এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বই

  • পড়া-শোনা

    Chayan Samaddar লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বই | ১৩ নভেম্বর ২০২১ | ১৮৬০ বার পঠিত | রেটিং ৪.৭ (৩ জন)
  • কী পড়া উচিত ছোটোদের? আজকালকার তাত্ত্বিকের চিন্তায়, কালচার-রাজনীতি-ক্ষমতার স্বর যা অনুমোদন করে আর যা করে না, তাদের মধ্যে একটা সমঝোতায় আসার প্রয়াসী হয়ে, শিশু-কিশোর সাহিত্য দীর্ঘকাল ধরে সেটাই ঠিক করে আসার চেষ্টা করছে। মুদ্রণ জগৎও ঠিক করে দিতে চায় কী পড়বে ছোটোরা। এক সাহেব পণ্ডিত, পেরি নুডল্‌ম্যান, মনে করেন, এই ঠিক করে দেওয়া সীমাটা, মাঝেমাঝে কিছু শিশু-কিশোর সাহিত্য, ডিঙোতে চাইলেও, কখনওই পুরোপুরি পেরে ওঠে না। 
     
    আমাদের চিন্তা এই কথাটা নিয়েই। কারণ, শিশু-কিশোর সাহিত্য গবেষণা এই জাতীয় সাহিত্যের মধ্যে খুঁজে পায় ‘লুকোন বড়ো’দের। এক তো যাঁরা ছোটোদের জন্য লেখেন, তাঁরা যেভাবে বাল্য-কৈশোরকে মনে করতে পারেন অথবা যেমনটি হওয়া উচিত ছিল বলে বিশ্বাস করেন, সেইভাবে দেখান। অন্যদিকে, তাঁরা এমন একটা পৃথিবীর ছবি আঁকেন, যেটাকে বুঝতে পারা সোজা; কিন্তু এই সহজতাই, আড়ে অবডালে বোঝাতে চায়, যে অবস্থা তথা অবস্থান এই সহজতার জন্ম দেয়, সেটা আদৌ সহজ নয়। অন্যভাবে বলতে গেলে, অনেক ছোটোদের জন্য লেখা আমরা খুঁজে নিতে পারি, যেখানে রচয়িতারা সহজ জটিলতা বা জটিল সহজতাকে ভাষার জাদুতে জীবন্ত করেছেন। এমন গল্প লিখেছেন, যা প্রাপ্তবয়স্ক পৃথিবীর, এবং চেয়েছেন ছোটোরা এই দুনিয়াটাকে নিজের চেতনার আলোয় বুঝে নিক। একই সঙ্গে তাঁদের আখ্যান বড়োদের সঙ্গেও কথা বলে গেছে, যেহেতু কথাপাঁচিলের আড়ালে লুকিয়ে আছে এক প্রাপ্তবয়স্ক। 
     
    এই কথাগুলো মনে রেখে, আমি, কয়েকটা কিশোর সাহিত্য হিসেবে পরিচিত বাংলা গল্প ও একটি উপন্যাস পড়ব। আর পড়ার সময়, নিজেকে দু’ভাগে ভেঙে নেব। চয়ন সমাদ্দারের শৈশব-কৈশোর আর পরিণত বয়সকে মিশিয়ে এই পাঠ বয়স্ক আর অল্পবয়সীর পঠনক্রিয়ার মধ্যে একটা সংলাপ রচনা করবে আশা করি। 
     
    মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় একবার লিখেছিলেন, 'বড়োদের জন্য লেখা এমন গল্প যদি বেছে নেওয়া যায় যাতে কিশোর মনকে বিগড়ে দেবার মতো কিছুই নেই; বরং গল্প পড়ে বড়োদের জীবন সংঘাতের কমবেশি পরিচয় পেয়ে কিশোর মন নাড়া খাবে, বিস্ময় ও অনুসন্ধিৎসা জাগবে,সেরকম গল্প কিশোরদের পড়তে দিলে দোষ কি?' বুঝতেই পারছেন, তিনি খোকাপনা বাদ দেওয়া, মানুষের গন্ধ মাখা, জীবনের তাপে উত্তপ্ত লেখার কথা বলছেন - যা ছোটো-বড়ো সবার। অর্থাৎ, ছোটোদের লেখা - বড়োদের লেখা এই বিভাজনটা, নেহাৎই আরোপিত। 
     
    কতটা আরোপিত তা বোঝার জন্য, প্রথম গল্পটা এবার পড়া যাক। সন ১৩৭৬ বা ১৯৬৯ সালের শারদীয়া কিশোর ভারতীতে "বাজারদর" নামে একটা গল্প লেখেন আশাপূর্ণা দেবী। ই. আর. ই. থেকে অবসর নেওয়া অঘোর চক্রবর্তীর অভাব কিছু নেই। ছেলেরা প্রতিষ্ঠিত। নাতি নাতনি নিয়ে ভরা সংসার। অঘোরবাবুর একটাই প্যাশন। তাঁর যৌবনের বাজারদর আর এখনকার বাজারদরের তুলনা। মোগলসরাইয়ের ঘি, বক্সারের আনাজপাতি, মাছ, মাংস; রঘুনাথপুরের দুধ আর খোয়া ক্ষীরের স্বপ্নে মশগুল তিনি। সংসার চালাতে এত খরচ কেন করে ছেলেরা তা তিনি ভেবে পান না। যাই হোক, মানিয়ে গুছিয়ে চলছিল সব ঠিকঠাক। হঠাৎ, একদিন অঘোরবাবুর এক ভাগনি এসে হাজির, আর তাঁরও সেই সস্তাগণ্ডার যুগের গল্পের ভাঁড়ার অফুরন্ত। বাড়িশুদ্ধ মানুষের কান ঝালাপালা। একদিন হঠাৎ ধৈর্যচ্যূতি ঘটে অঘোরের বড়ো ছেলে বিশুর। তীক্ষ্ণ ব্যঙ্গের হাসি হেসে, তিনি বলে ওঠেন, -'ছেলেমেয়েগুলোও কত সস্তা ছিল আপনাদের সেটা মনে পড়ে?... চোদ্দ আনা জোড়া ডিম, তাও তো আমরা ছেলেমেয়েদের দুটো করে খাওয়াই। কিন্তু, আমাদের ছেলেবেলায় সেই চোদ্দ পয়সা কুড়ির ডিমও তো আমরা ছোটোরা কখনো একসঙ্গে আস্ত খেয়েছি বলে মনে পড়ে না।...পয়সায় দুটো সন্দেশ, একসঙ্গে দু'পয়সার সন্দেশ কোনওদিন কোনও ছেলেটার হাতে দিয়েছেন? দেননি। দিলে মনে পড়তো... আপনারা কেবল সস্তার আহ্লাদে আটখানা হয়ে কতো কম খরচে সংসার চালানো যায়, তার সাধনা করেছেন। আর বাড়িতে অতিথি-কুটুম এলে তার কাছে মুখ বাড়াতে খরচ করেছেন...এ যে আপনি আমাদের ভালোবাসতেন না বলে, তা নয়। এটা শুধু দৃষ্টিভঙ্গী! ছোটো ছেলেপুলেদের যে কোনও দাম আছে, সে খেয়ালই ছিল না আপনাদের! তাদেরও যে পুষ্টির দরকার, তুষ্টির দরকার, তা ভাবেননি। কচি ছেলেটা ছাড়া কেউ তো কই দুধ খেত না। অথচ টাকায় ষোল সের দুধ ছিল। আসল কথা, ছোটোদের কোনও বাজারদর ছিল না তখন।' 
     
    বজ্রাহত অঘোরবাবু। রেলের সামান্য রোজগারে তিনি ছেলেমেয়ে মানুষ করেছেন, এই অহংকারে ডগমগ ছিলেন তিনি। সহসা এই আঘাত। এরপরেই গল্পের শেষ অনুচ্ছেদ : "চোদ্দ বছর বয়সে পড়া ছাড়িয়ে বাবা কাকে যেন ধরে রেল অফিসে একটা চাকরি জোগাড় করে বলেছিল, 'বাবা অঘোর, তোকে তো এবার ডান হাত হতে হবে। এতোগুলো কাচ্চাবাচ্চা সমেত বৃহৎ সংসার, আমার একার রোজগারে তো চলছে না আর।'কই বাবার সম্পর্কে তো কোনও অভিযোগ ছিল না অঘোরের! সে কি অঘোর মুখ্যু বলে?" 
     
