মন নিয়ে যত আলোচনাই হোক না কেন, যতই তার প্রভাব থাক সাহিত্যে, বাংলা ভাষায় বিষয় হিসাবে মনোদর্শন একপ্রকার ব্রাত্যই থেকে গিয়েছে। বিষয়টির প্রথম পরিচয় মজাচ্ছলে করেন দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়। দেবীদাস মজুমদার নামে এক সহপাঠীর সঙ্গে কিশোর-পাঠ্য বিজ্ঞানের বারোটি ছোট বই তৈরি করেছিলেন দেবীপ্রসাদ। পুরো সিরিজের নাম দেওয়া হয়েছিল ‘বিজ্ঞান বিচিত্রা’। তার মধ্যে শোনো বলি মনের কথা (অনুষ্টুপ) ছিল নয় নম্বরে।
ভূমিকাতেই দেবীপ্রসাদ স্বীকার করেছেন, চার দশক আগের লেখা এই বইগুলোর প্রাসঙ্গিকতা তখন যা-ই থাক না কেন, এ বিষয়ে সন্দেহ নেই যে আজকের বিজ্ঞানের সঙ্গে তাদের তফাত আকাশ-পাতাল। বিজ্ঞানের অগ্রগতি ক্রমশই এমন অভাবনীয় হয়ে উঠেছে জে ডি বার্নাল একবার মন্তব্য করেছিলেন যে, গত দশ বছরে বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ গবেষণা হয়েছে, তা আগের আড়াই হাজার বছরেও হয়নি।
দেবীপ্রসাদ মূলত এই বইতে পাভলভের পরীক্ষার উপর নির্ভর করেই মনের স্বরূপ বিশ্লেষণ করেছিলেন। দেবীপ্রসাদ যখন এই বই লিখছেন, তখন তত্ত্ব হিসাবে অত্যন্ত মান্যতা পেত আচরণবাদ (বিহেভিয়ারিজম)। সোজা করে বললে, বিহাভিয়ারিজম সেই তত্ত্ব, সেখানে আচরণ দেখেই মনের নাগাল পাওয়ার চেষ্টা করা হত। ‘সাইকোলজিক্যাল বিহেভিয়ারিজম’-এর হদিশ মেলে ইভান পাভলভ (১৮৪৯-১৯৩৬), এডওয়ার্ড থর্নডাইক (১৮৭৪-১৯৪৯) এবং ওয়াটসনের গবেষণায়। তবে আচরণবাদের সর্বোত্তম দৃষ্টান্ত বিএফ স্কিনারের গবেষণা। শোনো বলি মনের কথা গ্রন্থে দেবীপ্রসাদ মূলত পাভলভের ভাবনা-চিন্তা সহজ ভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। দেবীপ্রসাদ অননুকরণীয় ভঙ্গিতে পাঠককে নিয়ে যান সেন্ট পিটার্সবার্গের অ্যাপ্টিকারস্কি নামে ছোট্ট একটি দ্বীপে যেখানে অবস্থিত ‘স্তব্ধতার প্রাসাদ’— ইভান পেট্রোভিচ পাভলভের সেই বিখ্যাত পরীক্ষাগার। পাভলভের অনুসরণে দেবীপ্রসাদ বলেন, মনের কথা ঠিক মতো জানতে চাইলে বিজ্ঞানের নিয়মকানুন ছাড়া আর কিছুর উপর নির্ভর করলে চলবে না। পাভলভের কাছে তাই প্রধান নীতি ছিল স্বচক্ষে দেখা—অবজারভেশন অ্যান্ড আগেন অবজারভেশন। ফলে নিছক বৈজ্ঞানিক পরীক্ষা করে তিনি যা স্পষ্ট দেখতে পেয়েছেন, তা নিয়েই আলোচনা করেছেন। কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স ও জন্মগত ও স্থায়ী রিফ্লেক্স অর্থাৎ আনকন্ডিশন্ড রিফ্লেক্সের ফারাক নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। বলেছেন, মানুষের সঙ্গে অন্য জন্তু-জানোয়ারের তফাত খুঁজতে হবে কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্সের পথ ধরেই। তাঁর কাছে আমাদের আবেগ-অনুভূতি, বুদ্ধি-বিবেক— সবই আসলে কন্ডিশন্ড রিফ্লেক্স। মূলত পাভলভকে অনুসরণ করেই আলোচনা রয়েছে দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের বইতে। কিন্তু, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মন-বিষয়ক গবেষণা অনেক এগিয়েছে। সেখানে শুধু আচরণবাদ নয়, এসেছে আরও নানা তত্ত্ব। এই বই যখন লেখা, তার পর থেকে কালের নিয়মে ঢের জোয়ার এসেছে বোধবিজ্ঞানের গবেষণায়। এ কথা অজানা নয় যে, বোধবিজ্ঞান বর্তমানে তিনটি পর্যায় বা তিনটি তরঙ্গ পেরিয়ে এসেছে। প্রথম পর্যায় ছিল, ক্ল্যাসিকাল কগ্নিটিভ সায়েন্স। অর্থাৎ, শুধু পুরোনো কম্পিউটেশন বা পরিগণনার যে প্রক্রিয়া, তা অবলম্বন করে মানস-জ্ঞানের প্রক্রিয়াগুলো কী ভাবে হয়ে থাকে, তা নিয়ে আলোচনা। এই পদ্ধতির ত্রুটি দূর করতে দ্বিতীয় পর্যায়ে কানেকশনিজম বা আর্টিফিশিয়াল নিউরাল নেটওয়ার্ক এসেছে। এবং তারও পর মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার দিকে তাকিয়ে কগ্নিশনকে বোঝার চেষ্টা করা হচ্ছে। সেখানে আমাদের শরীর বা দেহের ভূমিকা অস্বীকার করা হচ্ছে না। কাজেই, প্রথম পর্যায়ে কম্পিউটেশনের যে মডেল ব্যবহৃত হত, তা শরীর-বিহীন ছিল। সেখানে শরীর, প্রতিবেশ, বিষয়ীর মানস অবস্থাগুলো (যেমন আবেগ, অনুভূতি)-র গুরুত্ব ছিল না। কিন্তু, তৃতীয় তরঙ্গে সেই সব বিষয় নিয়ে কগ্নিটিভ সায়েন্টিস্টরা কাজ করছেন। এখানে শরীর-নির্ভরতার গুরুত্ব প্রধান রূপে ফুটে উঠছে। এই যে একের পর এক তরঙ্গের মধ্যে দিয়ে কী ভাবে মনের স্বরূপ জানার ব্যাপারে অগ্রগতি হয়েছে বোধবিজ্ঞানের— এ বিষয় নিয়ে ধারণা পাওয়া যায় কল্পগল্পে মনোদর্শন গ্রন্থটিতে।
চিররহস্যের আড়াল থেকে মনকে অনাবৃত করার প্রচেষ্টা দার্শনিকেরা করেই চলেছেন। গত পঞ্চাশ বছরে কম্পিউটার ও স্নায়ু বিজ্ঞানের অগ্রগতি মনোদর্শনের চর্চাকে যে ভাবে উজ্জীবিত করেছে, তার অভিঘাত বাংলা প্রকাশনার জগতে সে ভাবে পড়েনি বললেই চলে। বহু বিচিত্রপথে বিশ্বের জ্ঞানচর্চার জগতে প্রায় সর্বত্র ছড়িয়ে পড়া আলাপ-আলোচনার সঙ্গে বাংলাভাষার আগ্রহী পাঠকদের পরিচয় হবে এই গ্রন্থটির মাধ্যমে। অমিতাদেবী ভূমিকাতেই রবীন্দ্রনাথ থেকে ডেনেটের উক্তি তুলে ধরে দেখিয়েছেন, তাঁর উদ্দেশ্য মনোদর্শনের সরটুকু কল্পগল্পে ফুটিয়ে তোলা। প্রশ্ন ওঠে, গল্পের আগে কল্প কেন? এখানেও লেখক রবীন্দ্রনাথের শরণ নেন। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গল্পমাত্রেই কি কল্পলোকের অধিবাসী নয়? ক্বচিৎ কখনও গল্প যদি সত্য হওয়ার দাবি রাখে, তবে অধিকাংশ গল্পই কেবল সত্য নয়, ‘আরও-সত্যি’।’’ [গল্পসল্প, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর়, বিশ্বভারতী]।
