''পাহাড়ের হৃদয়ে যতো নীলচে হলুদ ঝর্ণা দেখি
মনে হয়
দেশগাঁয়ে ছিল কিন্তু ছেড়ে আসা প্রতিটি মানুষ।''
এক উপন্যাস, এক নিবন্ধ এবং কিছু গল্পের 'হারানো দেশ হারানো মানুষ' সংকলনটি পড়তে গিয়ে বারবার অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তের এই ‘নির্বাসন’ কবিতার কথা মনে পড়ে। সংকলনটি দেশভাগের অব্যবহিত পরবর্তীকালে জন্ম নেওয়া ছিন্নমূল প্রজন্মের নতুন দেশে বেড়ে ওঠার নতুন জনপদের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য এক জরুরী প্রয়াস। বইয়ের প্রচ্ছদে যেন দেখি - কালো বাংলা অক্ষরমালারা কাছাকাছি আসতে আসতে ধেবড়ে গেছে, তাদের গা বেয়ে গড়াচ্ছে রক্তের দাগ, সেই রক্ত আবার কালচে জমাট বেঁধে জন্ম নিয়েছে মানুষদের আবছা অবয়ব। বইয়ের ভূমিকাতেও সোমনাথ রায়ের মনে পড়েছে তার কলকাতার বাড়ির পাশের খলিসাকোটা কলোনির মানুষদের কথা, যারা বরিশালের খলিসাকোটা গ্রাম থেকে চলে এলেও নিজেদের গণস্মৃতি এবং গণশোক ছিন্ন হতে দেননি এবং কলোনির নামের মধ্যে দিয়ে নিজেদের গ্রামকে ধরে রাখতে চেয়েছিলেন।
'ধুলোগ্রাম' উপন্যাসেও পাঠক পড়তে থাকেন ব্রহ্মপুর এলাকার কথা যেখানে 'উদ্বাস্তুরা এসে আমতলি গড়ে তুলেছে। ব্রহ্মপুরের কেউ বলে না ওটা আমতলি। তারা বলে কলোনি, রিফিউজি পাড়া। উদ্বাস্তু বসতিতে ব্রহ্মপুরের মানুষের আপত্তি নেই, কিন্তু তারা তো ব্রহ্মপুরেরই মানুষ হবে', আমতলি নাম মেনে নিতে তারা রাজি নয়।
'আমরা যেখানেই থাকি না কেন, আমতলিতেই রয়েছি, দেশ যতই আলাদা হয়ে যাক আমতলির মানুষ আমতলিতে রয়েছে, গেরাম কেড়ে লিয়া অত সহজ কম্মো নয়, গেরাম তো স্থাবর সম্পত্তি বটে স্থাবর যেমন এই মাটি, নড়ানো যায় না তারে, তেমনি এই বুকখানাও, বুকের ভিতরে যে আমতলি ঢুকে গেছে তারে তুমি সরাবা কি করে? লীগ কংগ্রেস দেখুক কি করেছি আমরা, আমরা দেশ ভাঙার বিরুদ্ধে আমতলি গড়লাম। নিজির গাঁ ছাড়া মানুষ বাঁচে?'
সব কিছু সঙ্গে আনা যায় না। কপোতাক্ষ নদ আসেনি। 'নদী তো মানুষ না যে সেধে নিয়ে আসব, নদী নেই বলে মাছমারা ক্যাওটরা কেউ আসেনি, এ আমতলিতে এক ঘরও ধীবর নেই।' হিন্দুর মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে গেছে পুরোনো আমতলির মুসলিম যুবক। নতুন আমতলির ঘরের স্ত্রী পলাতকা হয়ে যায় এপারের হিন্দু যুবকের হাত ধরে। পুরোনো আমতলির যে পুরোহিতের মুখস্থ ছিল কোন বাড়িতে কবে কোন পূজাচার, সে ঠাঁই পেয়েছে অন্য কোনো কলোনিতে, নতুন আমতলিতে সে অনুপস্থিত।
'এত বড় দেশটা দুটো ভাগে ভাগ হয়ে গেল তো কেউ কাদঁলই না তার জন্য, আসল লোক বিদ্যেবতী, হরিমতি, তার পাগল ছেলে হাজুকে ওপারে ফেলে রেখে স্বার্থপর লোক এপারে চলে এল, তাদের জন্য চোখের জলও ফেলল না কেউ'
ব্রহ্মপুরের কালোবুড়ি ধুলোগাঁর ফেলে আসা জীবনের গল্প বলে নতুন প্রজন্মকে। স্মৃতিরা মাথা বদল করে, বালক শুভ তাতে সংক্রামিত হয়। নতুন আমতলির ঘরের গুড় খেয়ে কালোবুড়ি মতামত প্রকাশ করতে দ্বিধা করে না - 'এডা সাতক্ষীরার সে গুড় নয়, এডা পাকিস্তানের গুড়, এ গুড়ে মিঠে ভাব নেই, গুড় কি এমনি এমনি হয়? তাতে লোকের মন লাগে না? মনের ভাব মিশেল হয় না? ধুলোগাঁয় ইয়াকুব, নছিম, নগেন, সাধন বসে একদলে গুড় বানাতো। সেই দল ভেঙে গেছে।' ধুলোগাঁর গাবগাছে থেকে গেছে বিদ্যেবতী ভূত। প্রতিদিন যাত্রীবোঝাই বাস যাওয়া আসা করে এপার ওপার। কালোবুড়ি শুভকে বলে হাতেবর মিঞাকে চিঠি লিখে খবর দিতে, সে এসে হাজু পাগল, তার মা আর বিদ্যেবতীকে আমতলিতে দিয়ে যাবে।
