বইটি পড়া শেষ করে মাথায় একটা কথা ঘুরপাক খাচ্ছে এবং মনে হচ্ছে যে এই বইটি না পড়ে মরে গেলে বড্ড অন্যায় হয়ে যেতো। প্রায় প্রতিটি অধ্যায়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত বারবার মনে হয়েছে যে এই বই আমার জীবনের ফেলে আসা দিনগুলোকে মনে করে লেখা হয়েছে। এই বই আমার একান্ত নিজস্ব জীবন দলিল বললেও হয়তো অত্যুক্তি হবে না।
পল্লীজীবনে স্তরে স্তরে কাদার প্রলেপ লাগিয়েই এই জীবন দলিলে জমা হয়েছে অভিজ্ঞতার পলি। এরপর একদিন বাবার হাত ধরে নীল হাফপ্যান্ট আর সাদা জামা পরে অ্যালুমিনিয়ামের বাক্স ভরে বই খাতা নিয়ে স্কুল জীবন শুরু। স্কুল থেকে ফিরে লুকিয়ে লুকিয়ে আচার কিম্বা আমূল দুধ….। কাদার কথায় মনে পড়ে গেল রাম্মামের কাদামাখা রাস্তায় পিছলে পড়া এক লিটল বুদ্ধের রাস্তাকে বকার দৃশ্য, কদিন আগেও যার ডেফারড্ লাইভ টেলিকাস্ট দেখে ক্যামেরার পিঠ চাপড়ে দিয়েছি। এই কাদা কখনো আমাদের কাঁদিয়েছে আবার কখনও এই কাদাই আমাদের শিখিয়েছে যে ‘দাগ আচ্ছা হ্যায়!’
লেখক অনেককিছুই মনে করিয়ে দিয়েছেন – ঈদে মঞ্জুরদের বাড়ি যাওয়া, বিজয়ায় পিন্টু মাধু কিম্বা মন্তুদের বাড়ি গিয়ে নারকেল নাড়ু আর ঘুগনি খাওয়া। ছোটবেলায় বেশ একটু সুবিধা বঞ্চিত ছিলাম, কিন্তু অভিযোগ ছিল না। মা-বাবা সাধ্যমতো কষ্ট মোচনের চেষ্টা করতেন। জনতা শাড়ি বলে একধরনের খুব সস্তার শাড়ি পাওয়া যেত, আমার মাকে ঐ শাড়ি পড়তে হতো দীর্ঘদিন। মা মাঝরাতে উঠে কয়লা ভেঙে উনান জ্বালিয়ে বাবার জন্য রান্না করতেন, বাবাকে সকালের শিফটে স্টিল প্ল্যান্টে কাজ করতে যেতে হতো।
আমার ছোট পিসামশাই পিসিকে ছেড়ে অন্য মহিলার সাথে থাকার কারনে পিসি আমাদের সাথেই থাকতেন। উনি আমাকে খুব ভালোবাসতেন। ওনার ছেলেও একসময় ওনাকে ছেড়ে বাবার সাথে নতুন মায়ের কাছে চলে গেছিলেন। আমার বাবার আদেশ মোতাবেক আমি ছোট পিসিকে আগলে রাখার চেষ্টা করেছি উনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করা পর্যন্ত। কষ্ট অনেকরকম দেখেছি, পিসি সারাজীবন ধরে অনেক কষ্ট করে জীবন অতিবাহিত করেছেন। আইনি পথে লড়াই করে পিশামশাইয়ের মৃত্যুকালীন পেনশনের অধিকার পেয়েছেন। শেষ জীবনে পিসির খাওয়ার টাকা ছিল, খিদে ছিল, খাবার ছিল, অথচ গলায় ক্যান্সারের কারনে না খেতে পেয়ে মারা গেছেন। এই কষ্ট আমি আজীবন ভুলতে পারব না, কারন খাওয়ার কষ্ট আমি দেখতে পারি না। আমার ঠাকুমা, মা এবং পিসি ক্যান্সারের কারনে মারা গেছিলেন, ওঁদের চরম ঈশ্বর বিশ্বাসও ওঁদের শান্তি করে মরার অধিকার দেয়নি। ঘটনাগুলো আমার ঈশ্বরের প্রতি অনাস্থা বাড়িয়ে দিয়েছে। এই অনাস্থা আরও প্রগাঢ় হয়েছে কাশ্মীরে এক হিন্দু মন্দিরে আসিফার ধর্ষিতা হওয়ার পর, আবারও উত্তরপ্রদেশের হাথরাসে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের হাতে দলিত মেয়েটির ধর্ষন ও খুনের পর এই অনাস্থায় আস্থা জন্মেছে আরও বেশি করে।
