেবা যদি করতে পারেন, মৃত্যুর পর পরজন্মে আপনি অবশ্যই ব্রাহ্মণ কিংবা ক্ষত্রিয় হয়ে পুনর্জন্ম নেবেন – অন্ততঃ বৈশ্য তো হবেনই! আর সব থেকে ভালো হল পুনর্জন্মের চক্করে না গিয়ে, সরাসরি মোক্ষ পেয়ে যাওয়া। একবার মোক্ষ পেয়ে গেলে, জন্ম-মৃত্যুর এই চক্র থেকে বেরিয়ে আপনি পিতৃলোক, দেবলোক, স্বর্গলোক, বৈকুণ্ঠলোক বা কৈলাসলোকে চলে যেতে পারবেন। কিন্তু এই লোকগুলোতে গিয়েও কোন স্থায়ী সমাধান হবে না। কারণ এই প্রত্যেকটি লোকের সুখ ভোগ করার একটা নির্দিষ্ট সময় আছে, সেই সময় শেষ হলেই আবার আপনাকে মর্তলোকে ফিরে আসতে হবে। অনেকটা আমাদের আজকালকার ছুটি কাটানোর মতো, তিনদিনের উইকেণ্ড বা একমাসের পূজা ভ্যাকেশন, তারপর তো সেই কাজে ফিরতেই হয়।

    চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত যেটা আছে, সেটাই হল পরমমোক্ষ–পরমমুক্তি – এর পরে আর মানুষকে মরজগতে ফিরে আসতে হয় না। তবে ব্যাপারাটা ভারি শক্ত, বিগত প্রায় আড়াই হাজার বছরে কজন মানুষ পরমমোক্ষ পেয়েছেন, সেটা কেউই সঠিক বলতে পারে না। কারণ পরমমুক্তি ব্যাপারটা হল পরম ঈশ্বরে বিলীন হয়ে যাওয়া। সাধনার যে উচ্চতম স্তরে পরম ঈশ্বরে লীন হওয়া যায়, সেই স্তরে সাধক আর কিছু বলার অবস্থায় থাকেন না। নদী যখন নিজেকে সমুদ্রের জলে মিশিয়ে দেয়, তখন সে তো আর নদী থাকে না, সে তখন সমুদ্রই হয়ে যায়। তেমনি সাধক যখন ঈশ্বরে লীন হন, তিনি ঈশ্বরই হয়ে যান। তাঁর পক্ষে সেই পরমমুক্তির আস্বাদ জাগতিক মানুষের কাছে প্রকাশ করা সম্ভব হয় না।

    ভারতীয় দর্শনের ভিত্তি অবশ্যই বেদ, বেদের সংহিতা এবং উপনিষদসমূহ। ভারতীয় দর্শনের প্রধান তত্ত্ব ছয়টি - সাংখ্য, পাতঞ্জল, ন্যায়, বৈশেষিক, মীমাংসা, বেদান্ত। একত্রে ষড়দর্শন বলা হয়ে থাকে। আমরা যে সময়ের কথা আলোচনা করছি, মোটামুটি ৬০০ বি.সি.ই পর্যন্ত, তার মোটামুটি শত খানেক বছর পরের কোন সময়ে দর্শন শাস্ত্রের সূত্রপাত হয়েছিল সাংখ্য দর্শনে। মহর্ষি কপিল এই সাংখ্যদর্শনের প্রবর্তক। মহর্ষি বা কপিল মুনি, ভগবান বিষ্ণুর অংশ-অবতার। শ্রীমদ্ভাগবত গীতার “বিভূতি যোগে” ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন,
    “অশ্বত্থঃ সর্ববৃক্ষাণাং দেবর্ষীণাঞ্চ নারদঃ।
    গন্ধর্বাণাং চিত্ররথঃ সিদ্ধানাং কপিলো মুনিঃ।। ১০/২৬[6]
    সমস্ত বৃক্ষের মধ্যে আমিই অশ্বত্থ, দেবর্ষিদের মধ্যে আমিই নারদ, গন্ধর্বগণের মধ্যে আমিই চিত্ররথ, সিদ্ধযোগীগণের মধ্যে আমিই কপিল মুনি।(শ্রীমদ্ভাগবত গীতা – বাংলায় অনুবাদ- লেখক)

    পণ্ডিতেরা বলেন সাংখ্য দর্শনের রচনাকাল ৫০০ বি.সি.ই-র কিছু আগে এবং তার কিছুদিন পরেই পাতঞ্জল দর্শনের রচনাকাল, এবং তারও কয়েকশ বছর পরে মোটামুটি ৩০০-২০০ বি.সি.ই-তে ন্যায়দর্শনের রচনাকাল। অতএব আমাদের আলোচ্য সময়কালের কিছু পরেই সাংখ্য এবং পাতঞ্জল দর্শন রচনা হয়েছে। সে প্রসঙ্গের একত্র আলোচনা আসবে অন্তিম পর্বে।   

