অচিন্ত্য প্রান্তর আমার অত্যন্ত স্নেহভাজন একজন মানুষ। তার মার্জিত ব্যবহার, পরিশীলিত বাচন, তার কন্ঠে রবীন্দ্রনাথের গান আমাকে মুগ্ধ করে।
যদি সে সম্পূর্ণ অচেনা কেউ হতো, রূঢ় এবং শিক্ষাহীন, তাহলেও আজ বিমানবন্দরে সিআই এসএফ যে ভাবে তাকে পরীক্ষা করেছে তার আপত্তি সত্ত্বেও, তার তীব্র প্রতিবাদ করতাম। কারণ লিঙ্গ পরিচিতি যে কোন মানুষের একেবারে ভেতরের উপলব্ধির বিষয়, তার একান্ত মানসিক এবং অনুভূতির ব্যাপার।
আসলে আমরা যারা কেবল নিজেদের স্বাভাবিক ব'লে জাহির করি, গতানুগতিকতার বাইরে সবাইকে সবকিছুকে অস্বাভাবিক ব'লে দেগে দিই, তাদের পক্ষে বোঝা মুশকিল, কেউ যদি মনেপ্রাণে নারী হয়, তার শরীরে অনিচ্ছায় পরুষ পুরুষ হাতের স্পর্শ কতোটা বিবমিষা জাগায় ! অনিন্দ্য প্রতিবাদ জানিয়েছে, মহিলা রক্ষীর দ্বারা পরীক্ষা করবার আর্জি জানিয়েছে, কিন্তু বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ তার কথায় কর্ণপাত করেনি। ধস্ত মন নিয়ে সে অফিসের কাজে দিল্লিতে নেমেছে।
অথচ এই মানুষগুলো কিন্তু মনসর্বস্ব। এদের সমস্তটাই শরীরের সঙ্গে মনের একটা ভয়ংকর লড়াইয়ের কাহিনী। জীবনের অনেকটা সময় কিন্তু এদের সেই মনটাকেই প্রতি পদে অস্বীকার ক'রে চলতে হয়। মেয়েদের মতো পোশাক আশাক পরতে চায় মন, কেউ তা করতে দেবে না। জোর ক'রে চুল কেটে দেবে। মেয়েলি ভঙ্গিতে কথা বললে তীব্র ধিক্কার দেবে,'কী মেয়ে মেয়ে রে তুই ! লজ্জায় মাথা নীচু হয়ে যায় তোর জন্য !' আর বিপরীত মানুষের প্রেমে পড়লে শূলে চড়াবে। বিবাহ, সন্তান, সংসার সবই এদের কাছে মরিচীকা।
কেন, কেন এই চিন্তার দৈন্য আমাদের ? বিষ্ণুর মোহিনী রূপে আমাদের আপত্তি নেই, একই শরীরে নারীপুরুষ অর্ধনারীশ্বর আমাদের পূজ্য। অথচ কল্পনার বাস্তবায়নে আমাদের বড়ই আপত্তি। আমাদের কাছে সব রূপান্তরকামীই 'হিজড়া', পৃথিবীতে সবচেয়ে বিষ-নীল প্রাণী। আমাদের ব্যবহারও সেইরকম, বিমানবন্দরের রক্ষী ব্যতিক্রম হবে কী ক'রে ! রূপান্তরকামীদের মধ্যেকার বিভাজন সম্বন্ধে আমরা ওয়াকিবহাল থাকি নাইই থাকি, মানুষের সঙ্গে মানুষের মতো ব্যবহার করতে কী অসুবিধে ! কেন নিকট আত্মজন থেকে শুরু ক'রে সমাজপতিরা খড়্গহস্ত এদের ওপর ? কেন শৈশবেই গৃহ থেকে বিতাড়িত হতে হয় রূপান্তরকামীর বেশির ভাগকে ? কেন শিক্ষার সুযোগবঞ্চিত থাকে এরা ? যদিও বা স্কুলে ভর্তি হতে পারে, কেন সহপাঠী থেকে শুরু করে সবাই কাছে এরা চক্ষুশূল ? কেন পরিবর্তী জীবনে কোনো সাধারণ পেশায় এদের ঢুকতে দেওয়া হয় না ? শুধু ভিক্ষাবৃত্তি এবং যৌনপেশা কেন এদের জন্য বরাদ্দ ক'রে রাখে ভদ্রজন ? অথচ এই কলকাতা শহরেই কর্পোরেট হাসপাতালে সুনামের সঙ্গে ওটি টেকনিশিয়ানের কাজ করছে রূপান্তরকামী। এই দেশে প্রথম। সব কাজেই সুযোগ পেলে নিজের যোগ্যতা দেখাতে পারবে এই প্রত্যয় এদের প্রত্যেকের আছে।
রাষ্ট্রই বা কম কী ! নতুন ট্রান্সজেন্ডার বিলে রূপান্তরকামীদের ওপর যৌন নির্যাতনের শাস্তি কী আমরা কি তা জানি ? ৬ মাস থেকে সর্বাধিক দু বছরের কারাদণ্ড ! অথচ যে কোন মানুষের থেকে এদের যৌন হেনস্থার সম্ভাবনা কিন্তু সবচেয়ে বেশি। মানুষকে মানুষের মতো বাঁচতে দেবে না ঠিক করেছে রাষ্ট্র, সমাজ এবং ব্যক্তি।
তাই পিঙ্কি প্রামাণিকের চূড়ান্ত হেনস্থা হয় খোদ প্রশাসনের ডেরায়, থানার ভেতরে, আইনশৃঙ্খলা রক্ষার ভারপ্রাপ্ত সেপাই সান্ত্রীর দ্বারা। তাদের তোলা পিঙ্কির নগ্ন শরীরের ছবি সেকেন্ডে ভাইরাল হয়। আমাদের উচ্চ রুচি এবং গভীর চিন্তাধারা আবার প্রমাণিত হয়। পিঙ্কি ছাড়া পায় কেবল তখনই, যখন প্রমাণিত হয় পুরুষের মতো ধর্ষণের ক্ষমতা তার নেই। কিন্তু তার সম্মান, কেরিয়ার ব্যক্তিগত পরিসরে এসবের ক্ষতি কী পূরণ হয়েছে ?
তবু তো মানুষ বাঁচতে চায়। সসম্মানে মাথা উঁচু ক'রে বাঁচতে চায়। সঠিক আইন প্রণয়ন হোক। সমাজপতিদের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাক। আমরা সন্তানকে যখন লিঙ্গের ফারাক শেখাব, নারী পুরুষ ভেদ শেখাব তখন যেন আরেকরকম মানুষের কথাও শেখাই। একমাত্র তাহলেই পৃথিবী এক বড় সংখ্যক মানুষের কাছে বাসযোগ্য হবে। সেই নতুন পাঠের ভাষা, ব্যাকরণ কী হবে তা নিয়ে ভাবনা চিন্তা এখনই শুরু হোক।
বিশেষ দ্রষ্টব্য -- অচিন্ত্য প্রান্তরের পোস্টে অসংবেদী মন্তব্যগুলি।
দাড়ি ও শাড়ি একটি প্রচণ্ড প্রতিবাদ। শাবাশ অচিন্ত্য প্রান্তর!