হাঙ্গামা / বিশেষ্য; ফার্সি / আলোড়ন, দাঙ্গা, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতা।
বাঙালিরা, বিশেষ করে শহর কলকাতার উচ্চ ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত, শিক্ষিত বাঙালি নিজেকে উদার এবং সহিষ্ণু বলে গর্ব অনুভব করে। সেটা খুব একটা মিথ্যেও নয়, কারণ অন্য জাতে বা ধর্মে বিয়ে করার মতো যেসব কাণ্ড ভারতের অন্যান্য জায়গায়, বিশেষ করে তথাকথিত গোবলয়ের মতো জায়গায় হলে গোলযোগের চূড়ান্ত হত, সেসবও কলকাতায় হামেশাই হয়ে থাকে। এই উদারতার অনেকটাই আসলে বাঙালি নবজাগরণের ফল, যার নেতৃত্বে ছিলেন ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর এবং রাজা রামমোহন রায়ের মতো ব্যক্তিত্বরা। স্বাধীনতা-উত্তর যুগেও বিশেষ করে ৩৪ বছরের নাস্তিক, কমিউনিস্ট শাসনও রাজনীতিতে জাত-পাত যাতে না ঢোকে তার শক্তপোক্ত বন্দোবস্ত করেছিল। কিন্তু, বলাবাহুল্য, অবস্থা চিরকালই এমন ছিল না। ঊনবিংশ শতকের শুরুতে, কলকাতা যখন টানা পশ্চিমি প্রভাবের আওতায়, তখনও, হিন্দু সমাজ, এমনকি কলকাতার হিন্দু সম্প্রদায়ও ছিল ভয়ংকরভাবে রক্ষণশীল। আর এই সময়েই ঘটেছিল শহরের বৃহত্তম কেচ্ছাটি। কালীপ্রসাদী হাঙ্গামা নামে কুখ্যাত এই কেলেঙ্কারিটির জল গড়িয়ে গিয়েছিল বহুদূর। এতে জড়িয়ে গিয়েছিল শহরের অনেক নামীদামী পরিবার, জল গড়িয়েছিল নানা ধর্মের উপাসনাস্থলে, যার মধ্যে কলকাতার বিখ্যাত হিন্দু মন্দির কালীঘাটও ছিল।
পরিবারসমূহ
বাংলার রাজা আদিসুরের আমন্ত্রণে দশম শতকে পুরুষোত্তম দত্ত কনৌজ থেকে বাংলার বালিতে বসতি স্থাপন করেছিলেন। ১২টি প্রজন্ম এবং ৪০০ বছর পার করার পর তাঁর বংশধর তেকড়ি দত্ত বালি থেকে হাওড়ার আন্দুলে গিয়ে বসবাস শুরু করেন। তেকড়ি সম্ভবতঃ ইলিয়াস শাহী রাজত্বের তৃতীয় সুলতান ঘিয়াসুদ্দিন আজাম শাহের কাছ থেকে চৌধুরী খেতাব লাভ করেছিলেন এবং কালক্রমে তাঁর পরিবার আন্দুলের দত্ত চৌধুরী পরিবার বলে পরিচিতি লাভ করে। এই পরিবারের একজন উত্তরপুরুষ, গোবিন্দশরণ দত্ত চৌধুরী, কলকাতার বাদররসা বলে এক জায়গায় বাস করতে শুরু করেন। পরবর্তীকালে তাঁর নামানুযায়ীই এই জায়গার নাম হয় গোবিন্দপুর। সেখান থেকে জগতরাম দত্ত বলে আরেকজন বংশধর, চলে আসেন হাটখোলায়, যা আজকের জোড়াবাগানের কাছাকাছি, এবং এইভাবে হাটখোলার বিখ্যাত দত্ত পরিবার প্রতিষ্ঠিত হয়। আঠারোশ শতকের শেষভাগে, ১৭৮৭ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত, সেই পরিবারের কর্তা ছিলেন মদন মোহন দত্ত।
হাটখোলার মোটামুটি এক মাইল উত্তরপূর্বে চলে গেলে পাওয়া যাবে শোভাবাজার রাজবাড়ি, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন রাজা নবকৃষ্ণ দেব।১৭৫০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের সময়ের এক সাধারণ মুন্সী থেকে কালক্রমে নবকৃষ্ণ হয়ে উঠেছিলেন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সবচেয়ে বিশ্বস্ত স্থানীয় এজেন্ট। তরুণ ও খামখেয়ালী নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে ছলে বলে কৌশলে ক্ষমতাচ্যুত করতে সাহায্য করে সহজেই কোম্পানির আস্থাভাজন হয়ে ওঠেন তিনি। স্বভবতই কোম্পানি এই প্রচেষ্টাকে বিপুলভাবে পুরস্কৃত করে আর নবকৃষ্ণ রাতারাতি অভাবনীয়রকম অর্থবান হয়ে পড়েন। তাঁর প্রাসাদোপম বাড়িতে ঢাকঢোল পিটিয়ে ঘটা করে দুর্গাপূজা পালনের এক প্রথা তিনি শুরু করেন, তার পর থেকে এখন পর্যন্ত এই পুজোই শহরজোড়া মহোৎসবের আকার নিয়েছে। নবকৃষ্ণের পৌত্র, রাধাকান্ত দেব ছিলেন উনিশ শতকে কলকাতার হিন্দু সমাজের এক অন্যতম মাথা। পারিবারিক প্রতিপত্তি ও অর্থের দৌলতে তিনি তৎকালীন ক্ষমতাশালী রক্ষণশীল গোষ্ঠীকে অচিন্ত্যনীয় মাত্রায় প্রভাবিত করতেন।
এই শোভাবাজার রাজবাড়ির সাড়ে নয় মাইল দক্ষিণ পশ্চিমে সাবর্ণ রায়চৌধুরীর নিবাস। যা এখন বেহালা। ষোলোশ' শতকে মুঘল সম্রাট হুমায়ূনের অশ্বারোহী বাহিনীর একজন সদস্য জনৈক পঞ্চানন গঙ্গোপাধ্যায় এক বিশালাকার প্রাসাদ তৈরি করেন হালিশহরে, যা কিনা বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগণার অন্তর্গত। এখান থেকে এই পরিবারটি পুরো দক্ষিণবঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে । ১৬০৮ এ তাঁর বংশধর লক্ষ্মীকান্ত গঙ্গোপাধ্যায় সম্রাট আকবরের বিশ্বস্ত সেনাপ্রধান রাজা মান সিংহের থেকে বিশালাকায় এক ‘জায়গিরদারি’ পান । জায়গিরদারির সাথে এল রায়চৌধুরী খেতাব, যা এখনো তার উত্তরপুরুষেরা ব্যবহার করে আসছেন। ১৭১৭ এ এই পরিবারটিই সুতানুটি, গোবিন্দপুর, আর কলিকাতা গ্রাম তিনটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কে লিখে দেন, যার থেকে আধুনিক কলকাতার সূত্রপাত।
কেচ্ছা
কালীপ্রসাদী হাঙ্গামার ব্যাপারে লেখার সমস্যা হল যে এর কোনো প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ বা প্রাথমিক সূত্র পাওয়া যায় না। যে সব সংবাদ পত্রে এই কেচ্ছার বিবরণ বেরিয়েছিল , যেমন ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্তের সংবাদ প্রভাকর, সেগুলি এখন অমিল। সে সময়ের কোনো লিখিত বিবরণও পাওয়া যায় না। আমাদের তাই নির্ভর করতে হয় প্রাণকৃষ্ণ দত্ত আর রাধারমণ মিত্র এর ওপর। এই দুজনই আবার জায়গায় জায়গায় একেবারেই বিশ্বাসযোগ্য নন এবং এঁরা রিপোর্ট খবরের সূত্র লেখার মতো সাধারণ নিয়মকানুনের ধারও ধারতেননা। প্রাণকৃষ্ণের এরকমই এক ভুল করেন চুড়া্মণি দত্তর ব্যাপারে, যা পরে বার বার উদ্ধৃত হয়েছে অনেকের হাতে। চূড়ামণি দত্তর মৃত্যু নিয়ে লিখতে গিয়ে প্রাণকৃষ্ণ লিখেছিলেন যে কিভাবে মৃত্যুশয্যাতেও তিনি, চুড়ামণি, তাঁর চরম প্রতিদ্বন্দ্বী নবকৃষ্ণকে টেক্কা দেবার জন্য এক নগর সংকীর্তন এর আয়োজন করেন। এই সংকীর্তনের লক্ষ্যই ছিল চূড়ামনির মৃত্যুকে মহিমান্বিত করা এই বলে যে চূড়ামণির দেহরক্ষা হয় গঙ্গার তীরে আর নবকৃষ্ণ মারা যান চার দেওয়ালের ঘরে। এখানে ভুলটি হল এই, যে, প্রাণকৃষ্ণ চূড়ামণিকে কালীপ্রসাদের বাবা বলে বর্ণনা করেন। এই ভুলটি অবশ্য তিনি পরবর্তী সংস্করণে স্বীকার করে নেন। যদিও এটি এই কেচ্ছার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত ঘটনা নয়, তবুও বিষয়টি দুটি তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে। এক, তৎকালীন কলকাতায় অভিজাত সম্প্রদায়ের রেষারেষি কতটা বিদ্বেষপূর্ণ ছিল আর দুই, নবকৃষ্ণের মৃত্যুর তারিখ : ২২শে নভেম্বর ১৭৯৭। তারিখটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ অন্য কোনো প্রামাণ্য নথি থেকে কালীপ্রসাদি হাঙ্গামার সূত্রপাতের সঠিক তারিখ আমরা পাইনা। সম্ভবত ২২শে নভেম্বর ১৭৯৭ থেকে ১৮০১, যে বছর কালীঘাট মন্দিরের নির্মাণ শুরু হয়, এর মধ্যেই কোনো এক সময় ঘটে কালীপ্রসাদি হাঙ্গামা।
কালীপ্রসাদ দত্ত , হাটখোলা দত্ত পরিবারের বংশধর, যদিও বংশলতিকা তাকে হাটখোলা নয়, কালীঘাটের বাসিন্দা বলে পরিচয় দেয়। তিনি মদনমোহন দত্তর জ্ঞাতিভাই। প্রাপ্ত তথ্য থেকে জানা যায় যে কালীপ্রসাদের একজন রক্ষিতা ছিলেন, যার নাম আনার বা আনারো বিবি। কেউ কেউ তাকে মোগল অথবা মুসলমান বলতেন আর কেউ কেউ বলতেন বাঈজী। তিনি মুসলমান ছিলেন তাতে সন্দেহ নেই কিন্তু বাঙালিরা যাকে বাঈজী বলেন, সেরকম তিনি ছিলেন কিনা তা বলা শক্ত। সে সময়ের বাঈজীরা বেশিরভাগই লখনৌ বা উত্তর ভারতের কোনো অঞ্চল থেকে তাদের নাচ গান আদব-কায়দা শিখে বাংলাদেশে আসতেন, আর কলকাতার তৎকালীন বাবুরা নিয়মিতই বাঈজী বাড়ি যেতেন। কিন্তু এখানে যেটা আলাদা, তা হল, কালীপ্রসাদ আরো এক ধাপ এগিয়ে, আনারো কে তার বেলেঘাটার বাড়িতে এনে তোলেন ও তার সাথে থাকতে শুরু করেন । সেখানেই শেষ নয়, তিনি তারপর মুসলিম ঘরানার পোশাক আশাক পরতে শুরু করেন আর তার থেকেও আশ্চর্যজনক ভাবে মুসলিম খাবার দাবারেও আকৃষ্ট হয়ে পড়েন (অর্থাৎ তিনি গরু খেতেন, যা তখন হিন্দু বাঙালিদের মধ্যে ভয়ঙ্কর ভাবে নিষিদ্ধ)।
এই আনারো বিবি ছিলেন কে? খুব বিশদে জানা মুশকিল। ১৮৩৩ এর পাওয়া ওয়াকফ দলিলে আমরা দেখি তার আসল নাম ছিল বিবি ফজলুন্নেসা। খাইরুদ্দিন খানের মেয়ে, মোল্লা হায়াৎ খানের নাতনি। এরা দুজনেই অবিভক্ত বাংলার ২৪ পরগনার জামনগরের বাসিন্দা ছিলেন। যদিও রাধারমণের মতে আনারো বিবির পরিবার লখনৌ থেকে আগত। অসাধারণ রূপসী আনারো বিবির আঞ্জুমান আরা বেগম বলে এক বোন ছিল, আর তিনি শিয়া মুসলমান ছিলেন, এ ছাড়া আর কোনো তথ্যই আমাদের কাছে নেই। এই মুসলমান মহিলার সঙ্গে এক বনেদী হিন্দু পরিবারের অভিজাত পুরুষ বসবাস করছেন, আর পোশাক, খানা পিনা মুসলমানদের মতো করছেন, এই কাণ্ড কলকাতার হিন্দু সমাজে নিন্দার ঝড় তুলে দেয় । এই ‘কেচ্ছা’ বাংলা খবরের কাগজে আত্মপ্রকাশ করে এবং প্রভাবশালী বাঙালিরা কালীপ্রসাদকে বয়কট করার নিদান দেন। ‘গ্যালো, গ্যালো, গ্যালো হিন্দু্যানি’ বলে এক গানও বাঁধা হয়। এর মধ্যে কালীপ্রসাদের মায়ের মৃত্যু না হলে বোধয় এসবে কালীপ্রসাদ চিন্তিত হতেন না । কালীপ্রসাদ যদিও বা নিজের ধর্মের প্রতি যত্নশীল ছিলেন না কিন্তু মায়ের শ্রাদ্ধ তো তাঁকে করতেই হবে! আর শ্রাদ্ধের জন্য চাই ব্রাহ্মণ। এদিকে নবকৃষ্ণের ছেলে, তাঁর উত্তরাধিকারী রাধাকান্ত দেব তখন এক রক্ষণশীল হিন্দু গোষ্ঠীর দলপতি। অনেক ব্রাহ্মণই তখন রাধাকান্ত দেবের মতো কিছু ব্যক্তির দান- ধ্যানের উপর নির্ভরশীল। রাধাকান্ত তখন অপরিসীম প্রতিপত্তিশালী। তিনি হুলিয়া জারি করলেন যে, তার নেকনজরে থাকতে হলে পথভ্রষ্ট কালীপ্রসাদের মায়ের শ্রাদ্ধানুষ্ঠানে যাওয়া একদম মানা।
অতঃকিম?
এদিকে হিন্দুমতে শ্রাদ্ধ না হলে আত্মার স্বর্গলাভ হবে না। এমনকি আজকের দিনেও, অনেক হিন্দু পরিবারে জন্ম নাস্তিকরা, যারা অন্য কোনো ধর্মাচরণ করেন না, তাঁরাও সমাজ সংসারের চাপে বা অন্তরের ডাকে অন্তত শ্রাদ্ধ-রীতিটুকু মেনে চলেন। আর সেই সময়ে, শ্রাদ্ধ না করা তো অভাবনীয়। কিন্তু ব্রাহ্মণ কোথায় ? বেপরোয়া কালীপ্রসাদ সাহায্য চাইলেন ধনী ব্যবসায়ী রামদুলাল সরকারের। অনেক কাল আগে অত্যন্ত দরিদ্র ছোট্ট রামদুলালের ভাগ্যের চাকা ঘুরতে শুরু করে যখন রামদুলালের ঠাকুমা হাটখোলার দত্ত পরিবারের রাঁধুনির কাজ পান। বালক রামদুলালের সুপ্ত প্রতিভা চোখে পড়ে যায় মদনমোহনের। রামদুলালের পড়াশোনা ও চাকরির বন্দোবস্ত হয়। তীব্র বুদ্দ্বিমত্তা আর কঠোর পরিশ্রম কাজে লাগিয়ে রামদুলাল খুব তাড়াতাড়ি নিজস্ব ব্যবসায় উন্নতি করে ফেলেন। খুব শিগগিরই এই রামদুলাল হয়ে উঠেছিলেন বাঙালির প্রথম লাখপতি যিনি কলকাতা বন্দরে ইওরোপিয়ান ব্যবসায়ীদের সাথে সেয়ানে সেয়ানে লড়াই করতেন।
রামদুলাল কিন্তু তার দুঃসময়ের মনিবদের কৃপা ভোলেননি। রামদুলাল সাফ বলে দেন, তাঁর সিন্দুকে টাকা থাকতে কালীপ্রসাদের কোনো চিন্তা নেই। যেহেতু মূল বিরোধিতা শোভাবাজার রাজবাড়ি থেকেই ছিল,তাই তাদের জব্দ করার জন্য, কালীপ্রসাদ দরবার করলেন তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী সাবর্ণ রায় চৌধুরী পরিবারের কাছে। সে পরিবারের মাথা তখন বৃদ্ধ সন্তোষ রায় চৌধুরী। তিনি কালীপ্রসাদকে আশ্বস্ত করে বললেন শুধু সন্তোষ স্বয়ং নন, তাঁর কাছের প্রত্যেকটি ব্রাহ্মণকে নিয়ে তিনি শ্রাদ্ধে যোগদান করবেন। মহাধুমধামে সাঙ্গ হয়েছিল সেই শ্রাদ্ধ। শেষে দেখা গেলো দত্ত পরিবারের হাতে গোণা কজন ছাড়া আমন্ত্রিত সবাই এলেন সেই শ্রাদ্ধে।
শেষাঙ্ক
তৎকালীন যুগের প্রচলিত রীতি অনুযায়ী যেকোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানের শেষে উপস্থিত ব্রাক্ষণদের উপহার প্রদানের একটি রীতি ছিল। সেই রীতি মেনে কালীপ্রসাদ ২৫,০০০ টাকা ব্রাক্ষণদের বিদায়ী উপহার হিসাবে দিতে চাইলে তাঁরা সেটি নিতে অস্বীকার করেন, কারণ জনমানসে সেটি ঘুষ হিসাবে পরিগণিত হওয়ার একটি সম্ভাবনা তৈরি হত। তখন সন্তোষ রায় চৌধুরী পরামর্শ দেন ওই অর্থ কোনো ধর্মীয় কাজে ব্যয় করতে। শেষে ওই অর্থ কালিঘাট মন্দির নির্মাণের কাজে খরচ করা হয়। বর্তমান মন্দির ভবনটি তৈরি হতে যে ৩০,০০০ টাকা খরচ হয়েছিল, তার ২৫,০০০ টাকাই এসেছিল কালীপ্রসাদের অনুদান থেকে। সন্তোষ রায় চৌধুরী মন্দির সম্পূর্ণ তৈরি অবস্থায় দেখে যেতে পারেননি। মন্দির নির্মাণ সম্পূর্ণ হয় ১৮০৯ সালে এবং তা এখনও অগণিত ভক্তের উপাসনাস্থল।
