ব্যাপারটার শুরু বিএসসি-র প্রথম বছরে। পরের দিন বিশ্বকর্মাপুজো-উপলক্ষ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ছুটি থাকবে শুনে আমি হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছি দেখে একজন মহীরুহসম, কিন্তু approachable শিক্ষক বললেন, “এতে অবাক হওয়ার কী আছে? যাদবপুর কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় - তা জান না?”
সে না হয় ভেবে দেখিনি, কিন্তু তা-ও, গোটা ইউনিভার্সিটিটা বন্ধ থাকবে সেই কারণে? আর কোনো স্কুল কলেজ বন্ধ থাক, না থাক?
সেই যে একটা অস্বস্তির সূত্রপাত, তারপর অনেক হিমবাহই জল হয়ে বয়ে গেছে। অস্বস্তির কারণ, তাৎপর্য, সমাধান – সবই এতদিনে নানাভাবে ঘুরেফিরে গেছে মাথায়। বছর আষ্টেক আগে একবার তো মনে হয়েছিল – এই তো, এরপর আর এই তক্কো আসবে না মার্কেটে।
যে হিসেবটা মনে ছিল না, তা হল – ‘জনতার স্মৃতিশক্তি’ – নেই বললেই চলে। তাই আজ আবার ত্যানা প্যাঁচাতে বসতে হল।
প্রশ্নটা খুব সোজা হতে পারত –
“শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পুজো করা কি ঠিক?”
নেহাতই নৈর্ব্যক্তিক প্রশ্ন। হ্যাঁ বা না বলে কাটিয়ে দেওয়া যেত, যদি না আরও নানা রঙের প্রশ্ন এসে পড়ত সামনে –
পুজোটা করছে কারা? প্রতিষ্ঠান? না ছাত্ররা? কোনো প্রতিষ্ঠানেরই কি তার মানুষগুলোকে ছাড়া কোনো অস্তিত্ব আছে? থামাবো বললেই হল – এত বছর ধরে চলে আসা আমাদের যে ঐতিহ্য – এর পূর্ণ অবক্ষয় না দেখে কি তোদের ঘুম আসে না, মিনসে? বাচ্চা ছেলেমেয়েগুলো এতদিন ধরে লকডাউনে কষ্ট পাচ্ছে, তাদের সরস্বতী পুজো নিয়েও ন্যাকামো?
আবার,
স্কুল-কলেজে সরস্বতী পুজো হলে, কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বকর্মা পুজো হলে, গণেশ পুজোও করতে হয়। হাজার হোক, ভদ্রলোক মহাভারতটা লিখেছিলেন – কাজকর্ম শুরুর আগের মঙ্গল-টঙ্গলের দাবিদাওয়াও তিনিই মেটান। ম্যানেজমেন্ট ইন্সটিটিউটগুলোয় তো অবশ্যই!
তাহলে হনুমান পুজোও করতে হয়। উত্তর ভারতের বহু জায়গায় গণেশের দায়িত্বগুলো হনুমানের কাঁধে ন্যস্ত। রামকৃষ্ণ মিশনের স্কুলগুলোয় প্রাত্যহিক উপাসনার সঙ্গে বিশেষ দিনগুলিতে ধুমধাম করে সারদাপুজো হোক – রামকৃষ্ণ তো তাঁকে আবার সরস্বতীর অবতার বলে ঘোষণা করেছিলেন... ইত্যাদি।
সংখ্যালঘুদের কী হবে? তাহলে ঈদও হোক। ক্রিসমাস, ইস্টার বাদ যাবে কেন? ভারতের কোন অঞ্চলের স্কুল-কলেজ নিয়ে কথা হচ্ছে, তবে তার ওপর নির্ভর করবে – কোন উৎসব পালন করা হয়, আর কোনটা করা হয় না – তাই না? সেক্ষেত্রে, প্রতিটি অঞ্চলের সংখ্যালঘু বাচ্চাকাচ্চাদের বুঝিয়ে দেওয়া যাবে – তোমার সংস্কৃতির কোনো গুরুত্ব নেই। সেটা মহারাষ্ট্রে বাঙালি, বা দিল্লিতে তামিল বাচ্চা – যা-ই হোক না কেন?