দেশভাগ হয়ে গেলে প্রশাসনও ভাগ। উপন্যাসের এই আঙ্গিকে স্বাধীনতার আগে শুভর বাবা রামরতন গ্রাম সালিশি সভায় জমির বিবাদ মেটানোর সময় প্রশাসনের কাছ থেকে মদত পেতেন। তার বিপক্ষে চলে গেছিল অবস্থাপন্ন হিন্দু মুসলমান, মহাজনরা। স্বাধীনতার পর উল্টে গেছে, প্রশাসনের মাথারা এখন তার বিপক্ষে। রামরতনকে বদলি করে দেওয়া হতে থাকে বাঁকুড়া থেকে আরো দূরে আদিবাসী অধ্যুষিত সাতপাহাড়িতে। দরিদ্র মানুষ সবসময়ই এই সরকারি কর্মচারীর পক্ষে। অথচ স্বাধীনতা সংগ্রামী বাবা তাকে চাপ দিতে থাকেন সততা বড়, কিন্তু বিপদের সময় নিজেকে বাঁচানো আরো বড়, সে যেন ওপরের সরকারি অফিসারের সঙ্গে ঝামেলায় না জড়ায়। আরেক গুণধর ছেলে নীলরতন গ্রামের আদি বাসিন্দা কাহারদের জমি ঠকিয়ে দখল নিলে তিনি খুশি হন।
এক সাদা লক্ষ্মীপ্যাঁচা নিমগাছ থেকে নিজেকে জ্যোৎস্নায় ভাসিয়ে দিতে দিতে শুভর মা প্রতিমার সঙ্গে কথা বলে। 'সাদা পাখি বসে আছে উঠোনের ঘাসে। প্রতিমার দিকে চেয়ে আছে দুটি আলোকময় চক্ষু। ফিসফিস করে, তুমি কি চেনোনি আমাকে, আমি সেই কালিহাতি থেকে আছি তোমার সঙ্গে, সেই অঘ্রান মাসে তোয়াজ খাঁ আমাকে নিয়ে এল তোমার ভাঙা ঘরে। আমি তো একা উড়ছিলাম, চরাচর অন্ধকার, আমি খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম তোমাকে আমার কোনো ঘর ছিল না, আমি মা লক্ষীকে ছাড়িয়ে পাক খাচ্ছিলাম একা একা, অন্ধ হয়ে যচ্ছিলাম। তখন সেই বুড়ো তোয়াজ খাঁ বলল, তুমি রয়েছ ভাঙা ভিটেয়, মুসলমানের ফেলে দেওয়া ছাড়া বাস্তুতে ধান ক্ষেতের ভিতরে, আমি গিয়ে দেখলাম সত্যিই তো তাই, মা কমলা বসে আছে ঘর আলো করে।'
এই সাদা প্যাঁচা যেন প্রতিমার কাছে কালিহাতি দাঙ্গার মত সমস্ত শোক ও বেদনার স্মৃতি যা দেশ কাল নির্বিশেষে যুগে যুগে সমস্ত ছিন্নমূল মানুষদের অনুসরণ করে যায়, করে যাবে।
সংকলনের 'সৌদামিনী ও সুরদাস' গল্পে যেমন, সৌদামিনীর ছোটবেলায় পরি দেখতে গিয়ে উন্মাদ হয়েছিল হরি সেন। সৌদামিনীর স্বামী তাকে বলেছিল পরি দেখলে নয়, আলোকলতার রস পেটে গেলে উন্মাদ হয়। বহুদিন বাদে সৌদামিনীর নাতনির সঙ্গে ল্যাপটপে চ্যাট শুরু করে অন্ধ কবি সুরদাস। সৌদামিনী চিনতে পারে, এ সুরদাস আসলে হরি সেন।
'যুদ্ধে যা ঘটেছিল' গল্পটি কোচবিহার জেলাশাসককে লেখা ছিটমহলের নাগরিকদের এক নিবেদনপত্র। রংপুরের নবাব ও কোচবিহারের রাজার মধ্যে গুলি ও কামান দাগার লড়াই এবং সেই লোককথা থেকে ছিটমহলের গ্রামের জন্মবৃত্তান্ত চিঠির মাধ্যমে আখ্যায়িত হয়।
এছাড়া সংকলনের কিছু গল্পে সেই শুভর প্রজন্মের চোখে পূর্বপুরুষের ধুরোল গ্রামে ফিরে যাবার অভিজ্ঞতা বা এককালে বেঁধে বেঁধে থাকা একদল মানুষের এতদিন বাদে সারা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়া উঠে এসেছে। আর বাকি গল্পগুলিতে সেই প্রজন্মকেই আসন্ন এন আর সির ভয়ের ভবিষ্যতের সম্মুখীন হতে দেখা যায়। সংকলনটি এইভাবে এক পঁচাত্তর বছরের বৃত্ত সম্পূর্ণ করে।
'কুমারী মেঘের দেশ চাই' উপন্যাসের একটা অংশ 'চোখ আর নদীর জল' গল্প নামে এই সংকলনে রাখা বিসদৃশ বলে মনে হয়েছে, বিশেষত ফুটনোটে লেখা - 'প্রকাশিতব্য কুমারী মেঘের দেশ চাই উপন্যাস থেকে এই গল্প', যেখানে উল্লিখিত উপন্যাসটি পাঁচ ছয় বছর আগে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত।