যখন কাউকে হত্যা করা হয়, তখন তা স্বাভাবিক মৃত্যুর চেয়ে ভয়ংকর হয়ে ওঠে নিহতের কাছে। কারণ দুর্ঘটনা বা স্বাভাবিক মৃত্যুর সময় তার আত্মসম্মানবোধ বা জীবনের কাছে হেরে যাওয়ার চরম গ্লানি থাকে না। কিন্তু হত্যা করার সময় প্রথম প্রাণের চেয়েও বেশি নিহত হয় আত্মবিশ্বাস, আত্মসম্মান। আতঙ্ক তাকে মেরে ফেলে প্রথমে। আর হত্যাকারী চায় যাকে সে হত্যা করছে, তার মেরুদণ্ড অথবা আত্মসম্মানবোধকে আগে হত্যা করতে। প্রাণে তো সে এমনিই মরবে। তো, আমরা যাই বলি না কেন, সন্ত্রাস যখন কেউ বা যারা করে, তখন তাদের মূল চিন্তাই থাকে যাদের উপর তারা সন্ত্রাস চালাচ্ছে, তাদেরকে মানসিকভাবে মেরে ফেলা। ভয় দেখানো এবং ভীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করা। প্রতিটি আক্রমণই কম বেশি এই পদ্ধতি অবলম্বন করে।
এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন, সেই সন্ত্রাসবাদী কে?
এ নিয়ে যদি আমরা ভাবতে বসি, তাহলে হয়তো আমরা চলে যাব সেই রাষ্ট্রকাঠামোর দিকেই। শাসননীতি এবং দমননীতি পদ্ধতিগুলোর কাছে। সেই যে এক হিন্দি সিনেমা ছিল, তার নাম পুলিশওয়ালা গুন্ডা। সেখানে হিরো সঞ্জয় দত্ত এক গুন্ডাকে প্রচুর মারার পর বলছেন— 'দেশকা সবসে বড়া গুন্ডা কৌন হ্যায়? পুলিশ।' তার এইসব ডায়লগে সিনেমা হলগুলোতে নিশ্চয় প্রচুর পয়সা পড়েছিল, কারণ সেখানে একজন পুলিশ ইন্সপেক্টর পুলিশ হিসেবে গর্বে ছাতি ফুলিয়ে এই কথা বলেছিল কিছু শারীরিক ক্ষমতায় দুর্বল গুন্ডাকে প্রচুর মারার পরে (জানি না, গডফাদার বা মাইকেল কী বলতেন এই শুনে কিংবা সরকারের বচ্চন)। পুলিশের ক্ষমতা সম্পর্কে জনগণকে জাহির করার জন্য এটা পারফেক্ট ছিল কি না জানি না, কিছু জনগণ এসব মুখে মুখে আউড়াত। পুলিশ দেখলেই বলত। হয়তো এ কারণেই সেন্সরে আটকায়নি, কারণ রাষ্ট্রও এ কথা কোনও না কোনও ভাবে জনগণকে বলতেই চায় যে আমাদের মতো গুণ্ডা আর কেউ নেই। সুতরাং সাবধান।
কিছুদিন আগে অভিনেত্রী কঙ্গনা রানাউতের মুখেও সেই সিনেমার দ্বারা পর্দা ফাঁস (পড়ুন, হুমকি) শুনি। "পার্লামেন্টে সংবিধান হাতে নিয়ে যারা চেঁচামেচি করছে, তাদের সব অপকর্মের পর্দা ফাঁস হবে আমার নতুন ছবি 'ইমারজেন্সি'-তে।"
তো হল কী, এতকাল এই গুণ্ডামিগুলো চলছিল আড়ালে। কেননা, এতদিন রাষ্ট্রের ভূমিকা ছিল অনেকটা ‘তোমাকে বকব, ভীষণ বকব আড়ালে’-র মতো। রাষ্ট্র বকছে, মারছে, জেলে পুরে দিচ্ছে, বিরোধীদের গলা কেটে দিচ্ছে কিন্তু সবার নজর এড়িয়ে, জনগণকে না জানিয়ে। যেন রাষ্ট্র হল সেই প্রেমিকা, যে লজ্জাবতী লতা, কিন্তু একমাত্র সীমান্তে শত্রু এলে ফোঁস করে উঠতে পারে। সেখানে এক তালপাতার সেপাইও বীর। অবশ্যই বীর। কিন্তু সেখানে সেই বীরের বীরত্ব মুছে যায় এবং রাষ্ট্রের আত্মবিজ্ঞাপন শুরু হয়।
সঙ্গে থাকে এই চেতাবনি, যে দেশের মধ্যে কেউ ট্যাঁ ফোঁ করলে 'ভয় পেও না ভয় পেও না তোমায় আমি মারব না।' আমরা গণতান্ত্রিক দেশ। আমাদের আইপিসি আছে। কিন্তু মানবাধিকার কমিশনও আছে। আইটি সেল আছে। কাশ্মীরও আছে, আবার গণতান্ত্রিক ভাবে রক্ষিত নকশালদের ডেনও আছে। ফলে বিদ্রোহী এবং বিদ্রোহ দমনকারীর এক শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নামই গণতন্ত্র।