অন্য একটা অভিজ্ঞতার কথা বলে বোঝাই। তখন চেন্নাইয়ের Institute of Mathematical Sciences (IMSc)-এ পোস্টডক। প্রায় ৮-৯ মাস থাকা হয়ে গেছে সেখানে। কোনো ধর্মীয় উৎসবই প্রতিষ্ঠানের তরফে পালন করা হয়নি, একদিনের জন্যেও। নবীনবরণ-মার্কা ধর্মনিরপেক্ষ কিছু অনুষ্ঠান বাদে।
ইন্সটিটিউটের ডিরেক্টর খ্যাতনামা ব্যক্তি, সকলের প্রিয়ও বটে – রামচন্দ্রন বালসুব্রমনিয়ন – লোকে আদর করে ডাকে, ‘বালু’।
এক খুব গরম বিকেলে, আমাদের ইমেল করা হল – ‘আয়ুধা পূজা’ হবে। ডিরেক্টরমশাই নিজেই নাকি সেই পুজো করবেন। ইন্সটিটিউটের যে গ্যারাজটির মত আছে, সেখানে। এসব ইন্সটিটিউটে বিকেলের চা খাওয়ার সময়, সেমিনার-টেমিনার থাকলে, আরও কিছু খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। সারাদিন ঘুপচি ঘরে ঘাড় গুঁজে থাকা ছেলেমেয়ের দল খানিক রেহাই পায়। তারে কয় – হাই-টি। ভারতবর্ষের নানা প্রান্ত, ধর্ম আর সংস্কৃতি থেকে আসা ছেলেমেয়েরা সেদিন সেই আয়ুধা পুজোর প্রসাদ হাই-টিতে গলাধঃকরণ করল। প্রসাদ খেতে খেতে মনে পড়ল, এখানে আসার সময় ভেবেছিলাম, রিসার্চ ইন্সটিটিউট – অন্তত এর ভেতরে ‘যস্মিন দেশে যদাচার’ পালন করতে হবে না।
শব্দটা, আমাদের উচ্চারণে ‘আয়ুধ’, মানে অস্ত্র – পুজো। অর্থকে ইলাস্টিকের মত টানলে, পেন, খাতা, কি-বোর্ড, মায় গ্রাফিক্স কার্ডও ঢোকানো যায়। অর্থাৎ? সেই – বিশ্বকর্মা পুজোর মামাতো বোন। পরে পড়ে দেখেছি, এর কাছাকাছি সময়ে ‘সরস্বতী’ পুজোও হয় – অনেক সময় পুরোটাকেই ‘আয়ুধা পূজা’ বলে চালানো হয়, তাতে ‘পেরুমল’ ঠাকুরের মূর্তিও বসে।
বেশি না হেজিয়ে, একটা কথা প্রথমেই পরিষ্কার করে নেওয়া ভাল – বহুজাতিক, বহুভাষিক, বহু সংস্কৃতির এই দেশে – সরকারি উদ্যোগে কোনো ‘আচার’ বা ‘উপাসনা’র অনুষ্ঠান পালন (খেয়াল করুন, ‘ধর্ম’-আচরণের কথা বলিনি, কারণ এক্ষুনি লাঙ্গুল-বাহিনী এসে বোঝাতে বসবে – কোনটা ‘ধর্ম’ আর কোনটা নয়) বাঞ্ছনীয় নয়।
প্রতিষ্ঠান সকলের। ব্যক্তিগত পরিসরে যে আচারই পালন করা হোক না কেন – উৎসব যদি ধর্মনিরপেক্ষ না হয়, তবে তা প্রতিষ্ঠান/সরকার আয়োজন করতে পারে না। নইলে, এর ভিত্তিতে শুরু হয় বিভাজন, আর বিভাজন ঠিক কোন জায়গায় এসে যে বিদ্বেষের সূত্রপাত করবে, সেটা বোঝা খুব সোজা নয়।
২০১৯ এর খবর, কেরালার বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষণা করেছে, বিশ্ববিদ্যালয় ধর্মনিরপেক্ষ, সেখানে সরস্বতী পুজো করা যাবে না। [1]
ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি বহুদিন ধরেই ক্যাম্পেন করছে, যে শিক্ষাঙ্গনে সরস্বতী পুজো করা যাবে না। তা নিয়ে তারা কী কী করছে, সেটা তাদের পাতায় গিয়ে দেখে নিন, একটি পোস্টের লিঙ্ক দিলাম।
কথা এখানে শেষ নয়, সবে শুরু। এ তো নয় আমি বিধান দিলুম, যে স্কুল-কলেজে পুজো কেন, কোনো ধর্মীয় অনুষ্ঠানই হতে পারবে না।
কী হবে, ছাত্রছাত্রীরা যদি চায়?
সে চায় তো স্কুল কলেজের বাইরে গিয়ে করুক – ক্যাম্পাসে নয়।
ক্যাম্পাস যদি আবাসিক হয়? যদি দূরদূরান্ত থেকে আসা কমবয়সীদের অন্য কোথাও যাওয়ার না থাকে?
যদি তারা কর্তৃপক্ষকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে করেই ফেলে অনুষ্ঠান?
এ ঘটনা আজকের নয় – ১৯২৮ এর (ঘটনাটা আগেই জানা ছিল – আবার দেখলাম সরস্বতী পুজোর সময় ‘ব্রাহ্ম বনাম হিন্দু’ ঢাক বাজিয়ে প্রচার পাচ্ছে)।
সিটি কলেজের সংখ্যাগুরু হিন্দু ছাত্রের দল কর্তৃপক্ষের অমতে সরস্বতী পুজো করায়, কলেজ তাদের জরিমানা করে। ছাত্রদের পক্ষ নেন সুভাষ বোস, কর্তৃপক্ষকে সমর্থন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লাও ঠ্যালা!
“মহাজ্ঞানী মহাজন, যে পথে করে গমন, হয়েছেন প্রাতঃস্মরণীয় / সেই পথ লক্ষ্য করে, স্বীয় কীর্তিধ্বজা ধরে, আমরাও হব বরণীয়... “
— আর তো চলবে না! কাকে ছেড়ে কোন মহাজনকে রাখবেন?
আমাদের আগের সিদ্ধান্ত অনুসারে কি রবীন্দ্রনাথ ঠিক ছিলেন?
(কর্তৃপক্ষ ‘ব্রাহ্ম’ বলে ভুল, আর নাস্তিক হলে ঠিক – তা তো নয়, ঠিক না ভুল সেটা অবস্থাই বলে দেবে)
আপাতত, আমাদের সুবিধের জন্যে একটা উত্তর ঠিক করা যাক। কর্তৃপক্ষ কোনোভাবেই কোনো অনুষ্ঠান করতে পারে না, কিন্তু, পঠনপাঠন নষ্ট না করে, ছাত্রছাত্রীরা যদি চায় – আনন্দ করতেই পারে। এখানেও গোলমাল। আসছি।
ভুল করেও ভাববেন না, এ সমস্যা পুরাকালের। এই সেদিনও দেখেছি – একটা গোটা হোস্টেলভরা ছাত্র গণেশপুজো করছে আইআইটি গুয়াহাটিতে। চাঁদা তুলতে এসেছে আমার ঘরে। আমি নাস্তিক। জিগালাম, ইন্সটিটিউট থেকে সাহায্য পাও? উত্তর এল – না। চাঁদা দিলাম। ছেলেমেয়েগুলো খাওয়াদাওয়া, ফূর্তি করবে – এটা আমার ‘অধর্মে’ সয়।
উত্তর হ্যাঁ হলে, দিতাম না। কর্তৃপক্ষ যদি পুজোর ব্যবস্থা করত, বলতাম – হাওয়া দাও।
কর্তৃপক্ষ যদি ছোকরাদের পুজো করতে না দিত? ঠিক সেই ভুল করত, যা সিটি কলেজ করেছিল।
বেশ, তবে কি সুভাষ ঠিক ছিলেন?
তাঁর তো বক্তব্য ছিল গণতান্ত্রিক – হিন্দু ছাত্ররা সংখ্যাগরিষ্ঠ, অতএব তাদের কথা মেনে নেওয়া হোক।
সংখ্যাগরিষ্ঠতাই সমস্যার সমাধান? মোটেই না।
এই উৎসব কত বড় করে হবে? একটা সম্ভাব্য উত্তর, দেখা হোক – সংখ্যাগরিষ্ঠ কী চায়। যে অনুপাতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাওয়া যাবে, সেই অনুযায়ী ঠিক হোক – ধুমধাম করে হবে, নাকি ছোটখাটো করে।
আবার গোলমাল। সেইসব উৎসবের কী হবে, যেসব দিনে সরকার ইচ্ছে করে, কায়দা করে আগে থেকে ছুটি দেয়? যেমন এবার হল? সারা দেশ জুড়ে চ্যাঁচামেচি শুনেও যে সরকারের টনক নড়ে না – তারা ঠিক সরস্বতী পুজোর একদিন আগে স্কুল-কলেজ খুলল – ঘোষিতভাবে পুজোর প্রস্তুতির জন্যে। ফলাফল – একটা হোয়াটসঅ্যাপ ফরোয়ার্ডে দেখি, সারা কলেজবিল্ডিং টুনিবাল্ব দিয়ে ঢাকা, মাইকে গান বাজছে – মেদিনীপুরের কলেজ, না কলকাতার বড়লোক ক্লাব – বোঝা দায়। একদম উপরে যে লিঙ্কে কেরালার বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা বলা আছে, সেই একই খবরে একথাও লেখা আছে, সেই একইদিন, “পাটনার একটি কলেজে আবার সরস্বতী পুজো উদ্যাপনে বার ডান্সারদের ডেকে এনে অনুষ্ঠান করানো হয়েছে।”
সংখ্যাগরিষ্ঠতার যুক্তি ঠিক হলে – এই বা মন্দ কিসে?
এর উল্টোদিকে, সেইসব উৎসব – যাতে ছুটি থাকে না, কিন্তু বাড়িতে খুব নিষ্ঠাভরে পালন করা হয়? খান দুই পার্সি ছেলেমেয়ে যদি থাকে ক্লাসে? আদিবাসী ক’জন? তামিল কোনো একটি ছেলে – আয়ুধা পূজাও করতে দেব তো তাকে আমরা?
দেব না, এটা প্রমাণিত। আমরা দেব পুজো করতে! হা হতোস্মি! কে কী জামাকাপড় পরবে, সেটাও যখন আমরা ঠিক করে দিই!
কর্ণাটকের সরকার, মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরা ব্যান করেছে। বলেছে, এমন পোষাক নাকি পরা যাবে না, যা law and order-এ ভাঙন ধরায়। সংহতি নষ্ট করে। [2], [3]
এর সমর্থনে বানরসেনা ছাড়া আর কাউকেই বিশেষ কথা বলতে শোনা যাবে না। বানরসেনা আনন্দ পাবে, কারণ তারা ইতর।
কিন্তু যদি কেউ বলে বসে – কপালে ছাই, হাতে মাদুলি, মাথায় হিজাব, কোমরে ঘুনসি – কোনকিছুই ইউনিফর্ম-এর অংশ নয়, তাই পরা যাবে না? তাতে কি ধর্মনিরপেক্ষতার জয়গান, নাকি ব্যক্তিস্বাধীনতার হত্যা হবে?
