সেই সব দিনে কলকাতায় যানজট লেগেই থাকত। সকাল-দুপুর-সন্ধ্যা-রাত-মাঝরাত—যানজটের বিরাম ছিল না। কিছু রাস্তা, ক্রশিং পেরনো ছিল লটারি জেতার মতো ব্যাপার। তারই তিনটি, মৌলালি, মল্লিকবাজার, পার্ক স্ট্রিট-মেয়ো রোডের ক্রশিং দিয়ে একদা সময় বেশ কয়েক বছর যাতায়াত করেছি। তিন সিগনালেই গাড়ি বলতে গেলে রোজই আটকে থাকত। এমনীতেই শহর মানে পদে পদে সিগন্যালের হুঁশিয়ারি। তার উপর যানজট। সেই কলকাতায় এক একটা ক্রসিংয়ে পনেরো-কুড়ি মিনিট আটকে থাকাই ছিল দস্তুর। ভিভিআইপির কনভয় গেলে তো কথাই নেই, সিগন্যালে ঘণ্টা খানেক আটকে থাকা অসম্ভব ছিল না। আর অবস্থানগত কারণেই ওই তিনটি জায়গা ছিল দুঃস্বপ্নের ক্রশিং।
এই যান-যন্ত্রণা নিয়েই অফিস ফেরতা গাড়িতে একটা মজার খেলা আমরা সহকর্মীরা খেলতাম। যানজট, ধোঁয়া, হর্নের শব্দ থেকে বাঁচতে অনেক সময়ই ভ্যাপসা গরমের মধ্যেও গাড়ির কাচ বন্ধ রাখতে হত। আবার এসি গাড়ি তখন হাতে গোনা। খবরের কাগজের গাড়ি বলতে লজ্ঝরে অ্যাম্বাসাডর। কর্তারা এক-দু’জন আলাদা গাড়ি পেতেন। কারও কারও হয়তো এসি গাড়িও জুটত। শ্রমজীবী সাংবাদিকদের জন্য বাস-ট্রাম, কখনও অফিসের বারোয়ারি গাড়ি। রাইটার্স বিল্ডিংস, লালবাজার, পুরসভা, রাজনীতি ইত্যাদি কভার করা সাংবাদিকদের সন্ধ্যা নাগাদ অফিসে তুলে আনতে গাড়ি বরাদ্দ থাকত। আমরা অফিস ফিরতাম কোনও দিন ধর্মতলা-লেনিন সরণি-মৌলালি, কোনও দিন মেয়ো রোড-পার্ক স্ট্রিট-মল্লিক বাজার হয়ে।
এই তিন ক্রসিংয়ে আসার আগে রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা, গতি ইত্যাদি দেখে অনুমান করে আমরা বাজি ধরতাম, গাড়ি সিগন্যালে আটকাবে কি আটকাবে না। বেশির ভাগ দিনই আটকে যেত। উল্টোটা ছিল ব্যতিক্রম। তবু একটা ব্যাপার লক্ষ্য করতাম, বেশির ভাগেরাই ব্যতিক্রমের পক্ষে বাজি ধরত। হতে পারে, সেটাই ভাগ্য পরীক্ষার অলিখিত ব্যাকরণ।
কিছু মানুষের উপস্থিতি সেই দমবন্ধকর পরিবেশটাকেও ক্ষণিকের জন্য বেশ উপভোগ্য করে তুলত। মেয়ো রোডের ক্রসিংয়ে তাঁদের কেউ রজনীগন্ধার স্টিক, কেউ বেলি ফুলের মালা, কেউ আবার স্ট্রবেরির গোছা নিয়ে হাজির হতেন। আর এক দল ভিক্ষা করতেন। কেনার জন্য পীড়াপীড়ি করতেন একদল মানুষ। আর একদল এক টাকা, দু’টাকা চেয়ে ঘ্যানঘ্যান করতেন। বিক্রেতারা বলতেন, নিয়ে যান, বাজারের অর্ধেক দাম। ভিক্ষা চেয়ে হাত পাতা মানুষগুলি এক-দু’টাকার জন্য দিনের পর দিন ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে যেতেন, ‘দু’দিন কিছু খাইনি।’