৫ই এপ্রিল ১৮৩৪, বাংলায় প্রকাশিত সংবাদপত্র সমাচার দর্পণের রিপোর্ট অনুযায়ী জনৈক বিশিষ্ট বাঙালি হিন্দু জনৈক আনারো বিবিকে বিবাহ করার জন্য ইসলাম ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়েছিলেন এবং ইজ্জত আলি খান নাম গ্রহণ করেছিলেন। সমস্ত সম্ভাবনা বিচার করে বলতে হয় ইজ্জত আলি খান কালীপ্রসাদ ছাড়া কেউ নন। তাঁর বই রচনাকালে, প্রাণকৃষ্ণ দত্তর হাটখোলা বসু পরিবারের এক মহিলার সাথে যোগাযোগ হয়, যিনি কালীপ্রসাদের মায়ের শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। তাঁর মতে কালীপ্রসাদ তাঁর জীবনের শেষ দিকে প্রায়শ্চিত্ত হেতু মন্দির প্রাঙ্গনেই বসবাস করতেন। বলা কঠিন যে তাঁর প্রায়শ্চিত্ত আন্তরিক ছিল কিনা, অথবা তিনি হিন্দু সমাজে পুন:প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন কিনা, কিন্তু অবশ্যম্ভাবী ভাবে তিনি তাঁর পূর্ব প্রণয়িনীর সংস্থানের কথা ভুলে যাননি।
কালীপ্রসাদ তাঁর বেলেঘাটার বসতবাড়ি, যেখানে তিনি আনারোর সাথে বসবাস করতেন, আনারোর নামে উইল করে দিয়ে যান। কালিপ্রসাদের মৃত্যুর পর আনারো পুনরায় বিবাহ করেন। তাঁর দ্বিতীয় স্বামী মুন্সী আমির, যাঁর নামে মুন্সীবাজার এখন বেলেঘাটায়। সম্ভবতঃ মুন্সী আমিরের কোনো বংশধর বেলেঘাটার বাগান বাড়ীটি ভিজিয়ানগ্রাম / বিজয়নগরের মহারাজাকে বিক্রি করে দেন। হাতফেরতা হয়ে সেই বাগানবাড়ির বর্তমান মালিক এখন পশ্চিমবঙ্গ সরকার। এখন সেখানে কমার্শিয়াল ট্যাক্সের পরিচালনা দপ্তর, লোকজন এটিকে “বেলেঘাটা সেল ট্যাক্স’ অফিস বলেই চেনে। দুর্ভাগ্যক্রমে, বসতবাড়িটি এখন আর নেই, যদিও বাড়ির বিশালাকার প্রবেশপথটি এখনও মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে।
১৮৩৩ সালে আনারো বিবি কলকাতার বেনিয়াপুকুর অঞ্চলে একটি ইমামবাড়া প্রতিষ্ঠা করেন। সেই ইমামবাড়া এখনও ভালো অবস্থায় আছে। প্রধান হলঘরের একটি পরিবেষ্টিত জায়গায় আনারো বিবিকে সমাধি দেওয়া হয়। কথিত আছে, ইমামবাড়ার মধ্যস্থিত একটি কুয়ো মহরম মাসের ১৪ অথবা ১৫ তারিখে দৈবক্রমে ভর্তি হয়ে যায়, এবং অনেকে ভক্তিভরে সেই জল সংগ্রহ করতে আসেন। “কলিকাতা দর্পণ” রচনার গবেষণাকালে রাধারমণ ইমামবাড়ার বাইরের দেওয়ালে একটি মার্বেল ফলক দেখেছিলেন, যাতে আনারো বিবির জীবনপঞ্জির বিস্তারিত বিবরণ ছিল, যদিও সেই ফলক বহুকাল নিখোঁজ এবং তার সাথে মানুষের মন থেকে হারিয়ে গেছে পুরোনো কলকাতার এক চিত্তাকর্ষক ইতিহাস।