পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলা আকাদেমির রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে কিছু মজার ঘটনা ঘটল। আকাদেমির সাধারণ পরিষদের সদস্যরা তাঁদেরই মধ্যের একজনকে রবীন্দ্র পুরস্কারের জন্য মনোনীত করলেন। এতদ্ব্যতীত যাঁরা রবীন্দ্র পুরস্কার নিলেন, তাঁদের একজনকে দেখা গেল চেয়ারে বসে বসেই পুরস্কারটা গ্রহণ করতে, যদিও দৃশ্যত তাঁকে অসুস্থ লাগছিল না এবং অনুষ্ঠানের শুরুতে তিনি সিঁড়ি দিয়ে মঞ্চে উঠলেন। কিন্তু, পুরস্কার নেওয়ার সময়ে উঠে দাঁড়ানোর স্বাভাবিকতাটুকু দেখা গেল না। (এইসবের পাশাপাশি অবশ্য ফ্রাঁস ভট্টাচার্যকে পুরস্কার দেওয়া হল, বহির্বিশ্বে বাংলাসাহিত্যের প্রসারে তাঁর দীর্ঘদিনের সাধনার কথা বাংলার কিছু মানুষ জানতে পারল হয়তো) এর পরে এল আসল হুলাবিলা। আকাদেমির চেয়ারপার্সন ঘোষণা করলেন এক ত্রিবার্ষিক নতুন পুরস্কার তাঁরা চালু করছেন, সেই পুরস্কার অর্পণ করা হচ্ছে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকে। এর আগের পুরস্কারগুলি প্রদান করা হলেও এইটি অর্পণ করা হল। আমরা হর্ষে-বিস্ময়ে দেখলাম মুখ্যমন্ত্রী মঞ্চে বসে থাকলেও এই পুরস্কার নিতে এলেন না, বরং এই পুরস্কার গ্রহণ করলেন বাংলা আকাদেমির চেয়ারম্যান যিনি অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছিলেন! তথ্য ও সংস্কৃতিমন্ত্রী তাঁর হাতে পুরস্কার তুলে দিলেন। পুরস্কারের সঙ্গে প্রদেয় সাম্মানিক উত্তরীয়টি পরানো হল সাহিত্যিক আবুল বাশারের গলায়, যিনি বস্তুতই হতভম্ব মুখ করে বসে থাকলেন। পরে অবশ্য মুখ্যমন্ত্রীকেও একটি উত্তরীয় দেওয়া হল। এরপর দেখলাম শুরু হয়ে গেল সন্তোষ ট্রফি বিজয়ী দলের কিছু ফুটবলারকে রাজ্যসরকারের চাকরি দেওয়ার ঘোষণা।
পাড়ার ক্লাবের রবীন্দ্রজয়ন্তী, ছোট পত্রিকার সম্মাননা পুরস্কারপ্রদানের অনুষ্ঠান এর থেকে বেশি পেশাদারিত্ব নিয়ে হয়।
যাই হোক, মুখ্যমন্ত্রীর পুরস্কার নিয়ে প্রভূত সমালোচনা চলছে। বাংলার সমস্ত শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিক তাঁকে এই পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত করেছেন, এরকম বলা হল। আকাদেমি চেয়ারম্যান বললেন, নিরলসভাবে সাফল্যের সঙ্গে সমাজের অন্যক্ষেত্রে অবদান রাখার পাশাপাশি যাঁরা নিরলস সাহিত্যচর্চা করে যান, তাঁদের জন্য এই পুরস্কার। এবং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কবিতা-বিতান কাব্যগ্রন্থটি স্মরণে রেখে এই পুরস্কার। এই কাব্যগ্রন্থটি দুর্ভাগ্যবশতঃ আমাদের পড়া নেই। দুচারটি কবিতা আমাদের গোচরে এসেছে মুখ্যমন্ত্রীর কিছু বক্তৃতায় এবং বিশেষ করে খেয়াল করা যায়, একটি বাজেটভাষণে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী অমিত মিত্র এই বইয়ের একটি কবিতা কোট করেছিলেন। কবিতাগুলি অপাঠ্য এরকম আমরা বলতে পারি না, তবে গুণমানে কোনও সাধারণ সাহিত্যপত্রিকায় নির্বাচিত হবে না বলেই মনে হয়। লক্ষ্যণীয়, সাহিত্যপত্রিকার কথা বললাম, স্কুল কলেজ ম্যাগাজিন বা অফিস-আবাসনের সুভেনিয়রে এইধরণের কবিতা পাঠক অবশ্যই দেখেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্যকৃতীর সঙ্গে পরিচিত হতে চাইলে, পাঠক হোয়াটস-অ্যাপ বা ফেসবুক পোস্টের উপর ভরসা না করে, ইন্টারনেটে সহজলভ্য আজব ছড়া বইটি দেখে নিতে পারেন- “ভাবি যখন একূল ওকূল/ মনে পড়ে কবি নজরুল/ শিকল পড়ার ছল/ বাড়ায় মনের বল” বা “টাপুর টুপুর বৃষ্টি পড়ে/ বৃষ্টির জল মোদের ঘরে/ ইচ্ছে হয় সাঁতার কাটি রাস্তা ধরে/ বৃষ্টি পড়লে মিষ্টি ঝরে” এরকম। আমাদের চারপাশে অবশ্যই কিছু লোককে আমরা দেখেছি, যাঁরা এরকম ছড়া লেখেন। নিজের পরিচিতমহলে সেগুলো শোনান-পড়ান। এঁরা অনেকেই নিজের পরিবার বা তার বৃহত্তর কোনও সামাজিক পরিসরের উন্নতিকল্পে নিরলস পরিশ্রম করেন এবং তাঁর মধ্যেও সাহিত্যচর্চা করেন। কিন্তু, সমস্যাটা হল, যে আমরা জানি অনুরূপ কঠিন পরিস্থিতিতে এর থেকে গুণমানে অনেকটা উন্নত সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা বাংলার বহুমানুষ করছেন। খবরের কাগজ বা সাময়িক পত্রতে তাঁদের খবর প্রায়ই পড়তে পারা যায়। সোশাল মিডিয়া তো মাসে একটা করে রাণু মণ্ডল বা ভুবন বাদ্যকরকে বের করে আনছে। কিন্তু, আমাদের শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকরা তা জানলেন না? এই প্রসঙ্গে আকাদেমির শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের শ্রেষ্ঠত্ব পুনর্বিচারের প্রয়োজন দেখা দেয়। তার আগে, একটা কথা স্মর্তব্য- কবিতা-বিতান বইটি একদিক থেকে কিন্তু বাংলার তাবৎকালের সমস্ত কবিতার বইয়ের থেকে এগিয়ে। তা হল দামে। ফ্লিপকার্টে বইটির দাম দেখাচ্ছে ১১৮০ টাকা। তবে, আমরা সহজেই আন্দাজ করে নিতে পারি এত দাম রাখা হয়েছে মূলতঃ ফান্ড রেইসিং-এর জন্য। দুর্জনে বলেন বাংলার সমস্ত সরকারি লাইব্রেরিকে এই বই কিনতে হয়েছে।
যাই হোক, আমরা এবার আকাদেমি ও তার পরিচালনার ব্যাপারে আসি। বাংলা আকাদেমির পরিচিতি হিসাবে পাচ্ছি “Paschimbanga Bangla Akademi is the official regulatory body of the Bengali language in West Bengal, India” অর্থাৎ, এই পুরস্কার দেওয়া বা দুচারটে বইপ্রকাশের বাইরে বাংলা আকাদেমির এক বিরাট কাজের পরিসর রয়েছে। আমরা জানি, বর্তমানে মান্য বাংলা বানান ও লিখনরীতির জন্য আমরা আকাদেমি নির্ধারিত নিয়ম অনুসরণ করি। এছাড়াও বিভিন্ন ভাষা থেকে আগত শব্দ, কোনও নতুন বিষয়ে নতুন প্রযুক্তি নিয়ে বাংলায় আলোচনার পরিভাষা ও পদ্ধতি এবং আঞ্চলিক ভাষা ও উপভাষা থেকে মান্য বাংলায় আসা শব্দ ও বাক্যাংশ বাগ্ধারার প্রচলন বিষয়ে আকাদেমির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকার কথা। তেমনি হাজার একটা নতুন প্রকাশনা, মিডিয়া ই-মিডিয়া এবং ব্রডকাস্টিং চ্যানেলে বিভিন্নভাবে বাংলার অভিনব প্রয়োগ দেখতে পাচ্ছি, ভুল প্রয়োগও দেখছি, ভুল উচ্চারণ, ভুল অর্থে শব্দ প্রয়োগ দেখছি। আকাদেমির নিশ্চিতভাবে কাজ সেই সংক্রান্ত গাইডলাইন জারি করা। কবীর সুমন কবে চেয়েছেন, গভার্নমেন্টে থাকা উচিত উচ্চারণের ডিপার্টমেন্ট। আবার আন্তর্জালে যখন পশ্চিমবঙ্গ, আসাম-ত্রিপুরা-ঝাড়খন্ড-আন্দামান এবং বাংলাদেশের বাঙালিরা কাছাকাছি চলে আসছেন, নিয়মিত মতবিনিময় করছেন, বাংলার বিভিন্ন মান্যরীতির মধ্যের ফারাকগুলি প্রকট হচ্ছে, বাংলা আকাদেমি সম্ভবতঃ সমতাবিধানের কাজটি শুরু করতে পারেন। কিন্তু, আমরা দেখি আকাদেমির সদস্যদের মধ্যে ভাষাবিদ কেউই নেই। সকলেই প্রায় সাহিত্যিক, কয়েকজন আমলা বা প্রকাশক এবং সাহিত্যিকদের মধ্যেও মাত্র একজন এইমুহূর্তে সরাসরি অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত। অর্থাৎ, ভাষাচর্চার লোক প্রায় কেউই নেই। সাহিত্যিকরা ভাষাকে দিশা দেখাতে পারেন, কিন্তু ভাষার সংস্কার বিশারদদের কাজ। এবং বাংলাভাষা যেহেতু বহুভাষার থেকে পুষ্টিগ্রহণ করে, বিবিধ ভাষার এক্সপার্টদের আকাদেমির প্রথমসারির নিয়ামকের ভূমিকায় থাকার দরকার তা নেই।
তাহলে কারা আছেন? যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলেই প্রায় সাহিত্যিক, তদুপরি তাঁরা সকলেই শাসকদলের ঘনিষ্ঠ। আকাদেমির চেয়ারম্যান বাংলার বিশিষ্ট নাট্যকার, কিন্তু তিনি তো মন্ত্রীও। তিনি নিরলসভাবে রাজনীতিটিও করেন। আকাদেমির আরেকজন প্রভাবশালী সদস্যের কথা এই প্রসঙ্গে উল্লেখ্য, তিনি কবি। ২০১৩ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান, উৎপলকুমার বসু তখনও সাহিত্য আকাদেমি পান নি। পুরস্কার পাওয়ার নিরিখে তিনি উৎপলকুমারের থেকে এগিয়ে ছিলেন। তাঁর সাম্প্রতিক ফেসবুক কবিতার দুটি ছত্র দেখলাম- “আগে ছিল লাইন মারা, আজ সব অনলাইনে/ কাকে ভালোবাসব আমি লেখা নেই কোনও আইনে।” কিম্বা দেখলাম গলা কাঁপিয়ে আবেগভরে আবৃত্তির ভিডিও করছেন- “এ বস্তিতে ও বস্তিতে সে বস্তিতে লোপাট ভগবান/ এ বস্তিতেও বস্তিতে সে বস্তিতে আছে একটা করে খেতে না পাওয়া প্যাংলা শাহরুখ খান”, মজার হল তাঁর কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলিও এর থেকে বেশি কিছু উচ্চমানের নয়। অন্ত্যমিলের চাপ না থাকায় একটু বেশি হাত খুলে লিখছেন, সাম্প্রতিক কিছু ঘটনা নিয়ে, তার শেষে দুটো ভারী কি-ওয়ার্ড কিম্বা একটা হাল্কা স্ল্যাং জুড়ে একটু সভা গরম করছেন। কিন্তু লক্ষ্যণীয় যে প্রায় কোনও কবিতাই ঘটনার সাম্প্রতিকতার বাইরে বেরোচ্ছেন না। আর, ছন্দ এবং অন্ত্যমিলের কাঠামোতে ঢুকলে এঁর হাবুডুবু খাওয়া ক্লাস ইলেভেনের হাত মকশো করা ছেলেমেয়েদের মনেও শ্লাঘা জন্মাবে।
