পার্ক সার্কাসে গিয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়ালেই আমার মনে পড়ে রক্তবীজের কাহিনী। আকাশ-চাটা আগুন-চিতায় সহমরণে মরতে যাওয়া মায়ের অসহ্য যন্ত্রণার চিৎকারের সঙ্গে সঙ্গে জরায়ু উন্মোচনে তার জন্ম। একফোঁটা রক্ত যেখানে পড়ে সেখানেই জন্ম হয় রক্তবীজের। এক থেকে একশ, হাজার, লক্ষ -- লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে তরুণাসুর রক্তবীজের সংখ্যা।
শুরু হয়েছিল শাহিন বাগে। নিজের দেশের মানুষের ওপর শাসকের নামিয়ে আনা পৈশাচিক অত্যাচার, নিজেদের অগ্নিসংযোগ, লুটপাট, জামিয়ার শান্তিপূর্ণ আন্দোলনে পিশাচবাহিনী লেলিয়ে দেওয়া -- প্রতিবাদে মর্মান্তিক যন্ত্রণায় দিল্লিতে বড় রাস্তার মোড়ে বসে পড়েছিলেন সন্তান নিয়ে কিছু মা। সেই শান্তিপূর্ণ আন্দোলন ছড়াচ্ছে রক্তবীজের মতোই। যতদূর যাচ্ছে শঙখধ্বনির মতো আজাদির শ্লোগান, ততোদূরই যেন বিস্তৃত হচ্ছে অগণিত মানুষের এই আন্দোলন। ইন্দোর, ভূপাল, এলাহাবাদ, বেরিলি, কানপুর, পাটনা ছাড়াও দিল্লিতে তিনটি, পশ্চিমবঙ্গে দুটি ধর্ণাস্থল। কফিনে শেষ পেরেক মারার মতোই এবার শুরু হয়েছে গুজরাতের আমেদাবাদে।
সেই গুজরাত, যেখানে সংখ্যাগুরুর আধিপত্যবাদকে কতটা টানা যায়, তার পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু। যেখানে মুসলমানদের মাজা ভেঙে দেওয়া গেছে, আর কখনো চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারবে না ওরা সেই আনন্দে আঠারো বছর পরেও আটখানা হয়ে থাকে কিছু মানুষ।
ফিরে আসি পার্ক সার্কাসে। গিয়ে বসলাম যেখানে সেখানে ঘোমটা-হিজাব, সব মিলে মিশে আজাদির শ্লোগানে ফেটে পড়ছে থেকে থেকে - আতঙ্কবাদ সে আজাদি, ছুয়াছুঁত সে আজাদি। তার মধ্যেও কিন্তু সমস্ত নারীমুখেই আশংকা আর দুর্ভাবনা মাখামাখি।
ডানপাশের মানুষটির কাঁধে আলতো হাত রাখতে যে মুখটি আমার দিকে ঘুরলো তাতে অনেক আঁকিবুকি, যেন প্রাচীন বটগাছের ঝুড়ি।
-হিয়া পে কেয়া চল রহা হ্যায় আম্মি ?
আমার প্রশ্ন শুনে নিষ্প্রভ চোখদুটোতে যেন হাজার সামাদান জ্বলে উঠল,
-হামলোগ সব এন্নার্সি কা খিলাফ লড় রহি হুঁ।
ব্যস, সেই যে পাহাড়ি ঝোরার মুখ খুলে গেল, অনর্গল অনর্গল শুনে গেলাম বাপ, দাদা,পরদাদা, তার পরদাদার আগের পুরুষদের নাম। কতোদিন আগে, কে জানে বাবরের সঙ্গে সমরখন্দ থেকেই কিনা এসেছিলেন যে উন্নতদেহী খড়্গনাসা পুরুষটি, ভারতবর্ষ তাকে টেনেছিলো চুম্বকের মতো। আর ফিরে যাওয়া হয়নি। কতো পুরুষ আগের কথা কেউ বলতে পারবে না, দিল্লিকে ঘিরে থাকা সব পাহাড় তখন অটুট ছিলো। পরের প্রজন্ম হয়তো কোনো কারণে ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে বঙ্গাল মুলুক। আজ তারই বংশজাকে কিনা বলা হচ্ছে কাগজ দেখাতে ! প্রমাণ করতে যে সে এদেশের নাগরিক। এতো সাহস হয় কোথা থেকে !
