মামাবাড়ির পাছ দুয়ারের সামনে ঘাসে ভরা অগোছালো জমি ছিল। সেই ছিল হুটোপাটি, দৌরাত্মির জায়গা। সেখানে খেলত বাচ্চার দল। খেলতে খেলতে ঘাসের জঙ্গল থেকে এক একটা ইঁটের টুকরো পায়ে বাজত। বিরক্ত হয়ে তুলে দূরের পুকুরে ছুঁড়ে দিত। ইঁটে চাপা থাকা জায়গাটা ফুটে থাকত খুঁটে দেওয়া ব্রণর দাগের মত। চারদিকের পায়ের পাতা ডোবান ঘাসের জঙ্গলের মধ্যে একটুকরো ন্যাড়া জমি। বেমানান, বেখাপ্পা।
অমনি বেখাপ্পা হয়ে যায় কিছু কিছু মন। ছোট্ট ঘাসের উপর ইঁট যেমন, তেমন কোন গুরুভার চাপে। মানুর অবশ্য কেন চাপ, কিসের চাপ অত বিশ্লেষণের দায় নেই। কেন নেই?
দুভাগে ভাগ হয়ে যাওয়া বুল্টনের মা বড় বৌদি, বোনের সঙ্গে চলে যাওয়া প্রেমিককে ভুলতে না পারা সীমাদি – এদের মত নয় মানু। সেইজন্যই মানু এই দু-ভাগ হয়ে যাওয়া জীবনটার উপর চেপে বসে আছে। এত সহজে মানুকে বুঝিয়ে ফেলা যাবেনা হঠাৎ এক কোপে একটা জীবন দু-ফালা হয়ে যেতে পারে। আর তখন একফালা জীবনের ওপর দাঁড়িয়ে অন্য হারিয়ে যাওয়া জীবনটার দিকে বড় বৌদির মত লাল চোখে বা সীমাদির মত বুড়োটে দৃষ্টিতে দেখতে হয়।
মানু তাই চোখে মোটা করে কাজল দেয়। কাটা পড়া বুল্টনের মত, অবিশ্বাসী প্রেমিকের মত আধখানা জীবনকে মোটেই পালিয়ে যেতে যাবে না মানু।
যাদের সঙ্গে মানুর নিত্য ওঠাবসা তাঁরা কিন্তু জানেন ঈর্ষা-ইঁটের গল্পখানাও। বৌভাতের সকালে যার বর মারা যায়, শোকে দুঃখে তার মাথা খারাপ হওয়ারই তো কথা। তাও আবার কীভাবে? না,
বেধবা বড়জা ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানের পায়েসে বিষ মিশশে দেছিল। বিষটা দেছিল মানুকেই। কে জানে ভগমানের মার, বাটি পাল্টাপালটি হয়ে বরটা মরে। আর মানুটাও মরে অবশ্য, তবে একেবারে নয়। রোজ রোজ মরে এভাবে।
গল্পের মধ্যের গল্পের সন্ধানে মন ছুঁক ছুঁক করবে না এরপর? দেওর-ভাজের পারস্পরিক সম্পর্ক কোন প্রেসারকুকারের চাপে সিদ্ধ হয়ে হয়ে এমন কুটিলরকমের বেঁকা হয়ে যায়? সম্পর্কের অন্য পারের যে রিক্ত মানুষটি বেঁচে রইলেন, সেই শ্বেতবসনা কিভাবে সইলেন এই আচমকা দুর্ঘটনাকে? সে সব গল্প অনুমানের সীমানায়। শুধু গল্প জুড়ে ভেসে থাকে এক দম চাপা অস্বাভাবিকতা আর চাপা অসহায়তা। আর কিছু উত্তর না বেরোন সম্পর্কের সমীকরণ। কার দোষে এই অকারণ, অপ্রয়োজনীয় জটিলতা যার অভিঘাতে জীবনগুলো ডানাভাঙ্গা পাখির মতন মুখ থুবড়ে পড়ে? লেখিকা অবশ্য এসবের ধার ধারেন না। তিনি নির্লিপ্ত ভাবে ভাড়াটে বৌ’র কথায় চলে যান। তার বাড়িতেও যে আজ বরের গায়ে ঢলে ঢলে পড়া বাড়িওয়ালার আইবুড়ো মেয়ে পদ্মকাটা বাটিতে কাঁটাচচ্চড়ি দিয়ে গেছে।
এই ভাবেই দশটি গল্প সাজিয়েছেন অরুন্ধতী। মেয়েদের গল্প বলব নাকি জীবনের গল্প বলব সে প্রশ্নের মীমাংসা হয়নি এখনো। তবে সব কটি গল্পেই মেয়েরা তীব্র রকমের আছেন। খুব মোলায়েম ভাবে বলা, নিখুঁত ডিটেইলিং ওলা জীবন্ত দশটি গল্প। প্রতিটা গল্পেরই উপজীব্য জীবনের জটিল অন্ধকার এক একটা দিক । আর প্রায় প্রতিটা গল্প অব্যর্থসন্ধানী তীরন্দাজ।