ফুল, ফল কেনার প্রয়োজন এবং সামর্থ্য কোনওটাই আমাদের ছিল না। তাই বাজারে এগুলির কী দাম, জানতাম না। অন্য গাড়ির কেউ কেউ জানালার কাচ নামিয়ে কিনতেন। সেই সুবাদে সারা দিনের দৌড়ঝাঁপ ক্লান্তিতে আমরা খানিক নতুন ফুল-ফলের সুবাস উপভোগ করতাম। তবে এক-দু’টাকা ভিক্ষে দেওয়ার সামর্থ্য আমাদের ছিল। সাধ্যমতো দিতাম। বিশেষ চেহারার কিছু মানুষকে দেখিয়ে সহকর্মীদের কেউ কেউ সতর্ক করতেন, ‘এগুলো সব পাতা খোড়। পাতা খেয়ে পড়ে থাকে। নেশার টাকা জোগাড় করতে এরাই ম্যানহোলের ঢাকনা চুরি করে।’
এভাবেই চলত যানজটে ব্যবসা এবং ভিক্ষাবৃত্তি। সেই ক্ষুদ্র কারবারেরও একটা ব্যাকরণ ধরা পড়েছিল চোখে। একটু ঝকমকে গাড়ি, আরোহী একলা পুরুষ অথবা নারী কিংবা কমবয়সি যুগল, তাঁরাই ছিলেন যানজটে ব্যবসার টার্গেট। কেউ কেউ বিরক্ত হতেন। আমাদের সে সবের বালাই ছিল না। ওই যে বললাম, ওঁরা মানুষ বাছতেন গাড়ির চেহারা দেখে। আমরা ছিলাম নির্ভেজাল দর্শক।
মল্লিকবাজার, মৌলালির মোড়ের ছবিটা খানিক ভিন্ন। ঝাঁকে ঝাঁকে, নানা বয়সের মানুষ যানজটে আটকে থাকা গাড়িগুলি ঘিরে ধরত। বেশির ভাগই ভিক্ষা চেয়ে হাত পাতে। এক-দু’জন ধূপকাঠি, বিস্কুট, নাড়ু, বাদাম, চানাচুরের প্যাকেট, খেলনা, ট্যাক্সিচালকদের জন্য লাল শালু কাপড় বিক্রি করেন। তারাই কালী পুজোর আগে মোমবাতি, দোলের আগে পিচকারি, আবির, রংয়ের প্যাকেট নিয়ে হাজির হতেন। পীড়াপীড়ি করায় এক-দু’বার কিনেছি। ভিক্ষাও দিয়েছি সাধ্য মতো।
সেই কলকাতায় খুচরোর বড় অভাব। বাসে সিটের উপর লেখা, পাঁচ-দশ টাকার ভাঙানি হবে না। খুচরো নিয়ে যাত্রী-কন্ডাক্টর নিত্য গোলমাল। দশ টাকার খুচরো পেতে বারো টাকা গুনতে হয়, গলা চড়িয়ে জানান দেন কন্ডাক্টর। আমাদের সাধ্য আবার খুচরোতেই সীমাবন্ধ।
মৌলালির মোড়ে একদিন ঘেরাও হয়ে গেল আমাদের গাড়িটি। তত দিনে এক-দু’টাকার কয়েন বাজারে এসেছে। সেদিন পকেটে বেশ কিছু কয়েন। অনেক দিনই দেব দেব করেও খুচরোর অভাবেই দেওয়া হয়ে ওঠেনি। সেদিন জানালা থেকে হাত বাড়িয়ে গাড়ি ঘিরে ধরা বাচ্চাগুলোর হাতে দিচ্ছি একটি করে কয়েন। হঠাৎই গোল বাধল। বছর দশেকের বাচ্চা মেয়েটি বলে উঠল, ‘এ বাবু উসকে লিয়ে দো রুপিয়া, মেরে লিয়ে এক রুপিয়া!’