-মেরা পরদাদা কে পরদাদা যব বঙ্গাল মে আয়ে থে তব কাঁহা থে মোদি শা ? আব্বাহুজুর যব সরফোরিশি কে তমান্না দিল মে ছুপা কর গান্ধীবাবাকে ভলান্টিয়ার বনে থে, তব কাঁহা থি ইয়ে এন্নারসি কা সওয়াল ?
সুর্মা পরা চোখদুটো থেকে আগুন ছুটছিল। সাদা আলোয় বিভ্রম হয়, আমি কি সিপাহি বিদ্রোহের সময়ে চলে গেছি ! আমার পাশে বসে কি আওধের দুখিনি কিন্তু গর্বিত বেগমসাহেবা ?
ভুল ভাঙে উত্তেজনায় তার গায়ের শালের এক কোণা মাটিতে লুটিয়ে পড়তে। তুলে গায়ে জড়িয়ে দিতে গিয়ে দেখি পুরনো পাতলা সস্তা চাদর, রিপু করার মস্ত চিনহ তাতে। গরীব কিনতু স্বাভিমানী এক প্রাচীন নারী!
আমার বাঁ পাশে বসা মুখটি কচি। বৃদ্ধার ক্রোধের প্রকাশে যেন একটু বিব্রত। পরিষ্কার বাংলা উচ্চারণে সে হাসিমুখে আমাকে বলে, 'আমার দাদী। রোজ দাদীকে নিয়ে আসতে হয়। কিছুতেই ঘরে থাকবে না। বয়স হয়েছে অনেক, একাও ছেড়ে দেওয়া যায় না। আমারও আসতে খুব ভালো লাগে।'
তার সঙ্গে কথা এগোবার আগেই মহা হৈ হৈ। কান্নান গোপিনাথন এলেন। প্রাক্তন আই এ এস, কাশ্মীরের কারণে যিনি পদত্যাগ ক'রে এখন সারা দেশ ঘুরে বেড়াচ্ছেন। উনি আসবার আগেই মাথায় হলুদ হিজাব পরা একটি অল্পবয়সী মেয়ে মাইকে বলছিলো, কান্নান সাহেব কো জানতে হ্যায় না আপলোগ ? এনার্সির বিরুদ্ধে লড়নেওয়ালাদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন ব'লে ওকে ইউপি পুলিশ লখনৌতে সুলতানগঞ্জ থানায় গতমাসে আটকেছিল। থানায় বসে বেওকুফ উর্দিবালোকে কান্নানসাহেব এমন বোঝালেন যে পুলিশরাই এনার্সি, সিএএ-র সাপোর্টার বনে গেল।
শুনে বেজায় হাততালি। কাচের চুড়ির রিনিঠিনি তাতে মিলে যেতে পরিষ্কার দেখলাম আধো অন্ধকারে বিরাট ব্যানারে বাবাসাহেবের মুখও হাসছে। নিজের সন্তানের সমঝদারিতে স্নেহময় পিতার মুখে যেমন প্রশ্রয়ের হাসি থাকে, তেমনি।
পাভেল এসে বললো, প্রতিভাদি, আসমতদির সঙ্গে দেখা না ক'রে যেও না। উনি আরো কয়েকজনের সঙ্গে মিলে এখানে মেয়েদের একাট্টা করেছেন।
আসমতের গলা ভেঙে গেছে, কপালে এই শীতেও ঘাম চকচক করছে, তবু কী উজ্জ্বল মুখ! অপরিসীম পরিশ্রমের পর সে তখুনি বসতে যাচ্ছিলো একটা প্লাস্টিক চেয়ারে, স্বাভাবিক ভদ্রতায় আবার উঠে দাঁড়িয়ে আমায় জড়িয়ে ধরলো।
- এই যে এখানে এতো মেয়ে জড়ো হয়েছে দিদি, এরা সবাই খুব খুব সাধারণ। কিন্তু এরা প্রতিজ্ঞা করেছে এসপার কি ওস্পার। চালাকি কি কেউ বোঝে না ! এনার্সির জোরে মুসলমানকে বে-ঘর বিদেশী নাম দেবে, তারপর দেশ ছাড়া করবে। সিএএ তে যে শরণার্থী হয়ে আবেদন করবে সেটুকু চান্সও দেবে না। মুসলমানের ওপর এতো রাগ কেন বলতে পারেন !
ওড়নার প্রান্ত দিয়ে পরিশ্রান্ত কপাল মোছে আসমত, তারপর বলে, হিন্দুরাই কি রেহাই পাবে বলুন আপনি ! আসামে তো বারো লক্ষই হিন্দু। সবাইকে শরণার্থী স্ট্যটাস দিতে পারবে ? পিলভিতের খবর শুনেছেন তো ?