    কোনও পক্ষ নেননি রচয়িতা। আপনি নিতে পারেন। নৈতিকতায় ঝলসে উঠে বলতে পারেন, অত অল্প আয় তো এত বাচ্চা কেন হে কামুক পাষণ্ড? তোমার প্রবৃত্তির জন্য নষ্ট হলো একটা কৈশোর! আবার, ভাবতে পারেন, অঘোরদের সময়ে চোদ্দকে কৈশোর ধরাই হতো না। প্রাপ্তবয়স ধরা হতো। অথবা, বাঁকা হাসি হেসে বলতে পারেন, পিতৃতন্ত্রের মগজধোলাইয়ের মন্ত্র পিতা স্বর্গ ইত্যাদি এমনভাবে আচ্ছন্ন করেছিল অঘোরকে যে তিনি প্রতিবাদের কথা ভাবেনইনি। বলতে পারেন, অঘোরের ছেলেমেয়েরা যে যুগের মানুষ, সেটা ইনডিভিজ্যুয়ালিটিকে মূল্য দেওয়ার যুগ। শিশু সম্পর্কে ধারণা বদলে গেছে ততদিনে। দুটো আলাদা মূল্যবোধের সংঘাতের কাহিনি বলে এ গল্প। আমি আবার, চুপি চুপি আরো একটা কথা বলব। অঘোর রেলের সামান্য মাইনের আখের গোছানো চাকুরে। তাঁর ছেলেরা অপর পেশায় সফল, স্বচ্ছল পুরুষ। তাই, এ গল্প মধ্যবিত্ত পরিবার কেমন করে ক্যাশ নেক্সাস দিয়ে নিয়ন্ত্রিত হয় তারও। বাইরের প্রতিষ্ঠান কেমন করে অন্দরের দখল নেয় এটা তার গল্প। নামটাই তো বলে দিচ্ছে তা! বাজারদর। বাজারের কথাই শেষ কথা। যাপনেও। 
     
    এবার ভাবুন একটি দশ পনের বছরের ছেলে বা মেয়ে এ গল্পের সামনে দাঁড়িয়ে কী করবে? বলা শক্ত! আমার মনে আছে, বারো বছর বয়সে যখন আমি প্রথম পড়ি এই গল্প, আমার একটা হতবুদ্ধিভাব এসেছিল মনে। একটা বেদনাবোধ কষ্ট দিচ্ছে, কী যেন একটা বুঝেও বুঝছি না। সোজা কথায়, গল্পটা ভীষণ ডিস্টার্ব করেছিল। বারবার পড়েছিলাম। ছোটোবেলায় তো বটেই, বড়ো হয়েও। এই যে নাড়া দেওয়া, এটাই সার্থক ছোটোদের লেখা করে থাকে। এ লেখা আসলে সবার জন্য লেখা। বারবার পড়ার জন্য লেখা। 
     
    এবার দ্বিতীয় গল্প। সন ১৩৮৬ বা ১৯৭৯ সালের পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলায় বেরিয়েছিল সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের ছোটো গল্প –‘মেঘ আসে রোদ হাসে।’ আমার আজও স্পষ্ট মনে আছে, এ গল্প সেই সাত বছর বয়সে আমি যে কতবার পড়েছি তার ইয়ত্তা নেই। খালি মনে হতো, এর সবটা বুঝছি না। অথচ আখ্যান বস্তু ভারি সরল। ডাকাবুকো সুকু আর শান্ত রুকু দুই ভাই। বাবার একটা দামী পার্কার কলম বাবাকে না বলে ইস্কুলে নিয়ে গিয়ে সুকু হারিয়ে ফেলে। তারপর ভয়ে লজ্জায় মিথ্যে করে বলে যে সে নয়, রুকু হারিয়েছে কলম। কিন্তু বাবার শান্ত প্রশ্ন :" কার মরাল সিঙ্ক করছে? সত্য নিয়ে কে বুক ফুলিয়ে আমার সামনে দাঁড়াতে ভয় পাচ্ছে"? তাকে ভেতরে কুঁকড়ে দেয়। সেই রাতেই তাদের শিক্ষক কীটতত্ত্ববিদ ফাদার ডাইসন পোকা মাকড় সংগ্রহ করতে বেরিয়ে তাদের জানলার বাইরে এসে দাঁড়ান। তাঁর অভয় বাণী : চিলড্রেন অফ গড কান্ট বি লায়ারস- সুকুর সাহস ফিরিয়ে দেয়। বাবার বেহালার করুণ সুরে কাঁপা সেই রাতে বাবার বুকে ঝাঁপিয়ে পরে সে দোষ স্বীকার করে। বাবা গর্বিত। ফাদার খুশি। তিনি বেহালার সুরে গেয়ে ওঠেন : "The sun was shining on the sea/ shining with all might." 
     
     কী বুঝিনি তবে আমার শৈশবে? বুঝিনি, এই গল্প একেবারে The Holy Bible এর সুরে বাঁধা। সেই গিল্ট, সিন আর কনফেশন এর ত্রিমূর্তি! দোষ, পাপ, অনুতাপ, স্বীকারোক্তি, শেষে উত্তরণ : redemption। বুঝিনি, এ গল্প নৈতিক শুদ্ধতার কাহিনি এমন একটা ভাষায় বলে যা বহুস্তরী। একটা উদাহরণ দিলেই যথেষ্ট : "সেই থেকে সুকু বারবার একটা স্তবকই পড়ছে। কিছুতেই মন বসাতে পারছে না। লাইনের পর লাইন চোখের সামনে অর্থহীন কালো কালো শব্দ। 
     
    For over the misty mountains grim
     The dungeons deep and caverns dim 
    We must away, ere break of the day
    To win our harps and gold from him.  
     
    সুকুর মনে হল সে নিজেই গল্পের বামনদের মতো ক্রমশ ছোটো হয়ে আসছে।" 
     
    এই অংশটা জাস্ট বুঝতাম না। অনেক পরে, এই গানটা পাই J.R.R. Tolkein এর The Hobbit বইয়ে। এটা সোনা আনতে যাওয়ার আগে গাওয়া ডোয়ার্ফ বা বামনদের গান। তার মানে সোনার লোভ আর সোনার নিব ওয়ালা পার্কার ফিফটি ওয়ানের ওপর লোভকে মিশিয়ে দেওয়া হলো। বোঝানো হলো লজ্জায়, পাপবোধে সুকু নিজের কাছেই ছোটো হয়ে যাচ্ছে। 
     
    সুকুর অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বকে ভাল মন্দের চিরায়ত দ্বন্দ্ব হিসেবে কীভাবে প্রকাশ করে এ গল্প তা বুঝতে আমায় ত্রিশ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। ততদিন গল্পটা একটুও মুরুব্বিয়ানা না করে বেশ হাসিখুশি মুখে আমায় উসকে গেছে। ইংরিজি শেখ (কোনও ইংরিজি গান বা কবিতা বাংলা হরফে দেওয়া নেই, মানেও বলা নেই), বিশ্বসাহিত্য পড়, বাইবেলটা পড়ে ফেল : তবে তো আমায় বুঝবে! তাহলে, এই হলো সার্থক শিশু কিশোর সাহিত্য। আদর্শ আছে, কিন্তু নান্দনিকতা মণ্ডিত। কোন ন্যাকামি নেই। ভাষা জোর করে হালকা করার চেষ্টা নেই। পরিণত মনও এর থেকে চিন্তার রসদ পেতে পারে।এই গল্প লেখার পর যদি আর একটাও ছোটোদের লেখা না লিখতেন সঞ্জীব তবুও বাংলাদেশ তাঁকে মনে রাখত।
     
    আমরা বোধহয়, এতক্ষণে বুঝতে আরম্ভ করেছি যে, ছোটোদের জন্য লিখতে গিয়ে জটিল-সহজতা কেমন ভাবে গড়ে ওঠে। যা খুশি লেখকের উপজীব্য হতে পারে, যদি তিনি ভাষা-বিভূতির সাহায্যে জাগ্রত জীবনের সঙ্গে তাঁর পাঠকের আলাপ করিয়ে দেন। এটা মাথায় রেখেই পরের গল্প পড়ি আসুন। না, গল্প নয়। উপন্যাস। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের। বস্তুত, ছোটোদের জন্য লেখা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটাই সম্পূর্ণ উপন্যাস আছে। 'মাঝির ছেলে'। 
     
