হুট করেই একটা কাণ্ড করে ফেলেছে বাংলাদেশের নারী ফুটবল দল। দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন হয়ে বসেছে! কী অদ্ভুত কাণ্ড ভাবুন একবার। কেন অদ্ভুত কাণ্ড? নিচেই একটা ছবি দিচ্ছি, ঢাকার মতিঝিলের শাপলা চত্বরের ছবি। নারী ফুটবল দল ছাদ খোলা এক বাসে করে শাপলা চত্বর ঘুরছে, ঘুরে ফুটবলের আঁতুড়ঘর, ফুটবল ফেডারেশনের অফিসের দিকে যাচ্ছে। ছবিটা কেন গুরুত্বপূর্ণ? কারণ এইটা হচ্ছে সেই শাপলা চত্বর যেখান থেকে হেফাজতে ইসলাম ১৩ দফা দাবী দিয়ে আল্টিমেটাম দিয়ে ছিল। যে দাবীগুলার মধ্যে ছিল নারীকে ঘরে বন্দী করে রাখার মত নানা দাবী। নারী চাকরি করতে পারবে না, ঘর থেকে বের হতে পারবে না ব্লা ব্লা ব্লা! সেই শাপলা চত্বরে নারীদের নিয়ে উচ্ছ্বাস, নারীদের বেশরিয়তি কাজ নিয়ে উদযাপন! এটা অন্য একটা মাত্রা পাবে না?
একজন ফুটবলারের মা ক্যামেরার সামনে বলছিল তাঁর অভিজ্ঞতার কথা। তাঁদের সকাল বিকাল সব সময় শোনানো হত যে সবাই মিলে জাহান্নামে যাবে! পুরো বংশ না কি জাহান্নামে যাবে এই মেয়ের খেলার কারণে! অর্থনৈতিক বাধা সবচেয়ে বড় বাধা, সেই বাধার পরে যখন শুনতে হয় সবাই মিলে দোজক নিশ্চিত তখন পরিস্থিতিটা ক্যামন দাঁড়ায়? এই প্রসঙ্গে বলে রাখি এই একই সুরের কথা কিন্তু আমরাও শুনছি। আমার খালাত বোন, যে আমাদের বাড়ির উঠান থেকেই বড় হয়েছে, আমাদের কলে পিঠে করে বড় হয়েছে, সে বর্তমান বাংলাদেশ নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক।
আমার খালাকে নিয়মিত শুনতে হয়েছে এই অমিয় বানী। সবাই জাহান্নামি হব আমরা। আমাদের ক্ষেত্রে আরও একটু খারাপ ছিল পরিস্থিতি, আমাদের অনেক আত্মীয় স্বজনও বলতে দ্বিধা করত না যে জ্যোতিকে খেলতে দিয়ে সব জাহান্নামি হবে। তাই জাহান্নামি হওয়ার গল্প আমাদের কাছে পুরাতন।
অনেকেরই শরীরে জ্বালা শুরু হয়ে গেছে। কারণ প্রথম ধাক্কাটাই খাচ্ছে মোল্লারা, যারা এক সময় মিছিল করেছিল এই মেয়েদের খেলা বন্ধ করতে। তাই সবার আগে প্রশ্ন এসে যাচ্ছে ওই মোল্লারা কই? এখন মোল্লারা নানা ব্যাখ্যা দিতে ব্যস্ত দেখা যাচ্ছে। কেউ বলছে এই মেয়েরা অভাবি তাই এমন বেশরিয়তি কাজ করছে, আর্থিক ভাবে সচ্ছল হলে এরা কেউ ফুটবল খেলত না। কেউ বলছে জিতছে উদযাপন করেন, এর মধ্যে আবার ধর্ম টানেন কেন? যেন তারা জানে না কেন ধর্ম টানে। সকাল বিকাল জাহান্নামে পাঠায় দিবেন আর বলবেন ধর্ম টানে কেন আজকে?
সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে এতদিন একতরফা ভারতের আধিপত্য ছিল। এবার গ্রুপ পর্যায়ে তিন শূন্য গোলে হারায় ভারতকে বাংলাদেশ। পাকিস্তানকে হারায় আট শূন্য গোলে। সেমিতে ভুটান হারে আট শূন্য গোলে। ফাইনালে নেপাল হারে তিন এক গোলে। বাংলাদেশ অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন হয়। এমন একতরফা খেলে টুর্নামেন্ট জিতল কোন দলটা? যাদেরকে প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয় পেটের ভাতের জন্য। রূপকথা না? এই দলটার আট জন এসেছে একটা গ্রাম থেকে, নেত্রকোনার কলসিন্দুর গ্রাম, যেখানে অদ্ভুত ভাবে মেয়েরা দারুণ ফুটবল খেলে। যাদের নিয়ে কয়েক বছর আগে তৈরি করা হয় একটা প্রতিবেদন, যেখানে তাঁদের চাওয়া কি জানতে চাইলে মেয়েরা বলে ভাল করে খাওয়া! এক বেলা ভাল করে খাওয়ায় দিয়েন!! কারা আমাদের সাফল্যের মুকুট এনে দিয়েছে বুঝা যাচ্ছে? পাঁচজনের বাড়ি পার্বত্য চট্টগ্রামে। তাঁদের তো আরও সমস্যা। কোন কিছুরই স্বীকৃতি নাই। পাহাড়িদের তো মানুষই মনে করে না আমাদের সভ্য সুন্দরেরা। তাঁদের নাই ঘর বাড়ি, তাঁরা গেছে ফুটবল খেলতে! এই সব সমস্যার পরে আমাদের ঐতিহাসিক আদর্শ নারী বিরোধীরা তো আছেই, যারা প্রতিনিয়ত অশ্লীল, পাপ, রসাতলে গেল সমাজ বলে চিৎকার করছে। এদেরকে লাথি মেরে এগিয়ে যাওয়া, শুধু যাওয়া না, চ্যাম্পিয়ন হওয়া এইটার সাথে কিসের তুলনা দেওয়া যায়? আমার জানা নাই, সত্যিই জানা নাই।
ফাইনালের আগেরদিন সানজিদা আকতার নিজের ফেসবুক পেজে এক অবিশ্বাস্য লেখা পোস্ট করে। কোন খেলোয়াড়ের, যে কোন ধরণের যে কোন মাপের খেলোয়াড়ের কথা মাথায় নিয়েই বলছি, এমন দুর্দান্ত জীবন বোধ সমৃদ্ধ লেখা আমি কোনদিন পড়িনি। আমি ওঁর পুরো পোস্টটা এখানে তুলে দিচ্ছি বুঝার সুবিদার্থে। -
"২য় বারের মতো সাফ উইমেনস চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে বাংলাদেশ। প্রথমবার ফাইনাল খেলেছি ২০১৬ সালে। সেবার ভারতের বিপক্ষে আমরা হেরে যাই। ৫ বার সাফের মঞ্চে এসে ১ বার রানার্সআপ, ৩ বার সেমিফাইনাল এবং ১ বার গ্রুপপর্ব থেকে বিদায় নিয়েছি আমরা।
আলহামদুলিল্লাহ, আমরা এবার মাঠে দারুণ ছন্দে রয়েছি, ফাইনালে প্রতিপক্ষ স্বাগতিক নেপাল। স্বাগতিক হিসেবে ফাইনাল খেলা কিংবা স্বাগতিক দলের বিপক্ষে ফাইনাল খেলা সবসময় রোমাঞ্চকর। এছাড়াও এবারের ফাইনাল ম্যাচটি কিছুটা ভিন্ন। বহুদিন পর সাফ পাবে নতুন কোনো চ্যাম্পিয়ন দেশ। আর তাই এবার রোমাঞ্চকর একটি ফাইনাল ম্যাচ হতে যাচ্ছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ পুরুষ জাতীয় ফুটবল দলের হাত ধরে ২০০৩ সালে দক্ষিন এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব পেয়েছিলো বাংলাদেশ। এখনো আমরা সেই গল্প শুনি। বাংলাদেশ ফুটবলের বড় সাফল্যের মহাকাব্যে সেটি উজ্জ্বলতম অংশ হিসেবে বিবেচিত হয়। এবার আমাদের জেতার সময় এসেছে। আমাদের দলের প্রতিটি সদস্য এটি জিততে মুখিয়ে আছে।
যারা আমাদের এই স্বপ্নকে আলিঙ্গন করতে উৎসুক হয়ে আছেন, সেই সকল স্বপ্নসারথিদের জন্য এটি আমরা জিততে চাই। নিরঙ্কুশ সমর্থণের প্রতিদান আমরা দিতে চাই। ছাদখোলা চ্যাম্পিয়ন বাসে ট্রফি নিয়ে না দাঁড়ালেও চলবে, সমাজের টিপ্পনী কে একপাশে রেখে যে মানুষগুলো আমাদের সবুজ ঘাস ছোঁয়াতে সাহায্য করেছে, তাদের জন্য এটি জিততে চাই। আমাদের এই সাফল্য হয়তো আরো নতুন কিছু সাবিনা, কৃষ্ণা, মারিয়া পেতে সাহায্য করবে। অনুজদের বন্ধুর এই রাস্তাটুকু কিছু হলেও সহজ করে দিয়ে যেতে চাই।
পাহাড়ের কাছাকাছি স্থানে বাড়ি আমার। পাহাড়ি ভাইবোনদের লড়াকু মানসিকতা, গ্রাম বাংলার দরিদ্র ও খেটে খাওয়া মানুষদের হার না মানা জীবনের প্রতি পরত খুব কাছাকাছি থেকে দেখা আমার। ফাইনালে আমরা একজন ফুটবলারের চরিত্রে মাঠে লড়বো এমন নয়, এগারোজনের যোদ্ধাদল মাঠে থাকবে, যে দলের অনেকে এই পর্যন্ত এসেছে বাবাকে হারিয়ে, মায়ের শেষ সম্বল নিয়ে, বোনের অলংকার বিক্রি করে, অনেকে পরিবারের একমাত্র আয়ের অবলম্বন হয়ে। আমরা জীবনযুদ্ধেই লড়ে অভ্যস্ত। দক্ষিন এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্বের জন্য শেষ মিনিট পর্যন্ত লড়ে যাবো। জয় - পরাজয় আল্লাহর হাতে। তবে বিশ্বাস রাখুন, আমরা আমাদের চেষ্ঠায় কোনো ত্রুটি রাখবো না ইনশাআল্লাহ। দোয়া করবেন আমাদের জন্য।"
আমি কি বাড়িয়ে বলেছি? আমার ধারণা না, আমি এক বিন্দু বাড়িয়ে বলিনি। সানজিদার এমন একটা পোস্টের পরে যখন দল জিতল ফাইনালে তখন স্বাভাবিক ভাবেই হাজির হয়েছে ছাদ খোলা বাসের প্রসঙ্গ। দ্রুত ব্যবস্থা হয়েছে বাসের। আর আজকে পুরো ঢাকা শহর, সেই সাথে যেন পুরো দেশ আনন্দে মাতল এমন দারুণ সুন্দর একটা উপলক্ষে।
আরেক বিষয় ছোট্ট করে বলে রাখি এখানে, আমি নারী পুরুষ তুলনায় বিশ্বাস করি না। কিন্তু একটা তুলনা এসেই যাচ্ছে এক্ষেত্রে, তা হচ্ছে এখন পর্যন্ত নারী দলই দুইটা কাপ এনে দিয়েছে আমাদের। ছোট বেলায় দেখছিলাম একবার পুরুষ দল সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল, এর পরে আর খবর নাই। এরপরে নারী ক্রিকেট দল জিতল এশিয়া কাপ আর নারী ফুটবল দল জিতল সাউথ এশিয়া কাপ! নারীর জয় গান না গেয়ে উপায় আছে?
এবার একটু তিতা কথা বলি। এই যে পুরো ঢাকা শহর সেই সাথে পুরো দেশ যে আজকে মাতল উচ্ছ্বাসে। এইটাকে আমি বেশি ভাল পাই না। আমি এদেরকে ভাল করেই চিনি। এরা আজকে মাতবে কালকে এই সানজিদাই যদি হাফপ্যান্ট আর জার্সি পরে জাতীয় স্টেডিয়াম থেকে হেঁটে বাফুফের অফিসে যায় অন্তত দশজন টিপ্পনী কাটবে, ভিড়ে কেউ কনুই দিয়ে গুঁতা দিবে, কেউ কেউ চোখ দিয়েই কাজ শেষ করে ফেলবে! যে স্বপ্ন আমরা দেখছি আজকের মানুষের উচ্ছ্বাস দেখে সেই স্বপ্ন থেকে কতদূর আমরা? না স্বপ্নই থেকে যাবে?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।