     
    ২.৬.৫ ব্রাহ্মণ্য-বিরোধী মতাদর্শ বা লোকায়ত দর্শন

    লোকায়ত দর্শনের মূলকথা হল, তারা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য এই জড়জগৎ ছাড়া অন্য কোন কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না। অতএব তাদের কাছে পার্থিব সুখ-দুঃখ ছাড়া অন্য আর কিছু পুরুষার্থ থাকতে পারে না। তাদের দর্শনে ঈশ্বর বা দেবতা নেই, পরলোক বা পরজন্ম নেই, মৃত্যুর পর মানুষের কিছুই অবশিষ্ট থাকে না। এই দর্শনকে ব্রাহ্মণ্য ধর্মে চূড়ান্ত অবিশ্বাসবাদও বলা হয়েছে। প্রসঙ্গতঃ বৌদ্ধগ্রন্থ “সামান্য ফলসূত্ত”-এর বর্ণনা অনুযায়ী জনৈক ব্রাহ্মণ্য ধর্মে অবিশ্বাসী অজিত কেশকম্বলীর কথাগুলি, এই দর্শনের ধারণাটিকে স্পষ্ট করে। এই দর্শনের সঙ্গে রামায়ণের তপোধন জাবালির মতের বিশেষ পার্থক্য পাওয়া যায় না।   

    “দান যজ্ঞ হোম এবং সুকৃত ও দুষ্কৃত কর্মসমূহের কোন ফলবিপাক নাই। ইহলোকও নাই, পরলোকও নাই। মাতা নাই, পিতা নাই, উপপত্তিক (যৌক্তিক বা প্রামাণিক) কোনো সত্তাও নাই। ইহলোকে সম্মগ-গতো (সম্যকজ্ঞানগত?) কোনো শ্রমণ বা ব্রাহ্মণ নাই – যাঁহারা সম্যক গমন করেন, যাঁহারা স্বয়ং অভিন্ন সাক্ষ্য দ্বারা ইহলোক এবং পরলোকগুলিকে অনুধাবন করিতে পারেন এবং নিজেদের জ্ঞান অপরের কাছে বিতরণ করিতেও পারেন।

    চারি মহাভূত-বিশিষ্ট পুরুষ যখন মারা যায় তখন তার কায়ার পৃথিবী পৃথিবীতে প্রবেশ করে, কায়ার জল জলে প্রবেশ করে, কায়ার তেজ তেজে প্রবেশ করে, কায়ার বায়ু বায়ুতে প্রবেশ করে এবং ইন্দ্রিয়গুলি শূণ্যে বিলীন হয়। চারজন শববাহী– এবং শবাধার হল পঞ্চম – তাহার মৃতদেহকে লইয়া যায় এবং সৎকার স্থানে পৌঁছানো পর্যন্ত মানুষেরা তাহার গৌরব কীর্তন করে। তাহার অস্থিগুলি কপোতের ন্যায় হইয়া যায় (পুড়িয়া ছাই হইয়া যায়) এবং তাহার আহুতিগুলি ভস্মে পরিণত হয়। ভিক্ষা অথবা দান – যাহারা এইরূপ তুচ্ছ মিথ্যা প্রলাপ বকে তাহাদিগকে আস্তিক্যবাদী বলা হয়। মৃত্যুর পর মূর্খ ও পণ্ডিতের মধ্যে প্রভেদ ছিন্ন হয় এবং মরণের পর আর কিছুই থাকে না”।

    আগেই বলেছি, লোকায়ত বা চার্বাক দর্শনের আজ পর্যন্ত কোন গ্রন্থ বা পুঁথি পাওয়া যায়নি, নিশ্চয়ই ছিল, কিন্তু নষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। লোকায়ত দর্শন বলতে সংস্কৃত ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতেরা বলেছেন, এটি সাধারণ লোকের দর্শন– জনসাধারণের দর্শন। লোকেষু আয়তো লোকায়তঃ। অর্থাৎ সাধারণ লোকের মধ্যে এই দর্শন ব্যাপ্ত বলেই লোকায়ত। লোকায়ত দর্শনের এই ব্যাখ্যায় ব্রাহ্মণ্য পণ্ডিতদের একটা প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ যেন লুকিয়ে আছে। সাধারণ লোক মানেই তারা মূর্খ এবং মূঢ়, বেদ ও উপনিষদের মহান জ্ঞান থেকে তারা বঞ্চিত। কিন্তু লোকায়তের আরও একটা অর্থ হয়। লোকায়ত হল ইহলোকের দর্শন। যারা পরলোক মানে না, আত্মা মানে না, ধর্ম মানে না, মোক্ষ মানে না, তাদের বলা হয় লোকায়তিক। তারা মনে করে মাটি-জল-আগুন আর বায়ু দিয়ে গড়া এই মানব দেহ এবং এই পৃথিবীটাই একমাত্র সত্য। দেহ যতদিন আছে, ইহলোক আছে, এই পৃথিবী আছে, দেহ না থাকলে অর্থাৎ মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই সব শেষ।