    ধারাবাহিক ভাবে এ লেখা বেরোয় 'মৌচাক' -এ। শ্রাবণ ১৩৪৯ থেকে অগ্রহায়ণ ১৩৫০ পর্যন্ত। পড়লেই দেখা যায় অন্যান্য ছোটোদের লেখা থেকে এ উপন্যাস কতটা আলাদা। ভাল মন্দ, সাদা কালোর সোজা-সাপটা ফারাককে বেমালুম অস্বীকার করে এ বই। বার বার জানাতে চায় জীবন ঠিক অতটা সরল নয়। যাদববাবু অভিজাত বংশে জন্মেছেন, কিন্তু মাঝির ছেলেকে নাগার প্রতি তাঁর কোনও তাচ্ছিল্য নেই। তাঁর মায়া আছে, মমতা আছে। আবার, তিনিই চোরাচালানকারী! নাগা এঁর কাছ থেকেই বিবেক আর ন্যায় এর ওপর আস্থা রাখতে শেখে। অন্যদিকে যাদববাবুর ভাই মাধববাবু কোনও বেআইনি পেশায় যুক্ত না থাকলেও, অর্থলোভে কত নীচে যে নামতে পারেন তার সীমা নেই। তাহলে এ গল্পের দুষ্টুলোক কে? নাগা যাদববাবুর সঙ্গী হয়; কিন্তু, তার মনে সদাই সংশয় আর দ্বিধা। সে বারবার দেখে, ভালো মন্দ সব ছাড়িয়ে মানুষ শুধু মানুষ। ডাকাত উদার হৃদয়, পুলিশের খোচর বন্ধুবৎসল। অথচ, সমাজ অস্বীকৃত পেশাও তো অস্বস্তি জাগায়। তাই নাগা বিশালের স্বপ্ন দেখে। সে সাগরে যেতে চায়। তারপর একদিন তুফানে উত্তাল নদীর বুকে জলপুলিশের তাড়ায় বিপথে ছোটা লঞ্চের বুক থেকে 'বড়ো একটা ঢেউ এসে.. নাগাকে.. তুলে নিয়ে চলে যায়।' আর নাগার মনে হয় এতক্ষণে তার সমুদ্রযাত্রা আরম্ভ হলো যার শেষ হবে 'একেবারে সমুদ্রের সঙ্গে মিশে গিয়ে'। 
     
    কাহিনির এই রূপরেখায় মাঝির ছেলের পরিচয় কিছুই পাবেন না আপনি। বুঝবেন না, কেমন করে এ উপন্যাসের প্রতি ছত্রে জেগে থাকে দপদপে প্রাণ। কী বলিষ্ঠ জীবনবোধ প্রকাশ করে লেখকের অননুকরণীয় রচনাশৈলী। তাই এ লেখা আপনাকে পড়তে হবে। আত্মস্থ করতে হবে। তারপর, হয়তো, এরই আদলে আপনি ছোটোদের জন্য লিখবেন এক জীবনপুরের কাহিনি। শেষ কথা হলো, নিজের শৈশব স্মরণ করে, ছোটোদের নিজের সমবয়সী ভাবতে হবে। তারপর ভাষা-বিষয় নিরূপিত কথনবিশ্বে নির্ভীকচিত্তে প্রবেশ। আপনি নিজেকে প্রস্তুত করে নিয়েছেন। এবার আপনি গল্প বলুন। ছোটোরা আপনার কথা শুনবে। মনেও রাখবে। এই বলা আর শোনার মধ্যেই শিশু-কিশোর সাহিত্যের চিরকালীনতার বীজ।
     
    আমরা প্রথমেই বলেছিলাম, কতগুলো রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক নির্ধারক শিশু-কিশোর সাহিত্যের বিষয় নির্ধারণ করার চেষ্টা করে। প্রশ্ন হলো, ক্ষিদে, বাঁচার জন্য শঠতা, রক্ত-ঘামের গন্ধ মেশা কোনও গল্প কি তাদের ছাড়পত্র পাবে? মনে হয় না। এটা মাথায় রেখেই পরের গল্প পড়ব আমরা। 
     
    সুহাসের জন্মদিন। অসীম আর নিখিলের নেমন্তন্ন। শনিবারের ছুটির পর তারা একসঙ্গে স্কুল থেকে বাড়ি ফিরছে। একটা ঘটার মড়া চলেছে রাস্তা দিয়ে। ছড়ানো হচ্ছে পয়সা। দুই ভিখিরি পেছনে পড়েছিল। একটা বুড়ো, একটা ছোকরা। হদ্দ নোংরা। দেখলেই ঘেন্না করে। একটা চকচকে সিকি কুড়িয়ে নিল বুড়ো। ছোকরার দাবী, সেটা আগে ও দেখেছে। বাধল মারামারি। আঁচড় কামড়। এর মধ্যে ছোকরা সিকি উদ্ধার করে উধাও। সবার সহানুভূতির মধ্যে বুড়ো তার মুখটা তুলে ধরল, দেখানোর জন্য। ধারালো নখের আঁচড়ে বিকৃত, ক্ষত বিক্ষত মুখ। মাংস খুবলে গেছে, চোখের নীচে ড্যালা পাকিয়ে উঠেছে। গায়ে ছিল একটা নোংরা হাফ শার্ট। সেটা ছিঁড়ে কুটি কুটি। সুহাসের মন গলে গেল। সে তাকে বাড়িতে নিয়ে এল। প্রবলকে শাসন করতে না পারার লজ্জা রূপ নিয়েছে ক্ষতিপূরণ করার ইচ্ছের। বাড়ি এনে শুশ্রূষা করা হলো। বুড়ো একটা জামা চাইল। একটু ছোটো মাপের। সুহাসের দাদার জামা আগে দেওয়া হয়েছিল। বুড়ো বলল, বড়ো হবে। ওদিকে, বড়ো জামায় রক্ত লেগেছে। ফলে, দুটো জামাই পড়ল সে বুড়ো। খাবার এলো। কেমন অদ্ভুত হেসে, বুড়ো সব ভালো খাবারগুলো কালকের জন্য সরিয়ে রাখল। একটা চকচকে আধুলি প্রাপ্তিও ঘটল। সে ঘর ছেড়ে রাস্তায় নামতে না নামতেই নিখিল ফলো করল তাকে। দেখা গেল এক রোয়াকে বসে, যত্ন করে সেই বুড়ো, যে তাকে মেরেছিল, সেই ছোকরাটিকে খাওয়াচ্ছে। বিভিন্ন মার খাওয়ার তরিকা নিয়ে আলোচনা চলছে। কে, কাকে,কীভাবে মারবে। সহানুভূতির ঢেউয়ে বেশি লাভ হবে কার! নিখিল ওৎ পেতে ছিল। লাফিয়ে পড়ল বুড়োর ঘাড়ের ওপর। জোচ্চোর, মারের অভিনয় করে রোজগার করিস শয়তান? নিখিলের এক রদ্দায় বুড়ো হঠাৎ মাটিতে পড়ে গেল। তারপরই, একটা অবিশ্বাস্য কাণ্ড করল। একটা থান ইঁটে কপাল ঠুকে ঠুকে রক্ত বার করে ফেলল! এরপর বুক ফাটা আর্তনাদ। ভিড় জমে গেল। নিখিলের বয়ানের চেয়ে, বুড়োর মুখের চেহারা বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে হলো তাদের। ছেলের হাতে অমন মার কেউ খেতে পারে? সামনের বাড়ির দরজা খুলে, এক প্রৌঢ়া যখন বুড়োকে ডাকলেন, তার ক্ষতি পূরণ করে দেওয়ার জন্য, নিখিলের আর সহ্য হলো না। চলতে চলতে পেছন ফিরে সে দেখল, বুড়োর মুখে এক অদ্ভুত বীভৎস হাসি। বিজেতার হাসি যেন! সব ঘটনা শুনে অসীম আর সুহাস স্রেফ হাঁ হয়ে গেল। তারপর, বাড়ি ফিরে, অসীম দেখে, তার মা সেই বুড়োকে ঝুলি ভরে ভিক্ষে দিচ্ছেন। নিজের চোখে তিনি দেখেছেন বুড়োকে মার খেতে! দু'আনা পয়সা, চিঁড়ে আর অসীমের পাঞ্জাবি নিয়ে বুড়ো রাস্তায় নামতেই, অসীম এক লাফে রাস্তায় পড়ল। আর সেই বুড়ো, ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, 'তুমিও বাবু আমাকে মারবে নাকি?' বলে সে তার বিকৃত মুখে সেই বীভৎস হাসি হাসলো। পরে গলা নামিয়ে বললে, 'মারো না, মারলেই আবার আমার পয়সা জুটে যাবে।' 
     
    আপনাদের কথা জানি না। তবে, এই লেখাটা পড়া শেষ করে আমার রক্ত জমে গিয়েছিল। 'মুখ দেখে' নামের এই লেখা অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত লেখেন ১৯৪১ সালে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। ব্ল্যাক আউটের জমানা। আস্তাকুঁড়ে মানুষ আর কুকুর মারামারি করছে খাবারের জন্য। মধ্যবিত্ত মনন গলদশ্রু, দরিদ্রের দুঃখে। এমন একটা সময়ে দাঁড়িয়ে সম্পূর্ণ উলটো দিক থেকে দারিদ্র‍্যকে দেখা অকল্পনীয়! লড়াই লড়াই লড়াই চাই। লড়াই করে বাঁচতে হবে। এ লড়াই বাঁচার লড়াই। বাঁচতে গেলে লড়তে হবে! নিজের দৌর্বল্যকেই শক্তিতে বদলে দেওয়া। একেবারে কিচ্ছুটি না করার জন্য লজ্জিত মধ্যবিত্ত বিবেকের দংশনের সুযোগ নেওয়া। আর, একটিবারের জন্যও, একটি শব্দ না লিখে, এই যোদ্ধাকে দিয়ে মনে করিয়ে দেওয়া, সারা দেশে, এই মুহূর্তে, ঠিক এমনই একটা যুদ্ধ চলেছে। দিনের পর দিন, বৃটিশ সিংহ, দুর্বলতা বলে যা বুঝিয়ে এসেছেন আমাদের, চোস্ত ইংরিজি বলা, অর্দ্ধোলঙ্গ এক ফকির, তাকেই শক্তিতে রূপান্তরিত করেছেন। দেশবাসী গাইছে, বেত মেরে কি মা ভোলাবি? আমরা কি মা-র সেই ছেলে? সাগরপারে রাগে কাঁপছেন উইনস্টন চার্চিল! 
     