আপনার লেখা আমাকে ওয়েলিংটন স্কোয়ারে মরা সাহেবের জামা কাপড় কোট সোয়েটারের কথা মনে পড়িয়ে দিয়েছে। অধ্যাপক শ্রী সুশীল মুখার্জির বাড়ি থেকে টিউশন নিয়ে বেরিয়ে দুবার গেছি। সেই সোয়েটার প্রায় তিরিশ বছর আমার শরীরে উষ্ণতা জুগিয়েছে।
শহরে প্রথম টিভি দেখি শ্রদ্ধেয়া প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর শেষকৃত্য অনুষ্ঠান দেখতে গিয়ে। কিছুই দেখা হয়নি, শুধু অগণিত মানুষের মাথা দেখে বাড়ি ফিরে এসেছিলাম।
দুর্গাপুজোর পর বাড়ির কাছেই জাগ্রত সংঘের মাঠে বিনে পয়সায় সিনেমা দেখানো হতো। আমরা ছেলে ছোকরারা পর্দার পিছনে বসে সিনেমা দেখতাম। বাবার ভয়ে সিনেমা শেষ হওয়ার কিছুক্ষণ আগেই বেরিয়ে আসতে হতো। কিন্তু এ দেখার চার্ম অন্য জগতের স্বাদ এনে দিত, দিল খুস হয়ে যেত।
ছোটবেলা থেকেই মেঘলা দিনে আকাশে মেঘের ভিতর নানা রকমের জীব জন্তুর আদল দেখতে পেতাম, বন্ধুরাও পেত, দিদিও দেখেছে। তারপর আপনার কথায় ভাসতে ভাসতে ঘুড়ির সুতোয় মাঞ্জা দিতে গিয়ে হাতে কাঁচের টুকরো বিঁধে রক্তারক্তি কান্ড। মনে পড়ছে বাংলার স্যারকে পছন্দ না হওয়ার কারণে উনি ক্লাসে এলেই জ্যোতির্ময়ের প্রচন্ড হাঁচি পেত, এবং বিরক্ত হয়ে উনি জ্যোতির্ময়কে বের করে দিতেন। জ্যোতির্ময় সেই সময় কানাই কাকুর কাছ থেকে কেনা তেঁতুলের চাটনি মাখানো শশা খেত সবাইকে দেখিয়ে।
গ্র্যাজুয়েশনের সময় হোল্ড অলে (তখন আমরা হোল্ডল বলে জানতাম) প্রচুর জিনিসপত্র গুছিয়ে নিয়ে বারাসতে মামাবাড়ি গিয়ে উঠেছিলাম। সেখান থেকে পায়ে হেঁটে ট্রেনে চেপে ফের পায়ে হেঁটে গোয়েঙ্কা কলেজ। হাত ভেঙে তিন বছরের কোর্স চার বছরে শেষ করে বাড়ি ফিরলাম।
কাদামাটির হাফলাইফ পড়তে পড়তে মনে পড়ল মাঠা পাহাড়ের মেলায় চপ মুড়ি ঘুগনি, স্কুলে যাওয়ার সময় আখের গুড় দিয়ে ফেনাভাত, দুটো মেরি বিস্কুটের মাঝে আমূল দুধ ভরে কিম্বা রুটি গোল করে পাকিয়ে চা দিয়ে অমৃতের মতো খেয়েছি।
যেমন মনে পড়ল দুর্গা পূজার দিন কয়েক আগে দুলাল মামা ডেকে পাঠাতেন কার কী জামাকাপড় হয়েছে সেটা দেখার জন্য। এই দুলাল মামার হাত ধরেই পাড়ার মাঠে জার্সি গায়ে ফুলবল খেলতে নামার সৌভাগ্য হয়েছে। উনিই নিজের উদ্যোগে একটা ফুটবল টুর্নামেন্টে খেলতে নিয়ে গেছিলেন, white border ক্লাবের কাছে আট গোল খেয়ে ফিরেছিলাম। পরের বছর আমরা সেমিফাইনাল অবধি পৌঁছেছিলাম।
কথায় কথায় লেখক শিখিয়েছেন বিজ্ঞান দিয়ে প্রচুর বিশ্বাস(অন্ধ!)-কে ওঝা গুণীনদের বুজরুকি বলে প্রমাণ করা যায়।
