"অমর-আকবর-অ্যান্থনি" ছবিতে অমিতাভ বচ্চনের চরিত্রের নাম ছিল অ্যান্থনি গঞ্জালভেজ। শুধু তাই নয় অমিতাভের লিপে গানও ছিল 'মাই নেম ইজ অ্যান্থনি গঞ্জালভেজ'। এই অ্যান্থনি কোন কবির কল্পনা নয়। হিন্দি ছবির এক বিখ্যাত বেহালাবাদক-তথা-অ্যারেঞ্জারের নাম ছিল অ্যান্থনি গঞ্জালভেজ। সুরকার-জুটি লক্ষ্মীকান্ত-পেয়ারেলালের পেয়ারেলাল বেহালা শিখেছিলেন এই অ্যান্থনির কাছে। শোনা যায় রাহুল দেব বর্মনও কিছুদিন অ্যান্থনির ছাত্র ছিলেন। "মাই নেম ইজ অ্যান্থনি গঞ্জালভেজ" গানটি পেয়ারেলালের গুরুদক্ষিণা বলা যেতে পারে।
সলিল চৌধুরী যখন 'দো বিঘা জমিন'-এর চিত্রনাট্য নিয়ে বম্বেতে যান বিমল রায়ের সঙ্গে কাজ করার জন্যে, তখন 'গাঁয়ের বধূ', 'রানার', 'পাল্কির গান' ইত্যাদি সলিল সুর করে ফেলেছেন। কিন্তু নিজেই বলেছেন যে তখনও তিনি বিলিতি সঙ্গীতের গ্রামার, যথা পলিফোনি বা হার্মনির কিছুই জানতেন না। ছেলেবেলা থেকে বিদেশী সঙ্গীত শুনে কান তৈরী হয়েছিল, কিন্তু গ্রামার মেনে গানের হার্মনি তৈরী করার পথ জানা ছিলনা। অথচ বম্বেতে তদ্দিনে হিন্দি ছবির গানে পশ্চিমি হার্মনির নিয়ম মেনে অ্যারেঞ্জমেন্ট রীতিই হয়ে গেছে। করতেন মূলতঃ গোয়ান মিউজিশিয়ানরা। কাজেই যখন বম্বেতে গিয়ে ছবির কাজের জন্যে গানে অ্যারেঞ্জমেন্টের প্রয়োজন হল, সলিল দ্বারস্থ হলে অ্যান্থনির, যাকে সলিল ব্রিলিয়ান্ট মিউজিশিয়ান বলে আখ্যা দিয়েছেন। দো-বিঘা-জমিন, বিরাজ-বহু, নৌকরি ইত্যাদি ছবিতে সলিলের গানে অনবদ্য অ্যারেঞ্জমেন্ট করলেন অ্যান্থনি গঞ্জালভেজ। সলিল নিজে অ্যারেঞ্জমেন্ট করতে জানতেন না বটে, কিন্তু বিদেশী-সঙ্গীতে তৈরী কানে অ্যারেঞ্জমেন্টের ভালমন্দ বিচারের ক্ষমতা ছিল প্রখর। তাই গানের সঙ্গে অ্যারেঞ্জমেন্ট উৎরে গেল দুড়দাড় করে।
তদ্দিনে বছর দুয়েক হয়ে গেছে বম্বেতে সলিলের। এরকম সময়ে মেহবুব ফিল্মের বিখ্যাত ডিরেকটর-প্রোডিউসার মেহবুব খান 'আওয়াজ' ছবির জন্যে পুত্রসম সলিলকে বরাত দিলেন মিউজিক করতে। আর সলিলের মিউজিক মানেই অ্যান্থনির অ্যারেঞ্জমেন্ট। সুর তৈরির কাজা শুরুর প্রে মাঝেমাঝে সলিল অ্যান্থনির কাছে অ্যারেঞ্জমেন্টের কুশল জানতে চাইলে অ্যান্থনি আশ্বাস দেন, ও নিয়ে ভাবতে হবে না দাদা, আপনি আমার কাজ জানেনই তো। প্রথম গান রেকর্ডিঙের দিন এসে গেল। লতা আর হেমন্তর ডুয়েট। স্টুডিওয় কলাকুশলীরা এসেছেন। অ্যান্থনি আছেন। সলিল আছেন। হেমন্ত-লতাও এসে গেছেন। আছেন