    অবিশ্বাস্য গল্প, না?  কিন্তু, সবচেয়ে তাজ্জব করা কথাটা এখনও বলিনি! এটা ছোটোদের জন্য লেখা। ১৯৪১ সালে, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায় -এর সম্পাদনায় প্রকাশিত, সোনালী ফসল বইয়ে বেরোয় এ গল্প। দেখছি, লেখা আছে, পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষা অধিকর্তার নূতন শিক্ষা-ধারা অনুসারে সমগ্র বিদ্যালয়ের ৭ম ও ৮ম শ্রেণীর উপপাঠ্যরূপে অনুমোদিত। (কলিকাতা গেজেট, ৩১ মার্চ, ১৯৪১)। মানে, বইটা একটা rapid reader এবং তের চোদ্দ বছরের ছেলেমেয়েদের জন্য এই গল্প লেখা। 
     
    আশি বছর আগের টীন এজাররা এই গল্পের কতটা রসগ্রহণ করেছিল, বলা অসম্ভব। আমি একমাত্র নিজের তের চোদ্দ বছর বয়সের কথা বলতে পারি। গল্পটা পড়ে যেতাম। হাত পা ঠাণ্ডা হওয়াটা হতো না। তবু, এ গল্পের সামনে বারবার টুপি খুলতে হয়। আর বিশ বছরের মধ্যে যিনি কেবল রামকৃষ্ণচর্চা করে চলবেন (ঠাকুর তোমায় কে চিনত, না চেনালে অচিন্ত্য - বলবেন দীকুসা) দেব সাহিত্যকুটীরের পাতায়, তিনি যে এরকম একটা মাস্তানির গল্প লিখে দেবেন, খোকা-খুকুদের সমবয়স্ক ভেবে, সেটাই বিশাল একটা ব্যাপার! 
     
    এবার যে গল্পটা পড়ব সেটা ছোটোদের জন্য লিখলেও, পরে বয়স্কপাঠ্য এক সঙ্কলনে তাকে স্থান দেন লেখক। ছোটো/বড়ো বাইনারি না মানার এরকম উদাহরণ বাংলা সাহিত্যজগতে আর আছে কিনা আমার জানা নেই। পাঁচের দশকের কলকাতা। একটা মেস। ম্যানেজার গোবর্ধনবাবুর তত্ত্বাবধানে সুখেই আছেন বোর্ডাররা। তাস-পার্টি, গান-বাজনা, রাজা-উজির, সিনেমা-ফুটবল, গ্রীষ্মের রাতে তেতলার ছাদে হাওয়া আর মালাই-বরফ, বর্ষার সন্ধেতে গরম চা, ফুলুরি আর ভূতের গল্প, মাসিক ফীস্টি - সব নিয়ে খাসা আছেন সকলে। আর, এই অতি স্বাভাবিক জীবনযাত্রার ছায়া-ছোঁয়া বাঁচিয়ে, একতলার সবচেয়ে ওঁচা, পচা, এঁদো, ঘুপচি ঘরটায় - যেটা আসলে থাকবার ঘরই নয়, ভাঁড়ার জাতীয় কিছু হবে - একা থাকেন হৃদয়রঞ্জন। সবচেয়ে শস্তা এ ঘরের ভাড়া - মাসে পঁয়তিরিশ টাকা, আর এঘরে আর কারো জায়গা হতেই পারে না। দ্বিতীয় কারণটাই হৃদয়বাবুর কাছে সবচেয়ে বড়ো আকর্ষণ। বহুবার একই ভাড়ায় অন্য, ভালো ঘরে যাওয়ার প্রস্তাব তিনি প্রত্যাখ্যান করেছেন। মাসের ভাড়া ঠিক সময়ে মিটিয়ে দেন। খাওয়ার সময় হয় অত্যন্ত কম খান, নয় খুব তাড়াতাড়ি খান। মোট কথা, তিনি সবার আগে খাওয়া শেষ করে ঘর ছাড়েন অতি দ্রুত। মেসের সবাই তাঁকে উপেক্ষা করতে পারতেন। কিন্তু, তাঁর এই সকলকে এড়িয়ে চলাটাকে তাঁরা ধৃষ্টতা মনে করেন। 'কালপ্যাঁচা,' বা 'চামচিকে' জাতীয় নামকরণ করে সাময়িক আমোদ পাওয়া যায়; তাঁর রক্তহীন, হলদে গায়ের রং, শির বার করা হাত, চোপসানো গাল, খাড়া খাড়া, কদমছাঁট চুল, বাঁকা নাক - এবং হৃদয়রঞ্জন নামের বিকট অসামঞ্জস্য নিয়ে কিছুদিন হাসি ঠাট্টা করা চলে, কিন্তু একটা লোককে নিয়ে মুচমুচে, রসালো গল্প বানিয়ে, তারিয়ে তারিয়ে তাকে উপভোগ করার - অর্থাৎ, বাঙালির জাতীয় বিনোদনের- রসদ পেতে গেলে, লোকটাকে তো একটা কিছু, যা হোক কিছু, করতে হবে? কিন্তু, হৃদয়রঞ্জনের কেবল অস্তিত্বই আছে, জীবন নেই। তিনি কোথায় চাকরি করেন কেউ জানে না। তিনি কোথাও যান না, তাঁর কাছে কেউ আসে না। একবার এক পিসির চিঠি ছাড়া, কোনওদিন কোনও চিঠি আসেনি তাঁর কাছে। তিনিও কাউকে চিঠি লেখেন না। সব মিলিয়ে তিনি এতটাই অকিঞ্চিৎকর, যে, তাঁর থাকা বা না থাকায় কারো কিছু এসে যায় না। তাঁর সম্বন্ধে 'রহস্যময়' শব্দটা প্রয়োগ করলে হাসি পায়, তাঁকে নিয়ে তামাশায় খানিক বাদেই হাই ওঠে। শুধু পুজোর চারদিন মেসে থাকেন না হৃদয়রঞ্জন। কোথায় যান, কেউ জানে না। সেবারের পুজোয়, হৃদয়বাবুর অনুপস্থিতিতে, ম্যানেজার মশাই তাঁর ঘরটা হোয়াইট ওয়াশ করিয়ে দেন। ফিরে এসে, সম্পূর্ণ নিজের স্বভাববিরূদ্ধভাবে প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে পড়েন হৃদয়রঞ্জন। তাঁর দাবী, ম্যানেজার তাঁর সর্বনাশ করেছেন। তারপর কথা কাটাকাটি। আর তারপরই আঁশবটি হাতে গোবর্ধনের ওপর চড়াও হন তিনি। লোকে ধরে না ফেললে রক্তারক্তি হতে পারতো। হৃদয়রঞ্জনকে পুলিশ গ্রেফতার করে। ব্যাঙ্কশাল কোর্টে কেস ওঠে। একশো টাকা জরিমানা হয়। গল্পের কথক, টাকাটা দিয়ে দেন। এবং জীবনে প্রথম অন্য কোনও মানুষকে ভালো করে চেয়ে দেখেন হৃদয়রঞ্জন। তাঁকে দয়া করা হয়নি, টাকাটা ধার হিসেবে দেওয়া যেহেতু হৃদয়বাবুর কাছে টাকা ছিল না - এটা জানার পর, কথকের সঙ্গে এক পেয়ালা চা খেতে রাজী হন তিনি। এবং, অনুভব করেন, অন্তত একটা মানুষকে তাঁর কথাগুলো বলা দরকার। কিন্তু, প্রথম কথাটাতেই আমাদের ভয় ধরিয়ে দেন এই কুদর্শন মানুষটি : 'প্রথম কথা আপনাকে এই বলতে হয় যে এই জগৎটাকে আমি একটুও ভালোবাসি না। আমার মনে হয় জন্মানোটাই দুঃখের, কিন্তু দৈবাৎ যখন জন্ম নিয়েছি তখন বেঁচে থাকার একমাত্র উপায় হ'লো লোকসংসর্গের বাইরে থাকা। বাইরে মানে - যতদূর পারা যায়। ...আজকের দিনে, মানুষকে এড়িয়ে চলতে হ'লে সেখানেই থাকতে হয়, যেখানে সবচেয়ে বেশি মানুষ জড়ো হয়েছে। অর্থাৎ কলকাতার মতো শহরে। শহরের রাস্তায় বেরোলে সব মানুষই নামহীন। অ্যালজেব্রার x এর মতো একটা চিহ্নমাত্র। ...কলকাতার ক্ষুদ্র আপিশে কেরানিগিরি ক'রে, মেস্-এর একতলার নির্জন ঘরে - আমি বেশ সুখেই আছি - ছিলাম। পৃথিবীতে যত মানুষ আছে তার মধ্যে সত্যিকারের খারাপ হয়তো শতকরা পাঁচ জনের বেশি নয়, কিন্তু কোনও-না-কোনও সুবিধের জন্য যারা সকলেই খারাপ হতে পারে তাদের সংখ্যা শতকরা পঁচানব্বুই। বন্ধুতা, ভালোবাসা, এমনকি সাধারণ ভদ্রতা - সবই সুবিধের ওপর নির্ভর করে।' 
     