সভা-গরম কবিতার একটা হালকা বাজারদর আছে, মেনস্ট্রিম সিনেমার মতন। কিন্তু, সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কারপ্রাপকদের বাকি তালিকা দেখলে সেই তালিকায় এঁর উপস্থিতি বুঝতে একটু অতিরিক্ত মাথা খাটাতে হতে পারে। বর্তমানে বাংলা আকাদেমিতে এই কবির প্রতিপত্তি নাকি অবিসংবাদী এমনকী সাহিত্য আকাদেমিতেও বাংলা থেকে মনোনীত কমিটির ইনিই চেয়ারপার্সন। বাকি সদস্যদের অনেকেই এঁর সুপারিশে কমিটিতে ঢুকছেন, পুরস্কার পাচ্ছেন। আমরা জানি, তিনি আগের শাসকদলের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। সিংগুর নন্দীগ্রামপর্বে সিপিএম নেতাদের থেকেও বেশি করে সিপিএমকে সমর্থন করেছেন। এর পাশাপাশি নিজস্ব এক বলয়, একটি গোষ্ঠী বজায় রেখেছেন, যাঁরা এঁকে বাহবা দেবে, মঞ্চে এগিয়ে দেবে। পরিবর্তনের পর অনুরূপ নিরলস সাধনায় তৃণমূল কংগ্রেসের কাছের লোক হয়ে উঠেছেন। মুখ্যমন্ত্রীকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন, ক্রমশঃ মঞ্চে মুখ্যমন্ত্রীর পাশের আসনের দাবিদার হয়েছেন। এবং এর পাশাপাশি নিজের গোষ্ঠী নির্মাণ, সেই গোঠের চূড়ামণি হয়ে থাকার কাজটিও করে গিয়েছেন। এবং ক্রমে সেই গোষ্ঠীর বাকিরাও সাহিত্যকমিটিগুলোর মাথায় উঠেছে। সেই সকল কবি-সাহিত্যিকের মধ্যেও ভাষাচর্চার বাইরে অন্যক্ষেত্রে নিষ্ঠা বেশি চোখে পড়ে। বিশেষতঃ মিডিয়া ও রাজনীতির মঞ্চে তাঁদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতন। এবং এইভাবে একটি চক্র সাহিত্যসমাজের পুরোভাগে বিরাজ করছেন। এই চক্র নিশ্চিতভাবে শুধু আজকের দিনের ব্যাপার না। পেশাদার রাজনীতিকদের বাইরে প্রতিষ্ঠিত সাহিত্যিকদের পৃষ্ঠপোষণা ছাড়া এই চক্রাবর্তন চলত না। এবং, এই সব করতে গিয়ে বাংলাভাষার উন্নতিকল্পে আকাদেমির ভূমিকা খাটো হয়ে আসছে।
তাই, পুরস্কার ইত্যাদির ক্ষেত্রে, শুধু কবিতার মানের প্রশ্নটুকুতেই বিচার নির্ধারিত হচ্ছে না। কবিতার মান ব্যাপারটিতে যেহেতু কিছু অজানা ফ্যাক্টর, কিছু ধোঁয়াশা মিশে থাকে, বলতে গেলে যে কোনও শিল্পসাহিত্যেই থাকে, বাকি ব্যাপারগুলি নিয়ে নিরলস সাধনা চালালে কবিখ্যাতি থেকে শুরু করে রাজসমাদর সবই যে জুটতে পারে, তা দেখা যাচ্ছে। বিশেষতঃ, একটি রাজনৈতিক দল অবসম্বাদীভাবে ক্ষমতায় থাকলে, তার পরিধির লোকজন তথাকথিত নিরলস সাহিত্যচর্চার পাশে সেই সকল সাধনাই করে যেতে থাকেন।
অর্থাৎ সাহিত্য পুরস্কার পাওয়ার চাবিকাঠি সহজেই হয়ে ওঠে সেই ডাবল নিরলসতা। মুখ্যমন্ত্রীর পুরস্কার সেইটাকেই হাইলাইট করছে।