এদিকে পূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতারও মুশকিল। IMSc-র আগের ডিরেক্টর ‘বালু’ যদি বলে বসেন, “আমি একজন ব্যক্তি হিসেবে এই ‘আয়ুধা’ পুজো করেছি, তাও গ্যারাজে – আর হাইটি-র খাওয়া স্পনসর করেছি।” – সেটা ঠিক হয়ে যাবে? প্রতিষ্ঠানের ভিতরে ডিরেক্টরের নিয়ম যে আসলে প্রতিষ্ঠানেরই নিয়ম – সে কথা তাঁকে বোঝানো যাবে তো?
তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল, যাঁর জীবনের সবথেকে স্মরণীয় কীর্তি – শঙ্খ ঘোষকে না চেনা (এ লেখার সময়ে তেনার সিবিআই সংসর্গ, ঘনঘন হাসপাতাল-যাপন এবং শিক্ষা-কেলেঙ্কারিতে অংশগ্রহণের কথা জানা ছিল না) – দেশ ও দশের কল্যাণে, নিজের ব্যক্তিস্বাধীনতা খাটিয়ে, এভাবেই, ৩ কুইন্টাল ৩১ কেজি বেলকাঠ, ১ হাজার বেলপাতা ও ৬০ কেজি ঘি সহযোগে তারাপীঠে মহাযজ্ঞ করেছেন সম্প্রতি। [4]
এ-ই প্রথম নয়, প্রতি বছর বোলপুরে, পূজ্য কালীমূর্তিকে সোনা দিয়ে মুড়ে দেওয়ার রেওয়াজ আছে তাঁর। প্রতি বছর বাড়তে থাকা সেই সোনার পরিমাণ? গত বছরের হিসেব – ৫৭০ ভরি। বাজারমূল্য ৩ কোটির বেশি। জনগণের খরচে সশস্ত্র পুলিশ মোতায়েন করা হয় সেই গয়নার সুরক্ষায়।[5]
তিনি সরকারে অধিষ্ঠিত দলের নেতা হিসেবে এ জিনিস করতে পারেন কি? কে বলবে একে, যে এ কাজ অনৈতিক? কে বাঁধবে বেড়ালের গলায় ঘণ্টি? সাধারণ ব্যক্তির সাহস আছে? কই, আমি তো কিছু বলে উঠতে পারিনি, ‘বালু’র আচরণের সমালোচনা করে!
কী কর্তব্য তবে?
অন্য যে কোনো বিষয়ের মতই, এই প্রশ্নের উত্তরেও দু’ভাবে পৌঁছনো যায়।
১) আমার মতে আদর্শ অবস্থাটা ঠিক কেমন, যাতে এই সমস্যাগুলোই আর না থাকে?
২) সেই অবস্থায় তো আর একদিনে পৌঁছনো যায় না; তদ্দিন কী করা উচিত, যাতে সাপও মরে, লাঠিও না ভাঙে?