    এখনও পর্যন্ত লোকায়ত দর্শনে এমন কী দেখা গেল, যার জন্যে ব্রাহ্মণ্য আস্তিকরা এতটা বিদ্বিষ্ট হয়ে উঠেছিল? প্রতিপাদ্য বিষয়টি খুব প্রচ্ছন্ন কিন্তু ভয়ংকর। ব্রাহ্মণ্য দর্শন নিচু স্তরের মানুষদের স্বপ্নের কথা শোনাচ্ছে। এই জন্মের শুদ্রত্ব বা দাসত্ব ভুলে গিয়ে তারা যদি উচ্চবর্ণের একনিষ্ঠ সেবা করে, তাহলে পরজন্মে তাদের উত্তরণ সুনিশ্চিত। উচ্চবর্ণে উত্তরণ তো সামান্য কথা, ঈশ্বরে প্রগাঢ় বিশ্বাস রেখে একনিষ্ঠ সেবা করলে মৃত্যুর পর স্বর্গলোকে চলে যাওয়াও অসম্ভব নয়। আর স্বর্গ মানেই তো, চূড়ান্ত আনন্দ এবং সুখভোগ– তৃষ্ণা নিবারণে সুধা, ক্ষুধায় পর্যাপ্ত সুস্বাদু খাদ্য, চিরবসন্ত ঋতু, স্থিরযৌবনা অপ্সরাদের নৃত্য-গীত এবং সঙ্গ। এ সব কিছুই পাওয়া যেতে পারে দাসত্ব এবং শূদ্রত্ব ভুলে একনিষ্ঠ সেবায়।

    লোকায়ত দর্শনের এখানেই আপত্তি। তাদের বক্তব্য এটা প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কিছুই নয়। স্বর্গ কে দেখেছে, পরজন্ম কে জেনেছে? ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কিছু স্বার্থপর ব্রাহ্মণ এই মোহ দেখিয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। সাধারণের কাছে যা কিছু প্রত্যক্ষ তার প্রমাণকে স্বীকার করাই, তাদের এই বিভ্রান্তি থেকে বাঁচার একমাত্র নিরাপদ রাস্তা। শুধু তাই নয় লোকায়ত দার্শনিকদের আরও একটা আশঙ্কা ছিল, এই স্বপ্নে নিবিড় আস্থা রাখলে, দাস ভুলে যাবে তার দাসত্ব, দরিদ্র ভুলে যাবে তার দারিদ্র। ব্যাপারটা হয়ে উঠবে, মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়ার মতো। কারণ এক অবস্থা থেকে উচ্চতর অবস্থায় উত্তরণের প্রচেষ্টা মনুষ্যত্বের স্বাভাবিক ধর্ম। বর্ণাশ্রমের বিধি অনুযায়ী একজন দাস বা শূদ্র জন্মসূত্রেই সে শূদ্র বা দাস। তার সন্তানাদিও দাসই থাকবে।

    ধরা যাক আমি একজন দাস। সারা জীবন মন দিয়ে সেবা করতে লাগলাম এবং আমার ছেলেমেয়ে, নাতিপুতিদেরও উপদেশ দিয়ে গেলাম, আমার মতো সেবা করতে থাক, তাহলে নিশ্চয়ই আমাদের আবার স্বর্গে দেখা হবে। স্বর্গে গিয়ে দেখা হচ্ছিল কিনা জানার কোন উপায় নেই, কিন্তু এই বিশ্বাসে বিভোর দাসেরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দাসই থেকে যাবে! তারা অন্য আর কিছু হয়ে ওঠার চেষ্টাই করবে না। এটাই মানুষের মনুষ্যত্ব ভুলে যাওয়া। আর এখানেই ব্রাহ্মণ্য দর্শনের সঙ্গে লোকায়ত দর্শনের সাংঘাতিক দ্বন্দ্ব। এবং বলা বাহুল্য এই দ্বন্দ্ব উচ্চস্তরীয় পরমমোক্ষ লাভের জন্যে নয়, খুবই নিচুস্তরের পার্থিব স্বার্থসিদ্ধির জন্যে। এ প্রসঙ্গে বলে রাখা ভাল, এই লোকায়ত দর্শনের অনেক প্রবক্তাই ক্রীতদাস ছিলেন। যেমন বৌদ্ধ শাস্ত্রমতে অজিত কেশকম্বলী ছিলেন একজন ক্রীতদাস।

    লোকায়ত দর্শন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের প্রায় শুরুর থেকেই সমান্তরাল পথে চলতে থাকলেও - নিরন্তর বিরক্তি উৎপাদন ছাড়া খুব মারাত্মক কোন প্রভাব ফেলতে পারেনি। ব্রাহ্মণ্য ধর্মের মনীষী পণ্ডিত প্রবক্তারাও কোনদিনই সহিষ্ণুতার পরিচয় দিতে পারেননি। তাঁরা লোকায়ত দর্শনকে বারবার শাপ-শাপান্ত করেছেন এবং প্ররোচিত করেছেন লোকায়তিক মানুষদের বিনাশ করতে। তার সব থেকে বড়ো উদাহরণ চার্বাক মুনির হত্যাকে মহাভারতের অকুণ্ঠ প্রশ্রয়।