ননদাই-এর চুল পড়েছিল বলে যে সুমিতাকে তার শাশুড়ি বাটি ভরে পেচ্ছাপ খাইয়েছিল, সেই সুমিতা আবার সংসারচক্রে শাশুড়ী শয্যাশায়ী হয়ে পড়লে তাঁকেই রোজ একটু করে পেচ্ছাপ খাওয়ায়, এমন সুমিতাদের আমি চিনি না, কখনো, কোন দিনও চিনতে চাই না। বড় তীব্র এসকল সামাজিক জীর্ণতার অভিঘাত। যে সমাজ এই সকল জীর্ণতাকে মেনে নিতে বাধ্য করে সেই সমাজ, সম্পর্কও আমি চাই কি? কী আশ্চর্য! ঘষা-ফরসা সুমিতার হাতে এই চয়েজের স্বাধীনতাটা থাকে না। যেমন থাকে না কালো বৌদের জীবনেও। আর সেই না থাকার দাম সে কড়ায় গন্ডায় উশুল করে অন্যভাবে। স্বামী সোহাগ বঞ্চিত মেয়ে যে পথে স্বামী-সোহাগ আদায় করে নেয়, পড়লে স্তব্ধ হয়ে যেতে হয়। আবার অন্তত এ সকল গল্পের গোলকধাঁধাকে জীবন থেকে ইরেজার দিয়ে ঘষে ঘষে মুছে ফেলার পথ যদি বা জানা আছে ভেবে কিঞ্চিৎ আত্মপ্রসাদ লাভ করলেও করা যেতে পারে, একলহমায় সে আত্মপ্রসাদ ভুলিয়ে দেওয়ার জন্য আছে বেদরদি সর্দি গল্পের ‘শীতবিধবা’ রাজবীর। একের প্রতি অপরের হিসেবী স্বেচ্ছা হিংসা কেই বা এড়িয়ে যেতে পারে? ১৯৮৪ র শিখ দাঙ্গা নিয়ে এমন মর্মস্পর্শী লেখা আর কখনো পড়ার দুর্ভাগ্য হয়নি। গল্প বলার তীব্রতম কোণের নির্বাচন অরুন্ধতীর স্বভাবসিদ্ধ, পরিমিতির জাদুটিও তাঁর হাতের মুঠোয়। শীতবিধবা কথাটি আগামী অনেকদিন ভোলা কঠিন হবে।
অবশ্য ভোলা কি সহজ কোন নাম নেই গল্পের করুণাকেই? এইটা পাশ করুণার বাবা-ঠাকুমার গলায় দড়ি দিয়ে মরার সুবাদে ছোটবেলা থেকেই পরিচয় দড়িবাড়ির মেয়ে বলে। বিয়ের পরে তার প্রমোশন হল ল্যাংড়া অনন্তের বৌ হিসেবে। দুটো নধর গোলগাল বাচ্চার মা হয়েই সর্বনাশ হল তার। এত সৌভাগ্যও তার পাথর চাপা কপালে ছিল? করুণার মনে একটা সাধ জাগল। সামান্য মেয়ের সামান্য সাধ।
কিন্তু করুণা একটু বদলেছে।
ওর মধ্যে বিয়ের আগের সেই ফুরফুরে প্রাণচঞ্চলতা নেই। বিয়ের পরের সেই আলগা লালিত্যের ভাবটাও নেই।
কিছুটা সন্ত্রস্ত, যেন কী একটা খুঁজে বেড়াচ্ছে, কী যেন শুনতে চাইছে। কাজকর্ম সবই করছে অথচ সর্বদা কেমন যেন একটা আনচান ভাব।
দরজার বাইরে কেউ এলেই আড়ালে লুকিয়ে পড়ে। শিকারি বেড়ালের মত কান খাড়া করে কী শুনতে চায়।
লোকে সদরে এসে ডাকে, “অনন্তর মা আছো নাকি?’’
কেউ বলে, “ও অনন্তর মা, ছেলে আছে নাকি ঘরে? আসলে একবার পাঠিও দিকি।”
কেউ কেউ অনন্তর নাম ধরেও ডাকে বটে। কিন্তু বৌয়ের নাম ধরে ডাকার তো চল নেই, তবু করুণা কী শোনে কে জানে?
গল্প ধীরে ধীরে সুতো ছাড়ে। করুণাদের সাধ তো মেটার নয়, তাই যা হওয়ার তাই হয়। কী আশ্চর্য অপচয় জীবনের! সে অবশ্য জেনেই গিয়েছিল যে মেয়েছেলেদের কোন নাম হয় না। একটা অন্যতর জীবন যেখানে সে শুধুই কোন বিশেষণহীন ভাবে করুণা বলে সম্ভাষিত হত তেমন জীবন কেন তার অধরা হল?
মানবমনের অন্ধকার, সম্পর্কের জটিল প্রকাশে অরুন্ধতী সিদ্ধহস্ত। তাঁর মেয়েরা সবসময় হেরে যায় না, কখনো কখনো জিতেও যায় বৈকি, যেমন শেষ হাসি হেসেছিল পাপ হে গল্পের সুষমা। বাঁচাও তো কখনো কখনো মৃত্যুর মত ভারি হয়।
পড়ার শেষে গল্পগুলো মাথার ভার বাড়ায়। অসহজ অস্বস্তির কাঁটা বেঁধে যেন গলায়। অকারণ হিংস্রতার যে মামুলি ঘর-ঘর-কি কহানি অরুন্ধতী এই গল্পগুলির অনেকগুলিতেই তুলে ধরেছেন, সেটা কেমন ভয় ধরায়। বড় দম বন্ধ করা অন্ধকার। সবটুকু চাঁপাফুলের গন্ধ যেন ব্লটিং পেপারের মতন শুষে নেয় সে। জীবনকে তখন কোথাও একটা দুহাত তুলে ধন্যবাদ দিতে ইচ্ছে করে, যে ভাগ্যিস ওই অন্ধকার গলিপথের গোলোকধাঁধায় সে সকলকে ঘুরিয়ে মারে না। ভাগ্যিস কাউকে কাউকে আলোর হদিশ দেয়। সেই আলোকে আলো বলে চেনার জন্যও অবশ্য অন্ধকারটুকু চোখে আঙুল গিয়ে দেখাতে লাগে। কতটা পথ পেরিয়ে আসা গেছে তা জানান দিতেও।