বিজেপির এক সাংসদের ছবি খবরের কাগজে বেরিয়েছে, যাঁকে একদম সন্তোষ দত্তের মত দেখতে। নাম হরিশ দ্বিবেদী, উত্তর প্রদেশ থেকে জিতে এসেছেন। সংসদে তিনি বক্তৃতা করছেন, মনে হচ্ছে খোদ লালমোহন বাবু দাঁড়িয়ে আছেন। এক বন্ধু হোয়াটসঅ্যাপে মন্তব্য করেছে জটায়ু "হিন্দি সেল্ফ টট" নিয়ে ঘুরতেন, আর এবার খোদ হিন্দি বলয়েই জন্মেছেন। "সোনার কেল্লা" ছবিতে জটায়ুর হিন্দি ভাষণ অমর হয়ে আছে। আম বাঙালী যা হিন্দি বলে, কাজের সূত্রে বা বেড়াতে গিয়ে, তা তো মুক্তোর মত। এই বেনা বনে তারই কিছু ছড়ানো যাক।
সমস্যাটা হয় মূলতঃ পুং লিঙ্গ স্ত্রী লিঙ্গের গোলমাল এবং ক্রিয়াপদের ব্যবহার নিয়ে। এছাড়া হিন্দির শব্দভাণ্ডার কম থাকাটাও বড় ঝামেলা। ফলে যা হয়, মুজতবা আলীর ভাষা ধার করে বলি, বাংলার তেলে ডোবানো সপসপে হিন্দি বার হয় বাঙালির মুখ দিয়ে।
"তোমার কাছ থেকে নেহি লেগা, তুমি তো এইটুকুনি দেগা।" দিল্লির ফেরিওয়ালাকে বলেছিলেন বাঙালি ভদ্রমহিলা। মুংফলি বিক্রেতা ওনার কথা বুঝতে না পারায় হাল ধরতে আসেন তাঁর দেওর। তিনি বলেন, "কাল দুসরা লোক অনেক বাদাম দিয়া থা। পরশু তুমনে অনেক কম দিয়া। ইস লিয়ে ভাবিজীকা মনমে আক্ষেপ হুয়া।"
এর পর বাদামওয়ালার কতটা আক্ষেপ হয়েছিল জানা নেই, তবে ওই দিল্লিরই এক কাজের মাসি কাঁদোকাঁদো হয়ে গিয়েছিলেন যখন তাঁর বাঙালি মালকিন তাঁকে নির্দেশ দেনঃ "বাসন মাজকে উল্টি করকে রাখনা"। পরিচারিকা কিছুতেই বুঝতে পারেননি কেন তাঁকে বাসন মাজার পর বমি করতে বলা হচ্ছে।
হিন্দিতে নির্দেশ দেওয়া নিয়ে আরও দু-একটা উদাহরণ দেওয়া যায়। "তুম কাপড়া ইধার রাখো, ম্যায় বাদমে মেল দুঙ্গি" কিম্বা অমলেট যাতে পুড়ে না যায় সে জন্য বলা "আণ্ডা পুরা মত দেনা"। প্রথম জন বাড়ির কাজের লোক৷ সে নিশ্চয় "মেল" শব্দের অর্থ খুঁজছিল। আর দ্বিতীয় জন ক্যান্টিনের কর্মচারী। সে বুঝে উঠতে পারেনি পুরো ডিম না দিয়ে কীভাবে দেবে।
এ তো গেল এক পর্ব। কর্মস্থলেও নানান কীর্তি বাঙালীর হিন্দি বলা নিয়ে। কর্মজীবনের শুরুতে লক্ষ্ণৌতে ট্রেনিং নিতে গেছেন এক বাঙালি মহিলা, আরও অনেকেই এসেছে একই কাজে। অফিসিয়াল কথাবার্তা ইংরেজিতে হলেও অন্য সময়ে বাকিরা হিন্দিতে বাক্যালাপ চালাচ্ছেন। এদিকে আমাদের বঙ্গতনয়াটি এক বিন্দু হিন্দি জানেন না। একজন বেশ ইয়ে ইয়ে ভাব দেখাচ্ছিল, নানান কথা বলছিল; কিন্তু এই সব মধুর কথা কি আর ইংরেজি ভাষায় হয়? তাই তিনি চুপচাপ থাকতেন। ফল? গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় লতা মঙ্গেশকর গেয়েছিলেন "প্রেম একবারই এসেছিল নীরবে / আমার এ দুয়ার প্রান্তে / সে তো হায় মৃদু পায় / এসেছিল পারিনি তো জানতে।" আমাদের এনার কেস অবশ্য উল্টো। ইনি পরিস্কার জানতে পেরেছিলেন দুয়ারে কে এসেছে, কেবল নিজে নীরব ছিলেন বলেই সে বেচারা ফিরে গেল। আজ পঞ্চাশোর্ধেও সেই আফসোস তাঁর যায়নি, অবশ্য এখন তিনি দিব্যি হিন্দি মে বাতচিত করতে পারেন।