স্বচ্ছ ভারতের নামে তথ্যপ্রমান বাদ দিয়ে যেভাবে বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে অস্বচ্ছতায় মুড়ে দেশের সর্বোচ্চ আদালত রামরাজ্য প্রতিষ্ঠায় মদত দিয়েছে, তাতে রাজনীতির ঠেকেদার বাদ দিয়ে কার লাভ হবে সেটা সাধারণ মানুষের চিন্তার বাইরে। ধর্ম তো ধারণ করবে, সে মানুষে মানুষে বিভেদ কেন তৈরি করবে এটা আমার মোটা মাথায় এখনও ঢোকেনি। কোনো রাজ্য বা দেশের সরকার কেন ধর্মকে প্রমোট করবে সেটা অনেক চেষ্টা করেও বুঝতে পারিনি। আপনার লেখা পাঠককে এটা ভাবতে সাহায্য করবে যে, একটা ধর্মহীন পৃথিবী কি তৈরি করা যায়না! আসলে বেশিরভার মানুষ নিজের মতো চিন্তা করার বদলে নিজেকে ভেড়ার পালের অংশ ভাবতে ভালোবাসে! পাঁচশ-হাজারি অনুদানের ফাঁদে মানুষের অস্তিত্ব এখন ভোটার বই আর কিছুই নয়।
ব্যক্তিগতভাবে কট্টর মানুষপন্থী হওয়ার কারণে এই লেখা পড়ে জানতে পারলাম বামপন্থীরা কেমন ছিলেন, কেমনভাবে তাঁদের মধ্যে পরিবর্তনের ছোঁয়া লাগল ইত্যাদি। ইমানুল হকের লেখা পড়ে এটা নিশ্চিত হতে পারলাম যে তখন আজকের মতো প্রচার মাধ্যমে কথায় কথায় হিন্দু বা মুসলিম কারো তেমন খাতরা ছিল না, সবাই মিলেমিশেই থাকতেন। তখন একটা রাজ্যের গোটা শিক্ষাসেল জেলে যায়নি, কিম্বা এখনকার মতো কথায় কথায় নেতারা এপাং ওপাং ঝপাং শেখেননি। তখন চোরদের পদ্ম সাবানে মেখে শুদ্ধ হওয়ার কনসেপ্ট ছিল না!
অধ্যায় ৫৭ থেকে –
'বাঙালি' যাত্রাপালায় সত্যপীর বলে,
হিন্দু ধর্ম বল, ইসলাম ধর্ম বল, সব বাজে। আমি বাঙালি জাতটাকে হিন্দুলাম ধর্মে দীক্ষা দেব। হিন্দু কেউ থাকবে না, মুসলমান কেউ থাকবে না-সব হিন্দুমান হয়ে যাবে।
মন্দিরে ঢুকে নামাজ পড়ে সত্যপীর।
নামাজ নয় পূমাজ।
সত্যপীর বলে,
ভগবানও নয়, খোদাও নয়,
ডাকতে হবে একজনকে- তার নাম খোদাবান। আমি মন্দির আর মসজিদ ভেঙে ফেলে মনজিদ তৈরি করব; তার ভেতর পুজোও হবে না, নমাজও হবে না, হবে শুধু পূমাজ। নইলে বাঙালির উদ্ধারের আর আশা নেই।
এই বই আমার ভাবনার পালে প্রবল হওয়া জুগিয়েছে। মাঝেমাঝে খুব অস্থির লাগে। ভাবতে থাকি জলের ধর্ম কি? বুক ভরে যে বাতাস প্রশ্বাস হিসাবে ফুসফুস হয়ে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে সেই বাতাসের ধর্ম কি? ঈদের চাঁদ আর দোলপূর্ণিমার চাঁদের মধ্যে তফাৎ কি? শারীরিক কারনে রক্ত প্রত্যাশীর কাছে রক্তের ধর্ম কি? পাহাড়ের ধর্ম? খেলার মাঠের ধর্ম? কুয়াশায় ভিজে কাঁপতে থাকা পাখির ধর্ম? বাঁশি সানাই? খিদের ধর্ম? অপত্য স্নেহের ধর্ম, রোগের ধর্ম? আমি বিশ্বাস করি আপনি বুঝিয়েছেন কর্ম এবং মানবতার চেয়ে বড় কোনো ধর্ম হয়না। এই প্রসঙ্গে মনে পড়ে গেল বেনারসে এক সাধু(!)-র দিকে ক্যামেরা তাক করার জন্য আমার এক ছবিকার বন্ধুকে ডেকে সাধুবাবা জিজ্ঞেস করেছিলেন “তেরা ধরম ক্যা হ্যায়? তু হিন্দু হ্যায় ইয়া মুসলিম?” আমার বন্ধু হাতে ধরা ক্যামেরা দেখিয়েছিলেন। উনি বুঝতে না পেরে ফের একই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করায় আমার বন্ধু বলেছিলেন “ফটোগ্রাফার।” উনি খুব অবাক হয়ে বলেছিলেন “অ্যায়সা কই ধরম নেহি হোতা হ্যায়।” আমার খুব অবাক লেগেছিল, কারন এরকম মানুষই এখন সরকার বাহাদুরের পরামর্শদাতা!