    জীবনকে ঘেন্না করলেও, কোথাও এতটুকু ভালো বা সুন্দর কিছু নেই, এটা ভাবলে, পাগল হয়ে যেতে হয়। তাই সুস্থতা বজায় রাখার জন্য অবাধ প্রকৃতির মধ্যে নিজের চেতনাকে ছড়িয়ে দেন হৃদয়রঞ্জন। কিন্তু, আসল নয়, প্রকৃতির অনুরূপের মধ্যে। ভ্রমণকাহিনি - নতুন- পুরনো-র জানলা দিয়ে প্রকৃতির টেক্সচুয়াল রিপ্রেজেন্টেশনকে দেখেন হৃদয়রঞ্জন। তাঁর কল্পনা উজ্জীবিত হয়। মেসের এঁদো ঘরের দেওয়ালে ধরা জলের দাগ তাঁর কাছে ছবি হয়ে ওঠে। তিনি দেখেন মহাসাগর, উটের ক্যারাভান, অরণ্যের মধ্যে জলপ্রপাত, বীণাপাণি সরস্বতী। তাঁর ইচ্ছামাত্র ক্যারাভান হয় অর্ণবপোত, পাহাড়চুড়োয় বসা শিকারী ঈগল। হোয়াইট ওয়াশের পর, শূন্য, অর্থহীন, নির্বোধ, নিষ্প্রাণ, নিরক্ষর দেওয়াল তাঁকে ধৈর্যের শেষ সীমায় ঠেলে দেয়। এমন ঐশ্বর্যময় দেওয়াল কলকাতায় হয়তো আরো আছে। কিন্তু, কোথায় তাদের খুঁজে পাবেন তিনি? এরপর কাহিনি থেকে মুছে যান হৃদয়রঞ্জন। পরে, মানি অর্ডারে কথক একশো টাকা ফেরৎ পান। 
     
    কিসের গল্প এটা? নিঃসন্দেহে একটা বাতিকগ্রস্ত, মানববিদ্বেষী লোকের। কিন্তু, তার সব কথা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়াও তো যাচ্ছে না! কিছু কথা, একেবারে অস্তিবাদী দর্শনের মতো শোনাচ্ছে। আসলে, এটা সাধারণত্বের খাঁচায় ডানা ঝাপটানো আমাদের অনেকেরই আত্মাপাখির গল্প। হৃদয়রঞ্জনের কল্পনা যে অসম্ভব শক্তিশালী ও প্রায় শৈল্পিক সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু, এমন একটা শরীর আর সামাজিক অবস্থানে তিনি বন্দি যেখানে তাঁর প্রকৃতির সঠিক বিকাশ সম্ভব হয়নি। তাই, তাঁর চিন্তাজগৎ আবিল হয়ে ওঠে, ঘেন্নামাখা হয়ে ওঠে মানবসমাজ। কিন্তু, হৃদয়রঞ্জন একটা জিনিস খেয়াল করেননি। তাঁর কাহিনির শ্রোতা হিসেবে একজন সহৃদয় মানুষকেই বাছতে হয় তাঁকে। সবচেয়ে বড়ো কথা, তাঁর কল্পনার উজ্জীবন মানুষের সাহায্যেই ঘটেছে। ভ্রমণ কাহিনির প্রকাশ মাধ্যম কী? ভাষা। ভাষায় গড়া প্রকৃতি কিছুতেই জড় প্রকৃতির প্রতিরূপ হতে পারে না। লেখকের দৃষ্টিভঙ্গী, তাঁর শব্দ-বাক্য-উপমা নির্বাচন সব দিয়ে সে প্রকৃতি রূপ পায়। সুতরাং, অপরের গড়া ভাষাপ্রতিমার প্রেমে পড়ে হৃদয়রঞ্জন মুক্তি খুঁজেছেন। তিনি বাসিন্দা হয়েছেন এক সৃজনবিশ্বের। এই কারণেই দেওয়ালে প্রাকৃতিক দৃশ্যের সঙ্গে তিনি সরস্বতী মূর্তি বা কিন্নরী মূর্তি দেখেন। 
     
    যারা সৃজনশীল কিন্তু সবরকমভাবে অনুকুল পরিবেশবঞ্চিত, তাদের প্রতীক হৃদয়রঞ্জন। তাঁর তিক্ততা, তাঁর ঘেন্না আমরা এখনো দেখি তাদের মধ্যে যারা অনুভব করতে জানে, কিন্তু প্রকাশ করতে পারে না। বা, করতে পারলেও লালন করার উপযুক্ত পরিবেশ পায় না। হয়তো, আশপাশের সামান্যতায় কবিতার খাতা ছিঁড়ে ফেলে তারা, হয়তো আপিসের চাপে আকাশের মেঘের বিভিন্ন মূর্তি ধরা দেখতে ভুলে যায়। কেউ খিটখিটে হয়ে ওঠে, কেউ বা রাতে ঘুমোয় না। বিভিন্নভাবে সর্বনাশ ঘটেই চলে। এবার, আসল কথা। বুদ্ধদেব বসুর লেখা, 'হৃদয়রঞ্জনের সর্বনাশ' নামের গল্পটা, ১৯৫৭ সালে, দেব সাহিত্যকুটীর -এর পূজাবার্ষিকী 'নব পত্রিকা'-য় প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ, আপাতভাবে এটা একটা কিশোর পাঠ্য গল্প। আপনারা বুঝছেন গল্পটা একসঙ্গে ছোটো ও বড়োদের সঙ্গে কথা বলছে। এতক্ষণ যা লিখলাম, তা বড়োদের পাঠ। নিজের কিশোর মনকে জাগিয়ে তুলে যখন গল্পটা পড়ছি, দেখতে পাচ্ছি, খুনের চেষ্টা উত্তেজিত করছে, দেওয়ালে ছবি দেখা একটা অদ্ভুত ভালোলাগা বোধ আনছে যেটা মূলতঃ লেখকের ভাষাজাদুর জন্য, হৃদয়রঞ্জনের জন্য একটা নাম না জানা সহানুভূতি জন্ম নিচ্ছে। এই গল্প আমি পড়ি ১৯৮১ তে, ন'বছর বয়সে। কিচ্ছু বুঝিনি। আবার পড়ি, তেরো বছর বয়সে, মনে একটা ছাপ পড়ে। আর এখন বুঝি, এরকম গল্প বাংলায় বেশি নেই। চৌষট্টি বছর আগের কিশোর-কিশোরীরা এই গল্পকে কীভাবে গ্রহণ করেছিল জানি না। তবে, এখনকার ছেলেমেয়েরা ভূত-থ্রিলার-গোয়েন্দা কাহিনি-খেলা -র ফর্মূলার বাইরের এই গল্প পড়ে কী বলে, আপনারা তা জেনে নিতে পারেন। মিত্র ঘোষ নির্মিত বুদ্ধদেব বসু কিশোর রচনা সমগ্র-তে গল্পটা পাওয়া যাবে। 
     