অবশ্য এই ভদ্রলোকের মত বলেন কি না জানা নেই যিনি পাঞ্জাবি ক্লায়েন্টকে বলেছিলেন, "হাম ঘরমে খাকে বনকা মোষ কিঁউ তাড়ায়গা?" অথবা সেই আর একজনের মত। ইনি একগাদা প্রিন্টআউট নিয়ে যাকে দেওয়ার তাঁকে বলেন, "পেজ থোড়া আগে পিছে হো গিয়া, আপ থোড়া গুছা লেনা।"
একটা কথা হেব্বি চালু, যা করবে কনফি নিয়ে করবে, স্মার্টলি করবে। যেমন এই বয়স্কা বাঙালি ভদ্রমহিলা।
স্বামী পুত্র পুত্রবধূ নাতি সহ লক্ষ্ণৌ বেড়াতে গেছেন। উঠেছেন এক পাঁচতারা হোটেলে। কোনও একটা জায়গা ঘুরে সেখানে ঢুকতে যাবেন, পাশ দিয়ে বেরোচ্ছেন অজয় দেবগণ। ছবির শ্যুটিং করতে বেরোবেন। বাঙালি মেয়ে কাজলের বর বলে কথা। মাসীমা হাত তুলে বললেন, "দাঁড়াও বাবা।" হ্যাঁ, ঠিক ওইটাই বললেন। হিরো দাঁড়িয়ে গেলেন। এর পরের টুকু তাঁর ছেলের জবানিতেই শোনা যাক। "বাবা তুমহারা বউ ভালো হ্যায়? বাচ্চালোগ ক্যায়সা হ্যায় ? তুমি শরীরকা যত্ন লেনা হ্যায়। আর অজয় দেবগন জোড়হাত করে হাঁ মাতাজি… সব ঠিক হ্যায় ঘরমে…বাচ্চা তো স্কুল যা রহেঁ হ্যায়…জরুর.. বিলকুল…সহি ফরমায়া আপনে ইত্যাদি বলে বার চার পাঁচ নমস্তে নমস্তে বলে কোনো রকমে কেটে পড়ল। আমি আর আমার বৌ একটু দূরে দাঁডিয়ে হে ধরনী দ্বিধা হও বলছি।"
হে পাঠক, এই অবধি যা যা পড়লেন সবই ঘটেছিল বিভিন্ন জনের ক্ষেত্রে, অর্থাৎ সবই ফ্যাক্ট। শেষপাতে একটু ফিকশনে যাওয়া যেতে পারে।
স্যুটেড বুটেড পাইপ চিবানো ইংরেজি কপচানো এক বাঙালি সাহেবকে সর্দার টিকিট চেকার ফার্স্ট ক্লাস কম্পার্টমেন্টে টিকিট দেখতে চেয়েছে। সাহেব জানাচ্ছেন তাঁর টিকিট আছে ব্রিফকেসে, তাই তিনি দেখাতে পারছেন না। এই নিয়ে কিছুকাল ইংরেজি, তারপর হিন্দিতে বিতণ্ডার পর দেখা গেল সাহেবের টিকিট নেই। চেকার মশাই জানালেন বাঙালি বাবুদের তিনি ভাল করেই চেনেন, তাঁরা ইত্যাদি ইত্যাদি। বনফুলের ছোট গল্পের নায়ক খাটো ধুতি পরা গেঁয়ো গরীব চেহারার শ্রীপতি সামন্ত পাশের বার্থেই ছিলেন নিতান্ত বাধ্য হয়ে, ঘুমোবার চেষ্টা করছিলেন, এদের চেঁচামেচিতে নিদ্রার বারোটা বেজে গেল। দু রাত দু চোখের পাতা এক করতে পারেননি, ঘুমটা খুব জরুরী। তাই সাহেবের টিকিটটাও তিনি কেটে দিলেন এবং চেকারকে ভর্ৎসনা করলেনঃ "কটা বাঙালি আপ দেখা হ্যায়? জাত তুলকে গালাগালি দেওয়া কোন দিশি ভদ্রতা রে বাপু? দুর্গা শ্রীহরি দুর্গা শ্রীহরি দুর্গা শ্রীহরি।" সামন্ত মশাই আপন বার্থে ফের লম্বমান হলেন।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।