সেই ‘আরও সত্যি’ দিয়েই মন নামক অধরা বাস্তব ধরে ফেলতে চান বলেই ‘কল্প-গল্প’ শব্দবন্ধের প্রয়োগ। কারণ আরও রয়েছে। সেই হেতু হল: এই সব গল্পের কোনওটিই অধ্যাপিকা অমিতা চ্যাটার্জির তৈরি নয়। বিভিন্ন দার্শনিক তাঁদের প্রাথমিক প্রকল্পগুলো প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে নানা লেখায় কল্প-পরীক্ষণ চালিয়েছেন। এই গ্রন্থে তেমন ২২টি কল্প পরীক্ষণ ঠাঁই পেয়েছে। এই সব কল্প-পরীক্ষণ মনবিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত প্রশ্নের উত্তর পেতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। এই প্রশ্নগুলি হল—মনের স্বরূপ কী, মনকে আমরা জানি কী ভাবে, ভাষায় আমরা যে মানস-বিধেয় প্রয়োগ করি, সে সব অর্থ পায় কোথা থেকে, মন নিয়ে গবেষণা করার আদর্শ পদ্ধতি কী—ইত্যাদি। এই কল্প-পরীক্ষণ এবং সে সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়েই মনোদর্শনের একটি রূপরেখা তৈরি হয়েছে।
অমিতাদেবীর এই গ্রন্থ বাইশটি অধ্যায়ে বিভক্ত। প্রথম অধ্যায়টিতে মন নিয়ে সমস্যার একটি দৃষ্টান্ত অমিতাদেবী তুলে ধরেছেন রাজশেখর বসুর একটি গল্প ‘দশকরণের বানপ্রস্থ’ অবলম্বনে। মন বিষয়ক সমস্যাগুলির রকমফেরের একটি রূপ পাওয়া যায় এই অধ্যায় থেকে।
দ্বিতীয় অধ্যায়, ‘আমি চিন্তা করি, সুতরাং আমি আছি’। র্যনে দেকার্তের বিখ্যাত ফার্স্ট প্রিন্সিপল অনুসারে অমিতাদেবী দেখিয়েছেন, কী ভাবে আধুনিক দর্শনে জ্ঞানতাত্ত্বিক মোড় নেওয়া শুরু হল দেকার্তের কজিটোর হাত ধরে। সঙ্গে, বার্নার্ড উইলিয়ামস্, গেওর্গ লিখটেনবার্গ অবলম্বনে দেকার্তের এই সূত্রের সমালোচনাও রয়েছে।
মজার বিষয় হল, এটি পাঠ্যপুস্তকের আকারে লিখিত নয়। ফলে যাঁরা এই (স্বল্প) আলোচনা থেকে মূল বিষয়ে আকৃষ্ট হবেন, তাঁরা মূল প্রবন্ধ বা বইগুলি পড়ে ফেলতে পারবেন—সেই খিদে জিইয়ে রেখেছেন লেখক।