    লোকায়ত দর্শন ব্রাহ্মণ্য ধর্মের ওপর তেমন কোন প্রভাব ফেলতে না পারলেও, দুটি নতুন দর্শন তাদের যথেষ্ট বিপদে ফেলেছিল। এই দুই দর্শনের প্রবল ধাক্কায় বদলে ফেলতে হয়েছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের খোল নলচে। সে দুটি হল জৈন এবং বৌদ্ধ দর্শন। সে আলোচনা আসবে পরবর্তী পর্বে।

    চলবে...
    (দ্বিতীয় পর্ব সমাপ্ত। তৃতীয় পর্বের প্রথম ভাগ আসবে ০৩/০৬/২০২২ তারিখে)

    মানচিত্র ঋণঃ
    https://cdn1.byjus.com/wp-content/uploads/2020/08/16-Mahajanapadas-768x591.png

    গ্রন্থ ঋণঃ
    ১) The penguin history of Early India – Romila Thapar
    ২) The wonder that was India – A. L. Basham.
    ৩) লোকায়ত দর্শন–শ্রী দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়।
    ৪) মহাভারত (মূল সংস্কৃত হইতে বঙ্গানুবাদ)–মহাত্মা কালীপ্রসন্ন সিংহ।
    ৫) শ্রীমদ্ভাগবত (পুরাণ) – বাংলা গদ্যানুবাদ শ্রীযুক্ত তারাকান্ত কাব্যতীর্থ।    
    ৬) বাল্মীকি রামায়ণ – বাংলায় গদ্যানুবাদ– শ্রীযুক্ত হেমচন্দ্র ভট্টাচার্য।
        ৭) শ্রীমদ্ভাগবত গীতা– বাংলা অনুবাদ (চিরসখা হে) – কিশোর ঘোষাল

    [1] এই ভোজ গোষ্ঠীপতির কন্যা মাতা কুন্তী, অতএব তিনি শ্রীকৃষ্ণের সম্পর্কিত পিসিমা, এবং পঞ্চপাণ্ডব তাঁর পিসতুতো ভাই।  

    [2] যদু গোষ্ঠী আমাদের কাছে যাদব গোষ্ঠী নামেই সুপরিচিত, যাঁর প্রধান ছিলেন রাজা নন্দ, তাঁর পত্নী মা যশোদা ছিলেন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের পালিকা মাতা।

    [3] বেদ না মানা মানুষরা – আসুর – অর্থাৎ অসুর ভাবাপন্ন – তাদের রাক্ষস বা অসুর বলাই চলে – যেখানে স্বয়ং শ্রীশ্রী গীতার অনুমোদন রয়েছে!

    [4] সংস্কৃত সাহিত্যে প্রায়শঃ দেখা যায় প্রবাসী পতির বিরহিণী পত্নীরা একবেণী-তে চুল বাঁধতেন। এর অর্থ পতি-সঙ্গে তাঁরা সাধারণতঃ দুই বেণী বা মনোহারি কবরীতে কেশ সজ্জা করতেন। এখানে অযোধ্যাপতি শ্রীরামচন্দ্রের বিরহে, অযোধ্যা নগরীই যেন বিরহীনি পত্নী। উপমা মাধুর্যে সংস্কৃত কাব্যের জুড়ি মেলা ভার।      

    [5] “নির্ভীক চিত্তে, উচ্চৈঃস্বরে, গর্ব্বিত বাক্যে” চার্বাকের প্রতি এই তিনটি বিশেষণ ব্যবহার করে মহাভারত রচয়িতা প্রচ্ছন্ন একটু প্রশ্রয়ের ইঙ্গিত করলেন কি? কুচক্রী এক রাক্ষসের সম্পর্কে অন্যান্য ক্ষেত্রে যে ধরনের ভাষা সচরাচর আমরা পড়ে থাকি, তার তুলনায় এই বিশেষণগুলি ঠিক যেন মানাচ্ছে না।      

    [6] কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের সময় কাল ৯০০ বি.সি.ই-র কোন সময়, ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে শ্রীশ্রীগীতা উপদেশ শুনিয়েছিলেন যুদ্ধক্ষেত্রে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে। তিনি তখন কপিলমুনির প্রসঙ্গ কী করে আনলেন? কপিল মুনি ও তাঁর সাংখ্য দর্শনের সময় কাল, ৫০০ বি.সি.ই-র কাছাকাছি।  ভগবান শ্রীকৃষ্ণ না হয় ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা, ভবিষ্যতের কোন কথাই তাঁর অজানা নয়। কিন্তু অর্জুন কেন কৌতূহলী হলেন না, বিখ্যাত এই কপিল মুনি কে? তাঁর নাম তো কোনদিন শুনিনি। অতএব, এমন সিদ্ধান্ত করাই যায়, মহাভারতে শ্রীশ্রীগীতা সংকলিত হয়েছে বহুযুগ পরে।
            
