১১ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭৩। চিলি এবং লাতিন আমেরিকার প্রথম নির্বাচিত মার্ক্সবাদী প্রেসিডেন্ট সালভাদর আইয়েন্দের বিরুদ্ধে সিআইএ ও মার্কিনিদের পদলেহী পাষণ্ড আউগুস্তো পিনোচেৎর নেতৃত্বে সেনাবাহিনী অভ্যুত্থান করে। যুদ্ধবিমান, রাষ্ট্রপতির প্রাসাদে নিরন্তর বোমা বর্ষণ করে অসহায় আইয়েন্দে ও তাঁর রক্ষীদের হত্যা করে। মৃত্যুর আগে স্বাধীনচেতা, নির্ভীক প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশ্যে অন্তিম ভাষণ দেন। তিনি বলেন, আমার দেশের মেহনতি মানুষের উদ্দেশ্যে আমি জানাতে চাই, যে চিলির ভবিষ্যতের ওপর আমার আস্থা আছে। অন্যান্য মানুষেরা রাষ্ট্রদ্রোহিতার এই তমসাবৃত সময় অতিক্রম করবে। এগিয়ে যান … প্রশস্ত সড়ক পথ ধরে স্বাধীন, মুক্ত মানুষ আবার পদচারণা করবেন এবং উন্নত সমাজ গড়ে তুলবেন।
একটি নির্বাচিত সরকারের ওপর এরকম নির্লজ্জ, নির্মম আক্রমণ সারা বিশ্বকে হতচকিত করে। পিনোচেৎর দীর্ঘ সতেরো বছরের পাশবিক শাসনকালে হাজারো বামপন্থী মানুষ নিহত হয়েছে, নির্যাতিত হয়েছে, আরও অনেকে চিরকালের জন্য নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। তাঁর নিও-লিব্যারাল অর্থনীতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন বিধ্বস্ত হয়ে গেছে। ১৯৮৩ সালে প্রখ্যাত চলচ্চিত্র-পরিচালক মিগুয়েল লিতিন ছদ্মবেশ ধারণ করে দেশে প্রবেশ করেন। ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসের পরিবেশে, রীতিমত জীবনের ঝুঁকি নিয়ে, তিনি চার ঘণ্টার একটি তথ্যচিত্র, ‘অ্যান এক্সাইলস জার্নি ব্যাক’ নির্মাণ করেন – যার প্রতিটি ফ্রেমে তিনি চিলির জনতার ওপর নৃশংস দমন-পীড়নের ছবি ফুটিয়ে তোলেন। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ তাঁর ‘ক্ল্যান্ডেস্টাইন ইন চিলি’ বইতে লিতিনের এই দুঃসাহসিক অভিযানের বর্ণনা তাঁর স্বভাবসুলভ রুদ্ধশ্বাস ভঙ্গিতে ফুটিয়ে তোলেন। তথ্যচিত্র এবং এই বইয়ের মাধ্যমে সারা বিশ্ব, চিলিতে মার্কিন সমর্থনপুষ্ট তথাকথিত গণতন্ত্রের পরিবর্তে যে কী বিভীষিকা রাজ চলছে, তা জানতে পারে। প্রবল প্রতিক্রিয়ার কারণে পিনোচেৎ ১৯৯০-এ রাষ্ট্রপতি পদ থেকে সরে দাঁড়ান, যদিও সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসাবে জাতীয় রাজনীতিতে তাঁর প্রভাব প্রায় অটুট থাকে।