আশার কথা, এই মিছরির ছুরির থেকে এবার রাষ্ট্র বেরিয়ে পড়েছে। ন্যায়, অন্যায়, ধর্ম, খাদ্য নানান সংহিতা তৈরি হচ্ছে। রাষ্ট্র আর মুখ লুকিয়ে থাকতে রাজি নয়। দেশদ্রোহীদের কড়া হাতে শায়েস্তা করা হবে। পুলিশ চাইলেই যে কাউকে দেশবিরোধিতার জন্য টেনে নিয়ে চলে যেতে পারে। কারণ রাষ্ট্র মানেই লেফট রাইট লেফট রাইট লেফট রাইট। কিন্তু আগামীদিনের ভারতবর্ষ ঠিক কেমন হয়ে উঠতে পারে? ধরুন আমাদের বুকশেলফ ভরে উঠতে পারে বিভিন্ন সংহিতায়। কী খাব? তার জন্য খাদ্যসংহিতা। কী পরব? তার জন্য পোশাকসংহিতা। কী রকম চুল কাটব? তার জন্য কেশসংহিতা (পুরুষের জন্য একরকম, মেয়েদের জন্য আরেকরকম), কাকে বিয়ে করব? তার জন্য সংহিতা (বিবাহসংহিতা), কার সঙ্গে প্রেম করব? তার জন্য সংহিতা (প্রেমসংহিতা)। এর পর ধীরে ধীরে বেরোবে কাশিসংহিতা, হাঁচিসংহিতা, পাদসংহিতা, মিলনসংহিতা, কন্ডোমসংহিতা, ইত্যাদি প্রভৃতি।
প্রসঙ্গত বলে রাখি উত্তর কোরিয়ার ছেলেমেয়েদের চুল কাটা থেকে শুরু করে পোশাক, কান্না (একটা বিশেষ দিন আছে, যেদিন সকলকে দাঁড়িয়ে লাইন দিয়ে কাঁদতে হয়), সন্তান ইত্যাদি নানা বিষয়ে এমন সংহিতা আছে।
এবার কথা হল এত সব সংহিতা ভালো না খারাপ? খারাপ বলার শক্তি নেই। খারাপ বললেই বিপদ, ভালো হবে হয়ত। কেননা, আমাদের নির্বাচিত সরকার, আমাদেরই ভালো চায় বলে ভোট দিয়ে জিতিয়ে এনেছি। সংহিতা মানেই ভালো। সংহিতা মানেই তা সকলের হিতের জন্য। বিশেষ করে দেশের হিতের জন্য এ ধরনের সংহিতার খুবই প্রয়োজন। এই ধরুন মানবাধিকার কমিশনের মতো দেশবিরোধী সংগঠনকে প্রথমেই তো বাতিল করা উচিত। প্রতিবাদ, প্রতিরোধের তো কোনও অর্থ নেই। রাষ্ট্র আছে বলেই না দেশের জনগণ আছে। রাষ্ট্রকে বাদ দিয়ে কি আপনি বা আপনারা পারতেন জন্মগ্রহণ করতে? আধার কার্ড, পেন কার্ড পেতেন কোথা থেকে? কেমন ভাবেই বা বলতেন, মেরা দেশ মহান? তবে?
তবে এসব প্রশ্ন তোলা যাবে না, আমাদের দেশ গণতান্ত্রিক দেশ। প্রশ্ন আপনারা করতেই পারেন, কিন্তু তার জন্য প্রশ্নসংহিতাকে মেনে চলতে হবে। অচিরেই বাড়িতে একটি নতুন বুকসেলফ করুন। সেখানে একের পর সংহিতা রাখবেন আর ছেলেমেয়ে জন্মালে জন্ম থেকেই মুখস্থ করাবেন। কারণ বিজ্ঞান না জানলেও সে বাঁচবে কিন্তু সংহিতা না জানলে সে বাঁচবে কীভাবে?
এ প্রসঙ্গে জানিয়ে রাখি, খবরে প্রকাশ, বেবি সাউ নামে একজন মহিলা কলকাতায় প্রথম ন্যায়সংহিতার আওতায় এফআইআর করেছেন। এতদিন যে আমি আমার এই ইউনিক নাম এবং পদবী নিয়ে ছাপান্ন ইঞ্চির গর্ব এবং বাংলা বাজারে ভুলভাল নাম ছাপার জন্য বিদ্রোহ করতাম— সব বুদবুদের ন্যায় মিলায়ে যায়। কিন্তু এ গর্ব আমি লুকোই কীভাবে? শুধু চিরজন্মের জন্য ইতিহাস রচনাকারী একজনের নেমসেক হয়ে আমিও ঢুকে পড়লাম ইতিহাসে।
বেরোতে গেলেও তো মুশকিলে পড়ব। কপাল আমার!