মেহবুব খানও। রিহার্সাল শুরু হয়েছে। সলিল বলছেন, "আমি শুনে স্তম্ভিত হয়ে যাচ্ছি। এ কী অ্যারেঞ্জমেন্ট করেছে? সম্পূর্ণ একটা অ্যাটোনাল অ্যারেঞ্জমেন্ট। গানের সঙ্গে একেবারেই যাচ্ছে না। আমার আর কিছু না থাক, কানটা তো আছে। তাতে বুঝতে পারছি এ একেবারেই যাচ্ছে না। হেমন্তদা বলছে, 'সলিল, এ কী হচ্ছে?' লতাও জিগেস করছে, "ইয়ে সব কেয়া হো রহা হ্যায় দাদা?" এদিকে ভায়োলিনিস্টরা সব হাসাহাসি করছে। আমাকে দেখিয়ে বলছে, 'ইয়ে মিউজিক ডাইরেকটর হোনে আয়া।' এয়ার-কন্ডিশনড স্টুডিওতে বসে আমি দরদর করে ঘামছি, কান-মাথা ঝাঁ-ঝাঁ করছে অপমানে। আর পারলাম না। আমি মেহবুব খাঁকে বললাম আমি প্যাক আপ করছি। আর অ্যান্থনিকে গিয়ে বললাম, 'অ্যান্থনি, গুডবাই। আমার ঘাড়ে বন্দুক রেখে তোমাকে আর এক্সপেরিমেন্ট করতে দেবনা। তোমার এক্সপেরিমেন্ট অন্য কারুর ওপর দিয়ে কর। যদি নিজে অ্যারেঞ্জ করতে পারি তো করব, নইলে কাজ ছেড়ে দেব।'" এই ঘটনার পর অ্যান্থনির ক্যাম্পের প্রায় কুড়িজন মিউজিশিয়ান সলিলকে সম্পূর্ণ বয়কট করেছিলেন।
সেদিনই সলিল আন্ধেরির বাড়িতে একটা পিয়ানো ভাড়া করে আনলেন। আর কিনলেন বিলিতি মিউজিকের বই। থিওরির বই, স্কোরের বই। সলিল ছেলেবেলায় পিয়ানো বাজাতে জানতেন, যদিও একেবারে মেঠো পদ্ধতিতে, স্টাফ নোটেশন পড়তে শিখেছিলেন। সেটা মনে ছিল। সলিল বলেছেন যে প্রায় হাজার টাকার বই কিনেছিলেন। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি হাজার টাকায় কত বই হবে, আন্দাজ করতে পারেন? জল মেশানো ভেবে নিয়ে যদি ধরি পাঁচশো টাকার বই কিনেছিলেন, পঞ্চাশের দশকে সেও বহু বই। সলিল সব কাজ ছেড়ে দিলেন। যা টাকা জমেছিল তা'তে সলিলের চলে যাবে। বলছেন পরের দু বছর দিনে চোদ্দ থেকে ষোল ঘন্টা পিয়ানোর সামনে বই নিয়ে বসে থাকতেন। দু বছর পরে যে সলিল বেরোলেন তাকে সারা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রি পরবর্তীতে হার্মনির গুরু মেনে এসেছে। পরে বম্বের অন্যান্য ডাকসাইটে অ্যারেঞ্জার, যথা সিবাস্টিয়ান প্রমুখ, সলিলের কাছে এসে জিগেস করতেন, দাদা এখানে কী কর্ড হবে বুঝতে পারছি না। ভি বালসারার মতন লোক সলিলকে মিউজিকাল প্রফেট বলে মানতেন। সলিল অবশ্য ন'দশ বছর থেকেই পিয়ানো বাজাচ্ছেন। কিন্তু এর পরে ওনার পিয়ানো বাজানোয় এমনই প্রফিশয়েন্সি হল - শুধু ফিঙ্গারিং-ই নয়, তার সঙ্গে নিজের সাঙ্গীতিক শিক্ষা লাগিয়ে হার্মনি প্রয়োগ - যে একসময় দেবব্রত বিশ্বাস যখন বম্বে সলিলের বাড়িতে অতিথি হয়ে থেকে ঘরোয়াভাবে ড্রইংরুমে গলা ছেড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাইতেন আর সলিল পিয়ানোয় তার সঙ্গত করতেন, তখন নাকি নীচে লোক জমে যেত।