লেখকের মতো প্রগতিশীল শিক্ষকদের উজ্জ্বল উপস্থিতির কারনেই আমাদের দেশের মেয়েরা এখন অনেকটা প্রগতি করতে পারছেন। আমার স্ত্রীও একজন স্কুল শিক্ষিকা। তাঁর মাতৃসুলভ আচরন ও দৃঢ়তা দেখেও আমি অনেককিছু শিখেছি। আমাদের সমাজে এখনও এরকম বলা হয় “মেয়েদের এটা করতে নেই, ওটা পড়তে নেই, বেশি রাত পর্যন্ত বাড়ির বাইরে থাকতে নেই, বড়দের সাথে তর্ক করতে নেই” ইত্যাদি প্রভৃতি। আমি আমার একমাত্র মেয়েকে বলে রেখেছি যে কখনও যদি কোথাও আমাকে ভুল মনে হয়, তাহলে যুক্তি দিয়ে সেই ভুল বুঝিয়ে দিতে পারিস, নিজেকে শুধরে নেবো। “গুরুজন দেখলেই প্রণাম করতে হবে” এই যুক্তিতে আমার বিন্দুমাত্র বিশ্বাস নেই। তাই কেউ আমায় পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে এলে আমি বাধা দেই, কারণ আমি এখনো প্রণাম নেওয়ার বা আশীর্বাদ দেওয়ার যোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছি বলে বিশ্বাস করতে পারিনা। প্রত্যুত্তরে আমি বলি “ভালো থাকার চেষ্টা করো, ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো।” আমি প্রতি মুহূর্তে এই চেষ্টা করি যেন গতকালকের থেকে আজকের আমি আর একটু ভালো মানুষ হয়ে উঠি।
ইমানুল হকের লেখা অধ্যায়গুলো একেকটা কঠিন বাস্তবতার দলিল বলে আমার মনে হয়েছে। লেখাগুলো অনেকটা বেনারসি পানের মতো, যেমন স্বাদ তেমন তার সুবাস – অনেকদিন ধরে মাতিয়ে রাখে আর ভাবিয়ে তোলে। লেখকের সবচেয়ে বড় গুণ হলো observation করার দক্ষতা, ঐ দক্ষতাই এই লেখাকে এত সহজ করে পাঠকের মনে সিঁদ কেটে ঢুকতে সাহায্য করেছে। তাই এখন অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি পরের অধ্যায়গুলো বই আকারে হাতে পাওয়ার।
জীবন মানেই উৎসব, জীবন মানেই সম্ভাবনা। এই লেখাগুলো প্রতি মুহূর্তে সেই জীবনেরই জয়গান গেয়েছে। কাদামাটির হাফলাইফ জীবন থেকে শিক্ষা নিয়েই জীবনকে উপলব্ধি করতে শেখাবে, এই বিশ্বাস জারি থাকল।
সবশেষে গভীর হতাশায় যাঁরা এই সুন্দর পৃথিবী থেকে মুখ ফিরিয়ে নিতে চাইছেন তাঁদের কাছে আমার বিনীত অনুরোধ –
ভালো না লাগলেও থেকে যা
থেকে যা ভোরের আলো
থেকে যা সবুজ পাতার রাশি
ভালো না লাগলেও দিয়ে যা
দিয়ে যা শিউলির পরশ
থেকে যা থেকে যা অনন্ত আশা
থেকে যা অনন্ত নীল আসমানী ভালোবাসা
সেইদিন ছুঁয়ে দিস চোখদুটো মোর
যেদিন এসেছে ফিরে স্নিগ্ধ কুয়াশা মাখা ভোর।
ভালো থাকবেন, ভালো রাখবেন।