প্রথম প্রশ্নের উত্তর যেহেতু ব্যক্তির ওপর নির্ভর করে, তাই প্রত্যেকের ক্ষেত্রে আলাদা হবে। ২য়, আশ্চর্যজনকভাবে, সবার জন্যে সমান হওয়ার কথা।
উদাহরণ: আমার ক্ষেত্রে প্রথম প্রশ্নের উত্তর – আদর্শ দুনিয়ায় ধর্মাচরণ কেবল আনন্দ-উৎসবের অজুহাত মাত্র। ইনফোসিসের ট্রেনিং চলাকালীন যদি জুতোর রঙের সঙ্গে বেল্টের রঙ মিলিয়ে পরতে লোকের আপত্তি না থাকে, তবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কোনো ধর্মাচরণ করা যাবে না – এতে কোনো অসুবিধেই হওয়ার কথা নয়। ধর্মাচরণ, অন্য সব আচরণের মতই, ব্যক্তিগত পরিসরে সীমাবদ্ধ থাকবে। বাকি সমস্ত ছোট ছোট fringe case-এর জন্যে কমন সেন্স প্রযোজ্য।
IIT গুয়াহাটির যে গল্পটা বলেছিলাম, সেক্ষেত্রে ভেবে দেখতে হবে – আবাসিক ছাত্রদের হোস্টেলটাই ঘরবাড়ি, যতক্ষণ না তারা তাদের থাকার জায়গার বাইরে কেত্তন বের করে নিয়ে আসছে, ততক্ষণ কোনো অসুবিধে নেই। নিয়মশৃঙ্খলা? যেভাবে বছরের অন্যান্য দিনে মেনে চলা হয়।
এ নেহাতই আমার আদর্শ দুনিয়া। গোঁড়া হিন্দুর মনে হতেই পারে, সারা পৃথিবী সনাতনী হয়ে যাবে, আর সক্কলে দিকে দিকে মহানন্দে ‘সরস্বতী মহাভাগে’ করবে। কিন্তু আসল গল্প তো ২য় প্রশ্নের উত্তরে।
২য়, এবং সবার জন্যে উপযুক্ত উত্তর – empathy
ওই একটিই বিষয় আছে আমাদের, প্রাণীজগতে গর্ব করার মত।
দ্রাবিড় আন্দোলনের জনক, থান্থাই পেরিয়ারের একটা কোট শুনেছিলাম পিএইচডি করার সময় (তার আগে ভদ্রলোকের শুধু নামই জানতাম): "If a larger country oppresses a smaller country, I'll stand with the smaller country. If the smaller country has majoritarian religion that oppresses minority religions, I'll stand with minority religions. If the minority religion has caste and one caste oppresses another caste, I'll stand with the caste being oppressed. In the oppressed caste, if an employer oppresses his employee, I'll stand with the employee If the employee goes home and oppresses his wife , I'll stand with that woman. Overall, Oppression is my enemy."
এই একটি বাক্যই উত্তর, ওই ২য় প্রশ্নের।
হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে মুসলিম মেয়েদের হিজাব পরতে বাধা দেওয়া যাবে না। বাংলাদেশে, হিন্দুদের দুর্গাপুজো আটকানো যাবে না। কর্তৃপক্ষ পক্ষ নিতে পারেন না, কিন্তু নিজেদের পালন করা নিয়ম পড়ুয়াদের ওপর নির্বিচারে চাপিয়েও দিতে পারেন না। নিজের বিশ্বাস যা-ই হোক না কেন, নিয়ামকরা তা নিজ-প্রতিষ্ঠানে পালন করতে পারেন না। তা ক্ষমতার অপব্যবহার মাত্র। ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সংখ্যাগরিষ্ঠতা – যে অজুহাতেই তা চাপানো হোক না কেন, সংখ্যালঘুর কাছে তা তেতো বিষেই পরিণত হবে। আবার ঘুরবে যন্ত্রণার চাকা। প্রজন্মের পর প্রজন্ম নিজেদের ভবিষ্যতকে ঘৃণা করতে, ভয় পেতে শেখাবে।
আর যা-ই হোক, নিজের প্রজাতির অন্য প্রাণীদের ধ্বংস করার লক্ষ্যে অজুহাত আমদানি করতে হোমো সেপিয়েন্সের জুড়ি নেই।
[1] কেরালার খবর: এই লিঙ্কে।
[2] হিজাব: লিঙ্ক ১।
[3] হিজাব: লিঙ্ক ২।
[4] অনুব্রত: লিঙ্ক ১।
[5] অনুব্রত: লিঙ্ক ২।