     
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • ধারাবাহিক | ২৭ মে ২০২২ | ৩০৬৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • Kishore Ghosal | ৩০ মে ২০২২ ২১:৫৭508255
  • @রঞ্জনবাবু, ডি ডি কোশাম্বীর বইটি পড়িনি, তবে অন্য বইতে ওঁর রেফারেন্স পড়েছিলাম। একদম খাঁটি কথা বলেছেন। কুরুক্ষেত্রে  দু দল যুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হয়ে উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটছে, সে সময় তাদের মাঝখানে রথে বসে ভগবান কৃষ্ণ অর্জুনকে গীতার আঠারোটি পর্ব শোনাচ্ছেন, আর অর্জুন কিছু বুঝে কিছু না বুঝে বারবার প্রশ্ন করছেন, আর কোন কোন কথার detailed clarification চাইছেন! এই কথা বার্তায়  - সে যত বড়ো বিদ্বান ও অসামান্য বুদ্ধিমানই হোন না কেন - অন্ততঃ চার-পাঁচ ঘন্টা সময় পার হয়ে যাওয়ার কথা।  সেই সময়টা দুই পক্ষের সেনাপতি ও সৈন্যরা চুপ করে বসে রইলেন? অবিশ্যি ভগবানের মায়ায় সবই সম্ভব ভাবলে, সব ল্যাঠাই চুকে যায়! 
     
    তাছাড়া, আবাল্য অর্জুন শুনে এসেছেন এবং প্রস্তুত হয়েছেন - তাঁর হাতেই কৌরবদের বিনাশ করার প্রধান দায়িত্ব। সে ভাবেই তাঁকে তাঁর পরিবার, পরিজন, দাদু বেদব্যাস, কাকা বিদুর, মামাতো ভাই ভগবান কৃষ্ণ, পিতা দেবরাজ ইন্দ্র, দেবাদিদেব মহাদেবও তাঁকে প্রস্তুত হতে সময় ও অকুণ্ঠ সাহায্য করেছেন - হঠাৎ যুদ্ধক্ষেত্রে গিয়ে  তিনি এমন বিষাদ্গ্রস্ত হয়ে পড়লেন কেন, কে জানে? আমাদের গীতা পড়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যে?   
     
     
    @ সারা ম্যাডাম, ধৈর্য ধরে পড়ার জন্যে কৃতজ্ঞতা নেবেন, আপনাদের ভালো লাগলে, সকল প্রচেষ্টাই সার্থক হয়ে ওঠে।     
     
  • Ranjan Roy | ৩০ মে ২০২২ ২১:৫৯508256
  • সারা মান
       মনে হয় আগামী বইমেলায় দু'একদিন জম্পেশ আড্ডা হবে।
  • দীপ | 42.***.*** | ৩০ মে ২০২২ ২৩:২৮508259
  • যথারীতি গরুর রচনা হিসেবে মনুসংহিতা চলে এসেছে।
    এর আগেও বলেছি, মনুসংহিতা স্মৃতিশাস্ত্র অর্থাৎ সামাজিক আইনের সঙ্কলন মাত্র, তার বেশি কিছু নয়। আর বর্তমান মনুসংহিতা কোনো একক ব্যক্তির রচিত নয়, এর মধ্যে একাধিক ব্যক্তির হস্তাবলেপ আছে। সুতরাং একে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার দরকার নেই। এর মধ্যে যেটুকু বর্তমান সমাজের উপযোগী, সেটুকুই গ্রহণ করতে হবে, বাকিটা ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে। 
    আর মনুসংহিতা ছাড়াও আরো অনেক স্মৃতিশাস্ত্র আছে, অত‌এব ভারতীয় সমাজ কখনোই মনুসংহিতা কে ধ্রুবসত্য জ্ঞান করেনি। আর পূর্বভারতের সমাজে (বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা) মনুসংহিতা র চেয়ে পুরাণ ও তন্ত্রের প্রভাব অনেক বেশি। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজ কোনোদিনই মনুসংহিতাকে ধ্রুবসত্যরূপে গ্রহণ করেনি।
    আর দার্শনিকের কাছে স্মৃতিশাস্ত্রের চেয়ে শ্রুতিশাস্ত্রের গুরুত্ব অনেক বেশি।
     
    প্রসঙ্গত মনুসংহিতা য় কিন্তু কানীন সন্তান ও পৌনর্ভব সন্তানকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ পৌনর্ভব সন্তানকে স্বীকৃতি দানের মাধ্যমে নারীর পুনর্বিবাহ মেনে নেওয়া হয়েছে।
    আর বর্তমান মনুসংহিতা মহাভারতের অনেক পরে রচিত।
  • দীপ | 42.***.*** | ৩০ মে ২০২২ ২৩:৩৯508260
  • যেকোনো সমাজে চারটি শ্রেণী থাকে। একটি শ্রেণী অধ্যাপনা, গবেষণায় ব্যাপৃত থাকে;  দ্বিতীয় শ্রেণী সামরিক ও প্রশাসনিক কার্যে নিযুক্ত থাকে; তৃতীয় শ্রেণী ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদনের সঙ্গে জড়িত, চতুর্থ শ্রেণী শাাীরিি
    শারীরিক পরিশ্রমের দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করে। সর্বদেশে এই চারটি শ্রেণী দেখা যায়। এই বিভাগ গুণগত। গীতাতে এই গুণগত শ্রেণীবিভাগ কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, অন্য কোনকিছু কেই গুরুত্ব দেওয়া হয়নি।
  • দীপ | 42.***.*** | ৩০ মে ২০২২ ২৩:৪৯508261
  • গীতার অষ্টাদশ অধ্যায়ে বলা হয়েছে, 
    শম, দম, তপঃ, শৌচ, ক্ষমা, সরলতা, জ্ঞান, শ্রদ্ধা - প্্র্্্্র
    প্রভৃতি গুণ ব্রাহ্মণের স্বভাবজাত কর্ম।
    পরাক্রম, তেজ, ধৈর্য, দক্ষতা, যুদ্ধবৃত্তি , শাসনক্ষমতা প্রভৃতি ক্ষত্রিয়ের স্বভাবজাত কর্ম।
    বাণিজ্য ও অর্থ উৎপাদন বৈশ্যের কাজ।
    সমাজের প্রতি সেবামূলক কর্ম শূদ্রের দ্বারা সম্পাদিত হয়।
    পুরো আলোচনায় একবার‌ও কিন্তু কোনো জন্মগত ব্রাহ্মণত্ব বা শূদ্রত্বের কথা আসেনি। সেজন্য‌ই চতুর্বর্ণের কথা এসেছে। 
    অর্থাৎ ব্রাহ্মণত্ব বা শূদ্রত্ব কোনটাই জন্মগত নয়, গুণগত।
    কিন্তু গরুর রচনা চলবেই!
  • দীপ | 42.***.*** | ৩১ মে ২০২২ ০০:০৩508262
  • স্বভাবজাত কর্ম = স্বাভাবিক কর্ম
    আর গীতাতে বারংবার স্বধর্ম পালন করতে বলা হয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ স্বধর্ম পালন করেনা! শিক্ষক ক্লাস না নিয়ে প্রাইভেট টিউশনি করে, ডাক্তার হাসপাতাল ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করে, নেতা ঘুষ‌ খায়।
    কেউ নিজের দায়িত্ব পালন করেনা! আর পরধর্ম পালনের ফল অতি ভয়াবহ হয়! গীীী
    গীতায় সেটাই বলা হয়েছে! 
    ভক্তির দরকার নেই, একটু সমাজবিজ্ঞান নিয়ে ভাবলেই ব্যাপারটা বোঝা যায়! 
    অবশ্য গরুর রচনা লিখলে আলাদা কথা!
  • দীপ | 42.***.*** | ৩১ মে ২০২২ ০০:২১508263
  • অহিংসা পরম ধর্ম বটে, কিন্তু বাড়িতে ডাকাত পড়লে হরিনাম করলে কোনো কাজ হয়না। তখন অস্ত্র ধরতে হয়। হিটলারের মতো পররাজ্য‌আগ্রাসীকে কোনো শান্তিমন্ত্রে সংযত করা যায়না। আত্মরক্ষা অন্যায় নয়, তা প্রত্যেক প্রাণীর স্বাভাবিক ধর্ম।
     
    আর যুদ্ধক্ষেত্রে দার্শনিক আলোচনা অবশ্য‌ই কবিকল্পনা; কিন্তু গীতা মহাভারতের প্রাথমিক পর্যায়েই সৃষ্টি হয়েছে। 
     
    আর বিদ্যানিধি মহাশয়ের মতে ভগীরথের সময় খ্রিপূ ২৭০০-২৮০০ ।  ভগীরথ সাগরের পৌত্র। কপিল সাগরের সমসাময়িক। অর্থাৎ কপিল কৃষ্ণের অনেক আগে।
     
  • দীপ | 42.***.*** | ৩১ মে ২০২২ ০০:৩৩508265
  • Sorry সগর
  • দীপ | 42.***.*** | ৩১ মে ২০২২ ০১:২৬508268
  • মূল মহাভারতেও গুণগত ব্রাহ্মণত্বের কথাই বলা হয়েছে। মহাভারতে আমরা বিশ্বামিত্রের কথা পাই, তিনি ক্ষত্রিয় থেকে ব্রহ্মর্ষিতে পরিণত হয়েছিলেন। এক‌ইভাবে আমরা মহাভারতে ধর্মব্যাধের উল্লেখ পাই, ব্রাহ্মণ কৌশিক যাঁর কাছে শিক্ষার জন্য উপনীত হয়েছিলেন। মহাভারতের এই অংশ ব্যাধগীতা নামে পরিচিত।
    মহাভারতের বনপর্বে যক্ষ যুধিষ্ঠির সংবাদে , অজগরোপাখ্যানে বারবার বলা হয়েছে জন্মের দ্বারা কেউ ব্রাহ্মণ বা শূদ্র হয়না, কর্মের দ্বারাই সে ব্রাহ্মণত্ব বা শূদ্রত্ব প্রাপ্ত হয়। স্পষ্টভাবেই এখানে গুণগত ব্রাহ্মণত্বকেই বলা হয়েছে, অন্য কিছু নয়।
    অর্থাৎ মহাভারতের মূল অংশের সঙ্গে গীতার চিন্তা সামঞ্জস্যপূর্ণ।
    আর মহাভারতে জন্ম নয়, মানুষের যোগ্যতাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। মহাভারতের কবি নিজেই কুমারী মাতার সন্তান। ভীষ্ম, দ্রোণ, কর্ণ- কারো জন্ম বৈধ বিবাহের মাধ্যমে হয়নি।আর যদুবংশ, কুরুবংশ- সব‌ই তো অসবর্ণ বিবাহের ফল! 
    অবশ্য এরপরও গরুর রচনা চলতে থাকবে!
  • Sara Man | ৩১ মে ২০২২ ০৯:১৩508290
  • কিশোরবাবু, আস্ত যুদ্ধ থামিয়ে রেখে পুরো একখান গীতাপাঠ করলে মহাভারত নাটকের নাটকীয় মূল‍্য বাধা পায়, একথা প্রথম পড়েছিলাম রক্তকরবীর শেষে টীকায়। 
     