আমার হাতে হাত জড়িয়েই সে বলে,
- এতো ভেদভাবের কোনো দরকার ছিলো ? আমরা তো কতোকাল থেকে পাশাপাশি আছি। এই দেশকে দুজনেই নিজের বলে জেনেছি। আজ সব উল্টে যাবে দিদি ? তা আমরা মেয়েরাই হতে দেব না। কিছুতেই না। আগামীকাল মুখ্যমন্ত্রী ডেকেছেন, দেখা যাক কী হয় !
অপ্রতুল ছোট ত্রিপল এসেছে। কিন্ত দেখে এসেছি ভোররাতের ছপছপে কুয়াশার জলে খোলা আকাশের নীচে কম্বল মুড়ি দেওয়া কিছু পুরুষ আর শুধু মাথার ওপর ছাদের ভরসায় চারদিক খোলা সিমেন্টের মেঝেতে অর্ধজাগ্রত কিছু নারী।
মানুষ তবু অদম্য। এতোদিন পাশের মসজিদের একটিমাত্র টয়লেট ব্যবহার করছেন এতো মহিলারা। সহনাগরিকেরা পাঠাচ্ছেন জলের বোতল, টুকিটাকি খাবার। মনে হলো, আসমতকে বলি হ্যান্ডমাইকটা পাল্টাবার কথা। ওতে যেটুকু শব্দ হয় তা প্রায়ই হারিয়ে যায় সমুদ্রগর্জনের মতো স্লোগানে। কিন্তু বড় সঙ্কোচ হলো সাহায্যের কথা বলতে। এতো প্রতিবন্ধকতা যারা দুহাতে ঠেলে সরাতে পারছে, বাকীটুকু তারা নিজেরাই করতে পারবে। আজ নাকি নতুন মাইক লেগেছে সরকারি বদান্যতায়। শুভ লক্ষণ। মানুষের আন্দোলন জয়যুক্ত হোক। রক্তবীজকে দেব দেবীরা যেমন ছলাকলায় কাবু ক'রে হত্যা করেছিল, দেবী কালিকা ভয়াবহ মুখব্যাদান ক'রে চেটে খেয়েছিল তরুণ রক্তবীজের ক্ষত থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তধারা, তেমনটি যেন না হয় এই আন্দোলনের সঙ্গে।
ফেরার সময় আধো অন্ধকারে বিশাল এবং কুখ্যাত পার্ক সার্কাস ময়দানের সবটুকু বিস্তার একা হেঁটে পার হতে একটুও ভয় লাগেনি। আন্দোলনস্থলের থেকে ভেসে আসা একটা সদর্থক উষ্ণ অনুভূতি ঐ কুয়াশার মতোই এ তল্লাটকে যেন আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রেখেছিলো। নিজেকেই নিজে বলছিলাম আসতে হবে, আবার আসতে হবেই।
পতন অভ্যুদয় বন্ধুর পন্থা যুগ যুগ ধাবিত যাত্রী !
চেতনাকে, মর্মকে একদম ঝাঁকিয়ে দেওয়া লেখা। এই ছোট্ট শহরেও সর্বভারতীয় লড়াইর আঁচ এসে পড়ছে। ছবির মতো পরিষ্কার আর সিনেমার মত জীবন্ত আপনার কথা বলার মুন্সিয়ানা।
"এতো ভেদভাবের কোনো দরকার ছিলো ? আমরা তো কতোকাল থেকে পাশাপাশি আছি। এই দেশকে দুজনেই নিজের বলে জেনেছি। আজ সব উল্টে যাবে দিদি ? তা আমরা মেয়েরাই হতে দেব না।" --- এইসব মানবীদের লড়াকু প্রত্যায়কে স্যালুট।
পাশে আছি অর্ধেক আকাশ।
"হিয়া পে কেয়া চল রহা হ্যায় আম্মি ?
আমার প্রশ্ন শুনে নিষ্প্রভ চোখদুটোতে যেন হাজার সামাদান জ্বলে উঠল,
-হামলোগ সব এন্নার্সি কা খিলাফ লড় রহি হুঁ। "
দাবানল ধীরে ধীরে ছড়াচ্ছে। মোদি শাহীর মসনদ পুড়িয়ে সে ক্ষান্ত হবে।
ঢাকা থেকে সংহতি।