সিগন্যাল সবুজ হয়ে গিয়েছে। আস্তে আস্তে চলতে শুরু করেছে গাড়ি। গতি বাড়ছে। কিন্তু সেই মেয়ের থামার নাম নেই। ওই ভিড়ভাট্টার মধ্যেই সে গাড়ির সঙ্গে সঙ্গে পাগলের মতো দৌড়চ্ছে। পিছনের গাড়ি হর্ন দিতে দিতে গতি বাড়িয়ে ছুটে আসছে। তবু ছুটছে বালিকা। ভাঙা রেকর্ডের মতো বলেই চলেছে, ‘এ বাবু, উসকে লিয়ে দো রুপিয়া, মেরে……।’ আমি, আমরা অসহায়। যে কোনও মূহূর্তে আমাদেরই গাড়ির চাকায় কিংবা পিছনের গাড়ি এসে পিষে দিতে পারে। নিজের চোখে দেখা তেমন তাজা দুর্ঘটনার ভয়াবহ দৃশ্যের কোলাজ মনের মধ্যে ভীড় করে। পকেট হাতড়ে দেখি আর একটি কয়েনও অবশিষ্ট নেই। সহযাত্রী সহকর্মীদের কাছেও নেই। আমার কয়েকগুলির একটি যে দু’টাকার, তা জানা ছিল না। ক্ষণিকের হাত বদলে বাচ্চাটি কী করে নজর করল আগের জনেরটা ছিল দু’টাকা? তারও দু’টাকা চাই।
ন্যায্য প্রতিবাদ। হতে পারে ভিক্ষা। ভাগাভাগিতে তবু বেশি-কম করা ন্যায়ের পরিপন্থী। আমার টাকা আমি দেব, যাকে ইচ্ছে যত দেব, অবচেতনে বয়ে বেড়ানো এমন ভাবনায় যেন হাতুড়ি পেটা করতে লাগল মেয়েটির কথা। তালতলার মোড় থেকে গাড়ির সঙ্গে ছুটতে ছুটতে মৌলালির মোড়ে চলে এল বালিকা। গাড়ির ভিতর আমরা কয়েক জন সেই দৃশ্য দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ়। মেয়েটির গতির সঙ্গে তাল মেলাতে আমাদের গাড়ি খানিক ধীরে এগোচ্ছে। কিন্তু পিছনের গাড়ি তা মানবে কেন? যে কোনও মুহূর্তে সিগন্যাল লাল হয়ে যেতে পারে। আর তা হলেই অনন্ত অপেক্ষা। মুখ বাড়িয়ে পিছনের গাড়ির চালকেরা বাছাই করা শব্দযোগে তাই আমাদের উদ্দেশে মুখখিস্তি করেই চলেছেন। মৌলালির মুখ থেকে গাড়ি ডান দিকে বাঁক নেওয়ার মুখে মেয়েটি থামল। গলা চড়িয়ে বলল, ‘এক রুপিয়া কাল দে দিজিয়েগা।’ গলা বাড়িয়ে বলা হয়নি, নিজেকে নিজে অবশ্য বলেছিলাম, দেব। একটু বেশিই দেব, মূল এবং সঙ্গে সুদ।
ধার না করা সেই দেনা আমার আর শোধ করা হয়নি। ওই পথ ধরে আরও কত দিন, কত সময় চলাফেরা করেছি। কখনও-সখনও, যানজটের ভিড়ে খোঁজার চেষ্টা করেছি। কী আশ্চর্য, সেই বালিকারই দেখা পাইনি। ভিক্ষা বাবদ তাকে মেটাতে না পারা সেই একটি টাকা বড় এক উপলব্ধি, কথা রাখতে না পারার ঋণ।
মেয়ো রোড, পার্ক স্ট্রিটের ক্রসিংয়ে এটা সেটা নিয়ে যে মহিলা প্রায়ই যানজটে আটকে থাকা গাড়ির দরজায় টোকা দিতেন, এক দিন লক্ষ্য করলাম, পাশেই ফুটপাথে দাঁড়িয়ে তিনি। চোখ-মুখে ক্লান্তি। বছর পনেরো-ষোলোর এক কিশোর গাড়ির দরজায় দরজায় ঘুরে এটা সেটা বিক্রি করছে। বোঝা গেল, দু-দণ্ড বিশ্রাম নিতে বিক্রিবাটার কাজে ছেলেকে এগিয়ে দিয়েছেন। তারপরও, দেখা হয়েছে আরও অনেক দিন, যানজটে আটকে থাকা গাড়ির ভিড়ে কখনও রজনীগন্ধার স্টিক, কখনও বেলি ফুলের মালা বেচতে বেচতে কিশোর থেকে তরুণ হয়ে গেল সে। কোনও দিন জানতে চাইনি, কী নাম, কোথায় বাড়ি। কেনই বা লেখাপড়ার বয়সে রাস্তায় এসে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য এত সব জেনেই বা কী করতাম! এ সব প্রশ্নের উত্তর অজানাও তো নয়।
এই ক্রসিংয়েই মরসুমি ফল বিক্রেতা ভদ্রলোক জানালায় মুখ ঠেকিয়ে বেশ মজা করে বলতেন, ‘খাবেন যখন, পাঁচ কান হওয়ার আগে খান। এ জিনিস মূহূর্তে ফিনিস, বাজারে পাবেন না।’ তবে গরমের ফল বর্ষায়, শীতে গরমের ফল জোগান দেওয়াই ছিল তাঁর ইউএসপি। ঝমঝমে এক বৃষ্টির দিনে কাকভেজা অবস্থায় প্লাস্টিকের একটি প্যাকেট জানালায় ঠেকিয়ে বললেন, ‘ভরা বর্ষায় পাকা আম, আহা!’