পিনোচেৎয়ের আমল থেকে চালু হওয়া বাজার অর্থনীতি কীভাবে চিলির মানুষের জীবন বিপর্যস্ত করে দিয়েছে, তা একটু আলোচনা করা যেতে পারে। ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পরই স্বৈরাচারী শাসক আইয়েন্দের আমলের কল্যাণমূলক প্রকল্পগুলি বাতিল করে দেয়। অসাম্য অভূতপূর্ব ভাবে বৃদ্ধি পায়; ২০০৬ সালে দেশের সর্বোচ্চ বিত্তশালী ১০%, সবচেয়ে নিম্নবিত্ত ১০%-এর চেয়ে ৩০ গুণ বেশি উপার্জন করত; ২০১৭ সালে সেটা হয়ে দাঁড়ায় ৪০%। শ্রমিকদের বিশেষভাবে নিশানা করা হয়। অস্থায়ী, ক্যাজুয়াল ও কন্ট্রাক্ট শ্রমিকের সংখ্যা বিপুলভাবে বাড়িয়ে দিয়ে তাঁদের ইউনিয়ন করার অধিকার হরণ করা হয়, কর্মক্ষেত্রে তাঁদের সমস্ত সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করা হয়। একটা সময় দেখা যায়, দেশের কর্মীসংখ্যার মাত্র ৩% ইউনিয়নে নথিভুক্ত। আইয়েন্দে-জমানায় পেনশন তহবিলে কর্মচারী, নিয়োগকারী এবং সরকার – প্রত্যেকেই নির্দিষ্ট অঙ্ক জমা দিত। পিনোচেৎ এই পেনশন ব্যবস্থা পালটে দেন। সেনা এবং পুলিশ বাদে বাকি সব শ্রমিক কর্মচারীদের ক্ষেত্রে নিয়োগকারী এবং সরকারের দান বন্ধ করে দেওয়া হয়। এর ফলে পেনশন এতটাই হ্রাস পায়, যে মধ্যবিত্ত মানুষরাও চরম সঙ্কটগ্রস্ত হয়ে পড়ে।
গত তিন দশকে যত সরকার চিলিতে ক্ষমতায় এসেছে, তারা প্রত্যেকেই এই অর্থনৈতিক নীতি অনুসরণ করেছে; একইভাবে জাতীয় রাজনীতিতে সামরিক বাহিনীর প্রভাব কম-বেশি অটুট থেকেছে। মাঝেমধ্যেই গণতন্ত্রের দাবিতে মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছে, সেনা পুলিশের সাথে খণ্ডযুদ্ধ হয়েছে। ২০০৬ সালে ছাত্রসমাজ শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। আইয়েন্দে সরকারের পতনের পর থেকে যে বেসরকারি শিক্ষা ব্যবস্থা দেশে চালু করা হয়েছিল তাঁরা সেটা বাতিল করার দাবি জানান। চিলির শিক্ষাব্যবস্থায় শ্রেণীবৈষম্য প্রকট; প্রায় অর্ধেক স্কুল সরকারি এবং সেগুলির অবস্থা শোচনীয়। তাঁদের অন্যান্য দাবিগুলি ছিল – বিনা পয়সায় সরকারি যানবাহন ব্যবহার করতে দেওয়া, কলেজের প্রবেশিকা পরীক্ষার ফি কমানো, এবং সরকারি নীতিতে ছাত্রসমাজের মতামতকে গুরুত্ব দেওয়া। প্রায় দশ লক্ষ ছাত্রছাত্রী ধর্মঘট ঘোষণা করেন। ব্যারিকেড তৈরি করে স্কুলে পুলিশের প্রবেশ রুখে দেন। প্রায় তিন মাস ধরে বহু স্কুল বন্ধ থাকে, অনেকে গ্রেপ্তার হন, কিন্তু মরিয়া ছাত্ররা সমস্ত দমনপীড়ন রুখে দেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট মিশেল ব্যাকেলেত, লাতিন আমেরিকার প্রথম মহিলা রাষ্ট্রপতি, ছাত্রদের অধিকাংশ দাবি মেনে নেন। ২০১১র ছাত্র বিক্ষোভ শুধু শিক্ষা-সংক্রান্ত দাবিতেই সীমাবদ্ধ থাকে না, সেই আন্দোলনে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের নানা দাবিদাওয়া উঠে আসে: পরিবেশবিদরা একটি জল বিদ্যুৎ কেন্দ্র বন্ধ করার দাবি তোলেন; তামা খনির শ্রমিকরা ধর্মঘট করেন; সমকামীরা লিঙ্গ সাম্যের দাবি তোলেন; কৃষকরাও নানা দাবিতে সরব হন। এই আন্দোলনেই গ্যাব্রিয়েল বোরিক নামে এক পঁচিশ বছরের ছাত্রনেতা জাতীয় রাজনীতিতে আত্মপ্রকাশ করেন।