    রঞ্জনবাবু, আমি শারদা মণ্ডল - @ পাকশালার ....
  • Ranjan Roy | ০১ জুন ২০২২ ০১:২৪508333
  • দীপ 
     রেগে যাচ্ছেন কেন?
     ১  এই শ্লোকটি এবং তার স্বামী জগদীশ্বরানন্দের টীকা দেখুন।
    শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ,
    স্বভাবনিয়তং কর্ম কুর্বন্নাপ্নোতি কিল্লবিষম্‌।। (১৮/৪৭)
     
    অতএব , স্বীয় বর্ণ ও আশ্রমবিহিত ধর্ম অঙ্গহীন ভাবে অনুষ্ঠিত হইলেও সম্যগ রূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা শ্রেয়। কারণ, স্বভাবনিয়ত কর্ম করিলে মানুষ পাপভাগী হয় না।(স্বামী জগদীশ্বরানন্দ)
     দেখতেই পাচ্ছেন, আপনি শূদ্র হলে যদি সেবা ভাল করে করতে না পারেন, অথচ অধ্যাপনকার্যে দক্ষ,তাহলেও আপনার অধ্যাপনা না করে আপনার জাতি ধর্ম সেবা করাই উচিত। আবার শূদ্র যাতে ব্রাহ্মণের কাজ না করে তার জন্য পাপের ভাগী হবার ভয়ও দেখানো হল। দেখতেই পাচ্ছেন -- স্বহাবজ মানে এখানে মানুষ জন্মসূত্রে যে বৈশিষ্ট্য পায় তার কথাই বলা হচ্ছে।
     বাল্মীকি রামায়ণে শূদ্রক তপস্বী হত্যার এপিসোড দেখুন।
    জনৈক ব্রাহ্মণ সন্তান অকালে মারা গেলে সবাই রামকে বললেন --দেখ, তোমার রাজ্যে কোন অনাসৃষ্টি ঘটছে। রাম গিয়ে দেখলেন একজন তপস্বী কঠিন তপস্যা করছে।  জিজ্ঞেস করে রাম জানতে পারলেন সেই তপস্বী শূদ্র জাতির। তখন রাম খড়্গ দিয়ে তার মাথা কেটে ফেললেন। অমনই ব্রাহ্মণ সন্তান বেঁচে উঠল এবং আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি হল।
    একলব্যের বুড়ো আঙুল কেটে ফেলার এপিসোড মনে করুন। ক্ষত্রিয় না হয়ে ক্ষাত্রবিদ্যা শেখার শাস্তি!
     
     
     
  • Ranjan Roy | ০১ জুন ২০২২ ০২:০০508334
  • দীপ
      এটাও দেখুন।  স্বভাব বা প্রকৃতি একই, 
     প্রকৃতেঃ ( প্রকৃতির, স্বভাবের)  আমি না, জগদীশ্বরানন্দ বলছেন শ্লোক ৩/৩৩।
     
    এবার সংস্কৃত টাইপ না করে সোজা ওনার বাংলা অর্থ তুলে দিচ্ছি। 
    "জ্ঞানীও স্বীয় প্রকৃতির অনুরূপ কার্য করেন, অজ্ঞের কি কথা"? 
    এবার উনি শংকরাচার্যের ভাষ্য অনুসরণ করে 'প্রকৃতি' মানে বোঝাচ্ছেনঃ
    "বর্তমান জন্মের আদিতে অভিব্যক্ত পূর্বজন্মকৃত ধর্মাধর্মাদির সংস্কারই প্রকৃতি"। 
    অর্থাৎ ওই প্রকৃতি বা স্বভাব জন্মসূত্রেই নির্ধারিত হয়। তাই ব্রাহ্মণের ছেলের উপনয়ন হয়, আমার হয় না। 
    এবার দেখুন দুটো শ্লোক পরে কী বলা হচ্ছে।
    "শ্রেয়ান স্বধর্মো বিগুণঃ পরধর্মাৎ স্বনুষ্ঠিতাৎ।
    স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়ঃ পরধর্মো ভয়াবহঃ।। ৩/৩৫
    "স্বধর্মের অনুষ্ঠান দোষযুক্ত হইলেও উত্তমরূপে অনুষ্ঠিত পরধর্ম অপেক্ষা উৎকৃষ্ট। বর্ণাশ্রম বিহিত স্বধর্ম সাধনে নিধনও কল্যাণকর; কিন্তু অন্যের বর্ণাশ্রমোচিত ধর্মের অনুষ্ঠান অধোগতির কারণ বলিয়া বিপজ্জনক"।
    দেখতেই পাচ্ছেন, তৃতীয় ও অষ্টাদশ দুটো অধ্যায়েই ভয় দেখানো হয়েছে। তুমি বাপু বর্ণাশ্রম ধর্ম মেনে চল। ভাল করে পড়াতে না পারলেও যখন ব্রাহ্মণ হয়েছ তখন পড়াতেই থাক। ভাল রান্না করতে জান বলে রাঁধুনি বামুন হতে যেয়ো না।
    আবার মুচির ঘরে জন্মেছ, জুতো সেলাই কর, ভাল করে না পারলেও। খামোকা চণ্ডীপাঠ করতে যেও না।
    কী বললে? তোমার সংস্কৃত উচ্চারণ ভাল? শুনে শুনে শিখেছ? তাতে কি? জাতে মুচি সেটা ভুলে যেও না।
     
  • হীরেন সিংহরায় | ০১ জুন ২০২২ ০২:১২508335
  • কিশোর 
     
    প্রার্থনা করি একদিন আপনার লেখাটি স্কুলের পাঠ্যপুস্তক তালিকার অন্তর্ভুক্ত হবে ।  আমি স্কুলে ইতিহাসের কিছুই শিখি নি, শেখানো হয় নি । সুযোগ দিচ্ছেন এখন। আপনার জয় হোক । 
  • Ranjan Roy | ০১ জুন ২০২২ ০২:২৯508336
  • দীপ,
    আপনি বলছেনঃ"
    "আর মনুসংহিতা ছাড়াও আরো অনেক স্মৃতিশাস্ত্র আছে, অত‌এব ভারতীয় সমাজ কখনোই মনুসংহিতা কে ধ্রুবসত্য জ্ঞান করেনি। আর পূর্বভারতের সমাজে (বাংলা, আসাম, ত্রিপুরা) মনুসংহিতা র চেয়ে পুরাণ ও তন্ত্রের প্রভাব অনেক বেশি। অর্থাৎ ভারতীয় সমাজ কোনোদিনই মনুসংহিতাকে ধ্রুবসত্যরূপে গ্রহণ করেনি।
    আর দার্শনিকের কাছে স্মৃতিশাস্ত্রের চেয়ে শ্রুতিশাস্ত্রের গুরুত্ব অনেক বেশি"।
     
    --উঁহু, আমরা এখানে শাস্ত্রের কী বক্তব্য সেটা টেক্সট ধরে ধরে দেখার চেষ্টা করছি। অনেক সংহিতা (যাজ্ঞবল্ক্য পরাশর গৌতম)  ইত্যাদি আছে বটে কিন্তু মনুসঙ্ঘিতাকেই শ্রেষ্ঠ আসন দেয়া হয়। 
    শংকরাচার্যের মত দার্শনিকও বার বার মনুস্মৃতিকেই রেফারেন্স ধরছেন। দার্শনিক আলোচনাতেও উপনিষদ এবং মনুস্মৃতি বার বার এসেছে। মেটাফিজিক্স চর্চায় উপনিষদ (শ্রুতি) এবং প্রয়োগ ও অধিকার প্রশ্নে মনু।
    আমি সোজা শংকরাচার্যের ব্রহ্মসূত্রের ভাষ্য থেকে উদাহরণ দিচ্ছি। অনুবাদ স্বামী বীরেশ্বরানন্দের।
    "purificatory ceremonies like Upanayan etc. are declared to be a necesary condition for the study of all kinds of knowledge or Vidya.; but these are meant only for the higher castes. 1.3.36
     
    "And because of the prohibition in the Smriti of hearing and studying (the  Vedas) and knowing their meaning and performing Vedic rites ( to Sudras, they are not entitled to the knowledge of Brahman. 1.3. 38
    রামানুজাচার্যেরও একই মত।
    এরকম আরও আছে। এছাড়া শূদ্রের বেদপাঠে শারীরিক শাস্তির কথাও শংকর এই ব্রহ্মসূত্রেই বলেছেন এবং এ'ব্যাপারে মনুকে অথরিটি মেনে।
    বিশ্বাস না হলে কাল আবার কোট করব। আপাততঃ ঘুমের দেশে যাই।
  • Ranjan Roy | ০১ জুন ২০২২ ০২:৩২508337
  • সারা মান,
       বুঝতে পেরেছি, শারদা মণ্ডলের শর্টকাট! :))
    ভালো থাকুন।
    হীরেনবাবুর সঙ্গে গলা মেলালাম।
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন