আমার সাম্প্রতিকতম পাঠ- কুমি কাপুরের Emergency: A Personal History। জরুরি অবস্থা নিয়ে সাধারণত আমাদের জ্ঞান অ্যানেকডোট নির্ভর। আমাদের পরিচিত অ্যানেকডোটাবলী আমরা যেভাবে পাঠ করে থাকি, কুমি কাপুরের বইটি তার থেকে আলাদা, বেশ কয়েকটি কারণে।
— কুমি কাপুর একজন সাংবাদিক, পরবর্তীকালে সিন্ডিকেটেড কলামনিস্ট।
— জরুরি অবস্থা জারি হবার সময়ে কুমি কাপুর ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে কাজ করতেন, যে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস দিল্লি থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রগুলির মধ্যে সবচেয়ে বেশি রাজরোষের সম্মুখীন হয়েছিল।
— কুমি কাপুরের জীবনসাথী, বীরেন্দ্র কাপুর ফিনান্সিয়াল এক্সপ্রেস (ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সিস্টার কনসার্ন)-এর সাংবাদিক ছিলেন।
— বীরেন্দ্র কাপুর জরুরি অবস্থার সময়ে জেলে গিয়েছিলেন, এবং দীর্ঘ সময় কারাবাস করেছিলেন।
— জরুরি অবস্থা জারির সময়ে কুমি অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন।
কুমির বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৫ সালে। যাঁরা মাঝে মধ্যে কুমি কাপুরের দুয়েকটি কলাম বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে পড়েছেন, তাঁরা প্রায় সকলেই নিঃসন্দেহে কুমির লিখনশৈলী পছন্দ করে ফেলবেন। এই বইটি তেমন শৈলীতেই লেখা।
বইয়ের নামে পার্সোনাল হিসট্রি থাকলেও, বইটি কেবলমাত্র সে ব্যক্তিগততাতেই আবদ্ধ নেই। পরবর্তীকালে বিভিন্ন মানুষের সাক্ষাৎকার নিয়ে ঘটনাকে ক্রমিক আকারে সাজিয়ে তোলা ও তার লজিকাল ব্যাখ্যা উপস্থাপনা করার জন্য যে বিপুল শ্রম প্রয়োজন, তা থেকে নিজেকে সরিয়ে নেননি কুমি। এমনকী আলাদা করে বীরেন্দ্র কাপুরেরও সাক্ষাৎকার নিয়েছেন, যেমন উদ্ধৃত করেছেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর পালিতা কন্যা নমিতা ভট্টাচার্যকেও।
জরুরি অবস্থার সময়ে জনসভার মঞ্চে ইন্দিরা গান্ধী ও সঞ্জয় গান্ধী
জরুরি অবস্থা, সম্ভবত এমন একটি ঘটনা, যা এক যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি; যেখানে সাধারণত পক্ষ নিতে হয়। সাংবাদিকতা, এমন এক পেশা ও দায়িত্ব; যেখানে পক্ষ নেবার পরেও একটা সামূহিক দুরত্ব রচনা করতে হয়, যেমনটি করা উচিত যে কোনও ধারাভাষ্যকারের। একেকজন সাংবাদিকের, আদর্শগতভাবে, একেকজন সঞ্জয় হয়ে ওঠার কথা, কুরুক্ষেত্রে।
কুমির একটা সুবিধা ছিল। তাঁর কর্মক্ষেত্র তাঁকে পক্ষ নেবার সুযোগ দিয়েছিল। কিন্তু রাষ্ট্র তাঁকে বিপরীত পক্ষ নেবার জন্য চাপ সৃষ্টি করে চলেছিল। কুমির সার্বিক অবস্থান ছিল কর্মক্ষেত্রের নিয়োজিত অবস্থানের সপক্ষে, রাষ্ট্রের দমননীতির বিপরীতে। এই বই সেই বিপরীতাত্মক সদর্থকতার একটি দলিল। দলিল শব্দটা বহুব্যবহারে জীর্ণ। তবু দলিল তো থাকে, অফিসে কিংবা আদালতে, নিবন্ধীকরণের দফতরে। দলিল থেকে তো মুক্তি নেই, হবেও না। ফলে দলিল দরকারি। কিন্ত যা কিছু দলিল হিসেবে দেখানো হয়ে থাকে, তার সবই দলিল নয়। এবং এ বই, দলিলের মত রসকষহীন নয়, এতে লিপিবদ্ধ রয়েছে পরাজয়ের হতাশার ক্ষণ, জয়ের আনন্দাশ্রুর মুহূ্র্ত, যে কারণে এ দলিল মানবিক।
কুমি না লিখলে সত্যিই কি জানা যেত যে, নির্বাচন ঘোষণা হবার পর, জয়প্রকাশদের দিল্লির সমাবেশে ব্যাপক ও অচিন্ত্যনীয় মানুষের সমাগমের পরবর্তী দিনটিতে সে খবর সংবলিত সংবাদপত্র নিয়ে এক হকার রাস্তা দিয়ে কাগজ নিয়ে দৌড়িয়েছিলেন “ডুব গয়ি, ডুব গয়ি” বলতে বলতে, সম্ভাব্য ইন্দিরাপতনের উল্লাসে? অথবা সেই সমাবেশে যোগ দিতে যাবার সময়ে অদ্ভুত আওয়াজ শুনতে পেয়ে নমিতা ভট্টাচার্যের উদ্ভূত কৌতূহল মিটিয়েছিলেন ট্যাক্সিচালক, জানিয়েছিলেন, সে আওয়াজ মানুষের পায়ের। যূথবদ্ধ পদধ্বনির। বা, বীরেন্দ্র কাপুরকে জেলের মধ্যে চরণ সিং বলেছিলেন, “দেখ লে বীরেন্দ্র, ইন্দিরাকো ইসহি সেল মে রাখুঙ্গা”। অথবা, ৭৭ সালে ইন্দিরা গান্ধীর ভোটপ্রচারের অ্যাসাইনমেন্টে গিয়ে কুমি তেমন ভাল হিন্দি না বুঝতে পারার জন্য বিরোধীদের উদ্দেশে ইন্দিরার ‘জাহান্নমমে যাও’ বক্তব্যটি মিস করে নিউজ এডিটরের রোষের মুখে পড়েছিলেন।
এগুলি অবশ্য অ্যানেকডোট। সে সময়কালের রাজনীতির অঙ্গনে সঞ্জয় ও তার সঙ্গীসমূহ, সিদ্ধার্থশংকর রায় ও তাঁর সম্পর্কে সঞ্জয়ের আপত্তি, এবং সর্বোপরি নানাজি, জয়প্রকাশ, এবং সুব্রহ্মণ্যন স্বামীর নায়কোচিত ভূমিকা, তাঁদের কার্যকলাপ বিস্তারিত বিধৃত রয়েছে এখানে। রয়েছে জর্জ ফার্নান্ডেজের বিদ্রোহী ইতিহাস, বাবু জগজীবন রামের দল ছাড়ার মুহূর্ত বাছার নিপুণ কৌশলকথাও। ইন্দিরা গান্ধীর অন্ধের মত সঞ্জয়ের উপর নির্ভরতা, যার বিরুদ্ধে তিনি কয়েকবার মাত্র পদক্ষেপ করেছেন, তার কথাও রয়েছে, সবিস্তারে।
মোট পনেরোটি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এই বইটি। তার আগে রয়েছে একটি সময়রেখা – যার শুরু ১৯৭১ সালের মার্চ মাস থেকে, যখন ইন্দিরা গান্ধী দুই তৃতীয়াংশ ভোট পেয়ে জয়যুক্ত হন। সময়রেখা শেষ হচ্ছে ২৪ মার্চ, ১৯৭৭-এ, যেদিন মোরারজী দেশাই পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথগ্রহণ করেন। তবে বই সেখানে শেষ হয়নি। মাত্র ৩ বছর মেয়াদি জনতা সরকার, সরকার শুরুর আগে থেকেই তার মধ্যেই ভেঙে পড়ার উপাদানের উপস্থিতি, চক্রান্ত— এ সবের তথ্যবহুল বিশ্লেষণ এই বইকে এক ইতিহাসের পাঠক্রমে উন্নীত করে, এবং আরও জানার দিকে পড়ুয়াকে ঠেলে দিতে থাকে, যা যে কোনও মহতী গ্রন্থের অবশ্যম্ভাবী বৈশিষ্ট্য।
আজকাল কিছু প্রক্ষিপ্ত তথ্যের মাধ্যমে দ্রুত সিদ্ধান্তে উপনীত হবার একটা ঘরানা তৈরি হয়েছে, সে সব তথ্যাদি থেকে বইটি পাঠ্য কিনা সে সম্পর্কিত সিদ্ধান্তও অনেকে নিয়ে থাকেন। তেমন ধরনের পাঠকদের জানিয়ে রাখা যাক, কুমি কাপুরের এই বইয়ের ভূমিকা লিখেছিলেন অরুণ জেটলি। এবং কুমি কাপুর পারিবারিকভাবে বিজেপি নেতা সুব্রহ্মণ্যন স্বামীর আত্মীয়। কুমির বোন রোক্সনা, সুব্রহ্মণ্যন স্বামীর স্ত্রী। এ দুটি তথ্য থেকে কুমির কংগ্রেস বিরোধিতা ও জনসংঘী প্রবণতা স্বাভাবিক ধরে নিয়ে বইটিকে পরিত্যাজ্য ধরে নেওয়ার আগে, এ বছরের গোড়ায় তাঁর প্রকাশিত একটি কলাম থেকে একটা অংশ উদ্ধৃত করা থাক।
Indira Parallels
The parallels between Narendra Modi and an authoritarian Indira Gandhi are unmistakable. The pandemic provided the perfect pretext for a further clampdown on individual rights and freedom of expression. No one in his party dares question the PM. The RSS is an appendage, Modi the driving force. Consensus-building with the Opposition or meaningful debates in Parliament are rare. Whether it was laying the foundation stone for a new Parliament House or a Ram Mandir at Ayodhya, the spotlight was on the PM alone.
উদ্ধৃতাংশটি ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত “2020 may have been disastrous for India, but not for Modi’s own image” শীর্ষক লেখা থেকে নেওয়া।
দুটি অতিরিক্ত প্রসঙ্গ— এই বই পড়তে গিয়ে বারবার শাহ কমিশনের রিপোর্টের প্রসঙ্গ আসে। জরুরি অবস্থা নিয়ে গঠিত এই কমিশন ১৯৭৮ সালে তিন খণ্ডে এই রিপোর্ট জমা দেয়, যা তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রক প্রকাশ করেছিল। ৮০ সালে ইন্দিরা কংগ্রেস ফের ক্ষমতায় আসার পর সমস্ত কপি খুঁজে বের করে নষ্ট করে দেওয়া হয়। তারপর, কোনও একজন ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে সে বই ফের ছাপার বন্দোবস্ত করেন। কিন্তু শাহ কমিশন রিপোর্ট বই হিসেবে লভ্য নয়। কিন্ডলে যে সংস্করণ রয়েছে, তাতে সে রিপোর্ট স্রেফ পিডিএফ আকারে তুলে দেওয়া রয়েছে বলে পাঠকরা কিন্ডলেই জানিয়েছেন। এ এক অসম্ভাব্য পরিস্থিতি ও বাস্তবতা।
লেখাটার মধ্যে এক জায়গায় জরুরি অবস্থার মত ক্ষেত্রে পক্ষাবলম্বনের কথা উল্লেখ করেছি। তার আগে ‘সাধারণত’ও লিখেছিলাম। ঐতিহাসিক বিপান চন্দ্র, ইন্দিরা ও জয়প্রকাশ নারায়ণ- দুজনের মধ্যেই ফ্যাসিস্ট প্রবণতা খুঁজে পেয়েছেন। ফলে এই বইয়ের আলোচনাকালে ফার্দার রিডিং হিসেবে In the Name of Democracy প্রথমে থাকবে। অবশ্যই থাকা উচিত কুলদীপ নায়ারের The Judgement। কুলদীপের বইটির হার্ড কপি হার্ড কভার এডিশনে ৬০০০ টাকা দামে পাওয়া যাচ্ছে দেখলাম, কিন্ডল বা অন্য কোনও সফট ভার্সন খুঁজে পাইনি।