২০১৯-এর আন্দোলন চিলির রাজনীতিতে একটি মাইলফলক। এই প্রথম জনতা কাঠামোগত পরিবর্তন দাবি করে। তাঁরা বলেন, বাজার অর্থনীতি শুধুমাত্র ক্রমবর্ধমান অসাম্য সৃষ্টি করেছে, সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছে। জনতা সোচ্চারে বলে, যে এই সামাজিক ও অর্থনৈতিক মডেল তাঁদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই মডেল বাতিল করার জন্য তাঁরা নতুন সংবিধান তৈরি করার দাবি জানান। দেশজুড়ে এই দাবির সমর্থনে বিপুল বিক্ষোভ সমাবেশ সংঘটিত হয়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি সেবাস্তিয়ান পিনেরা উপলব্ধি করেন যে শুধুমাত্র শক্তি দিয়ে এই জনজোয়ারকে রোধ করা যাবে না। ২৫শে নভেম্বর দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলি একত্রিত হয়ে একটি গণভোটের দাবি করে। এই ভোটের মাধ্যমে দেশের মানুষ একটি নতুন সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করা হবে কিনা, সেটার ওপর রায় দেবে; সেই খসড়া কীভাবে তৈরি করা হবে, সেটাও ঐ গণভোটের মাধ্যমে ঠিক করা হবে। গণভোটে ৭৮% মানুষ নতুন সংবিধান তৈরি করার পক্ষে রায় দেন। এর জন্য ১৫৫ জনের একটি কন্সটিটিউশনাল কনভেনশন গঠন করা হয়। এই কনভেনশনের গঠন অভিনব ও বৈচিত্র্যপূর্ণ। এতে চিলির মূলবাসী জনগণের ১৭ জনকে স্থায়ী সদস্য করা হয়। নিয়ম করে দেওয়া হয় যে লিঙ্গ ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য পুরুষ বা মহিলার কারোরই ৫৫%র উর্ধ্বে প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। এছাড়া বেশ কয়েকজন পরিবেশবিদকেও সদস্য করা হয়। কনভেনশন জুলাই, ২০২২ এর মধ্যে নতুন সংবিধান প্রস্তুত করবে। জনতা পুনরায় গণভোটের মাধ্যমে নতুন সংবিধান গ্রহণ করবে, না হলে পুরানো ১৯৮০ সালের সংবিধানই বহাল থাকবে।
ইতিমধ্যে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন চলে আসে। দু’জন প্রতিদ্বন্দ্বীর একজন, গ্যাব্রিয়েল বোরিক, যাঁর মধ্যে দেশের মানুষ আটচল্লিশ বছর আগের জননেতা সালভাদর আইয়েন্দের প্রতিচ্ছবি দেখেন। তিনি সোশ্যাল কনভার্জেন্স পার্টির একজন সদস্য যেই দল ‘আপ্রুয়েবো দিগ্নিদাদ’ জোটের সাথে সংযুক্ত। আরেকজন রিপাব্লিকান দলের হোসে আন্তোনিও কাস্ত, যিনি এক সময় পিনোচেৎর প্রবল সমর্থক ছিলেন, কিন্তু স্বৈরাচার-বিরোধী প্রবল জনমত দেখে ধীরে ধীরে নিজের অবস্থান পাল্টানোর চেষ্টা করেন। এছাড়াও বোরিক সাংবিধানিক পরিবর্তনের প্রবল সমর্থক এবং কাস্ত ছিলেন গণভোটের ঘোর বিরোধী।