গাড়িতে প্রেস স্টিকার দেখে ভদ্রলোক একদিন নিজেই জানালেন, বজবজের কারখানায় কাজ করতেন। ম্যানেজমেন্ট আর ইউনিয়নের যৌথ রোষের মুখে চাকরি গিয়েছে। ইউনিয়নের বাধাতেই ফুটপাথ, ট্রেনের কামরা, বাস-ট্রাম, কোথাও হকারির অনুমতি মেলেনি। শেষে ঠাঁই মেয়ো রোডের ক্রসিংয়ে। এক সহকর্মীর তীর্যক মন্তব্যটি মনে আছে। বলেছিলেন, ‘এই যানজটটাই মানুষগুলির ভরসা। নইলে ভেসে যেত।’
যানজটের অর্থনীতি নিয়ে আমরা সেদিন খানিক মজা-ঠাট্টা করলাম নিজেদের মধ্যে। কথায় কথায় ফটোগ্রাফার সহকর্মী ফের শোনান, যানজট নিয়ে তাঁর তোলা দুর্লভ সেই ছবিটির কথা। এক বিকালে গ্র্যান্ড হোটেলে থেকে বেরিয়ে চিড়িয়াখানার কাছে টাটা গ্রুপের হোটেল তাজের উদ্দেশ্যে রওনা হয়েছেন রতন টাটা। তিনি তখন টাটা গ্রুপের সর্বময় কর্তা। যানজটে দীর্ঘক্ষণ গাড়িতে বন্দি থেকে শেষে বিরক্ত রতন টাটা ময়দানের রাস্তা ধরে হাঁটা শুরু করেন।
পার্ক স্টিট উড়ালপুল চালুর পর মেয়ো রোডের যানজটে অনেকটাই ইতি পরে। মা উড়ালপুল চালুর হতে যানজট অনেকটাই কমেছে এক্সাইড মোড়ে। পার্ক সার্কাস সেভেন পয়েন্ট বলতে গেলে যানজট শূন্য। ওদিকে, বালিগঞ্জ আর লকগেট উড়ালপুল চালুর পর যানজটে রাশ টানা গিয়েছে গড়িয়াহাট এবং শ্যামবাজার পাঁচমাথার মোড়েও। যানজটে বেচাকেনায় বহু বছর হল ভাটার টান। কলকাতায় গাড়ির গড় গতি দেড়-দু’দশক আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুন। স্পিড লিমিটারে ধরা পড়ে গতিসীমা লঙ্ঘনকারী গাড়ি।
মল্লিকবাজার মোড়ে প্রথমে অন্তঃস্বত্ত্বা অবস্থায়, পরে বাচ্চা কোলে ভিক্ষা করত যে মেয়েটি, মেয়ো রোডের ছেলেটিরই বয়সি সে। কিশোরীর ওই পরিণতি কে করল? কেনই বা সে ওই বয়সে বাড়ি ছাড়া? জানা হয়নি। ফুটপাথে প্লাস্টিকের ছাউনির নিচে শিশুর সারল্যে কিশোরী মায়ের সন্তানের সঙ্গে খেলা, মাতৃস্নেহে শিশুর যত্নআত্তি করার দৃশ্য যানজটে আটকে থাকা গাড়ির আরোহী, পথচলতি মানুষের চোখ টানত। প্রেস স্টিকার সাঁটা গাড়ির আরোহীর মনে প্রশ্ন তোলপাড় করে দিয়ে যেত, এই কিশোরী মা মৌলালির সেই নাবালিকা নয়তো?
বছর বিশ-পঁচিশ আগের এমন সব টুকরো ঘটনা, দৃশ্যাবলি শহরের প্রায় সব প্রধান ক্রসিংয়ে এবং হাওড়া, শিয়ালদা, বালিগঞ্জ, দমদমের মতো বড় স্টেশনে এখন চোখ সওয়া হয়ে গিয়েছে। অন্তঃস্বত্ত্বা অথবা বাচ্চা কোলে ভবঘুরে বালিকা, কিশোরীদের দেখে কারও কোনও ভ্রুক্ষেপ নেই। সেই কলকাতায় খাদ্য সুরক্ষা, বাসস্থানের নিশ্চয়তা, শিক্ষার অধিকার, মানবাধিকার কমিশন, মহিলা কমিশন, শিশু সুরক্ষা কমিশন, এত থানা, পুলিশ, টহলদারি ভ্যান, সিসি-ক্যামেরা ছিল না। আজ এত নজরদারির মধ্যেই ফুটপাথে ঘুমন্ত নাবালিকা, কিশোরীকে গাড়িতে তুলে নিয়ে গিয়ে যৌন লালসা মেটানোর ঘটনা আর হাড় হিম করা খবর নয়। এ খবরে আর নতুনটা কী!
দু’-আড়াই দশক আগের কলকাতার ফুটপাথবাসীর বেশির ভাগই এখন শহর ছাড়া। শহরের রূপ বদলের যজ্ঞে প্রথম আহুতি তারাই। নিজেরই শহরে ভবঘুরে হয়ে টিকে আছে যে ক’টি পরিবার, বছর কয়েক আগেও ফুটপাথই ছিল তাদের নির্দিষ্ট ঠিকানা। সেই ঠিকানার সুবাদেই সেন্সাসের সময় মাঝরাতে তাদের ঘুম থেকে তুলে মাখা গুনতে দেখেছি জনগণনা কর্মীদের। ফুটপাথের ঠিকানাতেই ভোটার তালিকায়, স্কুলে, কলেজের খাতায় নাম ওঠে, মেলে রেশন কার্ড, আধার কার্ড। কিন্তু পুলিশ আর পুরসভার লাগাতার অভিযানে ফুটপাথের নির্দিষ্ট আশ্রয়টিও হাতছাড়া। ‘ঠিকানাবিহীন’ হয়ে দিন কাটে আজ এ রাস্তা, কাল সে রাস্তার ফুটপাথে। বিচ্ছিন্ন জীবন। গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে থাকার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি যে সুরক্ষা‒ সেটাই হারিয়ে গিয়েছে তাদের জীবন থেকে। ক্রমে হারিয়ে গিয়েছে বিপদে-আপদে প্রতিবাদী হতে সঙ্গ দেওয়া, অভয় দেওয়ার মানুষগুলিও।
বহু বছর হল, হাওড়া, শিয়ালদার মতো বড় স্টেশনগুলিতে পুলিশি ঘেরাটোপে নিরাপদে রাত কাটানো বন্ধ হয়ে গিয়েছে। প্রতি রাতে জিআরপি, আরপিএফ নিয়ম করে আশ্রয়হীন মানুষগুলিকে সিসি-ক্যামেরা সাক্ষী রেখে স্টেশন থেকে ঠেলে, পিটিয়ে বের করে দিয়ে শাটার নামিয়ে দেয়। মিডিয়ার ক্যামেরার লেন্সে এই দৃশ্য এখন কোনও রেখাপাত করে না। তাঁদের মধ্যে কি আছে সে দিনের সেই বালিকা? অন্য কোনও রূপে? অদ্ভুত জোর গলায় যে বলেছিল, ‘এক রুপিয়া কাল দে দিজিয়েগা।’
এমন নয় যে আজও খুঁজে ফিরি তাকে। কিন্তু বয়ে চলেছি শোধ না করা আমার সেই একটি টাকার ঋণ!