প্রথমেই যা নিবিষ্ট করে তা হল এই বইয়ের অত্যন্ত সুলিখিত ভূমিকাটি। লেখক পাঠক দুইয়ে মিলেই তো সাহিত্যের সেতু গড়া। "সকলে কি লেখেন? কত নিবিষ্ট পড়ুয়া আছেন, খুঁজে খুঁজে বার করে আনেন সাহিত্যের মণি-মুক্তোগুলি। ভালো পড়ুয়া আছেন বলেই অনেক মহৎ লেখক বেঁচে ওঠেন বিস্মৃতি থেকে।" এইরকম পাঠকেরাই খুঁজে বার করেছেন কতোদিনের হারিয়ে যাওয়া গল্পগুলি। তাদের অনেকগুলিই বিশ্বমানের, অথচ তাদের স্রষ্টারা আজ বিস্মৃত। এদের সংগ্রহ করে এবং একত্রে সংকলিত করে আমাদের ধন্যবাদার্হ হয়েছেন সাহিত্যিক অমর মিত্র, প্রকাশনার জন্য গুরুচন্ডা৯। আমাদের সাগ্রহ অপেক্ষা থাকে পরবর্তী খন্ডগুলির জন্য, কারণ "এই সংকলন যেন আমাদের বংশলতিকা খুঁজে বের করা। সেই খোঁজের শুরু হলো মাত্র।"
প্রথম গল্প শান্তিরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাঁধ ভেঙে দাও। পড়তে গিয়ে যেন 'শক' লাগে। ১৯৭২এ যে লেখকের মৃত্যু হয়েছে, ১৯৫০এ আনন্দবাজারে সাংবাদিকতার শুরু, তাঁর গল্প শুরু হয়েছে তিন যুবতির উপস্থিতিতে তাড়ি আর চা-এর মধ্যে কোনটি শ্রেয় এই বিভ্রান্তি নিরসনের চেষ্টা দিয়ে। "প্রেমিকাকে অবাক বানাতে এসে এমন ফ্যাসাদে পড়ে যাবে কে ভেবেছিল। তাও যদি এসেই 'মা ওকে ডেকেছে' বলে সিনেমায় দুজনে কেটে পড়ত।
সন্ধ্যাটা কাটত খাসা। নির্ভেজাল প্রেমিকাকে পাশে নিয়ে ভাড়াটে প্রেমিক-প্রেমিকার লদকালদকি দেখে সারা দেহ প্রেমে টইটুম্বুর হয়ে উঠলে ফেরার পথে টাকসিন।"
ভাষার যথেচ্ছ সাহসী ব্যবহার মাত্রেই সাহিত্যকে আধুনিক করে তোলে কিনা এই কূটতর্কে মেতে ওঠবার আগেই আমি চটপট পড়ে ফেলি গল্পটা, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের সামনে অসহায় ক্রোধী এক প্রেমিকের বিকারের গল্প, বাড়াবাড়ি বা 'এক্সেসে'র সংজ্ঞায় কতো রকমফের বুঝে চুপ করে যাই, ভাবি এই ভাষায় না বুনলে গল্পটা হত ম্যাড়মেড়ে শোণিতশূন্য এক হাস্যকর আখ্যান, শ্লীলতার দায়ে জবুথবু।
ব্রজমাধব ভট্টাচার্যের গল্প 'কোভ এন্ড জন'- এর রৌহন আলিতে উপস্থাপনা রীতি মেনে, কিন্তু আসল টান কাহিনি বিন্যাসে, শেষের বিতর্কিত চমকে। কে জানে ধর্মান্ধ এই সময়ে এই লেখা সম্প্রীতির শান্তিজল ছেটাবে, নাকি বিদ্বেষের আগুনে হাত সেঁকে নিতে বলবে।
চমকে দেয় চন্ডী মন্ডলের জীবনজন্ম। একটি লোক মারা যাবার পর কলকাতার রাস্তায় তার শব পড়ে আছে, দিনশেষেও তার কোনো পরিচিতের দেখা নেই। শেষ অব্দি যা হয়, লাশের ঠাঁই হল মর্গে, তারপর লাশকাটা টেবিলের ওপর। কিন্তু কী আশ্চর্য সারা শরীর ছুরির তলায় ছেনেও চিকিৎসকেরা বার করতে পারলেন না তার মৃত্যুর কারণ কী! রোগ সনাক্তকরণের এই ব্যর্থতা ব্যাপারটাকে এক আন্তর্জাতিক সমস্যা করে তুলল, "একটি মৃত্যুর কারণ জানা যাচ্ছে না। মৃত্যুর কারণ জানা না গেলে মৃত্যুর হাত থেকে মানুষকে বাঁচানোর প্রয়োজনীয় ওষুধ আবিষ্কার করা যাবে না। পৃথিবীর অনেক লোক যদি এমনি অজ্ঞাত কারণে মারা যেতে থাকে, পৃথিবীতে যদি এই অদ্ভুত মৃত্যুরোগের মড়ক লেগে যায়! সেই মড়কে যদি পৃথিবী থেকে মানুষ নামে জীব লোপ পায়! পৃথিবীর প্রত্যেকটি মানুষের জীবন ভয়ংকরভাবে বিপন্ন হয়ে পড়ল!"
চেনা পরিস্থিতি, চেনা প্রতিবেশ! কিছুকাল আগে পেরিয়ে আসা মড়ক এবং তার পাগলা দাশুগোছের পুনরাবির্ভাবের আশংকায় কাঁপতে থাকা আমরা মৃতদেহের সঙ্গে কি নিজেদের চকিত সনাক্তকরণ সেরে ফেলি না চটপট? আপনাকে এই চেনা আমার চলতেই থাকে গল্পের শেষ অবধি, যখন শ্রেষ্ঠ দার্শনিক, চিন্তাবিদগণের সহায়তায় দেখা গেল মৃতের মানসিক জটিলতাই তাকে তিলে তিলে হত্যা করেছে। সহানুভূতিহীন জীবনকে সে শ্রেয় বলে জানেনি কখনও, তাই আশাহত অস্তিত্বের নিঃসঙ্গতা তার আপাদমস্তক ভরে দিয়েছিল মৃত্যুচিন্তায়। "তখন সংসার থেকে ফিরিয়ে নিয়ে লোকটির শব শ্মশানে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সরকারি সৎকার সমিতির অতি পুরাতন জীর্ণ একটি গাড়ি সেই শীতের কুয়াশাময় শেষ বিকেলে, গাড়িটি যেন পৃথিবী, যেন জননী - তাকে তুলে নিল যন্ত্রণা জঠরে। সেখান থেকে শ্মশান এক জন্মের পথ।"
শেষ বাক্যটির অভিঘাত এই পাঠকের মনে আমৃত্যু লগ্ন হয়ে রইল।
আলোচিত গল্পগুলোর মতোই শৈবাল মিত্রের খয়ের খাঁর ইন্তেকাল আমার অপঠিত ছিল। ভয়ংকর গল্প। আমূল নাড়িয়ে দিয়ে চলে যায়, পেছনে পড়ে থাকে একগাদা প্রশ্ন। চিনিবিবি আত্মহত্যা করল কেন? সত্যিই শুধু ক্ষিদের জ্বালায়? দাশু হালদারের শক্ত কাঠ শরীর কী করে ঢুকল খয়ের খাঁর কবরে? হোচেন কি খুঁজে পেল তার বহুপ্রার্থিত সুদিন?
বইটিতে পাঠকের জন্য চমকের পর চমক অপেক্ষা করে আছে। সব গল্পের নাড়িনক্ষত্রের খোঁজ দিতে গেলে এ লেখা দীর্ঘ হয়ে যাবে। আর যে মণিমাণিক্য অন্তরের ধন, তাকে খুঁজে পড়া যেন অভীষ্টকে পাওয়া। তবু দুটো গল্পের কথা বলে শেষ করি। প্রথমটি প্রিয়তোষ মুখোপাধ্যায়ের শ্রীকৃষ্ণের পট। পরিচয় পত্রিকায় বেরনো এই গল্পটির যেমন শৈলী তেমন বিষয়। গোটা গল্পটি এগিয়ে চলে ছোট ছোট বাক্যে। টেনশন, উত্তেজনা, পাপবোধ সব কিছুকে ধরে ফেলে এই ছোট অসমাপ্ত বাক্যের ছাঁচ। এক মাতৃহারা বালক বয়স এবং ইন্দ্রিয়সুখে সাবালক হচ্ছে, কিন্তু সবটাই হচ্ছে অবৈধ সম্পর্কের পরতে পরতে জড়িয়ে। অনুশোচনা, পাপবোধ সবকিছু জলাঞ্জলি দেবার পর সে কি আর মা-কে খুঁজে পাবে?
আর একটি গল্প উল্লেখ করি, রাধানাথ মন্ডলের চালে যখন কাক গলছে। গ্রামীণ পটভূমিতে একটি হতদরিদ্র পরিবারের গানপাগল ছেলে বড়লোকের মেয়েকে বিবাহ করবার সুযোগ পেয়েও তা হেলায় হারাল। নিজের ইচ্ছেতেই। কারণ ঘটকের মুখে সে শুনেছিল পাত্রীর রূপগুণের কথা। মেয়েটির আজানুলম্বিত কেশ, তার থিরবিজুরি ত্বকের ঔজ্জ্বল্য, তাকে কুন্ঠিত করে রাখল, সে স্বেচ্ছানির্বাসন নিল নিজের ভাঙা ঘরের ভেতর, অথচ যৌতুকের অর্থে হালচাল সম্পূর্ণ পালটে নেবার প্রতিশ্রুতি ছিল,"আমাকে বার বার বলা হল মেয়ে দেখতে যেতে। কিন্তু আমি গেলাম না। আমি শুধু সারা বর্ষাকাল ভেবে ভেবে কাটালাম, আমাদের এই অভাবের সংসারে সেই দুধে আলতা গায়ের রঙকে কোথায় রাখব।"
ঘন শ্যামবাজার আর একটি স্তম্ভিত করে দেওয়া গল্প। বার বার পড়তে হয়। খেলনাপাতি, বুকের ছবি, কিছুটা পরিণতির আগাম আভাস থাকলেও বিদ্রোহের গল্প ঢোলিয়া, মুন্ডহীন মানুষের চলাফেরা, কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! এ বই হাতে থাকার অর্থ একটি রত্নখনির মালিকানা প্রাপ্তি। সত্যিই এই গ্রন্থের গল্পগুলি বাংলার ছোট গল্পের উজ্জ্বল উদ্ধার। ২০২৩ সালের অবশ্যপাঠ্য হিসেবে এই বই পাঠকের দ্বারা বিবেচিত হোক।