আমরা জানি ৫৫% ভোট পেয়ে গ্যাব্রিয়েল বোরিক, ছাত্র আন্দোলনের বহু ব্যারিকেড পেরিয়ে, পুলিশি দমনপীড়নের মোকাবিলা করে, নতুন রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন। তিনি ৪৬ লক্ষ ভোট পেয়েছেন যা তাঁর যে কোনও পূর্বসুরিদের চেয়ে বেশি। বোরিক দেশে গণতন্ত্র রক্ষা করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি নিও লিব্যারাল অর্থনীতির প্রবল বিরোধী। “চিলি নিও লিব্যারিলজমের জন্মভূমি ছিল, এখানেই সেটার কবর খোঁড়া হবে,” তিনি ডাক দিয়েছেন। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, পেনশন এবং কর সংস্কার করতে তিনি বদ্ধপরিকর। তিনি সামাজিক ন্যায়ের আওয়াজ তুলেছেন। তাঁর সরকারে মহিলা, মূলবাসী এবং এলজিবিটিকিউদের উল্লেখযোগ্য প্রতিনিধিত্ব থাকবে। তাঁর দল বামপন্থী; তিনি মার্কসবাদী কিনা, তার কোনও ইঙ্গিত এখন অবধি পাওয়া যায়নি। তিনি কল্যাণমূলক রাষ্ট্র নির্মাণ করার পক্ষপাতী।
লাতিন আমেরিকায় এই ধরণের রাজনীতির এখন বেশ রমরমা। এর আগে পেরুতে পেদ্রো ক্যাস্তিলো ‘নো মোর পুওর ইন আ রিচ কান্ট্রি’ আওয়াজ তুলে ক্ষমতায় এসেছেন। তিনি মাইনিং শিল্প, যা কর্পোরেটদের লীলাক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে, সেটির জাতীয়করণ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। হন্ডুরাসে বামপন্থী মহিলা প্রার্থী জিওমারা কাস্ত্রো ৫৩% ভোট পেয়ে ক্ষমতায় এসেছেন। কাস্ত্রো সাংবিধানিক পরিবর্তনের ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া শুরু করেছেন এবং তিনি গর্ভপাত সংক্রান্ত নীতি শিথিল করার পক্ষে। লক্ষণীয়, তিনি তাইওয়ানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে চিনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। এঁরা প্রায় প্রত্যেকেই বাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে। এঁরা ধনীর ওপর কর বসিয়ে অসাম্য কমানোর পক্ষে। এঁরা সরকারি তহবিল থেকে খরচ বাড়িয়ে দরিদ্র মানুষকে উন্নত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা দেবার পক্ষপাতী। এঁরা বেসরকারিকরণের রাশ টেনে ধরতে চান, অর্থনীতিতে বহুজাতিক সংস্থা ও কর্পোরেটদের রমরমা নিয়ন্ত্রণ করতে চান। কিন্তু এঁরা পুঁজিবাদী কাঠামোর র্যাডিকাল কোনও পরিবর্তন দাবি করছেন না। কর্পোরেটদের নিয়ন্ত্রণ করতে চাইছেন, কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করছেন না। আমেরিকার সাথে দ্বন্দ্ব আছে, আবার একটা চলনসই সম্পর্কও আছে। এঁরা প্রথাগত গণতান্ত্রিক কাঠামোয় বিশ্বাসী এবং সেই অর্থে এঁরা মহাদেশের পুরানো বামপন্থী দেশ কিউবা ও ভেনেজুয়েলা থেকে আলাদা। এটা লাতিন আমেরিকার এক বিশেষ ঘরানার বামপন্থা। সমাজ পরিবর্তনের লক্ষ্যে এটা একটা অভিনব পরীক্ষা বৈকি।