     এবার আমি এমন একজনের গল্প পড়ব, যিনি অবিসংবাদিতভাবে কিশোর সাহিত্যিক। তাঁর লেখা ছোটোদের মহলে আজও জনপ্রিয়। তাঁর লেখায় আছে কি কোনও হিডন্‌ অ্যাডাল্ট? আপনাদের বিপিন চৌধুরীকে মনে আছে? একা মানুষ, লোকের সঙ্গে মেলামেশা ধাতে নেই, আড্ডার বাতিক নেই, বন্ধু কম। বাড়িতে সন্ধের সময় লোক এলে সোয়া আটটা বাজলে হাঁকিয়ে দেন। তারপর ডিনার। তারপর আধঘন্টা বিশ্রাম। তারপর গল্পের বই হাতে বিছানায়। প্রতি সোমবার নিউ মার্কেটের কালীচরণের দোকান থেকে বই কেনেন বিপিন। একদিন এখানে এক ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা, যিনি নাকি বছর পাঁচেক আগে রাঁচি বেড়াতে গিয়ে তাঁর সঙ্গে পরিচিত হন। মনে পড়ছে? হ্যাঁ। আমি সত্যজিৎ রায়ের লেখা ‘বিপিন চৌধুরীর স্মৃতিভ্রম’ গল্পটার কথা বলছি। সন্দেশের শারদীয়া ১৩৭০ সংখ্যায় মানে ১৯৬৩ তে বেরিয়েছিল এ গল্প। আচ্ছা, গল্পটায় ছোটোদের ভালো লাগার মতো কী কী আছে? খুন নেই, অ্যাডভেঞ্চার নেই, থ্রিল নেই, রূপকথা নেই। আছে একটা ধীরে ধীরে চারিয়ে যাওয়া ভয়। একজন মানুষ দেখছেন তাঁর জীবনের এক খণ্ডাংশের কথা তাঁর মনে নেই। কিন্তু আরো অনেকের আছে। আত্মবিশ্বাস চলে যাচ্ছে তাঁর। অ্যাংজাইটি ধরছে। তিনি পাগল হয়ে যাবেন ভাবছেন। শয্যাশায়ী হয়ে পড়ছেন তিনি। তখন একটা চিঠিতে রহস্যভেদ হচ্ছে। 
     
     আপনারা জানেন, আমি এই লেখায় বারবার বলছি, সার্থক শিশু কিশোর সাহিত্য একই সঙ্গে ছোটো আর বড়ো - এই দুরকম পাঠকের সঙ্গে কথা বলে। এ গল্পেও তাই হয়েছে। গল্পটা অতি প্রাচীন দশচক্রে ভগবান ভূত - এর আইডিয়া ব্যবহার করেছে। সেই ব্রাহ্মণকে মনে করুন। বহুজন বলায় কাঁধের ছাগলকে যিনি কুকুর ভেবেছিলেন। তার মানে এই গল্প লোক ঠকানোর মোটিফ মাথায় রেখে লেখা। কিন্তু, তারপরই দেখা যায়, অসতের জয় নিয়ে লেখা হয়নি এই গল্প। গল্পটার একটা বলিষ্ঠ নৈতিক মেরুদণ্ড আছে। আমার মনে আছে, ১৯৭৮ এ, এই গল্প পড়ে আমি বিপিনবাবুর জন্য ভাবিত হয়ে পড়েছিলাম। তারপর প্রায় দশ বছর এই গল্প আমাকে চ্যালেঞ্জ করে গেছে। কিছু একটা মিস করছি, বুঝছি। কিন্তু সেটা কী? 
     
     পরে পড়তে গিয়ে দেখি, একেবারে দ্বিতীয় লাইন থেকে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে সমালোচনা করছে গল্পটা। 'যত রাজ্যের ডিটেকটিভ বই, রহস্যের বই আর ভূতের গল্প।' 'যত রাজ্যের' শব্দটা আগে কানে লাগতো। এখন বুঝি, ইচ্ছে করে লেখা। হঠাৎ বড়োলোক, আপস্টার্ট চরিত্রের পাঠাভ্যাস নিয়ে একটা নাক বাঁকানো ভাব দিয়েই শুরু হচ্ছে গল্প বলা। এরপর চুনীলালের কথা। 'তুমি কড়া মেজাজের লোক, পুরনো বন্ধুদের প্রতি তোমার সহানুভূতি নেই - এ সবই তো জানতুম।' গল্পের মাঝামাঝি জানছি, বিপিনের বন্ধু না থাকাটা তাঁর নিজের কারণে। পথ প্রস্তুত হচ্ছে গল্পের শেষের চিঠির জন্য। 
     
    প্রিয় বিপিন, হঠাৎ বড়োলোক হওয়ার কুফল যে তোমার মধ্যে এভাবে দেখতে পাব তা আশা করিনি। একজন দুস্থ বাল্যবন্ধুর জন্য একটা উপায় করে দেওয়া কি সত্যিই তোমার পক্ষে এত অসম্ভব ছিল? আমার টাকা নেই, তাই ক্ষমতা সামান্যই। যে জিনিসটা আছে আমার, সেটা হলো কল্পনাশক্তি। তারই সামান্য কিছুটা খরচ করে তোমার ওপর সামান্য প্রতিশোধ নিলাম। 
     
    একটা আস্ত না বলা গল্প ন্যারেটিভের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছেন লেখক। বিপিন, চুনী, হয়তো আরো অনেকে একসঙ্গে আড্ডা দিতেন একসময়। বন্ধু ছিলেন। তারপর হঠাৎ বড়োলোক হয়ে অন্য মানুষ হয়ে যান বিপিন। আর তাই, তাঁর একটা শিক্ষার প্রয়োজন হয়। কল্পনাশক্তির সামান্য খরচ করেন সাহিত্যিক চুনীলাল। তাতেই অস্তিত্ব সংকট হয় বিপিনের। ওদিকে চুনীর উপন্যাস ছাপার ব্যবস্থা হতে থাকে। সার্থক ছোটোদের লেখা। জ্ঞানী-গুণী আর টাকাওয়ালার মধ্যে কার ক্ষমতা বেশি তা এক কথায় প্রমাণ হয়ে যায়। একটা সৎ আদর্শের কথা বলা থাকে। কিন্তু, কোথাও, কাউকে খেলো করা হয় না। বিপিন সমালোচিত কিন্তু নিন্দিত নন। কারণ তিনি কোনও সামাজিক অপরাধ করেননি। তাই গল্প শেষ হয় তাঁর হাসি দিয়ে। তাঁর কোনও লজ্জাবোধ না দেখানো লেখকের বাস্তবতাবোধের নজির। সমাজে বিপিনরা অলজ্জিতই থাকেন। তাঁদের শাস্তি কাহিনির পরিসরেই ঘটে থাকে। জটিল-সহজ আখ্যানের মাধ্যমে। বিপিনবাবু শাস্তি পেয়েছিলেন মনের গভীরে। কল্পনার স্তর থেকে উঠে আসা কাহিনি বা ফিকশন তাঁকে যাপিত বাস্তব সম্বন্ধেই সন্দিহান করে তুলেছিল। তিনি সাময়িকভাবে বন্দী হয়েছিলেন নিজের মস্তিষ্কের ভেতরেই। তবু বলতেই হবে, চুনীলাল তাঁকে অল্পে অব্যহতি দিয়েছিলেন। কিন্তু, আরেকটা ছোটোদের গল্পে, যেটা আমরা পড়েছিলাম ১৩৯০ বা ১৯৮৩ -র সন্দেশ-এর কার্তিক সংখ্যায়, সত্যজিৎ এমন একটা চরিত্র বানিয়েছেন, যে নিজের তৈরি কাহিনিগারদে পাকাপাকি বন্দি। 
     
    'সাধনবাবুর সন্দেহ' গল্পের সাধনবাবু স্বাভাবিক, সহজ জীবনকে বিশ্বাস করেন না। বিশ্বাস করেন না, মানুষে মানুষে বেঁধে বেঁধে থাকায়। তাঁর মতে, তাঁর আবাসভূমি অসৎ, ঠক, জোচ্চোর, ফন্দীবাজ, মিথ্যেবাদীর ডিপো। কাউকে বিশ্বাস নেই। এ অবস্থায় সন্দেহই একমাত্র মানুষকে সাহায্য করতে পারে। এই গল্পেও, না বলা গল্পটা বেশি মারাত্মক। সাধনবাবু একা মানুষ, পরিবার নেই, নেই আত্মজন। পুরো গল্পটা তাঁকে যে ভাবে উপস্থাপিত করে, তার থেকে তাঁকে অসম্ভব সৎ, নীতিপরায়ণ, প্রবল সত্যবাদী - অসাধারণ, উজ্জ্বল কোনও ব্যক্তিত্ব মনে হয় না। বরং এক অতি সাধারণ, প্রায় অকিঞ্চিৎকর মানুষ মনে হয়। আশপাশের ভিড়ে তিনি চোখেই পড়তেন না, যদি তাঁর এই সন্দেহবাতিকটা না থাকতো। অন্যভাবে বলতে গেলে, নিজের অজান্তে, সাদামাটা জীবন যাপনকে সন্দেহ দিয়ে রচা ফিকশনের সাহায্যে রঙিন করে বাঁচেন এই মানুষটি। এটা এক ধরনের ডিফেন্স মেকানিজম। তাই, নন্দবাবুর মেয়ে মিনির অঙ্কখাতার ছেঁড়া পাতায় অপরাধী দলের কোড ল্যাঙ্গোয়েজ খুঁজে পান তিনি, মডার্ন এক্সচেঞ্জ থেকে প্যাকেট আসার কথা ভুলে গিয়ে, পার্সেলটায় একবার টাইম বোমা আছে ভাবেন, আরএকবার পটুয়াটোলা লেনে খুন হওয়া মৌলিকের কাটা মাথা আছে ভাবেন। লক্ষ্য করুন, খুন হওয়া শিবদাস মৌলিক যে সাধনবাবুর চেনা মৌলিক, সে কথা কোথাও বলা নেই। তাসের আড্ডার মধু মাইতিই যে খুনি সেটাও বলা নেই। আসলে, বলার দরকারও নেই। পুরো গল্পটাই ঘটছে সাধনবাবুর ভাবনার স্তরে। দয়া করে লক্ষ্য করুন, তাঁর সন্দেহ আসলে তাঁর জীবনটাকে সস্তা থ্রিলার হিসেবে দেখতে চাইছে। বিপিনবাবুর কেনা বইয়ের মতো যার গল্প। তত্ত্ব করে বলতে গেলে, কনটেক্সট বর্জিত টেক্সচুয়াল, তাঁর নিরাবলম্ব অস্তিত্ব। সত্যজিৎ এই ধরনের চরিত্রের প্রতি বেশি অকরুণ হতে পারেন না। কারণ, লোকটা আসলে করুণার পাত্র। তাই জলের দামের ঘড়ি জলে ফেলার পরই গল্প শেষ হয়। কিন্তু, আসলে তো হয় না। সাধনবাবুর কোনও উত্তরণ আমরা দেখি না। মনগহনের আঁধারে তাঁর বন্দিদশা, তাঁর মানেহীন জীবন একই থাকে। 
     
