।। চার ।।
গেটটা খুলতে একটু আওয়াজ হল, আলো জ্বলে উঠল মাথার ওপর। হন্ডা গাড়িটা দেখছি না। একদিকের দেওয়াল ঘেঁষে দুটো সাইকেল রাখা, একটা হল সেদিন দেখা লেডিস সাইকেলটা।
প্যাসেজের শেষে একটা কাঠের দরজা। সেখানে একটা ছেলে - আমাদের চেয়ে সামান্য বড় – এসে দাঁড়াল। "আসুন" বলে সরে দাঁড়ালো সে। আমরা একটা বড় ঘরে এলাম।
ঘরের এক দিকে একটা ছোট টেবিল, তাতে ফাইল-টাইল রয়েছে। টেবিলের দুদিকে তিনটে চেয়ার। অন্য দিকে একটা পুরনো ধাঁচের বড় ডাইনিং টেবিল। তার পাশে চারটে চেয়ার। ডানদিকের ঘর থেকে ছেলেটা দুটো প্লাস্টিকের চেয়ার আনল, ঘরের দরজাটা ভেতর থেকে ভেজিয়ে দিল কেউ। গন্ধ আর আওয়াজে বোঝা যাচ্ছে ওটা রান্নাঘর। বাঁদিকেও একটা দরজা, ওপাশ থেকে বন্ধ।
"বসুন" বলে ছেলেটা ফ্যানের সুইচ চালিয়ে দিল। আমরা ডাইনিং টেবিলের চেয়ারগুলোয় বসলাম। স্বর্ণালী বসছিল না, তৃষা ওকে ধরে বসালো।
ছেলেটার মোবাইল বেজে উঠেছে। "হ্যাঁ স্যার বসিয়েছি… ঠিক আছে।" ফোন রেখে ছেলেটা বলল, "ওনারা ভিআইপি রোডে জ্যামে আটকে গেছেন। আপনাদের কোল্ড ড্রিংকস দিতে বললেন।" তৃষা বলল, "একটু খাবার জলও দেবেন।” ছেলেটা পাশের ঘরটায় ফিরে যেতেই স্বর্ণালীর প্রশ্ন, "ওনারা মানে কারা?"
খোঁচা বলল, "আর একটু অপেক্ষা কর।"
"না। ওনারা কারা? ডু উই নো দেম?"
"জানি তোর অনেক প্রশ্ন আছে, বাট প্লিজ আর একটু ওয়েট কর,” বলল তৃষা।
রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে এল ছেলেটা, হাতে জলের বোতল। ওর পিছনে কালো মতো একটি মেয়ে, বয়স পঁচিশ টচিশ হবে, সিন্থেটিক শাড়ির ওপর একটা কিচেন অ্যাপ্রন পরা। মেয়েটা ট্রেতে পাঁচটা কাঁচের গ্লাসে কোলা-জাতীয় পানীয় এনেছে। জলের বোতল আর ট্রেটা টেবিলে নামিয়ে ওরা চলে গেল।
"এটা কাদের বাড়ি? আমরা কী করছি এখানে? বল, নইলে আইল জাস্ট লিভ," স্বর্ণালী এবার সত্যিই রেগে গেছে মনে হচ্ছে।
"কুল, কুল," অভিষেক বলল, "এভরিথিং উইল বি ক্লিয়ার সুন।"