তৃতীয় অধ্যায় ‘দুষ্টু জাদুকর’। শুরুতেই দীপকের গল্প। যে মা গত বছর পৃথিবী ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাঁর কণ্ঠস্বর দীপক শুনতে পান এক সময়। স্পষ্ট। দীপকের মনে হয়, তাঁর চার পাশে সবই যদি মিথ্যা হয়, তা হলে অন্তত এটা তো সত্যি যে জগতের বস্তুগুলো সম্পর্কে তিনি সংশয় পোষণ করছেন। এই সংশয় যদি কোনও দুষ্টু জাদুকরের কারসাজিও হয়, তা হলে জাদুকর যার ধারণা নিয়ে খেলছে, যাকে ঠকাচ্ছে সে নিশ্চয়ই আছে। দেকার্তের কল্প পরীক্ষণের সঙ্গে দ্বৈতবাদ প্রসঙ্গে দেকার্তের মূল চারটি সিদ্ধান্তের উল্লেখ করেছেন লেখক। দেকার্তের দর্শনে মনকে ব্যাখ্যা করার সমস্যা কী, তা-ও উল্লেখ করেছেন লেখক। তবে, ওই যে বললাম, মূল কথাটুকুই রয়েছে। তার বেশি জানতে হলে পড়ে ফেলতে হবে এ সম্পর্কে আকর গ্রন্থটি।
চতুর্থ অধ্যায়ে এসেছে রেমন্ড স্ফুলিয়ানের এক বিখ্যাত কল্পগল্প, যেখানে কার্তেসীয় দ্বৈতবাদের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য, সম্ভাবনা এবং অসুবিধা নিয়ে আলোচনা রয়েছে। ওষুধ খেয়ে মনোহীন হয়ে পড়ার বাসনার ফলে কী হল এক ব্যক্তির, তার জন্য পড়ে ফেলতে হবে এই অধ্যায়টি। কার্তেসীয় দ্বৈতবাদের কিছু সমস্যার জন্য দেকার্ত-পরবর্তী মনোদার্শনিকরা দ্রব্যদ্বৈতবাদ বর্জন করেন। দ্রব্যদ্বৈতবাদের পর আসে ধর্মদ্বৈতবাদ এবং তার প্রকার নিয়ে আলোচনা। এই পরিসরে স্পিনোজা-লাইবনিজ-এর তত্ত্ব যেমন আলোচিত হয়েছে, তেমনই এসেছে আধুনিক তাত্ত্বিক পিটার স্ট্রসন, ডোনাল্ড ডেভিডসন কিংবা নতুন শতাব্দীতে অ্যান্ডি ক্লার্কের লেখা বই মাইন্ড ওয়্যার-এর প্রসঙ্গও। সেখানেও রয়েছে দ্বৈতবাদের সমালোচনা।
অতঃপর, হ্বিটগেনস্টাইনের বিখ্যাত কল্প-পরীক্ষণ ‘বিটল ইন দ্য বক্স’। অমিতাদেবী দেখিয়েছেন, হ্বিটগেনস্টাইনের এই কল্প-পরীক্ষণটি নানা অর্থবাহী। তাঁর ব্যাখ্যায় এই কল্প-পরীক্ষণটি শুধু মাত্র ভাষাদর্শনের ‘প্রাইভেট ল্যাঙ্গুয়েজ আর্গুমেন্ট’-এর পরিসরে সীমাবদ্ধ নয়। মানস বিধেয়গুলোর অর্থনির্ণয়ে এর কী ভূমিকা, তা দেখিয়েছেন এই অধ্যায়ে। হ্বিটগেনস্টাইনের এই ‘খেলা’ ব্যবহার করে অমিতাদেবী দেখিয়েছেন, মানসজীবন ব্যাখ্যা করতে আমরা যে ভাষার প্রয়োগ করি, তা বাচ্যের নিরিখে অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে না। এই প্রসঙ্গেই আসে বিশ শতকের গোড়ায় দর্শনচিন্তায় নতুন বাঁক ‘দ্য লিঙ্গুয়িস্টিক টার্ন’-এর কথা। কার্তেসীয় তত্ত্বের ত্রুটি কী ভাবে দেখিয়েছেন গিলবার্ট রাইল, তা-ও বর্ণনা করেছেন লেখক। এই প্রসঙ্গে আচরণবাদের সমস্যার কথাও উল্লেখ করেছেন।