    তাহলে, সন্দেশে বেরোনো, দুটো কিশোর গল্পে সত্যজিৎ রায় সন্ধানী আলো ফেলেন দু'জন একা মানুষের মনের গহীনে। আর সেখান থেকেই উঠে আসে গল্প। ছোটো-বড়ো সবার একসঙ্গে পড়ার গল্প। 
     
    আমি পড়া-শোনার জন্য সেরা গল্পটা একেবারে শেষে রেখেছি। কারণ, রচয়িতার বৈশিষ্ট্য। ইনি সারাজীবন ছোটোদের বড়োদের পৃথিবীর গল্প শুনিয়ে গেছেন এবং তাদের অসীমের স্পর্শ দিয়েছেন। সব দিক থেকেই তিনি অনন্য। ১৯৭৮ এ দেখেছিলাম জটায়ু ছায়াছবি । তপেন চট্যোপাধ্যায় জটাধর, উৎপল দত্ত কালা গোঁসাই, সন্তু মুখার্জী শিবনাথ। অল্প অল্প মনে আছে। মনে আছে, সেই অননুকরণীয় ভঙ্গীতে উৎপল দত্ত বলছেন, আজ তোমাকে নিয়ে আমি পালিয়ে যাব। নারীহরণের দৃশ্য। তারপরই তপেন এসে ঝাঁপিয়ে পড়লেন, লড়াই হলো, ছুরি খেয়ে মরলেন, গলা টিপে মারলেন। হল থেকে বেরিয়ে, আমার শকট্ মুখ দেখে, অসম্ভব সুপুরুষ এক যুবক একটা খোলা হাসি হেসে, আমাকে বললেন, কালাগোঁসাই রাবণ হয়ে সীতাহরণ করছিল, জটাপাগলা জটায়ু হয়ে লড়াই করল। তোমার ওই ছবিতে রামায়ণে আছে না? এখানে অবশ্য সীতাহরণটা আটকে দেওয়া হয়েছে! কিন্তু, স্ক্রিপ্টের জন্যই হোক বা উৎপলবাবুর অলৌকিক অভিনয়ের জন্যই হোক, আমার মনে একটা ঘিনঘিনে ভাব জন্মায় - যাকে আমার মন বলত 'বড়োদের ব্যাপার।' 
     
    এর ঠিক দু'বছর পর ১৯৮০ তে আবার আমার সঙ্গে দেখা হলো কালা গোঁসাই, জটাধর আর শিবনাথের। দেব সাহিত্যকুটীরের 'ছোটোদের শ্রেষ্ঠ গল্প' নামের একটা বইয়ে। ‘জটায়ু’ রচনায়। ছোটোদের? তাই হবে। কারণ, সেই অস্বস্তিটা হচ্ছে না । বরং, সুন্দর লাগছে পড়তে : কিন্ত রক্ষা নাহি তোর,গড়ুরের পুত্র আমি জটায়ু মোর নাম। বৃদ্ধ আমি তবু আজি নখর প্রখর মোর। নখর আঘাতে তোর দশমুণ্ড করিব ছেদন! গল্পটাও তো ভারী সুন্দর। একটা গ্রাম। সেখানে কলকাতা থেকে নেপাল গুণ্ডা, কালী গোঁসাই নাম নিয়ে, কালিকেশ্বর শিব বসালো। গাঁয়ের নাটকের হীরো শিবনাথ। বিয়ে করতে চায়না। অভাবের লোহায় গড়া হরধনু (কী সুন্দর শব্দ) ভাঙার শক্তি নেই। শিবু কামারের বড়ো ছেলে জটাধর। অসামান্য অভিনেতা। কিন্তু পাগল। সীতাহরণে সে জটায়ু হয়নি। হয়েছিল উমেশ। স্টেজে উমেশের আত্মত্যাগে মুগ্ধ জটে সকালে তাকে জীবিত থেকে খেপে যায়। মরার ভান করে পড়ে থেকে সীতাহরণ হতে দিল? নকল জটায়ু হতভাগা। ঠক, জোচ্চোর। এরপর, হঠাৎ অভাবের লোহায় গড়া হরধনু ভাঙল শিবনাথ। বন্ধুর আনুকুল্যে একটা ছবিতে ছোটো রোল, পরের দুটোয় সাইড রোল, শেষেরটায় হীরো। ছায়াছবিজগতের রাজা এখন জটাধরের রামচন্দ্র। গ্রামে এল সে। জটাধর মহাখুশি। এবার সেও সিনেমা করবে। এইখানে একটা লাইন পড়ে আমার ধ্বক করে উঠেছিল। গলায় ব্যথা করেছিল : '- না রে - ওসব জায়গা ভালো নয় জটাধর। সেসব জায়গা বাবুদের। বাবুরা সেখানে চাষী সাজে, মুটে সাজে। চাষী মুটে যারা সত্যিকারের, তাদের তারা নেয় না।' নাছোড় জটেকে পার্ট দেবে বলে স্তোক দিল শিবনাথ। পোস্ট অফিসে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে সে। একজন ব্যঙ্গ করে বলে - হায় প্রভু রামচন্দ্র-দুর্ব্বাদলশ্যাম! তুমিও বঞ্চনা করলে দীন ভক্ত জটায়ু অধমে! হায় রাম! আহত জন্তুর মতো চিৎকার করে ওঠে জটাধর। বদ্ধ পাগল হয়ে যায়। চোখের জলে বুক ভাসে আটবছরের পাঠকের। এরপর, শিবনাথ বিয়ে করে। পৈত্রিক ভিটের সংস্কার আরম্ভ হয়। কালা গোঁসাই নাক গলায়। শিবনাথের নিযুক্ত ঠিকাদার তাকে বিনা পয়সায় সার্ভিস দেয়নি। অতএব, এ চলবে না। এরপর, কথাকাটাকাটি। শাসানি। তারপর শিবনাথ গেল কলকাতা। স্ত্রী কল্যাণী রইল গ্রামে। এক রাতে বাড়ির কাজ তদারকি করে ফেরার পথে, কালা গোঁসাই মুখে কাপড় বেঁধে তাকে নিয়ে পালানোর উপক্রম করল। কোথা থেকে এসে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল জটাধর। খান খান হলো চাঁদনি রাতের স্তব্ধতা - কে রে? কে রে? কে রে? কামাতুর পাপাচারী পিশাচ? আরে আরে চিনিয়াছি তোরে! পাপাচারী লঙ্কাপতি রাক্ষস রাবণ! রামের ঘরণী তুই করিলি হরণ? কিন্তু, রক্ষা নাহি তোর। গড়ুরের পুত্র আমি, জটায়ু মোর নাম.... জটাধরের পাঁচটা আঙুল বসে গেছে কালা গোঁসাইয়ের চোখে। কালা গোঁসাই ছোরা বার করেছে। এখন পাশাপাশি দু'টো লাশ পড়ে। জটের পাঁজরায় গভীর ক্ষত। কালাগুণ্ডার গলার একপাশে চারটে, অন্যপাশে পাঁচটা গভীরক্ষত। জটাধরের আধ ইঞ্চি লম্বা নখগুলো রক্ত মাখা। মুগ্ধ। মন্ত্রমুগ্ধ শিশু পাঠক। কোনও ঘিনঘিনে ভাব নেই। একটা বিশাল কিছু মনের এদিক থেকে ওদিক জুড়ে রেখেছে। সব জায়গা যদিও বুঝিনি, তাতে করে রসগ্রহণে বিন্দুমাত্র অসুবিধে হয়নি। ইশ, লেখককে একটা প্রণাম করা যেত যদি! নামটা দেখি তো। 
     