"হোয়াট ডু ইউ মিন বাই কুল?” ফেটে পড়ল স্বর্ণালী। “সামথিং ইজ হ্যপেনিং হিয়ার অ্যাণ্ড ইউ অল নো হোয়াট ইট ইজ এক্সেপ্ট মি। ইটস মাই বার্থডে। আমাদের সিটি সেন্টার যাওয়ার কথা ছিল টু এনজয় সাম ফুড।…”
ওর গলা ক্রমশঃ চড়ছে। আমি দেওয়াল ঘড়িটার দিকে তাকালাম, প্রায় সাতটা। আমরা আসার আগেই ওনাদের এসে যাওয়ার কথা ছিল।
“... হোয়্যার্যাজ আমরা বাঙুরের একটা বাড়িতে বসে আছি। কেন বসে আছি জানি না। তোরাও বলছিস না কিছু। অ্যান্ড আই কনসিডারড ইউ অ্যাজ মাই বেস্ট ফ্রেণ্ডস।…" হাঁপাতে লাগল স্বর্ণালী।
রান্নাঘরের দরজাটা একটু ফাঁক হল, ভিতর থেকে দু-তিন জন উঁকি মারছে।
"… তোরা যখন বলবি না তখন আমিই বলছি, ওনারা মিনস আমার মা অ্যান্ড সামবডি এলস, সামওয়ান স্পেশাল… সামওয়ান মোর স্পেশাল টু মাই মা দ্যান ইভেন মি। ওকে, দ্যাটস ফাইন উইথ মি...," দম নেওয়ার জন্য থামল স্বর্ণালী।
তৃষা আর স্বর্ণালী বসেছিল গ্যারাজের দরজাটার দিকে পিছন করে। ওদের মুখোমুখি আমি আর অভিষেক, তার চোখ মোবাইলে। খোঁচা আমার ডাইনে, সে তাকিয়ে স্বর্ণালীর দিকে। তাই আমার চোখেই পড়ল - আন্টি দরজায় দাঁড়িয়ে, হাতে নামী ব্র্যান্ডের কেকের বাক্স। তিনি তাকিয়ে আছেন মেয়ের দিকে।
আমি কিছু বলার আগেই স্বর্ণালী ফের শুরু করল, "... বাট যেটা আমি বুঝতে পারছি না সেটা হল হোয়াই ইউ পিপল আর সাইডিং উউথ দেম। ইউ ব্রট মি হিয়ার টু ইনট্রোডিউস মি টু দ্যাট সামওয়ান স্পেশাল। ডোন্ট ইউ? সরি, আমি সেই অপরচুনিটি তোদের দিতে পারছি না। বাই।"
স্বর্ণালী দ্রুত উঠল, তৃষাও উঠে দাঁড়িয়ে ওর হাত ধরল। "সিন ক্রিয়েট করিস না সোনা, প্লিজ।" জোর করে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে ঘুরতেই আন্টিকে দেখতে পেল সোনা, আর তার সাথে আর সবাই।
কয়েক সেকেন্ড সকলেই পাথরের মত স্থির হয়ে থাকলো। আন্টিই প্রথম কথা বললেন, এমনভাবে বললেন যেন স্বর্ণালীর কথাগুলো শুনতেই পাননি।
"অনেকক্ষণ এসেছো তোমরা? লেকটাউনের মোড়ে একটা অ্যাক্সিডেন্ট হয়েছে, খুব জ্যাম," বলতে বলতে আণ্টি ভিতরে এসে ছোট টেবিলটার ওপর কেকের বাক্সটা রাখলেন। চেয়ারে বসে মেয়েকে বললেন, "কি রে, কোল্ড ড্রিংকস খেয়েছিস?"
স্বর্ণালী এতক্ষণ শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল দরজার দিকে তাকিয়ে, আণ্টির দিকেও তাকায়নি। ওনার কথার কোনও উত্তর দিল না, হনহনিয়ে বেরিয়ে গেল। আমরা ছুটলাম, দেরি হলে হয়তো চলে যাবে গ্যারাজ দিয়ে। স্বর্ণালীও বোধ হয় তাই চেয়েছিল, কিন্তু গাড়িটা ফিরে এসেছে, ফলে জায়গা কমে গেছে। গাড়িটার ড্রাইভার সাইডের দরজার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছিল স্বর্ণালী। সেদিকের দরজা খুলে নেমে এলেন সেদিনের পান-কেনা ভদ্রলোক, যাঁকে আমরা এখন অরোরা আঙ্কল বলে জানি। আমরা দৌড়ে গাড়ির পিছনে এসে দাঁড়িয়ে গেছি। স্বর্ণালীর এখন দু-দিকই বন্ধ। আমাদের ওভাবে আসতে দেখে আঙ্কল কিছু একটা বুঝে নিলেন।
“হ্যালো স্বর্ণালী, নমস্কার। ম্যায় অশোক অরোরা।" স্বর্ণালী কিছু বলল না। "দেয়ার ইজ আ সেইং অ্যামং ম্যারেড পিপল - ডোণ্ট গো টু স্লিপ বিফোর রিজলভিং আ ফাইট। ইয়ে নীতি আপকো ভি ফলো করনা চাহিয়ে - ম্যায়নে ম্যাডাম কো বাতায়া থা।"
"ম্যাডাম!" স্বর্ণালীর মুখ দিয়ে যেন অনিচ্ছায় বেরিয়ে এল শব্দটা।
"আপ য্যায়সে এক বেটা অর বেটি হ্যায় মেরা। আই হ্যাভ আ রিকোয়েস্ট টু ইউ স্বর্ণালী। আজ আপকা এক স্পেশাল ডে হ্যায়। মেক ইট মোর স্পেশাল। রিজলভ এভেরিথিং। উসকে বাদ উই উইল সেলিব্রেট," আঙ্কলের গলায় অনুনয়।
উনি বললেন একটা ঘর খুলে দিচ্ছেন যেখানে স্বর্ণালী আর আন্টি কথা বলবেন। আর কেউ থাকবে না।
স্বর্ণালী চুপ করেই ছিল, একবার আমাদের দিকে তাকাল। আমি একটা কথা বলতে যাচ্ছিলাম, আঙ্কল হাত তোলায় থেমে গেলাম। শেষ পর্যন্ত স্বর্ণালী বলল, "ওকে"।
"থ্যাংক ইউ বেটি। লেটস গো ইনসাইড।"
আমরা ঘরটায় ফিরে এলাম। আঙ্কল ফোনে কথা বলছিলেন। আন্টি অন্ধকার মুখে তখনও তেমনই বসে, পাশে কেকের বাক্স। রান্নাঘরের দরজাটা বন্ধ।
কয়েক সেকেন্ড বাদে বাঁদিকের দরজাটা খুলে গেল। অরোরা আঙ্কলের স্ত্রী দরজা খুলেছেন। আন্টিকে দেখে বললেন, "নমস্তে বসুধাজী।"
আন্টি শুকনো মুখে নমস্কার ফিরিয়ে দিতে ভদ্রমহিলা ফিরে গেলেন। ওই ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে আঙ্কল ডাকলেন, "ম্যাডাম, এক মিনিট ইধার আইয়ে," বলে ভিতরে চলে গেলেন। আন্টিও গেলেন। স্বর্ণালী মন দিয়ে দেখছে দেওয়ালের ওয়াল পেপারের ডিজাইন – এবড়োখেবড়ো কাঠের দেওয়াল।
মিনিট দুই পরে ফিরে এসে স্বর্ণালীর পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন আঙ্কল। "যাও স্বর্ণালী।"
স্বর্ণালী ওনার দিকে, ওই ঘরের দিকে, আর আমাদের দিকে তাকাল। তারপর মাথা নিচু করল। আঙ্কলের ইসারায় খোঁচা ডাইনিং টেবিলের ওপর থেকে জলের বোতলটা এগিয়ে দিল। উনি সেটা স্বর্ণালীর সামনে ধরলেন। একটু ইতস্তত করে বোতলটা নিয়ে জল খেল স্বর্ণালী। খোঁচাকে বোতলটা ফেরত দিয়ে আঙ্কলের দিকে তাকাল। উনি হাতের ইসারায় দরজাটা দেখিয়ে দিলেন, স্বর্ণালী এগোল ধীর পায়ে, সঙ্গে আঙ্কলও গেলেন। দরজার মুখে এক মুহূর্তের জন্য থেমে ভেতরে ঢুকে গেল সোনা। আঙ্কল কোনও শব্দ না করে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
"চায় পিতে হ্যায়," চেয়ারে বসলেন উনি, আমাদেরও বসতে বললেন। (ক্রমশঃ)
(সানন্দা, ২ আগস্ট ২০১৯ সংখ্যায় প্রকাশিত)