পাঠক যদি দেবীপ্রসাদের শোনো বলি মনের কথা পড়ার পর অমিতাদেবীর কল্পগল্পে মনোদর্শন পড়েন, তা হলে এই অধ্যায়ে পাবেন আচরণবাদের ত্রুটি সম্পর্কে ধারণা। বস্তুত, আচরণবাদের ত্রুটি এড়িয়ে মনের স্বরূপ বোঝার ক্ষেত্রে কী ভাবে অগ্রসর হয়েছে মনোদর্শন চর্চা, তা পরের অধ্যায়গুলো থেকে জানা যায়। যেখানে হিলারি পাটনাম, ডেভিড লিউইসের মতো আধুনিক দার্শনিকদের বিখ্যাত কল্পপরীক্ষণগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন লেখক। এসেছে অ্যালান ম্যাথিসন ট্যুরিং-এর ইউনিভার্সাল ট্যুরিং মেশিন-এর ধারণা—যাকে বর্তমান কম্পিউটারের পূর্বসূরি হিসাবে ধরা হয়। উল্লেখ করা হয়েছে স্ট্রং আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের সমালোচনা প্রসঙ্গে জন সার্লের বিখ্যাত ‘চাইনিজ় রুম আর্গুমেন্ট’ কল্পপরীক্ষণটি, যেখানে সার্ল দেখিয়েছেন, “Syntax is not by itself sufficient for, nor constitutive of, semantics.” সার্লের মূল বক্তব্য, কম্পিউটার যতই ‘বুদ্ধিমান’ হোক না কেন, তার ‘বোধ’ হওয়া সম্ভব নয়। এই প্রসঙ্গে চিনা ভাষার ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেছেন জন সার্ল। অমিতাদেবী সুন্দর বাংলা দৃষ্টান্তের সাহায্যে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেছেন—‘‘যদি কাগজে ইকড়িমিকড়ি লেখা থাকে, তা হলে তার উত্তর হবে চাম চিকড়ি।’’
আলোচনার এক বাঁকে উল্লেখ করা হয়েছে রবীন্দ্রনাথের ইচ্ছাপূরণ গল্পটির অনুষঙ্গ। সেখান থেকে অমিতাদেবী চলে গিয়েছেন, ডোনাল্ড ডেভিডসনের অনুসরণে মন বোঝার ক্ষেত্রে সুপারভিনিয়েন্সের ধারণায়। আলোচিত হয়েছে, টমাস নাগেলের বিখ্যাত প্রবন্ধ ‘হোয়াট ইজ ইট লাইক টু বি আ ব্যাট’, জুলিয়ান ব্যাজিনির জ়ম্বি নিয়ে কল্পপরীক্ষণের মূল প্রতিপাদ্য। ফ্রেড-এর গল্প, ‘আর্থারাইটিস ও থার্থারাইটিস’, ডেনেটের ‘কোয়াইনিং কোয়ালিয়া’, মনের স্বরূপ বোঝার ক্ষেত্রে ‘সিম্যুলেশন থিয়োরি’ ও ‘থিয়োরি থিয়োরি’র ভূমিকা প্রসঙ্গে ‘স্যালি-অ্যান’ কল্পপরীক্ষণের মূল কথাটিও উঠে এসেছে। মূল গ্রন্থ বা প্রবন্ধ অনুসারে এই কল্পপরীক্ষণগুলো প্রথমে বর্ণনা করে অমিতাদেবী দেখিয়েছেন, কী ভাবে তা মনের স্বরূপ বুঝতে সহায়ক হয়।
চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শিক্ষকতা করছেন, গবেষণা করছেন এবং করিয়েছেন, দেশ এবং বিদেশের বহু বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর পাশাপাশি অমিতাদেবী যুক্ত থেকেছেন বহু গবেষণা সংস্থার সঙ্গে। প্রেসিডেন্সি কলেজের কৃতী ছাত্রী, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিংবদন্তি অধ্যাপক রমাপ্রসাদ দাসের কাছে গবেষণা করে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি, সেখানে ‘সেন্টার ফর কগ্নিটিভ সায়েন্স’-এর প্রতিষ্ঠা এবং বঙ্গভূমে বোধবিজ্ঞানচর্চার প্রদীপশিখাটি প্রজ্বলন, চাকরির মেয়াদ শেষ করে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য এবং সেই পর্ব মিটিয়ে বর্তমানে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমেরেটা অমিতাদেবী পড়াশোনার সঞ্চারপথের খেই-হদিশ দেওয়া এক কথায় শক্ত। মনোদর্শন, বোধবিজ্ঞান (কগ্নিটিভ সায়েন্স) যদি তাঁর অন্যতম প্রিয় বিষয় হয়, তবে তার পাশেই রয়েছে লজিক, পাই সেখানে আন্ডারস্যান্ডিং ভেগনেস (প্রগতি পাবলিকেশনস)-এর মতো এক আকরগ্রন্থ, আবার স্টানফোর্ড এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ফিলোজফি থেকে তলব আসে ‘ন্যাচারালিজম ইন ক্যাসিকাল ইন্ডিয়ান ফিলজফি’ নিয়ে প্রবন্ধ লেখার। কখনও সম্পাদনা করেন আইসিপিআর জার্নাল, ডিভিশন ফর লজিক, মেথডলজি অ্যান্ড ফিলজফি অফ সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির দ্বিতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসাবে দায়িত্ব সামলানোর পাশে অমিয়কুমার বাগচীর সঙ্গে সম্পাদনা করেন মার্ক্সিজম: উইথ অ্যান্ড বিয়ন্ড মার্ক্স (রাটলেজ), কিংবা রাহুল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পাদনা করেন ইন্ডিয়ান ফিলোজফি অ্যান্ড মেডিটেশন: পার্সপেক্টিভস অন কনশাসনেস (রাটলেজ)-এর মতো বই। এর পাশাপাশি চলতে থাকে এমফিল কিংবা পিএইচডি-র কোর্স ওয়ার্কে রিসার্চ মেথডলজি পড়ানো, বিদেশে সেমিনারে প্রবন্ধ পাঠ, দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংস্থা থেকে আসা বহুবিধ দায়িত্ব। অনুরোধ আসে বুদ্ধদেবের নাস্তিকতা (কারিগর)-এর ভূমিকা লেখার জন্য, কিংবা অরিন্দম চক্রবর্তীর এ তনু ভরিয়া — দর্শন আপাদমস্তক (অনুষ্টুপ) নিয়ে গ্রন্থসমালোচনা। কল্পগল্পে মনোদর্শন তাঁর লেখা প্রথম বাংলা বই। বইটি এমন ভঙ্গিতে লেখা হয়েছে, যা পড়ে পাঠক মূল বই বা প্রবন্ধগুলি পড়তে বাড়তি উৎসাহ পেতে পারেন। সে ক্ষেত্রে তাঁর কিঞ্চিৎ সুবিধাই হবে। উদ্দেশ্য একটাই—বোধবিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম গবেষণার সঙ্গে পাঠকের পরিচয় ঘটানো।
বইটির শরীরে যত্নের ছাপ স্পষ্ট। মুদ্রণপ্রমাদ প্রায় নেই বললেই চলে। কৌস্তভ চক্রবর্তীর অলংকরণ এবং চন্দন বসুর প্রচ্ছদে বুদ্ধিমত্তার ছাপ লক্ষণীয়। এমন একটি বইয়ের জন্য প্রকাশক সাহিত্য সংসদ ধন্যবাদার্হ।
নিঃসন্দেহে এ কথা বলা যায়, বাংলায় এ জাতীয় গ্রন্থ ইতিপূর্বে রচিত হয়নি। পাঠ্যবইয়ের বাইরে মনোদর্শন নিয়ে সাম্প্রতিক এবং বৃহত্তর গবেষণাক্ষেত্রের সাধ পেতে এই বইটি এক কথায় নির্বিকল্প। ভাষা এবং আধুনিকতায় অনন্য।