আর সেই অ্যান্থনি? অ্যান্থনি এরপরে বম্বেতে সিম্ফনি অর্কেস্ট্রা অফ ইন্ডিয়া তৈরি করেন। তারও বছর কয়েক পরে ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রি ছেড়ে সিরাকিউজ ইউনিভার্সিটির একটা গ্রান্ট নিয়ে মার্কিন মুলুকে পাড়ি দেন। সলিল যদিও বলেছেন অ্যান্থনি বস্টন ফিলহার্মোনিকে বাজাতেন, আমি সে সম্বন্ধে তথ্য খুঁজে পাইনি। অবশ্য খুব যে খুঁজেছি তাও নয়। এর সঙ্গে অ্যান্থনি সিম্ফনিও লিখতে শুরু করেন। সলিল বলেছেন, ওই ঘটনার পরে অ্যান্থনির সলিলের ওপর শ্রদ্ধা এত বেড়ে গেছিল যে যখনই অ্যামেরিকা থেকে দেশে ফিরত, নিয়ম করে সলিলের সঙ্গে একবার দেখা করত। এর অনেক পরে অ্যান্থনি দেশে ফিরে গোয়ায় নিজের গাঁইয়ে ফিরে গানবাজনার চর্চা নিয়েই শেষজীবন কাটিয়ে ২০১২ সালে পৃথিবীর মায়া কাটান।
এসব গল্পকথা খুঁটে খুঁটে জোগাড় করলেও, মূল কাহিনীটা পেয়েছি কবীর সুমনের সঙ্গে সলিলের পাঁচ পার্টে (আসলে ছ' পার্টে) একটা কথোপকথন যে ইউ টিউবে আছে তার শেষ পর্বে। এতসব গপ্পোকথা পরে যদি কেউ বিলিতি হার্মনি, কর্ড, কাউন্টার-পয়েন্ট ইত্যাদি নিয়ে হাল্কা ফান্ডা করতে চান আর হাতে ঘন্টাখানেক সময় থাকে তাহলে নিচের ক্লিপটা অবশ্যই দেখবেন। আমি বছরের পর বছর কসরৎ করে ও খুঁটে খুঁটে যে জিনিস আধা শিখে ভয়ংকরী বিদ্যা অর্জন করেছি, সলিল একঘন্টায় তা শিখিয়ে দিয়েছেন, বিশেষতঃ কাউন্টারপয়েন্ট ব্যাপারটা। তবে সঙ্গীত তো ফলিত বিদ্যা, অল্প বিস্তর কোন একটা বাজনা না বাজাতে পারলে বা গাইতে না পারলে বোঝা একটু শক্ত হতে পারে, এ বলে রাখলাম।
Videoটিতে 11:43 এ উল্লিখিত Igor Stravinskyর রচনাটির নাম The Four Seasons নয়, ওটির The Rite of Spring (বসন্তোৎসব) নামক ballet এবং orchestral রচনা। এটি Stravinsky1913 সনে রচনা করেন এবং 29 May 1913 এটি জনসম্মুখে পরিবেশিত হয়, এবং পরিবেশনের সময় নানারূপ দাঙ্গা হাঙ্গামা ঘটে। বিস্তারিত বিবরণ নিম্নে প্রদত্ত URLএ পাওয়া যাবে।
https://www.theguardian.com/stage/2013/apr/12/rite-of-spring-rude-awakening
The Four Seasons Antonio Vivaldi দ্বারা 1717 নাগাদ রচিত চারটি concertoর সমষ্টি।