     
     দেখলাম। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। 
     
    পরে দেখেছি, ১৯৫৩ সালে দেব সাহিত্যকুটীরের শারদীয়া 'বসুধারা'তে 'জটায়ু' প্রকাশ পায়। গল্পটা নানা দিক থেকে অবাক করা। 
     
    প্রথমত, এই গল্প যেটা করে, তাকে তত্ত্বের ভাষায় বলে appropriation of an epic। মহাকাব্যকে নিজের প্রয়োজনমাফিক কাজে লাগানো, রসহানি না করে। প্রায় অসম্ভব এ কাজ। কিন্তু, কী অনায়াসে পেরেছেন লেখক! করুণরস আর বীররসের নিখুঁত ভারসাম্য এক ফোঁটা ছোটো জিনিসকে ত্রিসীমানায় ঘেঁষতে দেয়নি, যা শিশু-কিশোরমনে পচ ধরাতে পারে। 
     
    দ্বিতীয়ত, সমাজচেতনা। গরীব বড়োলোকের ব্যাপারটা তো আমিই ধরতে পেরেছিলাম। আসলে, ছোটো থেকে গরীব চাষী, গরীব বামুনের রূপকথা শোনা মন পারবেই ধরতে। কিন্তু, তখন যেটা বুঝিনি সেটা? দেখে নিই। ১৯৫৩তে তারাশঙ্কর তাঁর টিপিক্যাল প্রিসিশন বজায় রেখে লিখছেন : ‘১৯৪৭ সালে কালা গুণ্ডা প্রথম দিন এ অঞ্চলে পা দিয়েই ত্রাসের সৃষ্টি করেছিল। তার হাতে সেদিন ছিল চিমটে।...হাতের চিমটে হাতের লোহার বালার সঙ্গে ঠুকে শব্দ তুলে এসে হাঁকলে - আরে শুনো হিন্দু - ব্রাহ্মণ আর চণ্ডাল - সব জাত - শুনো, প্রভু বিশ্বনাথের হুকুমৎ। লে আও চন্দা। চাঁদা আনো চাঁদা! - চাঁদা! - হাঁ --চাঁদা - হিন্দুকে বাঁচানেকে লিয়ে চন্দা। বাবা বিশ্বনাথকে হুকুমৎ। হিন্দুকে ধরম যাচ্ছে। পাঁচ হাজার দশ হাজার কলকত্তা- নোয়াখালি, জেনানীর ইজ্জত, হিন্দুর ধরম বাঁচানে কে লিয়ে চাঁদা।‘ চাঁদা দিয়ে হবেটা কী? বলা নেই। যেমন বলা নেই মুরশিদাবাদ শেখের পাড়ায় কায়েদে আজমের ফরমান নিয়ে আসা ফকির সেজে যে চাঁদা তুলেছিল কালী গোঁসাই বা নেপাল গুণ্ডা, সেটা দিয়ে কী হবে। বলা নেই, কিন্তু এনতাজ মিয়ার মাথায় চিমটে বসানোর চেষ্টার সময়কার কালা গুণ্ডার যে মুখভঙ্গী ফোটায় শিল্পী প্রতুলচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের তুলি, তাতে বুঝতে কিছু বাকী থাকে না। দাঙ্গার আশঙ্কা ঘন হচ্ছে। Riot rhetoric লিখছেন তারাশঙ্কর। বসুধারা প্রকাশের মাত্র সাত বছর আগে ঘটে গেছে The Great Calcutta Killing। লেখক কোড রেখে যাচ্ছেন। বয়স্ক পাঠকরা সঙ্গে সঙ্গে বুঝবেন। ছোটোরা বুঝবে কালে। এই আমার মতো। 
     
    তৃতীয়ত, ভাষা। একেবারে ভিন্টেজ তারাশঙ্কর । একটা উদাহরণই যথেষ্ট। ‘- মন্দিরের প্রদীপগুলি নিভে গিয়েছে । শরীকেরা গরীব হয়ে গিয়েছে। দেখলাম - শ্যাওলা ধরা মন্দিরের গায়ে চাঁদের আলো পড়ে যেন লজ্জা পাচ্ছে - লজ্জা দিচ্ছে।’ তারাশঙ্কর যেহেতু তারাশঙ্কর তাই পিগমি শিশু-কিশোর সাহিত্যিকদের মতো পাঠকদের অবোধপানা, সোনার হাঁদা ভাবেননি। রবীন্দ্র - অবন - এর মতোই আন্ডার এস্টিমেট করেননি তাদের। ভাষার loftiness শিশুকিশোরমনে যে একধরনের elevation আনেই তা তাঁর জানা ছিল। এই সবকিছু মিলিয়ে 'জটায়ু' এমন একটা উচ্চতা ছুঁয়েছে যার সমতুল খুব বেশি কিছু এ অধম দেখেনি। 
     
     এতক্ষণ ধরে, আপনারা দেখলেন, নিজেকে বিশ্লিষ্ট করে আমি বোঝাতে চেয়েছি, সার্থক ছোটোদের জন্য লেখায় একটা স্তর থাকবেই, যা বড়োদের অধিগম্য। তা না হলে কালজয়ী হবে না সে। নিজের মত প্রতিষ্ঠার জন্য পাঠ করেছি, নিজের পছন্দমতো কিছু গল্প ও একটি উপন্যাস। এবার আপনাদের পালা।খুঁজে নিন আর পাঠ করুন বহুস্তরী কিশোর-সাহিত্য। তাহলেই, এই পড়া-শোনা একটা অর্থ পাবে।
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৩ নভেম্বর ২০২১ | ১৮৬০ বার পঠিত
  • আরও পড়ুন
    রণছোড় - Chayan Samaddar
    আরও পড়ুন
    মালিক - Chayan Samaddar
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • ইন্দ্রাণী | ১৪ নভেম্বর ২০২১ ০৩:১২501143
  • খুব ভালো লাগল। আবার পড়ব। ভাবব। লেখার চেষ্টা করব।
    নমস্কার জানবেন।
  • স্বাতী রায় | ১৪ নভেম্বর ২০২১ ২০:২০501169
  • এই বিশ্লেষণ বার বার পড়ার। আর  শেখার।  পড়তে শেখার। 
  • b | 117.205.***.*** | ১৪ নভেম্বর ২০২১ ২০:২৫501170
  • খুব ভালো লাগলো। 
  • যদুবাবু | ১৫ নভেম্বর ২০২১ ০৮:০৩501215
  • বাঃ, চমৎকার লাগলো। 
  • Ranjan Roy | ১৫ নভেম্বর ২০২১ ১৪:২০501230
  • 'জটায়ু'  প্রথম পড়েছিলাম পাঁচ বছর বয়সে-- কালী গুন্ডার সেই চিমটের ঘায়ে লাউ ছেতরে দেওয়া আর ব্যোম কালী চেৎ চণ্ডী হুংকার কাঁপন ধরিয়েছিল শিশুমনে, বুঝতাম কিছু একটা অমঙ্গল ঘটতে যাচ্ছে। তারপর পুলিশ এল , তার  ভাবলাম এবার কিছু হবে। কোথায় কী? কালীগুণ্ডা জামাতুলে পাঁজরে দাঙ্গার সময়ে পাওয়া ছুরির ঘা দেখিয়ে বাঙাল ভাষায় বলে --আমার কী অইব!
      ভয় পাই। কালীগুণ্ডার নিষ্পত্তি এত সহজে হবে না।
     ক্লাইম্যাক্সে মুখে মদের গন্ধ আর কাঁধে তুলে বুলি--সিনেমাওয়ালি হম তুমকো লেকে ভাগেঙ্গে।
     হঠাৎ যেন বড়দের দুনিয়ায় ঢুকে পড়ি!
    তারপর বিভিন্ন সংকলনে যখনই দেখা পাই পড়ে ফেলি।
    তেমনই তারাশংকরের আরও দুটো বহুওপঠিত গল্প-- 'সিংহচর্ম'  ও 'ডাক হরকরা'। বড়দের ও ছোটদের মাঝের রেখাটি মুছে যায়।
     
     
  • রমিত চট্টোপাধ্যায় | ১৫ নভেম্বর ২০২১ ১৫:০১501231
  • দারুণ বিশ্লেষণ। ছোটদের লেখা লিখতে গিয়ে আজকালকার লেখক কবিরা বাস্তব থেকে বেরিয়ে গিয়ে একটা স্যানিটাইজড লেখা তৈরি করেন। এটা বদলানোর দরকার আছে।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। মন শক্ত করে মতামত দিন